দুঃখবোধের গল্প

 


দুঃখবোধের গল্প
জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ

তখন আমার বয়স ৭ কিংবা ৮। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সোজা ছুটে যেতাম যমুনার পাড়ে । বলা চলে; যমুনা আমাকে প্রেমিকার মত কাছে ডাকত; তার ডাকে বড্ড মায়া ছিল। ছুটে যেতাম সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে। সত্যি বলতে আমার ভীষণ ভালোও লাগতো। যাক সে কথা; পাড়ার বন্ধুরা মিলে যমুনায় কত জল কাটাকাটি খেলতাম।
আমার মামাতো ভাই আসাদুর; ও অনেক বেশি সাহসী ছিল । ওর সাহস আমাকে অবাক করত এবং ভয় জাগিয়ে দিত। অসম্ভব রকমের ভয়। এক কথায় বলে বোঝানো যাবেনা। গ্রীষ্মের সময়। যমুনার জল তখন যমুনার পেটে চলে যেত। কিনার থেকে জলের দূরুত্ব ছিল প্রায় ৪০ ফুট। আসাদুর সেই ৪০ ফুট ওপর থেকে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ত। ওর এমন দুরন্তপনা আমার শরীর শিউরে দিত । ভাবতাম; আল্লাহ্, ওকে এত সাহস দিয়ে বানিয়েছে; ক্যামনে। শুধু আমি একা বললে ভুল হবে; আরো অনেকে’ই ছিল আমাদের সাথে। প্রায় ২ থেকে ৩ ঘন্টা জলে লাফালাফি শেষে যমুনার মরুভূমির মত বুকে হাত পা ছড়িয়ে রোদ মেখে নিতাম । কি এক অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করত; বোঝাতে পারবনা ।
২.
একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি বাড়ির পাশে বন্যার পানি এসেছে। হালকা হালকা ¯্রােত বইছে। খেয়াল করলাম; কিছু মাছের আনাগোনা। দৌড়ে গিয়ে জাল নিয়ে এসে নেমে পড়লাম মাছ শিকারে। আহা; তাজা মাছের লোভ কে সামলাতে পারে। আমিও পারিনি। বেশ কিছু পুঁটিমাছ পেলাম; আরো ছিল টেংরামাছ। জাল দিয়ে না পেরে শেষমেশ মাকে গিয়ে বললাম; মা- টাকা দাও বর্শি কিনব । মা আমার; কথা শুনে প্রায় রাগে গর্জে উঠলো। অবশ্য; মায়ের এমন রাগ নিত্যদিনের। মায়ের রাগ উপেক্ষা করে দোকানে গিয়ে বর্শি আনলাম; তারপর বর্শি গুটিয়ে মাছ শিকারে নেমে পড়লাম। বাড়ি চারপাশ নতুন পানি। ঘোলা পানি। নানা রকম মাছের উৎপাত। শামুক কেটে কেটে বর্শিতে মাছের আহার বানিয়ে পানিতে ফেলে রাখলাম। সহযোগিতা করত আমার এক ছোটমামা; আর ছোট দুই বোন । ওরাও মাছ ধরায় ছিল ভীষণ পটু। প্রায় ২০টা বর্শির কঠিন দ্বায়িত্ব নিয়ে আছি আমরা চারজন। সবার চোখ কেবল বর্শির টোনের উপর । কখন যে মাছ এসে টিপ দিবে। বেশ কিছুক্ষণ পাড় হয়ে গেল । কিন্তু কোনো মাছের সাড়া-শব্দ নেই। আমার নিজের ভেতর কেমন যেন একটা রাগ তৈরি হলো। এত আগ্রহ নিয়ে বর্শি কিনে এনে যদি মাছ ধরতে না পারি; তাহলে আমাদের ইচ্ছের কোনো পূর্ণতাই পেল না। এক প্রকার জিদ তৈরি করলাম যে; আজ মাছ না ধরে এখান থেকে উঠব না। এমনটা ভাবতে ভাবতে ওদিকে আমার বোন জান্নাতী একটা বর্শি দ্রুত তুলে ফেলল। তারপর দেখি; সেই বর্শিতে বড় একটা বাইন মাছ ধরা পড়েছে। এতক্ষণে নিজেকে একটু স্বস্তি দিতে পারলাম। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল চলে এলো। বাড়ির যাবতীয় কাজ শেষ করে মা আমাদের মাছ ধরা দেখতে এসেছে। পাতিলে খুলে যা দেখল মা; তাতে মায়ের মনটা ভালো হয়ে গেল। ভাবতে শুরু করলাম; এই মাছ যদি আজ না ধরতে পারতাম; তাহলে মায়ের হাতের পিটুনি খাওয়া ছাড়া কপালে আর ভাত জুটতো না। আহ ! সেই সুন্দর শৈশব আজ কোথায় যে হারিয়ে গেছে; কে জানে !


৩.
আমার গ্রাম; আমার বাড়ি; আমার ঘর আর এই গ্রামের মাটি আমার সারা শরীরে মেখে আছে। কত মায়া; কত প্রেম; কত শান্তিতে লুকিয়ে আছে; কেউ জানেনা। ছোট থেকে বড় হয়েছি; সব বুঝতে শিখছি। এই গ্রামের মানুষ; এই গ্রামের ন্বিগ্ধতা; এই গ্রামের বাতাশ; এই গ্রামের গন্ধ আমার বুকে জুড়ে লেগে আছে।
আজ আমার গ্রামটা যমুনার জলে ভেসে গেল। আমার পড়শি; আমার কৈশোরের বন্ধুরা; আমার ছুটে চলার নিবিড় ঠিকানা হয়ত বা আর ফিরে পাবোনা । যমুনার এই ভাঙোনে কে কোথায় চলে গেছে; কে জানে । আর এখন মাটির কত দাম; ক’জনের’ই বা সেই সার্মথ্য আছে যে; তারা টাকা দিয়ে মাটি কিনে সেখানে ছোট করে একটা ঘর বানিয়ে কাটিয়ে দিবে বাকি জীবন। এসব ভেবে ভেবে আমার বুকের ভেতরটা আটকে আসে। নিঃশ্বাস নিতে পারিনা; চোখের উপর জল চলে আসে। জানিনা; সৃষ্টিকর্তা কেন এটা করল । হয়ত বা ভালো কিছুর জন্য। কারণ; সে যা করে; সব’ই তার বান্দার মঙ্গলের জন্য করে।
৪.
আমি ভাবতেও পারিনা; যমুনা আমার গ্রাম নিয়ে গেছে; বাড়ি নিয়ে গেছে; ঘর নিয়ে গেছে; পড়শি নিয়ে গেছে; শান্তি নিয়ে গেছে। যে যমুনার কাছে আমি বেশি’র ভাগ সময়’ই কাটিয়েছি খেলতে; দুলতে; ঘুমোতে। আহ! সেই যমুনা কিনা আমার কিংবা কিছুই রাখলো না। কতটা নির্মম; কতটা নিষ্ঠুর হয়েছে যমুনা; আমি চিন্তাও করতে পারিনা।
হে যমুনা; তবু ভালো থাকো; আমাদের দুঃখে; আমাদের অভাবে; আমাদের ঘরে; আমাদের উঠোনে। তুমি ভালো থাকো; যমুনা...
 


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট