বাক্স বন্দি জীবন

 

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


বাক্স বন্দি জীবন

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান



আব্দুল করিম সাহেব একটি বায়িং অফিসে চাকরি করেন। পরিবার নিয়ে ঢাকার উত্তরায় বসবাস করেন। স্ত্রী মুনা করিম এবং দুই সন্তান তারেক ও তাহিয়াকে নিয়ে ছোট্ট সুখি সংসার। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় পরিবারের সাথে খুব বেশি সময় কাটাতে না পারলেও তিনি পরিবারের প্রতি খুব যতœশীল। হঠাৎ করেই পৃথিবীর বুকে মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে করোনা ভাইরাস। চীনের উহান থেকে শুরু করে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে করোনা ভাইরাসে প্রতিদিন হাজারে হাজারে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এই মহামারী ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দিয়ে আইসোলেশনে রাখা ছাড়া আর কোন চিকিৎসা নেই। ব্যাপক গবেষণা করেও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি। পর্যাপ্ত পিপিই না থাকায় ডাক্তাররাও চিকিৎসা দিতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং সর্বোপরি তারাও আক্রান্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছে। বলতে গেলে লাশের মিছিল চলছে। এদিকে বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাস হানা দিয়েছে। বিদেশ ফেরত প্রবাসীরা যেভাবে দেশে প্রবেশ করেছে এবং বাইরে ঘুরছে-ফিরছে, এতে করে বাংলাদেশেও এই মহামারী দ্রুত বিস্তার লাভ করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। হঠাৎ করেই শোনা যায়, এক স্কুল শিক্ষার্থী নাকি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। তাই করিম সাহেব ও তার স্ত্রী বেশ চিন্তিত তাদের ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। ওদের স্কুল এখনো বন্ধ ঘোষণা করেনি। এই অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করতে দেশের বুদ্ধিজীবীরা সরকারকে জোরদার পরামর্শ দিচ্ছেন। দুদিন পর দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা এলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন করিম সাহেব ও তার স্ত্রী। তবে বন্ধ নেই করিম সাহেবের অফিস। সন্তানদের নিয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও তিনি এখন নিজেকে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। করোনার ভয় নিয়েও রুটিনমাফিক অফিস করতে বাইরে যেতে হচ্ছে। অফিসে বিভিন্ন ক্লায়েন্টের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রবাসী ক্লায়েন্টও আসছে। অস্বস্তি নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের সাথে হাসি মুখে কথা বলতে হচ্ছে। এ যেন নিজের সাথেই নিজের যুদ্ধ। তবে এই যুদ্ধ খুব বেশি দিন করতে হয়নি। করোনার সংক্রমণ রোধে সরকার কর্তৃক জরুরি ছুটি ঘোষণা করা হলে করিম সাহেব দশ দিনের লম্বা ছুটি পেয়ে যান। তবে এই ছুটি অন্যান্য সাধারণ ছুটির মত ছিল না। বলা যেতে পারে, নিজ গৃহে বাক্স বন্দি জীবন যাপনের ছুটি। আর সরকার কর্তৃক চলছে সারাদেশে অঘোষিত লকডাউন।


করিম সাহেব এমন লম্বা ছুটি পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন। পরিবারের সাথে কখনো এভাবে থাকা হয়নি। যখনই ছুটি পেয়েছেন, সেটা পরিবার কিংবা নিজের ব্যক্তিগত কাজে ঘরের বাইরে বেশি সময় কাটিয়েছেন। এবার লম্বা দশ দিন পরিবারের সাথে নিজ গৃহে সময় কাটাবেন ভাবতেই খুব রোমাঞ্চিত হচ্ছেন। প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করে ফ্রিজে ভরে রেখেছেন। খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোনো রকম টেনশন নেই। বাসায় প্রতিদিন পিকনিক আমেজে খাওয়া দাওয়া করবেন আর রাতে স্ত্রী মুনার সাথে হানিমুন বানাবেন। সেই জন্য করিম সাহেব গোপনে কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। ফার্মেসী থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের পাশাপাশি এক বোতল মধু, এক বক্স কনডম, তিন প্যাকেট সিন্ড্রেলাফিল ট্যাবলেট কিনে ছিলেন। কয়েক বছর যাবত আগের মত পেরে উঠছেন না। দীর্ঘ সঙ্গম তো দূরের কথা, অল্পতেই তিনি ক্লান্ত হয়ে যান। তখন স্ত্রী মুনার কাছে লজ্জা পেতে হয়। তাই মুনাকে তৃপ্ত রাখতে সিন্ড্রেলাফিল ট্যাবলেটেই করিম সাহেবের একমাত্র ভরসা। এই দশটি দিনে মুনাকে বুঝিয়ে দিবেন করিম সাহেবের যৌবন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। তাই তিনি রাতের অপেক্ষায় আছেন। রাতের ডিনার সেরে করিম সাহেব নিজের বিছানায় শুয়ে টিভিতে সংবাদ দেখছিলেন আর মুনা তখন বাচ্চাদের ঘুম পাড়াচ্ছে। এই ফাঁকে লুকিয়ে করিম সাহেব দুই চামচ মধুর সাথে দুটি সিন্ড্রেলাফিল ট্যাবলেট খেয়ে নিলেন। যদিও একটি ট্যাবলেট খাওয়ার নির্দেশ। তারপর বালিশের নিচে এক প্যাকেট কনডম লুকিয়ে রেখে মনে মনে তিনি বলছেন, আজ খেলা হবে। টিভি চ্যানেলের সংবাদ দেখতে দেখতে তিনি বোরিং হয়ে গেছেন কিন্তু মুনার ফিরে আসছে না। এদিকে করিম সাহেবের শরীরে ডাবল ডোজ সিন্ড্রেলাফিল ট্যাবলেটের একশন শুরু হয়ে গেছে। তাই তিনি বাধ্য হয়ে বিছানা থেকে উঠে পাশের রুমে গিয়ে দেখেন বাচ্চাদের নিয়ে মুনা ঘুমিয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে করিম সাহেব রাগান্বিত স্বরে মুনাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ডাক দিলেন। তখন মুনা জেগে ওঠে বিরক্ত হয়ে ডাকাডাকির কারণ জানতে চাইলে, করিম সাহেব ইশারায় মুনাকে তাদের বেড রুমে আসতে বলেন। মুনা সাফ জানিয়ে দেয়, সে বাচ্চাদের সাথে ঘুমাবে। তখন করিম সাহেব ইনিয় বিনিয়ে অনুরোধ করেও কোন লাভ হলো না। এদিকে বাচ্চাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়, তখন মুনা ক্ষেপে ওঠে করিম সাহেবের উপর। তখন নিরুপায় হয়ে নিরস মুখে অনেকটাই লেজ গুটিয়ে নিজের রুমে চলে যান করিম সাহেব। মনের ক্ষোভে ছাই চাপা দিয়ে টিভি দেখে আর বিছানায় ছটফট করে একদম ভোর রাতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।


পরদিন বেলা বারোটার দিকে মুনার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে করিম সাহেবের। তিনি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে চা-নাস্তা খেয়ে টিভি দেখতে বসেন। অভিমান করে স্ত্রীর সাথে কোনো কথা বলেননি। ভেবেছিলেন, অভিমান ভাঙাতে মুনা হয়তো তার পাশে বসে খুশ মেজাজে কথা বলতে আসবে। কিন্তু তিনি যা ভেবেছিলেন, তার ঠিক উল্টোটাই ঘটলো। ঘন্টাখানেক পর মুনা এসে তুমুল ঝগড়া জুড়ে দিয়েছে বাজার সদাই নিয়ে। ‘এটা নেই, ওটা নেই, কেন আনলে না, কেন ভুলে যাও, সামান্য বাজার সদাই পর্যন্ত ঠিকঠাক করতে পারো না। এখন টানা এই কটা দিন কেমন করে চলবে?’ করিম সাহেব অসহায় হয়ে ভাবছেন, এতো বাজার করার পরেও স্ত্রীর মুখে এতো অভিযোগ! নিরুপায় হয়ে তিনি বললেন, ‘যা যা বাকি আছে, আজ বিকালেই বাজার থেকে নিয়ে আসবো।’ তবুও যেন মুনা খুশি হয়নি। তার মুখে কী যেন এক বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ছিল। করিম সাহেব অনেক চিন্তা ভাবনা করেও সেই রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি। তবে চিন্তা করে বেশি সময় নষ্ট করতে পারেননি। আধা ঘন্টা পরেই মুনা এসে চেঁচিয়ে বলছে,

- এভাবে বিছানায় শুয়ে টিভি দেখে সময় কাটাবে নাকি ঘরের টুকটাক কাজে হাত লাগাবে? আমি তো রান্না ঘরে একা কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।

- কেন, তাসলিমা আসেনি? ওকে তো আজ একবারও দেখেনি। কাজে ফাঁকি দিল নাকি?

- আমি আসতে না করেছি। তিন চারটে বাসায় কাজ করে। কখন কার বাসা থেকে করোনা ভাইরাস নিয়ে আমাদের বাসায় ঢুকবে, সেই হিসেব কী আছে?

- ও আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। তাহলে এখন আমার কি করতে হবে শুনি।

- আমি বাচ্চাদের গোসল করিয়ে এসেছি। ওদের নিয়ে এখন লাঞ্চ করবো। তুমি এই ফাঁকে গোসল সেরে নাও আর বাথরুমে ওদের কাপড়গুলো ডেটল পানি দিয়ে ধুয়ে নিবে।

- আচ্ছা ঠিক আছে। তবে একটু সময় অপেক্ষা করো। আমি আসলে পর সবাই মিলে একসঙ্গে খাবো।


স্ত্রীর কথা মত করিম সাহেব কাপড় ধুয়ে গোসল সেরে বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখেন ওদের খাওয়া দাওয়া প্রায় শেষ। মনে মনে বেশ কষ্ট পেলেন কিন্তু মুখ খুলে কিছু বললেন না। একটু পর গোমড়া মুখে তিনি একাই ডাইনিং টেবিলে বসে লাঞ্চ সেরে নিলেন। তার গোমড়া মুখ দেখেও মুনার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এটা ভেবেই তিনি বেশ অবাক হচ্ছেন।


অঘোষিত লকডাউনের মধ্যেই করিম সাহেব বিকালে বাজার সদাই করে বাসায় ফিরে এলেন। তখনই মুনা বলে উঠে, ‘কিচেনে বাজার রেখে সোজা বাথরুমে ঢুকে গোসল করে বের হবে।’ তিনি স্ত্রীর কথা মত তাই করলেন। গোসল থেকে ফিরে এসে বাচ্চাদের কাছে ডাকলেন। ওরা তার ডাকে সাড়া দিয়ে কাছে এলেও একটা দূরত্ব বজায় রেখেছে। তখন তাদের আরো কাছে আসতে বললে করিম সাহেবের ছয় বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে তাহিয়া জানালো, ‘আম্মু তোমার কাছে যেতে নিষেধ করেছে।’ করিম সাহেব তখন রেগেমেগে আগুন হয়ে উচ্চ স্বরে স্ত্রীকে ডাকলেন। মুনা আসতেই তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন,


-কেন আমার সন্তানদের আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখছো? কেন ওদের আমার কাছে আসতে নিষেধ করেছো?

- একদম বোকার মতো কথা বলবে না। তুমি এখন হোম কোয়ারেন্টাইনে আছো। তাই ওদের তোমার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছি।

মুনার কথা শুনে করিম সাহেব অবাক বিস্ময়ে আকাশ থেকে যেন মাটিতে পড়লেন।

- খুব অবাক করলে। আমি নিজেই জানি না আর তুমি বলছো আমি নাকি হোম কোয়ারেন্টাইনে আছি! তাহলে আমাকে বাজারে পাঠালে কেন?

- বুঝতে পারছি তোমার শুনতে খুব খারাপ লাগবে কিন্তু কিছু করার নেই। আগামী চোদ্দটা দিন তোমাকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।

- কেন, আমি কি বিদেশ ফেরত প্রবাসী নাকি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী?

- তুমি বায়িং অফিসে চাকরি করো। সেখানে বিভিন্ন দেশের মানুষ আসা যাওয়া করে। এমনকি চীনারাও আসে। নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবে না।

- তুমি কী বলতে চাইছো আমার শরীরে করোনা ভাইরাস আছে?

- আরে বোকা! সেটা কখন বললাম। যদি আমাদের সত্যিই তুমি ভালোবাসো, তাহলে মাত্র চোদ্দটা দিন এই রুমের মধ্যে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকো।

- না, আমি হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে পারবো না। তুমি আমার কাছে না আসলেও আমার সন্তানদের আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না।

- চেষ্টা করে দেখো না। তোমার সন্তানরাও তোমার কাছে যাবে না। আর হ্যাঁ, বেশি জিদ করো না। নয়তো তোমাকে প্রাতিষ্ঠানিক হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠাতে হবে।


করিম সাহেব মন খারাপ করে টানা চারদিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থেকে একদম বিরক্ত হয়ে গেছেন। তার উপর ঘরের টুকটাক কাজ করতে হচ্ছে। ডেটল পানি দিয়ে ঘরদোর মুছা, কাপড় ধুয়ে দেওয়া। এসব কিছু করে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। রাগে ও মনের কষ্টে কনডমের বক্স ও সিন্ড্রেলাফিল ট্যাবলেট গার্বেজ বক্সে ফেলে দেন। পরে চিন্তা করলেন, এগুলো উনার কাজে না লাগলেও কারো না কারো কাজে আসবে। বাসায় বন্দি থেকে আর মোটেও ভালো লাগছে না। তাই একটা ছুতো বের করে বাইরে গিয়ে একটু হাঁটাহাটি করতে চাইছেন। তাই ময়লা ফেলার ছুতোয় তিনি বাসা থেকে বের হলেন। ময়লার ব্যাগের সাথে অন্য একটি ব্যাগে কনডমের বক্স ও সিন্ড্রেলাফিল ট্যাবলেটের স্ট্রিপ গুলো নিয়ে নিলেন। রাস্তায় পুলিশ ও আর্মি দেখে তিনি বেশ ভয় পেয়ে যান। তাই হাঁটাহাটির চিন্তা বাদ দিয়ে একটা রিক্সা ডাকেন। কোন কিছু না ভেবেই রিক্সাওয়ালে বাজারের দিকে যেতে বলেন। যেতে যেতে তিনি রিক্সাওয়ালার সাথে গল্প জুড়ে দেন।


- তোমার মুখে মাস্ক দেখে খুব ভালো লাগছে। তবে এই কঠিন সময়ে ঘরের বাইরে থাকা কিন্তু মোটেও উচিত নয়। করোনা ভাইরাস সম্পর্কে কিছু জানো?

- স্যার, এইসব নিয়া আমাগো কোন টেনশন নাই। হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। যেদিন মরণ লেখা, ওইদিনেই মরণ হইবো। এর একদিন আগেও মরমু না।

- তুমি যদি নিজেকে নিরাপদে না রাখো, তাহলে আল্লাহ্ আর কী করবেন? এই মহামারীর সময়ে ঘরে থাকতে হবে।

- ঘরে থাকলে তো স্যার পেটে ভাত জুটে না। রাস্তায় প্যাডেল ঘুরাইলেই চারটে মানুষের পেটে ভাত জুটে। কয়েক দিন ধইরা খোরাকির টাকাই উঠে না। আপনারা বড়লোক মানুষ, ক্ষুধার জ্বালা বুঝবেন না।

- সরকার ও বিভিন্ন সংগঠন তো খাদ্য দিয়ে শ্রমজীবীদের সহযোগিতা করছে। তুমি কি কোনো সহযোগিতা পাওনি?

- না স্যার, এখনো পাই নাই। কার শখ হয় মরার জন্যে ঘরের বাইরে যাইতে। পেটের খাবার জুটলে ঘরের মইধ্যেই থাকতাম।

- আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। আমি তোমাকে কিছু টাকা দিবো। তবে শর্ত একটাই, সেটা দিয়ে তুমি বাজার সদাই করে বাসায় চলে যাবে। রিক্সা নিয়ে বের হতে পারবে না।

রিক্সাওয়ালা রিক্সা থামিয়ে কান্না শুরু করে দেয়। তারপর সে করিম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে,

- স্যার, আমারে টাকা দেওন লাগবো না। আপনে মুখে কইছেন, এতেই মনটা ভইরা গেছে। তুমি রিক্সা চালাইয়া যা পাই, তাই খামু।

করিম সাহেব পাঁচটি কচকচে এক হাজার টাকার নোট ওই রিক্সাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,

- বেশি কথা না বলে টাকাগুলো ধরো। এক্ষুনি বাজার সদাই করে ফিরে আসো। আমি তোমার রিক্সায় বসে রইলাম।


রিক্সাওয়ালা অশ্রুভেজা চোখ মুছে করিম সাহেবের হাত থেকে টাকা নিয়ে বাজারে ঢুকে। আধা ঘন্টা সময় নিয়ে বাজার সদাই করে হাসি মুখে ফিরে আসে। করিম সাহেব রিকশাওয়ালার হাসি ভরা মুখ দেখে ভীষণ তৃপ্তি পেলেন। নিজের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার কষ্ট ভুলে গেলেন। এবার তিনি রিক্সাওয়ালাকে উনার বাসায় পৌঁছে দিতে বলেন। রিক্সা চলছে আর করিম সাহেব বেনসন সিগারেট ফুঁকছেন। আজ এই নিয়ে তিনটি সিগারেট টানলেন। বাসায় গেলেই আর সিগারেট টানা যাবে না। তাই চতুর্থ সিগারেট ধরিয়ে তিনি আবারো রিক্সাওয়ালা গল্প শুরু করলেন।


- যদি কিছু মনে না করো, তাহলে তোমাকে আরো দুটি জিনিস দিবো।

- কি যে বলেন স্যার, আপনের কথায় মনে করার কিছু নাই। আপনি অনেক দিছেন আর লাগবো না।

- না, এবার তোমাকে অন্য কিছু দিবো। যেটা দিয়ে এই কটা দিন ঘরের ভেতর তোমার ভালো সময় কাটবে।

- ঠিক আছে স্যার। তাইলে তো ভালোই হয়। ঘরে বইসা থাকতে আমার ভালো লাগে না। দেন দেহি কি দিবেন।

করিম সাহেব রিক্সাওয়ালাকে ওই ব্যাগটি দিয়ে বললেন,

- এই ব্যাগে এক বক্স উন্নত মানের কনডম ও কিছু ট্যাবলেট আছে। তোমার কাজে লাগবে।

রিক্সাওয়ালা মুচকি হেসে বলল,

- স্যার কনডম কামে লাগবো কিন্তু ট্যাবলেট দরকার নাই। আপনে রাইখা দেন, যদি আপনার কামে লাগে।

রফিক সাহেব নিরস মুখে বললেন,

- এসব আমার দরকার নেই। তোমাকেই দিয়ে দিলাম। তোমার কাজে না লাগলেও ফেলে দিও।


কথা বলতে বলতে এক সময় বাসার গেইটে এসে পৌঁছালেন করিম সাহেব। তিনি রিক্সাওয়ালার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে যান। কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে অগ্নিমূর্তির রূপ ধারণ করে পথ আগলে দাঁড়ায় মুনা। সে জানতে চায় করিম সাহেব এই দীর্ঘ সময় ধরে কোথায় ছিলেন? এটা নিয়ে তুমুল ঝগড়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে করিম সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন আবারো রান্তায় বের হয়ে যাবেন। কিন্তু রাস্তায় টহল দিচ্ছে পুলিশ ও আর্মি। অহেতুক কেউ ঘোরাঘুরি করলে মোটা ডান্ডা দিয়ে পিটিয়ে ঠান্ডা করে দিচ্ছে। এই অবস্থায় বের হওয়া বোকামি ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। তাই তিনি মুনার কাছে লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চান। এবং প্রতিশ্রুতি দেন, বাকি দিনগুলো একদম হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। তারপর মুনা করিম সাহেবকে বাসার ভেতরে ঢুকতে দেন। করিম সাহেব বাকি দিনগুলো হোম কোরেন্টাইনের নিয়ম মেনে বাক্স বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। আর এই ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন, রিক্সাওয়ালা নিশ্চয়ই সময়টা খুব উপভোগ করছে। ওইদিকে রিক্সাওয়ালা ভাবছে, লোকটা নিশ্চয়ই পাগল আর নয়তো ফেরেশতা। আর নয়তো এভাবে কেউ এতগুলো টাকা ও ওইসব জিনিস দিয়ে যায়।


চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ, ঢাকা



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট