অমরি !

 



অমরি

মনিরুজ্জামান প্রমউখ


গল্পে’র মূখ্য চরিত্রের একটা নাম দেয়া দরকার । চরিত্র যার সে- একটা কুকুর । নাম দিলাম ‘অমরি’ । দেখতে সে- নিরীহ যথেষ্ট, অন্য হতে । সুন্দর- এর লুকে, মানানসই; এর ঘরে’র সদস্য নয় সে। দেখলে  ম্যামোথ্যামো লাগে, এমন । না তুচ্ছ, না স্বচ্ছ । মেদহীন দেহের গড়ন । কিছু-টা সাইক্লোন ঝড় যে ওর শরীর বেয়ে ছায়াবর্ত করে গেছে, তার ছাপ স্পষ্ট । তার কিছু হয়-তো অ-ভূক্ত থাকা’র নিয়ত ডোর। আর- কিছু হয়-তো বার বার সন্তান জন্ম-দানে, নিবার্য-তার জের । রংয়ের বিবরণ কী দরকার ? কুকুর-তো আর- মানবীয় রমনী নয়, যে- বিচারে সাদা, কালো কাঠি হবে- সমাজ তুতলে । 

আমার স্বভাবে মায়ার ভাগীদার সব- প্রাণী-কূলের মধ্যেই গোছানো । বাদ যায়-না দুই, চার, আট পা বিশিষ্ট তার অতি ক্ষুদ্র, বৃহৎ কোনো প্রাণী । সব মাখলুকাতে’ই আমার অতীব- দয়াদ্র মন । কেনো জানি-না । কেনো জানি- হিংসা’ই মনে ধরে-না । অথচ- অস্তগামী সূর্যের মতোই আমার জীবন-বিচরণ । না আয়, না ব্যয়। ব্যয় ধরে এগোলে, আয়ের কথা- মনে পড়ে যায় । দয়াদ্রের আকাশে তখন- মেঘ জমে । আমি অন্ধকারে ঢাকা পড়ি । নিজস্ব আলোয়- বেরিয়ে আসি । চারপাশে’র আলোয়- বিকশিত হবার প্রয়াস এখানে, বান-ভাসি মানুষের চুরমার আর্তনাদে’র মতো’ই । 

এখানকার মানুষদের আমি দেখেছি, পরিপূর্ণ জমিনকেও কিভাবে তারা- অনায়াসে অনুর্বর করে । পর্বতের চূড়ালোকন করে, বলে- এ আর- এমন কী ? নল দিয়ে, খল করলেই নেমে আসবে- ক্ষুদিরাম । নদীর বিকশিত ¯্রােত দেখে, বলে- এ জন্মে কতো... দেখেছি । হাওয়ার টাল সারলেই পরে যাবে- সিলসিলা । কোনো এক-টা নিরিহ প্রাণী চোখের সামনে পরলেই তারে দেয়- দৌড়ানি । হাতের কাছে যাই থাকুক তাই নিয়ে, তেড়ে যাবে মারতে, শত্রু-তার ঔরশ কাঁপিয়ে । এমন-কি কখনো কখনো- সবিস্তারে মৃত্যুর ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দেয় । যেনো- মানুষ ব্যতীত আর- অন্য কোনো প্রাণীর বেঁচে থাকার অধিকার নেই, এই ধরণীতে ! কি আশ্চর্য বিড়ম্বনা ! দেখে- মুমূর্ষু-তা লাভ করি । খ-, বিখ- হই ! 

এই যেমন- মাছ ধরার নিমিত্তে জাল পেতে, জাল টেনে এনে, মাছ-গুলো নিয়ে, মাছের সাথে ভাই ভাই উঠে আসা- নিরিহ কাঁকড়া আর নির্বিষ ডোরা সাপ-গুলো মারা পরে, তাদের হাতের নিকটে পাওয়া যে- কোনো দন্ড, অ-দন্ড কিছু’র প্রহারে প্রহারে। 

আরেক যেমন- বাড়ির আশেপাশে, কিংবা- চলতি হাঁটোয়া পথে, দৃষ্টি’র নৈকট্যে একটা কুকুর বা- বিড়াল পরলো । ব্যস্ হুশহাশ করে, অথবা- নলখাগড়া জাতীয় কিছু মিললেই হলো । দিবে চপান্তর করে । যেনো- কতো জনমের শত্রু-তা ঐ পক্ষান্তর-হীন প্রাণী-গুলো’র বরবাদে ! যা- আরেক মানবের সাথে, চরম শত্রুতায়ও এমন মনস্খলন আচরণ লক্ষিত হয়ে, ওঠে-না ! কেননা- শত্রু-তারও এক-টা বেলা থাকে, এক-টা ভূমি থাকে । সময় অ-সময় থাকে । কিন্তু দেখার আড়ে দেখেছি, ঐ অসহায় প্রাণী-গুলো প্রায় সব হাড়ে’ই নিগৃহীত হয়। এ কেমন মানসিক-তা মনুষ্যজীবিদের ? গল্গের গায়ে প্রশ্ন । 

কুকুর এমন এক জাতীয় প্রাণী । যারা যৎ-সামান্য আহার, আর- একটু উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলে, সকলে’র খাতে পরম উপকারী । মেল-বন্ধনে’র এক বিরল উদাহরণ- সম্মত । যা- আমরা নানান ঘটনা’র উৎকর্ষে, তার সাক্ষী । পার্থক্য কেবল এই যে কেউ উপলব্ধির চাবি দিয়ে, তার সহানুভূতির তীরটা উন্মোচন করি । আর কেউ করিনা, বা করতে পারিনা, বোধের অ-সামাজিক দৈন্যতার কারণে । সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে, আমরা এখন- সুদূরকেও কাছে টানি । পরকেও করি- আপনের আহব্বায়ক । বহুল কনটেন্টের মাধ্যমে দেখতে পাই, কুকুর কিভাবে- মানুষের জীবনের উত্তম সহায়কের ভূমিকা পালন করে থাকে । একাকীত্ব ঘুচাতে, আরেক মানব সহকারীর বিকল্প রোল পে করে, সর্বোপরি- জীবন বাঁচাতে, তড়িৎ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে । অথচ- তাদের মানুষে’র কাছে, কোনো- চাওয়া পাওয়া নেই । জবর-দস্তি নেই । বাড়ির যে কোনো- এক প্রান্তে, পড়ে থাকা । সারাদিন এ-বাড়ি, ও-বাড়ি, অলি-গলি ঘুরে-ফিরে খাবারন্ত কিছু মিললে, আর- মানুষের ফেলে দেয়া- উচ্ছিষ্ট ঠুকরে বেঁচে থাকা ।  

অমরি’র দেখা মিলে এক-রকম আচমকা’ই বলা চলে । আচমকা এই অর্থে- জন্ম-সূত্র ধরে একটু একটু করে- বেড়ে উঠতে, দেখা এক। আর- চার পাঁচটা বাচ্চা বিয়ানো ক্ষয়, মানুষের ছিঃ ছিঃ প্রবৃত্তির ফলাফলের জের- খাদ্য ঘাটতি, ও পৃষ্ঠ-দেশের রোম ঝরে পরে অনাবৃত অংশ-সমূহের বৈকল্য দেখে- মনুষ্য অর্জিত যে কোনো মানবের হৃদয়ে, হাহাকার করে ওঠা আরেক । অমরির আরেক দেখায় আমি- মর্মাহত । জীর্ণ-শীর্ণ অমরির আপদমস্তক প্রাণ গেলো গেলো- পৃথিবীর রচনাকালে, আমি- মামু হয়ে উঠি । কিন্তু- হলে, কী- হবে ? আমিও ছিলাম- আর্থিক রুগ্নতায় পলেস্তরাহীন দিনযাপনের রাতহীন । কী করে, পারি- অমরির পেটের খাবারের চাহিদা পূরণে- সক্ষম হতে ? 

বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা । গোনে নিলে- বছর দশেকের কম হবে-না । হলে, বেশি হবে । আমাদের ঘরের লাগোয়া সামনে দিয়ে, যে গলি পথ গিয়ে, বাকিলা বাজারে আসা-যাওয়ার রাস্তায়- গা জুড়েছে, সেই পথ ধরে’ই অমরির নিরর্থক যাওয়া-আসা হতো । আগ-দরজা বা- সদর-দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে, এই-বেলা না ঐ-বেলা অমরিকে দেখতে হতো । এই দেখার সিঁড়ি বেয়েই মমতার আলোড়ন ঘটলো- হৃদয়ের এ-পাশে, ও-পাশে । একদিন আলোড়ন ভরে, কি যেনো- এক-প্রকারের খাদ্যকণা ছিটিয়ে দিই, অমরির অ-ভূক্ত  দৃষ্টির সামনে । সে লুফে নেয় বদান্য নয়নে । 

কোথায় যেনো তার আস্তানা, জানা নেই । তার নিজস্ব বেলা করে, সে- আসতো । কখনো নিয়মিত, কখনো অ-নিয়মিত । আমার খাবারের অংশ হতেই তার- ভাগ্যের দানা । মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যেতো- অমরি কয়েক মাস, বছরের জন্য । লম্বা বিরতি নিয়ে ফিরে, আমাকে বিষ্ময়ের জানান দিয়ে চলেছে, অমরি । এইতো গেলো তিন মাসের বিরতি শেষে আসলো লাগাতার ছয়দিন । তার-পর আজ ধরে সাত-দিন উধাও । 

অমরি ভাত খায়-না, খায়-না রুটিও । খাওয়া’র মধ্যে সে শুধু- বিস্কুট-টা’ই খায়। খুব রসালো আস্বাদন তার বিস্কুটকে জীব্য করে । যদিও বিস্কুটে তার ভোগের দাবি- অচল, অ-পূর্ণ থাকে, আমার অ-সামর্থ্যের কারণে। যোগান দিতে পারি- হয়-তো তিনসংখ্যা । তার হয়তো নয় সংখ্যাও কম হয় । আর এই অমিলের কারণে, ভেতরে ভেতরে অমরি রেগে-মেগে, নিয়মের উধাও হয়ে যাওয়া’র চালটা হয়-তো চালে । যাতে পরের বার এলে, তার- ভাগ্যোন্নয়ন ঘটে । কিন্তু- দিন যায়, বছর যায়, আমার- ভাগ্যে’র চাকা সেই অনুপাতে ঘুরে-না। যেই অনুপাতে, অমরি ঘুচাতে পারতো, তার- ক্ষুধার বিজ্ঞান । 

মাঝে মাঝে উল্টো স্রোতের দাঁড় টেনে মনে হয়- অমরি এখন আর- ক্ষুধার টানে এখানে আসে-না । তার হয়তো এখন আর তেমন ক্ষুধা নেই । সে হয়তো আসে- ঋণের টানে । ঐ যে তার- জীর্ণ সময়ের কালে, বাঁচার সামান্যতম খোরাক হয়েছিলাম, সে জন্যে । মাঝে মাঝে হারিয়ে গিয়ে, পুণরায় এসে- নত মস্তকে, লেজের নম্র হেলুনিতে, সে তার ঋণের প্রতি শ্রদ্ধা- জানিয়ে যায়। খাওয়া’র মুখরোচক স্বাদ-টা তার কাছে, হয়তো এখন গৌণ । 

দীর্ঘ হায়াতের অমরি তার পরবর্তী আগমনের জের কখন টানবে, সেটা শুধু- অমরির একার খ-ন । একটা অপেক্ষা তার মোলহেড। 


হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর । 



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট