শব্দ সুবাসিত পাণ্ডুলিপি : পরান কথার ঘ্রাণ












শব্দ সুবাসিত পাণ্ডুলিপি 
পরান কথার ঘ্রাণ

বিদ্যুৎ দেব 

ছন্দের ব্রহ্মা-ে সব প্রাণের নিয়মে আলাপ হয়, যাপনের আলাপ। ভিন্নতা নিয়ে এগিয়ে যায় সবকিছু। যদিও প্রকৃতির সবকিছুই রূপান্তরের অংশ। চিন্তা, মগ্নতা, ধ্যান, পূর্ণ প্রকাশ ক্ষমতা একমাত্র মানুষের। আগুন আবিষ্কারের পরম্পরায় আজকের বর্তমান। মানুষ এগিয়েছে, এগোচ্ছে, এগোবে। বলা যায়  আজকের সভ্যতা চিন্তার-ই ফল। সে চিন্তা একমাত্র মানুষের। নয় কি? মানুষ প্রতিনিয়ত চলমান রাখে খোয়াবনামা।
পিছনের যত কাজ জানার বাসনা হলে আমরা নানান আশ্রয়ে স্থান নিই। খুদাই করা, আঁকা, চিত্র, লিখিত মাধ্যমে এগোতে হয়। তরঙ্গ জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল ইদানিং, কাগজের দিন শেষ হবে অথবা হবে না তা নিয়ে নানান কিছিমের মতামত। অথচ কাগজ আবিষ্কারের পরেই শিল্প বিপ্লব তথা কারো পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আলোর দিকেই ধাবমান হয় মানুষ।
সবার আছে নিজস্বতা। মানুষের যা গুন। তথা সমস্ত প্রাণির আলাপেও এমটা হয়। প্রাণি বিষয়ক যত আলাপ হয়েছে বিজ্ঞান বলার আগে থামাই দরকার হয়। অথবা বিজ্ঞানের সংজ্ঞার অদল-বদল করার খুব বেশি প্রায়োজন পড়ে।
জমানো সব মুদ্রিত হয়ে জমা হয় সংরক্ষণে। হয়ে আসছেও তাই। তারবাদে কথা হয় নিজেকে নিজের। নিজেকে-ই করে নিতে হয় আত্মআলাপ। কবি শেখর দেব এর কবিতা পড়ছি। অপ্রকাশিত পা-ুলিপির কবিতা। যার কবিতা পাঠ পেয়েছি শিশু বেলা পেরিয়ে শৈশব অথবা আত্ম-মগ্নতার বর্তমানেও। পাঠ করার বাসনায় নতুন কবিতা দেয়ার আকুতি বার বার করি। শেখর দেব কবিতা চর্চার ধরণ প্রথম থেকেই নিজস্বতার প্রমাণ দিয়ে কবিতার এদিক সেদিক নিয়ে বলার চেষ্টায় মগ্ন। কবিতা পাড়ার অনেকেই সেই ব্যাপারে জানেন এবং কবির কবিতা পড়েনও।
কবির প্রথম প্রসব বেদনার ফসল আমাদের ঘরে তুলি ‘প্রতœচর্চার পাঠশালা’(২০১৪) থেমে নেই কবিতার কাজ। দৈনিকের যত আয়োজন লিখে চলেন নিয়ম কাব্য ব্যাকরণে। প্রায় দৈনিকের সাপ্তাহিক সাহিত্য পাতা শেখর দেব দখলে নিয়ে অলস কবিদের মগজে প্রেরণার কারণ হয়ে চলেন। বছর দুয়েক পেরিয়ে মলাটে পাই ‘বাঞ্চাকল্পতরু’(২০১৬)। প্রথমের কিছুটা ব্যাতিক্রম কথা যারা পাঠ নিয়েছেন তারাই এর মতামত দিয়ে দিয়েছেন। শেখর দেব নিজের আসন ছিনিয়ে নেন কবি এবং কবিতার পাড়ায়। ‘আরাধ্য আকাশবৃত্তি ’(২০১৮) চলমান দায় নিয়েই নিজের কথা নিয়মিত সাদা খাতার বুকে খরফে আঁকছেন দৈনিক অথবা প্রথাবিরোধী রকম কাগজে।
চোখ কান খোলা রাখার জন্য পাঠ করা চাই পরিবেশ। কবি আর কবিতার বেলায়ও। কবিতার সংসারে কারা কেমন সাজিয়েছেন, কারা কী বলছেন জানার আগ্রহ থাকা চ্ইা-ই চাই । নিজেরও কথা বলার অধিকার চাই। সেই অধিকারে শেখর দেব খোলাসা করেন কবিতা বিষয়ক কথা, কবিতার ধরণ, করণ, কৌশল, প্রবণতার মিশালো প্রবন্ধ ’কবিতার করিডোর’(২০১৭)
কবির এত সব পাঠ নিয়ে বিমোহিত আমোদিত এবং নিজেকে এগিয়ে নেয়ার পাঠ নিয়েছি বহুবার। তার মাঝে কবি শেখর দেব সিমাহীন হওয়ার তাগিদ অনুধাবন করেন। সম্পাদনা করছেন শেকড়ের সঞ্জীবনী কবিতার কাগজ ‘শাঁখ’ সময়ের বাড়ে পরিসর, এখন প্রকাশনাও। ‘শাঁখ’ নামলিপি নিয়ে চলমান। জীবনবোধে মানুষ বদলায়। বদলায় চেতনা। বলার ধরণ। জানার বিষয়। বলছি আগামীর মলাট কাব্য ‘পরান কথার ঘ্রাণ’(২০২০) এর কথা। কবি শেখর দেব নিজেকে ডিঙ্গিয়ে আঁকেন নতুন অবয়ব। পাঠের পরে বুঝ আসে, নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কোন গলিতে ভাবনা ঘুরন্তি খায় অথবা ব্যক্তিগত আবহে  সার্বজনীন নন্দনের চর্চা বাড়াতে হয়।
এবার পা-ুলিপির জমিনে চাষ দেখার পালা। প্রথমে ‘আষাঢ়িয়া’ শুরুতেই অমৃত কথা ঝরিয়ে গেলেনও কবিতায়। মননের সীমানার কথায় লুকানো অসিম। আর আকুল হৃদয়ের আলাপ করেন এভাবেই,
ছুঁলেই তোমাকে যদি ফুটে ওঠে পাহাড়িয়া ফুল
চঞ্চল ঝরনা ধারা নেমে আসে দারুণ আবহে
ধবল পাখির চোখ পড়ে নেয় প্রেমের গণিত।
বিষহরি যায় মনোবাসে, কোন কারণে তার অংক মিলে যায় শূন্যে। সব আয়োজন শেষে চেষ্টার পরেও সব নিয়ম মেনেই চলমান। তাইতো ঘুরে ফিরে নেমে আসে মরমিয়া পাহাড়িকা জল। যাপিত জীবন আঁকছেন কবি। চলন-চিন্তা মিলানো সুর অথবা অমিল ব্যাকুলতা। সদ্য নতুন কামলা দেয়ার পরিবেশ নিয়ে লিখে দেন ‘রক্তিম বাগের ভেতর’ গতিময় পরিবেশ খাপ খাওয়ানোর বেদনা সহয়ক হাত শাসনÑশোষণ। আলোর দিকে এক পা টেনে ধরা অবয়বের চেতনা মিলমিশ খোয়াবনামা পড়েছি এভাবেই


 লাল ফুল ভেবো নাকো প্রেমের প্রতীক, রক্তের ধারায়
 মিশে থাকা ত্যাগ, বারবার জাগে শুধু শোষণ- শাসনে
পুরানো স্মৃতি বর্তমানের মনোবাক সময়। মনন রেখায় ঘূর্ণমান অতীত। মায়া ছাড়ে না। অন্ধকারেও আলো খোঁজা একমাত্র কবি এবং কবিরাই বলতে পারেন। বাতলে দেয় বাস্তবায়নের আগুনও।
হায় জীবন! তার লক্ষ্যের নানান ধারণা। নতুন বলছে অথবা বাতিলের তালিকায় নাম্বার পায় কত ভাবনা। ‘ভেষজবিদ্যা’ কবিতায় নতুন সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছেন এভাবেই,
চোখের উপর দুটি তুলসী পাতা ঝুলে থাকে জন্মবধি। পাতাদ্বয় চোখ ছোঁবে ছোঁবে করে কাটায় পিপাসার্ত প্রহর। সেই প্রহরের নাম জীবন।
পাঠ করে করে কবিতার শেষ সমাধান, জীবনের শেষ মৃত্যুর। তার পরে আয়ত্তে আসে বিদ্যা। ভেষজবিদ্যা। কবিতার আলাপ করার বা বিষয় ব্যাখ্যার যা জ্ঞান তা সংজ্ঞাহীন। ভাল লাগা আরাম লাগা সুখ লাগা মনন হিসেবেই বিবেচ্য। চলমান পাঠের ব্যব¯’া হয় সুবাসিত ফুলের বিচরণে জমা রাখা সুখ, নিজের অস্তিত্ব অতঃপর ভ্রুণের মায়া। শূন্যতার প্ররোচনা, নদীগর্ভ জল, প্রিজমের মায়া, আলোর ফুল, কাপালিক চোখ, অন্দর ¯্রােতে, প্রস্পুরণ, অবকাশ চোখে, সুবীর নন্দীর মৃত্যুতে, ক্রয়কৃত গ্রাম, প্রথম দেখার দিন, বৈশাখী ধানের ঘ্রাণ, দেরি হয়ে যায় এবং আলাপে নদীতে ভাসে অন্তর্গত মাছ। মোহ আঁকড়ে ধরে পরান পাখি। কবি প্রশ্ন করেন শূণ্য মুখে উর্ধ্বমুখে! পৃথিবীর মায়িক ¯্রােতের টানে কোথায় ¯ি’র হয় জীবন? সমাধান করার তাগাদা আসে লিখে ফেলেন এভাবে,
নিজেকে খনন করে পেয়েছি অনন্ত শোভা অমলিন
শূন্যেরে দেখব বলে  সারাদিন আকাশে পেতেছি চোখ
সমুখে রয়েছো তুমি মাঝে তার শূন্যতা অপার তাই
শূন্য সেধে যাই পূর্ণতার কাছাকাছি তোমাকেই চাই।





পরের কবিতা চেয়েছি আগুনের কাছে, ঘুমন্ত সুন্দর, নীরবতা নিযে খেলা, শ্রাবণে দলনে। কবি শেখর দেব গণিত জীবন যাপণ করেন তার গানিতিক চেতনা সবাই বুঝে যাবে ভ্যাকুয়াম কবিতা পড়ে। সংখ্যার বাইরে তার নামও কি গণিত নয়? দেখা যাক সেই গণিত,
জগৎ+ আমি= জগৎ
জগৎÑ আমি= জগৎ

জগৎ+ শূন্য= জগৎ
জগৎÑ শূন্য= জগৎ

অতএব, আমি= শূন্য
‘আমি’ বড়ো বায়বীয়
অথবা ভ্যাকুয়াম।
গোলাপ অথবা কবিতা, কবি এখানে ফুল দেখলেই কবিতা মনে করেন। সে কী ফুল জানার অপেক্ষা পাঠকের আরো কিছু দিন জমা আছে বৈকি! বর্ষা যেভাবে নামে, মরীচিকা বনে, তার পরে তন্ত্র- মন্ত্র- যন্ত্র। এই কবিতায় রাষ্ট্র এবং মানুষের মেল বন্ধন দেখান কবি। পড়ে নিলে সময়ের সুষম বন্টন হবে আশা করি,
গণতন্ত্র থেকে গণ তুলে নিয়ে দেখি তন্ত্র থাকে শুধু। মন্ত্র থেকে মন তুলে নিলে কিছু কি থাকে? অথচ হৃদযন্ত্র থেকে হৃদয় তুলে নিলে যন্ত্র থাকে। বাড়ে যন্ত্রের আধিপত্য। ঠুনকো হয় সর্ম্পক। রাষ্ট্রের সাথে মানুষের। মনের সাথে মনের। মনতন্ত্রে তাই মনের হাত নেই আজ। 
নদী আর ঢেউ অমৃত আলোকবর্ষে মোহবীণ আর চোখের প্রমাদ হয় জিঞ্জিরা বাতাসে ফিরে ফিরে আসে কোজাগরী রাত। ঘর্মাক্ত মেঘ সুখ জোয়ারের খোঁজে অপেক্ষা করা পাখির চোখ। সবুজ বাংলার হৃদয়ে সঞ্জীবনী বৈশাখী ঝড়ের আগে কবি বলেন এভাবে,
সুন্দর মৃত্যুর জন্য জীবনকে ছুঁয়ে ছেনে দেখি
নক্ষত্র হবার স্বাদ ক্রমাগত করেছে আলাদা
ক্রমশ পথের সীমা ছেড়ে যাই
                     পথহীন গন্তব্যের দিকে।
অতন্দ্র ফসিলে জেগে থাকা তাপদগ্ধ প্রান্তরে জমা হয় দেবীর জন্য শোকগাথা। জমা কান্না আর তুমুল আবেগে শিমুলে বাদুড় বসে ঝুলে ঝুলে দেখে রাত্রির রঙ। অন্তরের মহারাজ রাতের সুবাস নিতে জেগে থাকে মাতৃসদনের রাত। মোহের মোহন্ত হয়ে রমনী অবয়বে পাড়ার আরেক নব্য বিশ^াসীর ভয়ে নিরাপত্তাহীন দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মানবী বিগ্রহ। পা-ুলিপির শেষ কবিতা ‘পরম্পরা’। কবির চাওয়া বুঝে নিলাম সহজে  এভাবেই,
অবশেষে ব্রহ্মা-ের আলো ঢুকে পড়ে
                 ঘরহীন মোকামে আমার
পরম্পরা প্রাণ উন্নত উদরে আজ
খেলা করে বৃন্দাবনের মায়ায়
তাকেই জড়িয়ে রাখি নিবিড় আবেগ।
‘পরান কথার ঘ্রাণ’ কবির মনন দিয়ে জারিত হয়ে সাদা খাতায় স্থান পায়। তার প্রকাশ পাওয়া সময়ের অপেক্ষা। নিজস্ব চেতনা সার্বজনীন করার এর ভাল কোন উপায় নাই বললেও হয়।
ব্রহ্মা-ে চিন্তা বাড়ানোর সহায়ক হবে সেই দাবি করতেই পারে পা-ুলিপি ‘পরাণ কথার ঘ্রাণ’। আমাদের অপেক্ষা শব্দ সুবাসের পা-ুলিপি ‘পরান কথার ঘ্রাণ’ মলাটবদ্ধ হয়ে আসুক সাহিত্য সংগ্রহশালায়।   



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট