কদমপ্রেম ও বিরহসমগ্র

     অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


কদমপ্রেম ও বিরহসমগ্র

জুয়েল আশরাফ


অনেকক্ষণ হলো কনস্টেবল মাহেরের হাত চুলকাচ্ছে। হাত চুলকালে টাকা আসে, বিথী বলেছিল। কোন হাত চুলকালে টাকা আসবে সেকথা বলেনি। মাহেরের অবশ্য দু’টো হাত-ই চুলকাচ্ছে। টাকা আসবে দূরের কথা, সাত হাজার টাকা ঋণ করে বাড়ি ভাড়া দিতে হয়েছে। এই মাসে অনেক খরচ হয়ে যাচ্ছে। খরচাখরচের সংসার না, দুজন মানুষ মাত্র। তবু সংসার তো, এর মুখে যত ঢালো হাঁ করে থাকে আরও গিলে ফেলার জন্যে। বিথী মেয়েটা ভালো, অযথা খরচের অভ্যাস নেই। অপচয়কে দু চোখের বিষ মনে করে। সেদিন রাতে বাসায় এক কেজি আদা সঙ্গে নিয়ে ঢুকেছিল। দেখেই বিথীর সেই কী রাগ! রেগেমেগে আগুন হয়ে বলেছিল, ‘তোমাকে তো বলেছি আদাটাদার দরকার নাই। অল্প আদাতেই তরকারি রান্না হয়ে যায়। এম্নিতেই যা দাম!’ মাহের বলল, ‘ঠিকমত মশলা না হলে কী তরকারি স্বাদ হয় বলো?’ বিথী বলল, ‘মশলা হলেই তরকারি স্বাদ হবে এই ধারণা ভুল। যিনি রাঁধতে পারে দুটো পেঁয়াজ আর একটুকরো আদা দিয়েও তরকারিতে স্বাদ আনতে পারবে। যিনি পারবে না, তার মুখেই শুনবে মশলা নিয়ে ধানাই-পানাই।’

ধানাইপানাই কী মাহের জানে না। বিথীকে জিজ্ঞেসও করেনি কখনও। মাঝে মাঝেই বিথী কোনো কিছু উদাহরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই শব্দটা ব্যবহার করে। আজ বাসায় গিয়ে জিজ্ঞেস করবে। দুই বছর হলো বিথীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। এখনো অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করা হয়নি। যেমন- বিথীর প্রিয় খাবার কী, প্রিয় রঙ কী মাহের এসবের কিছুই জানে না। ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে। মাহের অবশ্য বিথীর প্রিয় ফুলের নাম গোপনে জেনে গেছে। ‘গোপনে জানা’ ব্যাপারটা হলো- স্কুল জীবন থেকে বিথী একটি ডায়রি ব্যবহার করছে। সেখানে তার পছন্দ অপছন্দ লেখা থাকে। বিয়ের পর ডায়রিটা বাবারবাড়ি থেকে নিয়ে আসে। লুকিয়ে রাখে আলমারিতে এবং লেখেও লুকিয়ে। একদিন কৌতূহলবশে মাহের আলমারি থেকে ডাইরিটা লুকিয়ে বের করে আনে। পৃষ্ঠা উল্টাতেই প্রথম লেখাটা পড়ল- ‘আমার হাতের লেখা ভয়ংকর বাজে। হাতের লেখা অসুন্দরের জন্য জীবনে অনেক মার খেয়েছি। প্লিজ, কেউ আমার ডাইরিটা পড়ো না। লজ্জায় মরে যাব!’

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ

এরপর দ্বিতীয় পৃষ্ঠা উল্টাতেই পড়ল- ‘আমার প্রিয় ফুল কদম।’ মাহের সেই ডাইরির আর তৃতীয় পৃষ্ঠা উল্টায়নি। বিথীর লাজুক মুখটা মনে এলো ঠিক সেই মুহূর্তে। এক ধরনের ভাললাগার তীব্র আবেশ নিয়ে ডাইরিটা সে জায়গা মতো রেখে দিল।

হাত চুলকাতে চুলকাতে হল ঘড়িটার দিকে তাকায় মাহের। রাত পৌনে দুইটা বেজে চলেছে। সে অপেক্ষা করছে এস আই আবদুল মালেক স্যারের জন্য। আজ রাতে ডিউটি শেষে বাসায় গিয়ে খেতে বসেছে, তখনই ফোন আসে। খাওয়া অর্ধেক রেখেই থানায় এসে হাজির। থানার পাশেই বাসা। স্যারের ফোন পাওয়া মাত্রই আসা যায়। রোজই ছুটে আসে সে। ছুটে আসতে হয়। চাকরিটাই এরকম, দিনরাত নেই, রোদ-ঝড়বৃষ্টি নেই। এখন তো করোনাকাল, এই মহামারীকালেও পুলিশের খাকী পোশাকে কোথাও নেই অখন্ড অবসর। বের হওয়ার সময় রোজকার মতো বিথী তিরিক্ষি গলায় বলল, ‘চাবি পা-পোছের নিচে রেখে দিলাম।’ আজও ভোর হওয়ার আগে বাসায় ফিরতে পারবে না হয়তো। অবশ্য বিথী ভোর হওয়ার আগেই জেগে যায়। উঠে ফজরের নামাজ পড়ে। বাড়িতে এসে পা-পোছের নিচ থেকে চাবি বের করে তালা খুলতে হয় না মাহেরের। তালা খোলা-ই থাকে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বিথীর মিহি সুরে কোরআন পড়ার শব্দ পায়। আপাতত এখন এটাই প্রতিদিনকার চিত্র।

প্রায় আধ ঘন্টা ধরে থানার অফিস ঘরে মাহের বসে আছে। থানায় এসেই শুনতে পায় আবদুল মালেক স্যার বাথরুমে। এখনও বের হচ্ছে না। আজকে কোথায় যাবেন জানা নেই। লকডাউন আসার পর থেকেই শহরে নতুন নতুন ঝামেলা আরম্ভ হয়েছে। পুলিশবাহিনীর দিনরাত পরিশ্রম বেড়ে গেছে। সাথে আক্রান্তের ভয় তো আছেই। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যারা সামনে থেকে কাজ করছেন ভয়টা তাদেরই বেশি।  চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। এদের আক্রান্ত হওয়ার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মৃত্যুর এমন ঝুঁকি নিয়েই করোনা প্রতিরোধে কাজ করে যেতে হচ্ছে সবার। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সংবাদকর্মীসহ যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন, তাদের একটি বড় অংশ এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন। যতক্ষণ সে বাইরে থাকে, মাহের জানে দুশ্চিন্তায় বিথী ঘুমাতে পারে না। সেদিন তো মন খারাপ করে বলেই ফেলল, ‘আগে জানলে কোনোদিনই পুলিশের বউ হয়ে আসতাম না। জীবনের নিরাপত্তা নেই। কখন করোনা ধরে বসবে!’ বলতে বলতেই বিথীর চোখ ভিজে উঠল। বিথী খুবই আবেগপ্রবণ মেয়ে।

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ

মাঝে মাঝে মাহেরেরও আবেগে চোখ ভিজে ওঠে। গত মাসের এক রাতের সামান্য ঘটনাতেই তার চোখে পানি চলে এসেছিল। মফস্বলের এই এলাকায় এক ভাড়াটিয়াকে বাড়িওয়ালা জবরদস্তি রাতারাতির মধ্যে ঘর খালি করতে চাপ সৃষ্টি করে। ভাড়াটিয়া একজন নিম্ন আয়ের শ্রমজীবি মানুষ। দেশে লকডাউন চলছে। আয়ের সব পথ এখন বন্ধ। স্ত্রী অন্তঃস্বত্তা। দুই মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। সংসারে খাওয়ার টাকা-ই যোগাড় হচ্ছে না। বাসা ভাড়া দেবে কোথ্থেকে! বাড়িওয়ালা এসব শুনবে কেন? বাড়ি ভাড়ার টাকায় তার সংসার চলে। স্বামীর সঙ্গে অন্তঃস্বত্তা স্ত্রীকেও রাত বারোটায় ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজায় তালা লাগাল। খবর পেয়ে এস আই মালেক স্যার এলেন। স্যারের সঙ্গে মাহের পৌঁছে দেখে অন্তঃস্বত্তা স্ত্রী বৃষ্টির রাতে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এমন দৃশ্য জীবনে সে সিনেমাতে অনেক দেখেছে। কিন্তু বাস্তব জীবনেও এমন ঘটনা ঘটে থাকে সেদিন দেখল। প্রথমে বাড়িওয়ালাকে খুব বোঝানো হলো। বাড়িওয়ালা সব রকম বুঝ মানতে নারাজ। তাকে রাজি করাতে হলে দুই মাসের ভাড়া দিয়েই ঘরে ঢুকতে হবে। আবদুল মালেক স্যারের কাছে এতো টাকা ছিল না। কিন্তু সেই সময়ে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে মাহের বুঝে ফেলেছিল, তার কাছে থাকলে সে নিজেই বাড়িওয়ালাকে দিয়ে স্যারের শিশুসুলভ কোমল মুখ থেকে দুশ্চিন্তা দূর করত। যে কয়টা টাকা ছিল বাড়িওয়ালাকে দিয়ে সেই রাতটিতে একটা সমাধান করলেন মালেক স্যার। সেদিন রাতে একজন অন্তঃস্বত্তা নারীকে আশ্রয়হীন হয়ে বৃষ্টিতে ভেজা দৃশ্যে তার চোখ ভিজে ওঠেনি, বরং একজন পুলিশ কর্মকর্তার মানবতার দৃশ্যে তার চোখে জল এসেছে। সেদিনই মাহের টের পায়, বিথীর মতো সে নিজেও খুব আবেগপ্রবণ। আবেগপ্রবণ বলেই সামান্য ঘটনায় তার মতো একজন পুলিশের চোখে জল এত সহজে আসতে পারে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেই এস আই আবদুল মালেক মাহেরকে দেখা মাত্রই বললেন, ‘সেই বুড়োটা মারা গেছে।’ 

কদিন থেকেই মনে ধরেছিল কথাটা, বুড়োটা বাঁচবে না। করোনায় নয়, পারিবারিক অত্যাচারেই বাঁচবে না বুড়ো। দুই সপ্তাহ আগে করোনা রোগী শনাক্ত হবার পর একটি বাড়িকে লকডাউন ঘোষণা করার জন্য আবদুল মালেক স্যারের সঙ্গে মাহেরও গিয়েছিল। সেই বাড়ির দোতলায় একজন বুড়ো স্ত্রী ছেলে বউ নাতি নাতনীদের সঙ্গে থাকতো। বাড়িটি লকডাউন ঘোষণার দুদিন পর বুড়োর জ্বর শুরু হয়, সঙ্গে কাঁশি। পরের দিন শ্বাসকষ্টও হচ্ছিল। বাড়ির সবার ধারণা বুড়োকে করোনায় ধরেছে। অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না দেখে, পরিবারের সবাই বুড়োটাকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। রক্তের সম্পর্ক কীভাবে রক্তকে ছেড়ে পালায়! অবাক লাগে। যত দিন যাচ্ছে মায়া মমতা মানুষের ভেতর কেমন ফিকে হয়ে আসছে।

আবদুল মালেক স্যার বললেন, দুপুর পর্যন্ত লাশ একা ঘরেই ছিল। দুপুর থেকে বুড়ার স্ত্রী এসে লাশ নিয়ে বসে আছে। লাশের গোসল, কাফন-দাফন করবে, কেউ সাহস পাচ্ছে না। 

বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। বজ্রপাত আর বৃষ্টি। এখন প্রায় রোজ রাতেই বৃষ্টি হচ্ছে। মরা বাড়িটা দেখে মাহেরের বিথীর কথা মনে পড়ল। বাড়িটার সামনে একটি কদম গাছ। প্রবল বর্ষণে কদমফুলগুলো অযাচিত ভিজছে। মাহের মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, এই বরষায় বিথীকে একটি কদম ফুল উপহার দেবে। নিশ্চয়ই কদমফুল পেয়ে বিথী বিস্ময় আর অভিভূত হয়ে তাকাবে। অবাক হয়ে জানতে চাইবে- ‘কদমফুল আমার প্রিয় তুমি জানলে কীভাবে?’ মেয়েটা বৃষ্টির রাতে একা ঘরে কী করছে কে জানে! খুব মায়া হচ্ছে মেয়েটাকে  ভেবে। এস আই আবদুল মালেক স্যার বরফ শীতল গলায় বললেন, ‘মাহের, রেডি তো? করোনার ভয় লাগলে লাশ ধরো না।’

মাহের লাজুক মুখে বলল, ‘মরতে আমার ভয় নেই স্যার।’

বৃষ্টি কমেনি, বরং আগের চেয়েও বেড়েছে। বাড়ন্ত বৃষ্টিতে লাশ নিয়ে চলেছে দু’জনে। মাহেরের কাঁধে লাশ। চোখে পানি। মৃত্যুতে তার ভয় নেই। তবু সে কাঁদছে। স্যার দেখে ফেললে খুব লজ্জায় পড়বে! স্যারের কাছ থেকে চোখ আড়াল করার প্রয়োজন নেই। প্রকৃতি জল ঢেলে ে চোখের জল মুছে দিয়ে তার লজ্জা আড়াল করে দিচ্ছে।





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট