লেখিকা হওয়ার গল্প





লেখিকা হওয়ার গল্প
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

মানুষের জীবনে হঠাৎ করেই এমন কিছু মোড় আসে, যা তার জীবনটা বদলে দেয়। এমনকি বদলে যায় তার পরিচিতি। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে আমি ছিলাম একজন ষোড়শী যুবতী। তখনই আমার বিয়ে হয় আর আমি লাল শাড়ি পরে হয়ে গেলাম একজন নারী। বাপের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার পর আমার নামটাও বদলে যায়। বাবার দেওয়া নাম সোনালী ইসলাম থেকে তখন স্বামী আসিফ রহমানের নামের শেষাংশ গ্রহণ করে হয়ে গেলাম সোনালী রহমান। বছর ঘুরতেই আমাদের প্রথম সন্তান জারিন এবং ঠিক তার দুই বছর পর দ্বিতীয় সন্তান তৌসিফের জন্ম। খুব দ্রুতই হয়ে উঠি দুই সন্তানের জননী। সংসার ও সন্তান সামলাতে গিয়ে লেখাপড়া একদম শিকে উঠে কিন্তু আমার বই প্রীতি ঠিকই থেকে যায়। যখনই সুযোগ পেতাম, আমার প্রিয় লেখকদের বই পড়তাম। তবে সাংসারিক চাপে বই পড়ার সুযোগ খুবই কম পেতাম। বিয়ের পাঁচ বছর পর স্বামীর হাত ধরে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাই স্বপ্নের দেশ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে। সেখানে শুরু হয় সম্পূর্ণরূপে এক নতুন জীবন। বলতে গেলে নতুন করে একটা জীবন যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে গা ভাসিয়ে কখন যে বাঙালি ললনা থেকে আমেরিকান মেম হয়ে গেলাম, সেটাই টের পাইনি। এক সময় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ হয়ে গেলাম পুরোদস্তুর আমেরিকান। যদিও আমাদের মতো মাইপ্রেট করা নাগরিকদের এখানে বাঙালিই বলা হয়ে থাকে। এটা বলাটাই খুব স্বাভাবিক কারণ আমাদের পরিচয় বদলে নিলেও অনেকেই মনেপ্রাণে ষোলো আনা বাঙালি থেকে যায়। তাদের মধ্যে আমিও একজন। শাড়ির প্রতি আমার ভীষণ টান, প্রায়ই ছুটির দিনে জীবনানন্দের বনলতা সেন সেজে আয়নার সামনে বসে থাকি।

স্বপ্নের দেশ আমেরিকা থাকলেও সবার জীবন স্বপ্নের মতো রঙিন হয় না। কারো কারো জীবনের রঙ বেদনার ধূসর রঙে ঢেকে থাকে। এক কথায় বলা যায়, কষ্টের সাথে বারোমাস বসবাস। কষ্টকে নিয়তি মেনে চরিত্রহীন মাতাল স্বামীর অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেও শেষ পর্যন্ত আর সংসার টিকিয়ে রাখা গেল না। হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে নরক থেকে মুক্তি নিয়ে নতুন করে শুরু করি আরেক জীবন যুদ্ধ। আমার সন্তানেরা বড়ো হয়ে গেছে। তারা তাদের নিয়েই থাকে মহাব্যস্ত আর আমি কাজকর্মের ফাঁকে বইয়ের রাজ্যে। মাঝেমধ্যে সময় পেলে ফেসবুকেও কিছু সময় কাটাই কিন্তু ততোটা সময় হয়ে উঠে না। ফেসবুকে অনেক নামীদামি বাঙালি লেখক-লেখিকার সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় ও ম্যাগাজিনে তাদের লেখা গল্প ও কবিতা ছাপা হয়। আমি তাদের লেখাগুলো ভীষণ মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। মাঝেমধ্যে নিজেও ফেসবুকে টুকটাক লেখালেখি করতে চেষ্টা করতাম কিন্তু তেমন পেরে উঠতাম না। তাই আমার অধিকাংশ লেখাই ফেসবুকে ‘অনলি মি’ করে রেখে দিতাম। তবে হ্যাঁ, আমার পরিচিত বন্ধুদের কেউ কেউ আমার কিছু লেখা পড়ে বেশ প্রসংশা করে। যদিও ওই লেখাগুলো ছিল নিউইয়র্কে আমার চলার পথে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন মজার ঘটনাবলি। আমার কষ্টের জীবনে এসব লেখা লিখে এক ধরণের মানসিক প্রশান্তি অনুভব করতাম। তবে নিজে কখনো যে একজন লেখিকা হয়ে উঠবো, সেটা স্বপ্নেও কল্পনাও করিনি। যেদিন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় পত্রিকার সাহিত্য পাতায় আমার লেখা গল্প ছাপা হলো, সেটা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার বন্ধুরা তো রীতিমতো ঠাসকি খেয়ে যায়। এমনকি ফেসবুকে আমার নামীদামি লেখক-লেখিকা বন্ধুরাও অবাক হয়ে যায়। তাদের অনেকেই ধারণা করেছিল, আমি হয়তো কোন ভাবে ম্যানেজ করে আমার লেখা গল্পটি ওই পত্রিকায় ছেপেছিলাম। নয়তো আমার লেখা কেন ছাপাবে? আমি তো কোন ভাবেই লেখিকা নই। ফেসবুকে মাঝেমধ্যে কিছু রম্য টাইপের লেখালেখি করি। এসব লিখে তো কেউ আর লেখিকা হতে পারে না। মজার ব্যাপার হলো, এক সময় দেখা গেল বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো শীর্ষস্থানীয় জাতীয় পত্রিকায় ও ম্যাগাজিনে আমার লেখা গল্পগুলো গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হতে থাকে। ধীরে ধীরে কিভাবে যেন আমিও একজন নামীদামি লেখিকা বনে গেলাম। এখন সবাই আমাকে ‘লেখিকা’ বলেই সম্বোধন করে। তবে হ্যাঁ, আমি লেখিকা হয়ে উঠার পেছনে একজন লেখকের গল্প জড়িয়ে আছে। যার একান্ত প্রচেষ্টায় আমার লেখিকা হয়ে উঠা।



ফেসবুকে সাঈদ জামানের সাথে আমার পরিচয়। তিনি খুব ভালো লিখেন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় ও ম্যাগাজিনে নিয়মিত ভাবে তার লেখা প্রকাশিত হয়। আমি ছিলাম তার লেখার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। ফেসবুকে তার প্রতিটি লেখাই আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। মাঝেমধ্যে আমার মুগ্ধতার কথা জানিয়ে মন্তব্য করতাম। হঠাৎ একদিন ফেসবুক নোটিফিকেশনে দেখলাম আমার একটি পোস্টে সাইফ জামান মন্তব্য করেছেন। আমি খুব উত্সাহ নিয়ে সেই মন্তব্য পড়ে অবাক হয়ে কয়েক মিনিটের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে ছিলাম। তিনি মন্তব্য করে ছিলেন, ‘আপনার লেখায় যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। লেখাটা অব্যাহত রাখুন। মুগ্ধতা জানিয়ে গেলাম। ‘এমন মন্তব্য পড়ে ভেবেছিলাম, তিনি হয়তো এমনিতেই আমার মতো ভক্তকে খুশি করতে এই মন্তব্য করেছেন। তবুও মনের কৌতুহল থেকে উনার ইনবক্সে গিয়ে নক করলাম।
কেমন আছেন। আপনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আপনার মন্তব্যটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
মেসেজ লিখে অপেক্ষায় রইলাম দীর্ঘ সময় ধরে কিন্তু তিনি অনলাইনে আসছেন না। অনলাইনে এসেও আমার মেসেজ পড়লেন না। মন খারাপ করে উত্তরের আশা ছেড়ে দিলাম। হঠাৎ দুদিন পর দেখি উনার মেসেজ।
প্রথমেই দুঃখিত, আপনার মেসেজ পড়তে দেরি হয়ে গেল। আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। আমি কখনো মিথ্যা কিংবা বাড়িয়ে মন্তব্য করি না।
তাই নাকি! তাহলে কী সত্যি সত্যিই আমার ওই লেখাটি আপনার ভালো লেগেছে?
শুধু ভালো নয়, ভীষণ ভালো লেগেছে। আপনার বেশ কয়টি লেখা পড়ে ওই মন্তব্য করে ছিলাম।
আমার একদম বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি তো আর আপনার মতো লেখক নই।
আমার চাইতেও অনেক ভালো লিখতে পারবেন। আপনি সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত।
জ¦ী একদম ঠিক বলেছেন। আমি উনার অন্ধ ভক্ত। তবে আপনি সেটা কিভাবে বুঝলেন?
আপনার লেখা পড়েই বুঝতে পেরেছি। তবে হ্যাঁ, আপনার লেখায় নিজেস্ব ধাঁচ আছে। সেটাও আমাকে বেশ আকৃষ্ট করেছে।
কি বলছেন, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। আমার লেখার নিজেস্ব ধাঁচ আপনাকে আকৃষ্ট করেছে।
নিজের উপর আস্থা রাখুন, নিয়মিত লেখালেখি করুন। আপনার রম্য লেখার হাত আছে। এইদিকে খুব ভালো করতে পারবেন।

সাঈদ জামানের সাথে কথা বলার পর গভীর চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার কয়েকজন বন্ধুর সাথে এক আড্ডায় সাঈদ জামানের সাথে যেসব কথা হলো, সেসব নিয়ে আলোচনা করলাম। তারা সবাই খুব হাসাহাসি করলো। আমাকে টিপ্পনী কেটে বললো, সম্ভবত ওই লেখক লেখাতে নয়, আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। লেখকদের চরিত্র এমনই হয়, ভুলিয়ে ভালিয়ে নারীদের মন জয় করা। ওদের কথায় সাঈদ জামানের প্রতি আমার ভীষণ রাগ হলো। এরপর থেকে বেশ কিছু দিন তার কোন লেখাও পড়িনি। হঠাৎ একদিন আমার ইনবক্সে সাঈদ জামানের একটা মেসেজ পেলাম। মেসেজ দেখেই চমকে উঠলাম। আমার লেখা একটা গল্প বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার রম্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। গুগুলে সার্চ দিয়ে দেখলাম ঠিক আছে। জীবনে এই প্রথম আমার লেখা কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, সেটাও কি-না এতো জনপ্রিয় একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে! তারপর সাঈদ জামানের সাথে যোগাযোগ করলাম। তিনি জানালেন, আমার টাইম লাইন থেকে গল্পটি নিয়ে কিছু সংশোধন করে ওই পত্রিকায় ইমেইলে পাঠিয়ে দিয়ে ছিলেন। তখন আমি উনার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলাম। কেন আমার অনুমতি ছাড়া আমার লেখা পত্রিকায় পাঠালেন। উনার আসল উদ্দেশ্য জানতে চাইলাম, কেন আমাকে ইম্প্রেস করতে চাইছেন। তিনি তখন ভীষণ বিরক্ত হলেন। আমাকে রাগান্বিত হয়ে বললেন, আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াতেই তিনি লেখাটা ঠিকঠাক করে পত্রিকায় পাঠিয়ে ছিলেন। এখানে অন্য কোন উদ্দেশ্যে নেই। ধীরে ধীরে আমরা দুজন বেশ ভালো বন্ধু হয়ে যাই। যদিও বয়সে সাঈদ জামান আমার চেয়ে বেশ ছোট কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ। লেখালেখির বিষয়ে আমাকে অনেক পরামর্শ দিত এবং বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করত। আমি তার পরামর্শ ও সহযোগিতা পেয়ে আমার চারপাশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা থেকে একের পর এক রম্য গল্প লিখে যাচ্ছি।

একদিন সাঈদ জামান আমার ইনবক্সে বেশ কিছু ইমেইল এড্রেস দিলেন। তিনি জানালেন, এগুলো বিভিন্ন জনপ্রিয় পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের ইমেইল এড্রেস। আমি যেন আমার লেখা গল্পগুলো ইমেইলে পাঠিয়ে দিই। আমার ধারণা ছিল, আমার লেখা পত্রিকায় ছাপাবে না। তবুও সাঈদ জামানের চাপে গল্পগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় ইমেইলে পাঠিয়ে দিলাম। কিছু দিনের মধ্যেই সবগুলো লেখা প্রকাশিত হয়। তখন সাঈদ জামান আমাকে ইনবক্সে বললেন,
এবার তো আমি ইমেইলে লেখা পাঠাইনি। তবুও কিভাবে এতোগুলো পত্রিকায় আপনার লেখা গল্প গুলো ছাপা হলো? রহস্যটা কি বলুন তো?
আমি তখন বেশ লজ্জা পেলাম। সেই সাথে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কোন উত্তর না দিয়ে কিছু সময় চুপ করে রইলাম। তারপর উত্তর দিলাম,
নিজের উপর আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। তবে শুধুমাত্র আপনার সহযোগিতার জন্যেই মনে হচ্ছে আমিও একদিন লেখিকা হয়ে উঠবো।
হা হা হা.. এখনো কী লেখিকা হতে পারেননি? আমার আর কোন সহযোগিতা আপনার দরকার নেই। আপনি এগিয়ে যান, শুভকামনা রইলো।
আমি সাঈদ জামানের মেসেজ পড়ে বেশ কষ্ট পেলাম। তিনি কেন যেন আমার থেকে দূরে সরে গেলেন। এদিকে পত্রিকা অফিস থেকে বিভিন্ন পত্রিকা অফিস থেকে আমার কাছে ইমেইল আসছে নতুন গল্প পাঠাতে। আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি। অনেক উত্সাহ উদ্দীপনা নিয়ে নতুন করে গল্প লিখে ইমেইলে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার লেখাগুলো নিয়মিতভাবে ছাপা হচ্ছে। আমার ভক্তের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুজন প্রকাশক আমার লেখা গল্পগুলো দিয়ে বই প্রকাশের আগ্রহ প্রকাশ করে। আমি তখন খুশিতে আত্মহারা। যথা সময়ে বই দুটি প্রকাশিত হয় এবং বইমেলায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। বইমেলা উপলক্ষে আমি বাংলাদেশে গিয়ে ছিলাম। তখন আমাকে নিয়ে আমার ভক্তদের আগ্রহ দেখে অবাক হয়ে যাই। এতো সাধারণ একজন মানুষ, যার লেখাপড়াও খুব বেশি নয়। সেই মানুষের কাছে অটোগ্রাফ নিয়ে ভক্তরা বই কিনছে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা এসে ইন্টারভিউ নিচ্ছে। এটা যেন আমার কাছে অকল্পনীয়। যে মানুষটির জন্যে অকল্পনীয় ব্যাপারটি বাস্তব হলো, সেই মানুষটির সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি। অনেক চেষ্টা করেও তার দেখা পাইনি। বর্তমানে আমার পরিচয়, আমি একজন জনপ্রিয় লেখিকা। তবে আমার লেখিকা হওয়ার পেছনের গল্পটাই সবার কাছেই অজানা।

কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ, ঢাকা




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট