জাদুর কুমড়োর বীজ

 



জাদুর কুমড়োর বীজ

আহমাদ স্বাধীন


একজন বৃদ্ধ পিতার ছিলো দুইজন ছেলে। 

বৃদ্ধ ছিলো খুব গরিব। তার সন্তানদের মা বেঁচে ছিলেন না। দুই ছেলেকে নিয়ে একটা ভাঙাচোরা কুড়েঘরে ছিলো তার বাস। অন্যের জমিতে চাষ করে চলতো তাদের সংসার। কিন্তু যখন বৃদ্ধ অসুস্থ হয়ে গেলো, তখন তাদের অভাব আরো বেড়ে গেলো। 

কারণ তার ছেলে দুজন ছিলো এক একটা কুড়ের বাদশাহ্। সারাদিন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো। 

কাজে মন ছিলো না কারোই। বৃদ্ধ অসুস্থ হয়ে যখন বিছানায় পরলো তখন হুস হলো ছেলেদের। 

বাবা একা কাজ করে প্রতিদিন খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। এখন ঘরে খাবার নেই। 

তাদের বাবা অনেক বুঝিয়েও তাদের দিয়ে কোন কাজ করাতে পারে নি। এখন ছেলেরা ভাবনায় পড়লো।

তাদের বাবা মরে গেলে কী হবে ?

তারা এমন কোন কাজ শেখেনি যা করে জীবিকা চালাতে পারে। বাবার কাছেও এমন কোন সম্পদ নেই যা দিয়ে তাদের চলে যাবে। ভীষণ চিন্তিত হয়ে পরলো দুই ভাই। এদিকে তার বাবার অসুস্থ্যতা বেড়ে গেলো আরো। মৃত্যুর সময়ও ঘনিয়ে এলো প্রায়। তিনি দুই ছেলেকে কাছে ডাকলেন। বললেন, শোনো ছেলেরা। 

সম্ভবত আমার চলে যাবার সময় হয়ে গেছে। 

এতে আমার কষ্ট নেই। আমার কোন সম্পদ নেই তাতেও আমার কষ্ট নেই। কষ্ট হচ্ছে আমি তোমাদের কোন কাজ শিখিয়ে যেতে পারছি না, যা দিয়ে তোমরা জীবিকা চালাতে পারো। তোমাদের মা তোমাদেরকে ছোট রেখেই মারা যায়। আমি একাই তোমাদেরকে এতোটা বড় করে তুলেছি। 

তোমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখোনো জোর করিনি এজন্য যে তোমরা কষ্ট পাবে। এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি। তোমাদেরকে কখনো কখনো আমার শাষন করা দরকার ছিলো। সেটা করলে তোমরা কিছুটা হলেও শিখতে পারতে। যাই হোক, তোমাদেরকে দিয়ে যাবার মতো কিছুই আমার নেই তা তোমরা জানো। 

তবে আমার কাছে দুটো কুমড়োর বীজ আছে। 

এ দুটো বীজ আমাকে দিয়েছে একজন সন্যাসী। 

তোমরা তখন ছোট, তাকে একবেলা আহার করানোর পর খুশি হয়ে তিনি এই বীজ দুটো আমাকে দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন এ বীজ দুটোর মধ্যে একটা বিশেষ জাদুর বীজ আর একটা সাধারণ বীজ। তবে কোনটা জাদুর আর কোনটা সাধারণ তা আলাদা করা নেই। দুটি বীজ দেখতে এক রকম। 

এটা বোঝা যাবে তখনই যখন বীজ দুটো রোপণ করা হবে। জাদুর বীজ থেকে প্রতিদিন অনেক ফলন হবে। 

যা বিক্রি করে অনেক ধনী হয়ে যাবে। 

আর সাধারণ বীজ থেকে স্বাভাবিক ফলন যা হয় তাই হবে। এই বীজ দুটো আমি তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি। তবে শোনো, শর্ত হচ্ছে আমি মরে যাবার পর তোমরা দুজন আলাদা হয়ে যাবে। দুটো বীজ তোমরা দুটো আলাদা গ্রামে রোপণ করবে।  

আমি জানি না তোমাদের কার ভাগ্যে জাদুর বীজ আছে আর কার ভাগ্যে সাধারণ বীজ। যে জাদুর বীজ পাবে সে কিন্তু নিজের ভাগ্য বদলের পাশাপাশি গ্রামের গরীব লোকেদের সাহায্য করবে। তবে নিজের ভাইকে নয়। এই জাদুর বীজ পাওয়ার পরে যদি গরীব লোকেদের সাহায্য না করো অথবা ভাইকে এর কোন অংশ দাও তবে এই বীজের ফলন বন্ধ হয়ে যাবে।  

অপরদিকে যে সাধারণ বীজ পাবে সে এই বীজের ফলন ফলিয়ে পরিশ্রম দিয়ে চেষ্টা করবে নিজের ভাগ্য 

ফেরাতে। 

আমি আরো আগেই তোমাদেরকে এই বীজ দুটো দিতে পারতাম, কিন্তু আমি এটা দেখতে চাইনি যে আমার এক ছেলে অনেক ধনী হয়ে উঠেছে আর এক ছেলে ভীষণ দরিদ্রতার সাথে দিন কাটাচ্ছে। 

আমি তোমাদের দুজনকেই সমানভাবে ভালোবাসি। 

তবে একটা কথা মনে রাখবে ছেলেরা। 

যদি পরিশ্রম করতে জানো তবে সৌভাগ্য কেউ ঠেকাতে পারবে না। বৃদ্ধ আর কোন কথা বলতে পারলেন না। মরে গেলেন তিনি। তার ছেলেরা বাবার লাশ কবর দিয়ে দিলো। দুজন দুটো বীজ নিয়ে পাশাপাশি দুটো আলাদা গ্রামে চলে গেলো। গিয়ে যার যার বীজ রোপণ করে যতœ নিতে থাকলো।  

ছোট ভাই সকাল বেলা তার বীজটা নিয়ে রোপণ করেছিলো একটা পাহাড়ের পাশে। 

অবাক হয়ে দেখতে পেলো বিকেলেই সেটা গাছ হয়ে গেছে। এরপর দেখা যায় গাছটি বড় হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড়ে। তারপর কুমড়ো হয়ে বড় হতে হতে এতো বড় হলো যে এই গ্রামে এতো বড় কুমড়ো আর কারো নেই। ছোট ভাই বুঝতে পারলো যে সৌভাগ্যের বীজটা সে পেয়েছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে জাদুর কুমড়ো তুলে নিতো লাগলো সে। সেই কুমড়ো বিক্রি করার জন্য নিয়ে গেলো বাজারে। এতো বড় আর মজার মিষ্টি কুমড়ো খুব সহজেই সব বিক্রি হয়ে গেলো সব। ভালো দামও পায় সে। পরের দিন দেখতে পায় আবার কুমড়ো ধরে আছে লতায়। আবার বিক্রি করলো সে।  

আবার কুমড়ো ধরে গেলা লতায়।  

আবার বিক্রি করলো। এমন করে প্রতিদিন কুমড়ো ধরে আর প্রতিদিন বিক্রি করে খুব তাড়াতাড়ি ধনী হয়ে যায় ছোট ভাই। 


অপরদিকে বড় ভাই তার কুমড়োর বীজটি নিয়ে একটা নদীর পাড়ের ক্ষেতে রোপণ করেছিলো। 

সেটা গাছ হতে অনেক দেরি হয়ে যায়। 

আর কুমড়ো ধরতেও সময় লেগে যায় অনেক। 

বড় ভাই বুঝতে পারে সে পেয়েছে সাধারণ বীজ। 

তবু সে মনে মনে খুশি হয় এই ভেবে যে তার ছোট ভাই জাদুর বীজটা পেয়েছে। 

আর সেটি পেয়ে নিশ্চই সে ভালো আছে।  

বড় ভাই নিজের সাধারণ কুমড়ো লতার বেশ যতœ নেয়।  আর পরিশ্রম করে কাজ করে অন্যের  জমিতে। 

শুরুতে যদিও তার বেশ কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু ধিরে ধিরে সয়ে যায় তার পরিশ্রম। তার গাছে কুমড়ো ধরলে তা বিক্রি করে সে খুব সামান্যই টাকা পায়।  

তবু সে খুশি হয়। 

কারণ এটা তার বাবার দেয়াএকমাত্র সম্পদ। 

অন্যের জমিতে সে একটু বেশিই পরিশ্রম করে। 

আর কাজও করে বেশ গুছিয়ে। যে কারণে সবাই পছন্দ করে তাকে। সে একদিনও বসে না থেকে শুধু কাজ করে যায়। কাজের পারিশ্রমিক আর কুমড়ো বিক্রির টাকা জমিয়ে রাখে সে। এভাবে কেটে যায় কয়েকটা বছর। সে তার একটা কুমড়োর গাছ থেকে বীজ তুলে রাখে। জমানো টাকা দিয়ে একখন্ড জমি কিনে সেখানে সেই বীজ দিয়ে কুমড়োর চাষ শুরু করে। 

কুমড়ো ক্ষেতের প্রচুর যতœ নেয় সে। 

তাই সেখান থেকে অনেক ফলন পায়। 

তা বিক্রি করে বেশ ভালো টাকা আয় হয় তার।  

সে আরো জমিন কেনে।  আরো কুমড়োর বীজ রোপণ করে। তার যতেœ সেখান থেকেও অনেক অনেক কুমড়োর ফলন হয়। এমন করে অল্প কয়েক বছরেই বড় ভাই বিশাল জমিন কিনে খামার করে খামারের মালিক হয়ে যায়। 

এক সময়ে সে তার ছোট ভাইয়ের খোঁজ নিতে তার গ্রামে গেলে দেখতে পায় তার ছোট ভাই সেই গ্রামে নেই। অনেক খুঁজে খুঁজে তার সন্ধান পায় একটা বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করা অবস্থায়।

কী হয়েছে জাদুর বীজ পাওয়া ছোট ভাইটির! 

খবর নিতে গিয়ে জানতে পারে তার দুর্ভাগ্যের কথা।  যদিও সে পেয়েছিলো জাদুর কুমড়োর বীজ,  

তবে বেশিদিন সে সুখে থাকতে পারে নি। 

তার ছোট ভাই তাকে জানায়, আমি জাদুর কুমড়োর বীজ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম।  

ভুলে গিয়েছিলাম বাবার উপদেশ। তিনি বলেছিলেন, 

যে জাদুর বীজ পাবে সে যেন তার গ্রামের গরীব লোকদের নিয়ে ভালো থাকে।  

বাবা বলেছিলো আমার জাদুর কুমড়ো বিক্রি করা টাকার একটা অংশ যেন দান করি। আমি প্রথম কিছুদিন সামান্য কিছু দান করেছিলাম, তবে যখন কুমড়ো বিক্রি করে আমার অঢেল সম্পদ আসা শুরু হলো তখন সব ভুলে গেলাম। আমার কুমড়োর ক্ষেত অন্য কাজের লোককে দেখার দায়িত্ব দিয়ে আমি সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম। রাতের বেলায়ও পরে থাকতাম সরাইখানায়, মদ আর জুয়ার আড্ডায়। 

তবুও এক বছরের বেশি সময় আমার জাদুর কুমড়োর গাছটা তার ফলন বন্ধ করে নি।  

একদিন এক অন্ধ ভিখিরি আমার কাছে সাহায্য চাইলো। আমি মাতাল অবস্থায় তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। বললাম, দূর হ সামনে থেকে। সেইদিন থেকেই আমার কুমড়ো গাছের ফলন বন্ধ হয়ে গেলো। 

কিন্তু আমি এতোটাই বেখবর ছিলাম যে তা বুঝতেও আমার লেগে গেলো অনেক দিন। 

যখন বুঝলাম তখন আর কিছুই করার নেই। 

আমার কুমড়োর ফলন বন্ধ। কোন আয় নেই। 

এদিকে আমার কাজের লোকদের বেতন বাকি। 

কিছু দেনাদার ছিলো আমার, তারাও টাকার জন্য চাপ দিচ্ছিলো, তখন আমি বাড়ি বিক্রি করে দেনা ও কাজের লোকেদের টাকা পরিশোধ করলাম। 

এরপর খুব তাড়াতাড়িই আমি হয়ে গেলাম আগের মতো সহায় সম্বলহীন। চেষ্টা করলাম কোন কাজ করে পেট চালানো যায় কিনা, কিন্তু সেই যোগ্যতাও আমার নেই।  বুঝলাম যখন সামান্য কাজেও আমার প্রচুর সময় লাগছে আর অনেক ভুল হচ্ছে। কেউ আমাকে কোন কাজ দিলো না। পেটের ক্ষুধায় শেষে ভিক্ষাই শুরু করতে হলো আমাকে। 

ছোট ভাইয়ের ঘটনা শুনে খুবই কষ্ট পেলো বড় ভাই। বলল- যা হবার হয়ে গেছে, আল্লাহর ইচ্ছায় তোমার সাথে আমার দেখা তো হয়ে গেলো। 

এখন তোমাকে আর ভিক্ষা করতে হবে না।  

তুমি আমার সাথে থাকবে আর আমার বিশাল খামারের দেখাশোনাও করবে। ছোট ভাই বলল, কিন্তু বাবা তো বলেছিলো আমরা কেউ যেন নিজেদের ভাইকে সাহায্য না করি।  বড় ভাই হেসে বলল,  বাবা ঠিক এ কথা বলেননি। তিনি বলেছিলেন যে জাদুর বীজ পাবে সে যেন ভাইকে সাহায্য না করে। 

আমি তো জাদুর বীজ পাইনি। 

আমি পেয়েছি পরিশ্রমের জাদুর বীজ। 

যে বীজের ফসল ফলাতে জানলে কখনোই ফুরিয়ে যায় না। তুমি আমার সাথে থাকলে সেই বীজ কি করে ফলাতে হয় তা শিখে যাবে। 

জাদুর বীজের উপর তোমাকে নির্ভর করতে হবে না। তারপর থেকে দুই ভাই একসাথে বসবাস করতে লাগলো। আর ফলাতে লাগলো পরিশ্রমের জাদুর বীজ। 



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট