নুন-পূর্ণিমা : মুঠি করলেও ফাঁকা, খুললেও ফাঁকা !



নুন-পূর্ণিমা : মুঠি করলেও ফাঁকা, খুললেও ফাঁকা

মো. আরিফুল হাসান

 

 “মেয়েদের স্তনে আছে পূর্ণিমার দুধ আর সাগরের নুন,/ চিকন লিকলিকে একটা সাপ যেমন ছিদ্রপথ গলিয়ে/ টুক করে খসে পড়ে ঘরের মেঝেয়,/ এই পংক্তিটি হঠাৎ/ হাসান চৌধুরির করোটিতে হিল হিল করে উঠে।” সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কাব্য “নুন-পূর্ণিমা” অপ্রকাশিত কাব্য হিসেবে প্রকাশ হয় তৃতীয় প্রয়াণবার্ষিকীতে। মৃত্যুর পরে উনার ল্যাপটপ থেকে পাওয়া যায় নভেম্বর ২০০২ থেকে জানুয়ারি ২০০৩, গুলশান, ঢাকায় লিখিত এ অমূল্য কাব্যআখ্যানটি। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত চমৎকার প্রচ্ছদের বইটির ব্যাক কাভারে লেখা আছে, “সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশের কবিতার ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছেন অভিজ্ঞতা ও জীবন যাপনের বহুকৌণিক দিক উন্মোচন করে। তাঁর কাব্যভূবন নাগরিক জীবনের অভিঘাত এবং অন্যদিকে স্মৃতির তাড়ণায় উজ্জ্বল। বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালায় তিনি জীবনযন্ত্রণার, বিবমিষার, ক্রোধের, সময়ের স্পন্দনে ও উচ্চারণে হয়ে উঠেন আমাদের কাব্য-আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ কবি।.......মৃত্যুর আগে রচিত নুন-পূর্ণিমা কাব্যগ্রন্থে এই বহুগুণান্বিত কবি দীর্ঘ এক কবিতার প্রবাহমান জীবন ও নারীর প্রতি ভালোবাসার যে ছবি অঙ্কন করেছেন তা তীব্র, সুক্ষ্ম সংবেদনে বাংলা কবিতায় এক নবীন মাত্রা সংযোজন করেছে। কতিার সৃজন, মননধর্মে ও স্বাতন্ত্র্যে তিনি যে কত শক্তিমান এ কাব্যগ্রন্থে তার বিচ্ছুরণ আছে।”


নুন-পূর্ণিমার শুরুতে আমরা দেখতে পাই কবি ও সাংবাদিক হাসান একটি পঙক্তি দ্বারা তাড়িত হয় এবং সে সাপেক্ষ সংসারের খবরাখবরের মাঝে শতগুণ অধিক আলোর ভিড়ে রাজপথে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে। কিন্তু বাড়ি কোথায়? কবির ভাষায়Ñ “এই হাসানকে আমরা এক্ষুনি দেখতে পাব/ বিজন খাঁ খাঁ ঘরে একা দাঁড়িয়ে,/ অপেক্ষায়Ñ

এই অপেক্ষার আর শেষ হয় না। হাসান তার স্ত্রী মায়মুনার জন্য প্রতিক্ষিত থেকে বালক পুত্রের কাছে এসে দাড়ায়, তার চুলে হাত রাখে। ভাত রেধে রেখে গেছে বুয়া। সে ভাত ঠা-া হয়ে হিম কড়কড়ে হয়। বুকের ভেতর থেকে ডাক আসেÑ মায়মুনা! মায়মুনা! ডাকের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় পুত্র মোহিতের। ‘অস্পষ্ট জড়িত কণ্ঠে সাড়া দেয়, বাবা।/ খেয়েছিস? সাড়া নেই।/ মা ফোন করেছিলো? ঘুমের ভেতরে আরও ডুবে যায় বালক মোহিত।’ সাংবাদিক কবি হাসান টেবিলে বসে দ্রুত হাতে লিখে রাখে পঙক্তিটি হারিয়ে যাবার আগেই।


তারপর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা কতকাল, কতদিন পর আমরা আবার হাসান চৌধুরির দেখা পাই হরিষাল গ্রামে। হরিষাল গ্রামের পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক উল্লেখ করেন, জলেশ্বরী থেকে আধকোশা নদী পার হয়ে গো-গাড়িতে/ প্রথমেই মান্দারবাড়ি,/ তারপর হাগুরার হাট,/ তারপর পাথারের পর পাথার/.....ধুঁকতে ধুঁকতে এক সময় পৌছে যাবে হরিশাল গ্রামটিতে। হরিষালের ওপারেই আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র।’

হরিষালে যেতে যেতে লেখক মানবের চিরাচরিত চরিত্র বর্ণনা করেন এক দারুণ অভিঘাতে। তিনি বলেন, কোনো কেন্দ্র বিন্দুতে নেই আমরা। না পাপের, না পূণ্যের জীবন ধারন করি আমরা। ফলে আমাদের চরিত্র লেখতে গেলে, কোনো প্রশংসা বা নিন্দে কোনোটাই একপেশেভাবে করা যাবে না। লেখকের ভাষায়Ñ না পোশাকে না নগ্নতায়, না গার্হস্থ্যে না লাম্পট্যে,/ না আলোয় না অন্ধকারে,/ না পাপে না পূন্যে! আমরা এসব যুগলের প্রতিটির মধ্যভাগে আছি।’ লেখক বলেন, ‘নববর্ষে মানুষের উৎফুল্ল মিছিলের রঙিন ছবি/ আর বটতলায় বোমা বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন লাশÑ/ সেটিও রঙিন।


এই অন্ধকারেই পা ভুল পথে যেতে যেতে আমরা দেখতে পাই প্রাচিন হরষিত নামের হরিষালে কোনো হর্ষ নেই। ‘মনে হবে বহুকাল আগেই এ জনপদ থেকে উঠে গেছে বসবাস।’ তবুও মানুষের দেখা পাবার আশা রেখে আমরা যখন আরও গভীরে পৌঁছাবো হরিষালের, দেখবো কালাপীরের মাজার, মাজার ঘিরে কিছু বাড়িঘর বাশের ও চৌচালা  আটচালা। আমরা আরও দেখি গভীর রাতে কীভাবে জেগে উঠে হরিষাল গ্রাম। দিনের বেলায় খোলসছাড়া সাপের মতো গ্রামটি রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পেরিয়ে চোরা ব্যবসায় মেতে উঠে।

মাজারের উপরে সবুজ ত্রিকোণ আন্দোলিত পতাকাগুলো বহু মানুষকে ডেকে আনে এখানে। লোকে বলে. কালাপীরের মাজারে পূর্ণিমার তিন রাত্রি বাস করলে বন্ধ্যা নারী সন্তানবতী হয় আর অমাবস্যার তিনরাত বাস করলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পর বশীভূত হয়। 


সম্ভবত এ জন্যেই আমরা শুনশান হরিষালে কালাপীরের মাজারের চালাঘরে দুটো পরিবারের দেখা পাই। তারা কেউ এসেছে পূর্ণিমা শুরু হওয়ার আগে কেউ পৌঁছেছে অমাবস্যার অনেক পরে। তারা অপেক্ষা করছে অমাবস্যা এবং পূর্ণিমার। লেখক এ যায়গায় মানুষের চিরন্তন আকাঙ্খাকে ব্যক্ত করেন এভাবেÑ “বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তির চিৎকার প্রতিটি মানুষের,/ প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বিরূপকে বশে আনবার দিকে যাত্রা।”

কিন্তু এই ‘না পাথরে না পলিতে, না গোলাপে রা কণ্টকারীতে’ আমরা তারপর মগ্ন হই এক যুবতীর সাথে। তার সাথে আমরাও প্রবেশ করি হরিষাল। ‘পালিশ করা কালো পাথরে দুপুরের রোদ্দুর যেনো,/....এই যুবতীর নাম কী? পরিচয় কী? কে সে?” প্রশ্নগুলো থেকে যায় আর সৈয়দ হক একেএকে উত্তরগুলো মেলে ধরেন আমাদের কাছে।


‘যৌবন তার শরীরে যেন সৃষ্টির সংবাদে তোলপাড়।’ যুবতীটি জানায়, তার নাম পুষ্প কাহার। পুষ্প কাহার অতঃপর গ্রামের রমনীদের সহযোগীতায় তার পোড়াভিটিতে ঘর তোলে। ‘কতকালের একটা দিঘির ওপরে যেনো আলো পড়ে,/ আয়না হয়ে যায়। সে আয়নায় আমরা দেখতে পাই যে খুশবো নিয়ে পুষ্প কাহার এসেছিলো সে খুশবো ক্রমাগত বদবু হতে থাকে। পুষ্প কাহারের ঘরে দুপুরের রোদে পুরুষের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। মাঝরাতে চোরাকারবারীরা দল বেঁধে তার ঘরে আসে। পুষ্প খরিদ্দার সামাল দিতে শহর থেকে আরও নারীদের নিয়ে আসে। তাদের মসৃণ দেহ, চুলের ভাঁজ দুপুরের রোদে পুকুরের পানিতে ঢেউ তুলে। গ্রামের রমনীরা লজ্জায় মরি মরি হয়ে জিভ কাটে।

‘মান্দারবাড়ির ভাঙা প্রাসাদ এখনো যাদের সাক্ষী,/ সেই কাহারেরা নেই/ যাদের বংশধরেরা অন্নের জন্যে ত্যাগ করেছে গ্রাম।/ এবং যারা ত্যাগ করেনি গ্রাম,/ তারা এখন পরিণত হয়েছে সীমান্ত-চোরে।’ এখানে লেখক এ ভূমির অতীত ইতিহাসকে নান্দনিক বর্ননায় তুলে ধরেন। কবি এক অনির্বচনীয় আখ্যান বর্ণনার মধ্যে আমাদের মনে করিয়ে দেনÑ ‘এখনো আমাদের কারো কারো ঘরে আছে পুরনো কালের লাঠি/ আছে পালকির ভাঙা টুকরো, মরটে ধরা বল্লম টেঁটা/ এখনো খুঁজলে পাবে।’


মফস্বল থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কবি-সাংবাদিক হাসান চৌধুরির চোখ একদিন আটকে যায়। কালাপীরের মাজারে তিন রাত অমাবস্যা কাটালে নাকি ফিরে পাওয়া যায় হারানো মানুষকে। কবি হাসান চৌধুরির অবচেতনে মায়মুনার মুখ ভেসে উঠে। গভীর রাতে মোহিতকে ডেকে তুলে তাই সে রওয়ানা দেয় হরিষালের দিকে। 

জলেশ্বরীর নদী আধকোষা পার হয়ে হাসান চৌধুরী হরিষালে এসে পৌঁছে। ‘শব্দের মরুভূমিতে সে উটের মতো সারারাত হাঁটে।/ মাঝে মাঝে সে মাজারের সেবকের কাছে গিয়ে বসে।/ বাবা, এ সকল সত্যি কি? ফিরে আসে? একদিন যে চলে গেছে সে আবার ফেরে? খাদেম নিমিলিত চোখে জোড়াসন হয়ে বসে থাকে। খাড়া পিঠ, কঞ্চির মতো চিকন তার দেহটি, হাতে তার জ্বলন্ত ছিলিম। উচ্চস্বরে সে হেঁকে ওঠে, ‘পুষ্প, তুমি সত্য, তোমার বাণী সত্য।’

সীমান্তবর্তী হরিষালে মোহিত একাকী হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে পিলারের কাছে পৌঁছে যায়। হঠাৎ কে যেনো ডাকে। মোহিত পেছন ফিরে দেখে একটি বালিকা। বালিকাটি দৌঁড়ে এসে মোহিতকে প্রতিহত করে। ‘করছো কি? এক্ষুনি সোলজার এসে যাবে। ভয়ে ভয়ে বালক তাকায় পিলারের ওপারে দূর বিস্তৃত ধূসর পাথার। তারা ভয় পেয়ে ফিরে আসে।

হাঁপাতে হাঁপাতে তারা এসে একটি পাকুরের ছায়ায় স্থির হয়। সেখানে আমরা নাম জানতে পারি বালিকাটির। তার নাম ময়না। বুকের কাছে ছোট্ট চুপড়িতে সাপের বাচ্চা ধরে আছে সে। মোহিত চুপড়িটি দেখতে চায়। বুকে চেপে রাখা চুপড়িতে সে হাত দেয়। ময়নার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। “আগামী নারীর ঘণ কণ্ঠে সে বলে ওঠে,/ তুমি আমার বুকে হাত দিলে যে!”


কাব্যোপখ্যানের শেষ প্রান্তে এসে আমরা দেখি হাসান পুষ্প’র ঘর থেকে বিধ্বস্ত হয়ে আসে। তারপর ময়নার মা খোদেজা ও হাসানকে রাতের অন্ধকারে পাকুরের তলায় মুখোমুখি দেখা যায়। হাসান এসেছে হারিয়ে যাওয়া মায়মুনার খোঁজে কালাপীরের মাজারে। আর ময়নার বাবা মোজাফফর খোদেজার ভাষায়Ñ আমার বরের নাম রাক্ষসকে মানাত!” 

এদিকে চাঁদ তার হিং¯্র সহাসৗ মু-ু তুলে নক্ষত্রের অরণ্য ভেদ করে লালা ঝরিয়ে চলেছে অবিরাম। “না জমিতে না পানিতে,/ না সৌরম-লে না কৃষ্ণগহ্বরে,/ না পাথরে না পলিতে,/ না গোলাপে না কণ্টকারীতে,” আমরা জীবনকে একটা মাঝামাঝি পর্যায় থেকে দেখি। এবার কি হাসানের করোটিতে তার সেই প্রথম পঙক্তির পর দ্বিতীয় পঙক্তিটি লিকলিকে সাপের মতো ঝুপ করে খসে পড়বে? অতঃপর “খোদেজা আর হাসানকে দেখি হাত ধরে চালাঘরে যেতে।/ আমরা তাদের দেখতে পাব ঝাঁপ বন্ধ করে দিতে।/ দূর থেকে আমরা দেখবো আলোর নির্বাপণ।/ আমরা পাথারের ওপর দিয়ে বহে যেতে শুনবো/ পুষ্প কাহারের হাসি।/ আর শুনতে পাব কালাপীরের সেবকের কণ্ঠেÑ/ মুঠো করলেও ফাঁকা, খুললেও ফাঁকা!


কুমিল্লা, বাংলাদেশ




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট