ফিলিস্তিন বিষয়ক পদাবলি : ০২

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


দু’টি কবিতা

নাসরিন জাহান মাধুরী 


উদবাস্তু


হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লাম উদবাস্তু শিবিরে

আমি যে উদবাস্তু এ শহর তা জানে;

ভাঙাচোরা, দেয়ালচাপা কিছু দীর্ঘশ্বাসের সাথে মিশে যায় আমার দীর্ঘশ্বাস 

ঐ আলোহীন, চালচুলোহীন অভুক্ত মুখগুলো 

মনে করিয়ে দেয় আমার উপবাসের দীর্ঘকালের কথা

একাল সেকাল করে কত সুদীর্ঘকালের উপবাসে!


গোগ্রাসে এই চোখ গিলে খায় পৃথিবীর তাবৎ ত্রাণ 

এখন কোথাও আর ত্রাণ নেই

এই অভুক্ত শিশুটির জন্য বরাদ্দ ত্রাণ টুকুও আমি ভক্ষণ করেছি

এপথ সেপথ ঘুরে আমি সময়ের পথে পায়ের ছাপ রেখে যাই

পিছনে তাকালে দেখি অনেক দূরে চলে এসেছি তবুও 

আমার পায়র তালুতে লেগে আছে সেই সব কোমল শিশুদের রক্তের দাগ

পৃথিবীর কোন ইতিহাস মুছবে এ কলঙ্ক! 

এ দাগ অমোচনীয় 


উপরে সেই হাজার বছরের পুরোনো তারা

আজো জ্বলছে মিটিমিটি

তারো উপরে আরো আরো আরো উপরে আকাশ

তিঁনি সব দেখেন...




ভাবনা


আজকাল আমাকে ভাবাও তুমি

তোমার খেলা বুঝি না কিছুই

কি আনন্দে মেতে আছো কি ভেবে


কত সহজেই থামিয়ে দিলে আমায়

যাই লিখি মুছে যায় শূন্যতার অদৃশ্য ইরেজারে

আমি চাঁদের গল্প, রূপালি রাতের গল্প বলতে চেয়েছিলাম

দেবশিশুটির রক্তাক্ত মুখ, ওর নিষ্পাপ চোখ দুটি আমায় থামিয়ে দিলো।

এ গল্প লিখতে চাই না

আমায় বিজয়ের গল্প লিখতে দাও

পৃথিবীর সব শিশুদের গল্প

সেই শিশুরা মায়ের কোলের অভয়াশ্রমে

নিশ্চিন্তে ঘুমাবে 

সেই আস্থার কথা লিখতে দাও

সেই বিশ্বাসের কথা লিখতে দাও

রক্তাক্ত গল্প আর লিখতে চাই না..



ভুলে গিয়ে মনে রাখা

ফজলুর রহমান


আয়োজন করে দুঃখ দিয়েছো বলে তা মনে রাখার জন্য ক্যালেন্ডারের তারিখ মুখস্থ করতে হয় না আমার। আমি তোমাকে না পেয়ে যেভাবে  তোমাকে মনে রেখেছি পেলে তোমাকে মুখস্থ করা হতো হয়তো মনে রাখা হতো না। মূলত মানুষ ব্যবহারে ক্ষয় হয় স্মৃতিতে তোলা থাকে ফুলতোলা রুমালের মতো। পরিপাটি, সুগন্ধি চেতনার মতো। তোমার ভাবনা তিরিশ বছর আগে বাদ দিয়ে দেখেছি আমি আসলে তিরিশ বছর ধরে কর্মে যতটা মনোযোগী হয়েছি ‘তোমাকে আর কখনো ভাববো না’Ñ এই চিন্তায় তার  চেয়ে ঢের বেশি মনোযোগী ছিলাম। বিগত তিরিশ বছরে আমার ওষুধের  কৌটা, মাথা ব্যথার বাম, চশমার বক্স, ছাতা, জলের গ্লাস, কলম, সঞ্চয়িতা, পাঞ্জাবি-পায়জামা বা হাতঘড়ি কোথায় রাখি এসব ভুলে গিয়ে পনোরো অক্টোবর উনিশশো নব্বই এ সাভার বিরুলিয়া গ্রামের গোলাপ বাগানের নির্জন সন্ধ্যা, তার পরের বছর বিজয়া দশমীর দিন লোকাল বাসে  চেপে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দুর্গা মাকে দেখতে যাওয়া কিংবা যে বছর অনেক বর্ষা হলো সে বছর মাধবপুর মেলা শেষে দুজনে বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে নাগরদোলায় উঠে দোল খাওয়াÑ কীভাবে এসব আমার মস্তিষ্কের নিউরনের পরতে পরতে এতো সজীব! তবে কী তোমাকে ভুলতে চেয়ে অবচেতনে মনে রাখার চর্চা করেছি নিত্য? তুমি আয়োজন করে দুঃখ দিয়েছো কিন্তু আমি তা গোপন করে যাপন করেছি। তুমি বলেছিলে, 

‘আামাকে পেলে তুমি সুখী হবে, না পেলে তুমি অমর হবে।’Ñ কোনটা চাও?

আমি অমরত্ব চেয়েছিলাম। তুমি এসে দেখে যাও তোমাকে যে পেয়েছে তার চেয়ে তোমাকে না পেয়ে কতোটা ঢের বেশি পেয়েছি তোমায়। 



কয়েদী চিন্তা

নূরে জান্নাত


কাঁচের জানালায় ঝাপসা স্বপ্নগুলো।

দেখ সুনীপন ভঙ্গিতে একা পাখি

কবিতা গেলার মতো

বিশুদ্ধ বিষদতা গিলছে!

আহা..

চাঁদরে মেঘের গন্ধ

শরীর জুড়ে বকুল ফুল!

আঙুল গুলো ফ্যাকাশে প্রেমে

ছুঁয়ে দেখতে চায় মনের চারিপাশ।

ঘুমের ঘোরে নগ্ন স্নানে কাম

ডোবো ডুবাও ভাসো ভাসাও

কাছে খুব কাছে গিয়ে

কয়েদী চিন্তা গুলোকে!

বাম পায়ের বৃদ্ধাঙুলে দাঁতের বসত গড়ো।

অন্ধকার নিরাকার তুমি কে

ছাঁয়া রুপে আকার দাও

ওটা তুমি? চিন্তা? কাম?

নাকি যাকে আমি খুঁজি!



শহরতলির গোলচত্বর

মাসুদ পারভেজ


শহরতলির গোলচত্বরের মাথার উপর গোলাকার রোদ,

এখানে মানুষ ব্যস্ত হয়-ক্লান্ত হয়, কেউ দিক্বিদিক

রিক্সার হুড তুলে চলে যাচ্ছে সময়-

রংধরা সূর্যের আশায়;

এক আকাশ অবসাদ নিয়ে তাকিয়ে দেখছে প্রণয়।

সূর্য কি রং হারিয়েছিল আঁধারের কাছে?

সে আর ফিরে আসেনি কখনো এই শহরতলির গোলচত্বরে।




এই পৃথিবী শিশু বাসযোগ্য নয়

জীবন রাজবংশী


আমি এক অন্য পৃথিবীতে বাস করছি 

যার হৃদয় পাথর 

যেখানে বিবেক মনুষ্যত্ব নামে

শিশুরা অনেক দূরে সরে গেছে 

কোন এক অজানা নদীর তীরে তারা 

খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। 


তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না-

কেননা এই অভিশপ্ত পৃথিবী শিশু বাসযোগ্য নয়। 

তোমরা ধর্মের নামে

সাম্রাজ্যের নামে 

গোলাগোলির খেলায় মত্ত। 

এ ধরা শিশু বাসযোগ্য নয় সত্য। 

আমি পৃথিবীর পথ চেয়ে আছি.... 

যদি আবার আসে কোন দিন।




কী হবে, নিরীহ গানে

জাফর ওবায়েদ


কী হবে, নিরীহ গানে অন্ধ এ-সরণি কাঁপিয়ে!


নারী ও শিশুর রক্ত আজ হোলির নিদান

সহ¯্র জীবন মোড়লের হাতের খেলনা 

মানবাধিকার নির্মম ক্রীড়ার সস্তা গুটি!


কী হবে পৌরাণিক স্লোগানে প্রমিলা কন্ঠ ফাটিয়ে!


পৃথিবী চায় সিংহের সৌভিক গর্জন

শহর খোঁজে দ্রোহের আগুন পোড়া বিজয়ের প্রত্যয়

মানুষ চায় নিতিসুখ হন্তারক অত্যাচারীর পতন!


অকৃপণ চাঁদ কৃষ্ণ কাপড়ে ঢেকেছ ম্রিয়মান মুখ

ঘনঘনে সূর্যের আলো লজ্জায় ফিরিয়েছে অবনত চোখ

অন্ধকারেই কি কেটে যাবে মানুষের প্রকৃষ্ট সময়!




কেঁদো না ফিলিস্তিন 

আমির হামজা


জলপাই গাছগুলো দিনে দিনে বিলীন হচ্ছে, পাখিবাগান উড়ছে,

বসতি জ্বলছেই,

খাবার পানি ক্রমশ কমে আসছে

আজ কতদিন হলো বাবার মুখটাও দেখিনা! ঘরে খাবার নেই

জোর করে জমি দখল করে আমার দেশ থেকে আমাকেই বের করে দিচ্ছে!


তবুও

কেঁদো না ফিলিস্তিন 

তোমার আসবেই সুদিন

নাসরুম মিনাল্লাহী ওয়া ফাতহুন কারিব।


পাখির মতো মেরে মেরে শিশুদের নিশ্চিহ্ন করছে 

বাবার কাঁধ বেয়ে ঝরছে সন্তানের শেষ রক্তবিন্দু 

মৃত সন্তানের লাশ কোলে 

মায়ের হাসিমুখ উজ্জীবিত করে তুলে আমাদের 

আমরা কারো আশায় না থেকে নিজেরাই লড়তে শিখে গেছি 

আমাদের ভয় নেই

আমাদের আকসা আমরাই ফিরিয়ে আনবো 

সিজদায় লুটিয়ে কেঁদে কেঁদে আবার হাসবো।


কেঁদো না ফিলিস্তিন 

তোমার আসবেই সুদিন

নাসরুম মিনাল্লাহী ওয়া ফাতহুন কারিব।



রবের মদদ আসবেই 

আসমান ফুঁড়ে আসবে আবার আবাবিল

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে

হাসবে ফিলিস্তিন। 

কেঁদো না ফিলিস্তিন 

তোমার আসবেই সুদিন

নাসরুম মিনাল্লাহী ওয়া ফাতহুন কারিব।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট