পাহাড়ের ডাক

 



পাহাড়ের ডাক

রাশেদ সাদী


রাত আড়াইটা। প্রধান সড়ক দিয়ে একটা মালবাহি ট্রাক আসে আর চলে যায়। এরপর দীর্ঘ নিরবতা। বসন্তের ফুরফুরে জ্যোৎ¯œায় ফিনফিনে বাতাস বয়ে যায়। দুটো বিড়াল ঝগড়ায় মেতে ওঠে। ফের সব আগের মতো, নীরব। 

এমন নীরবতা ঘুমহীন রাত ইস্পাতরে ফলার মতো বুকে বিধে অস্বস্তি দিতে থাকে। বালিশ উলটা-সিধা করে, এপাশ-ওপাশ করেও আরামপদ একটা অবস্থান পাই না। ঘুম আসে না। 

অন্ধকার ঘরে রেলিং গলে আলোর কতগুলো স্তম্ভ মেঝেতে পড়ে আছে। তাতে কতগুলো পাতা কাঁপছে। এই দূর পাড়াতের পাদদেশে অপরিচিত হোটেলে শুয়ে ভাবতে চেষ্টা করি আসলে আমি এখানে কেন? 

কিন্তু কেন যেন ভাবনাটা কিছুতেই শরীর পায় না। শুধু ফসকে যায়। ঠিক যেন পাহাড়ের মেঘের মতো। নাকে মুখে এসে ঠেলা মারছে, কিন্তু ধরতে গেলেই কিছু নেই। বরং পা-টাও যেন ফসকে যাচ্ছে। চেতনার পাহাড় থেকে কখন যেন হঠাৎ পা হড়কে যায়; পড়ে যাই ঘুমের নিঃসীম আধারে।


খুব সকালে ঝটপট গোছল সেরে ঠান্ডা আলু ভর্তা, ডাল-ভাত খেয়ে কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে পড়ি। সাঙ্গু নদী থেকে একটা ট্রলারে করে যাত্রা। রিঝুক ঝরনায় গিয়ে শেষ।

পাহাড়ী কন্যা সাঙ্গু। মারমা সম্প্রদায়ের ভাষায় ‘শঙ্খকে রিগ্রাই থিয়াং’ অর্থাৎ স্বচ্ছ পানির নদী। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে কয়টি নদীর উৎপত্তি তার মধ্যে সাঙ্গু অন্যতম। নদীটা পাহাড় শ্রেণিকে চিরে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে। একমাত্র ট্রলারের যান্ত্রিক শব্দের বইরে কোনো শব্দ নেই। সকাল হলে পাহাড় ডাকে; থমথমে কেমন একটা ডাক সেটা। সেই ডাককে ট্রলারের ম্যাশিনের খিট্-খিটি-খিট্ আওয়াজের ভেতর আরও জীবন্ত মনে হয়। 

  পাহাড়ের পিঠে কোথাও কোথাও আদিবাসী নারীদের দেখা যাচ্ছে উবু হয়ে জুমের পরিচর্যা করতে। পরনে তাদের নিজস্ব ধরণের স্কাট আর লেহেঙ্গা। ঠিক পাহাড়ের মতো নির্লিপ্ত তাদের অভিব্যক্তি। এতো শব্দ করে নদীতে আলোড়ন তুলে আমরা যাচ্ছি, তাতে তার কিচ্ছুটি আসে-যায় না। যেন পাহাড়ের কানে কানে তারা কি গোপন কথা কইছে।


আমাদের ট্রলারটা এসে ভীড়ল ঘাটে। ঘাট বলতে কয়েকটা পাথরের চাঁই। সামনেই প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে রিঝুক মহা কল্লোলে আছড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের বুকে। ঝরনার ¯্রােত পাথরে আছড়ে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে পাথরের চাইয়ের নিচে। সেই পানি পাথরের তল দিয়ে ঝিকঝিক শব্দ করে গিয়ে পড়ছে সাঙ্গুর বুকে। এসব অসংখ্য ঝরনার ফলেই আদিবাসী ললনার মতো সাঙ্গু এমন যৌবনবতী। স্বয়ংবরা রাজকন্যার মতো এগিয়ে যাচ্ছে পাহাড়েরর পর পাহাড় পাশ কাটিয়ে কোনো এক অজানার উদ্দেশ্যে। 

বাম দিকে রিঝুক আর ডান দিকের পাহাড়ের খাঁজে ওই বাড়িটা। দুটো টিনের ঘরের নতুন চাল সকালের রোদে হিরের টুকরোর মতো ঝলমল করছে। কাছাকাছি আসতে ম্যাশিনটা বন্ধ করে দিল মাঝি। অদূর থেকে কুকুরটার অস্থির ঘেউঘেউ পাহাড়-পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে একটা বিচিত্র কোলাহলের সৃষ্টি করেছে। অতঃপর উঁকি দিল সেই মুখটি।


প্রথম যেদিন এখানে আসি, সেদিনের কথা স্পষ্ট আমার মনে আছে। পাহাড়ের উপর থেকে সেই মুখটি যখন দেখা দিল বাস্তবিকই আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম, সকালের আলোটা আসলে কোথা থেকে আসছে? আমার পেছনের আকাশ থেকে, না ওই উঁকি দেওয়া মুখটি থেকে। মুখটিতে পাহাড়ি এক দুর্বোদ্ধতা। পাহাড় ফুড়ে বেরিয়ে আসা লাবণ্যময় পাথরের মতো। প্রথম পরিচয়টা অতিক্রম হয়ে গেলে তার মতো সুন্দর, তার মতো আপন এই ধরাধামে কিছু নেই। 

  মুখটি চেয়ে আছে আর অদৃশ্য কারো সঙ্গে কী নিয়ে যেন কথা বলছে। পেছনের লোকটার মুখও এইবার দেখা দিল। পরাগদা। ঠিক ছোটখাট একটা পাহাড়। মাথায় উপর চুলের বন দীর্ঘ কপাল ঢেকে রেখেছে। হালকা ভ্রুর নিচে মাংসের তলে চোখের তারা হারিয়ে গেছে।

  হনুউঁচু আর মাংসল চোখের শক্ত বাঁধুনির ভেতর চকচকে দুধসাদা দাঁতে হেসে সে আমাদেরকে স্বাগত জানাল। পাশের তরুণীকে কী যেন বলতে সে একগাল হেসে উধাও হলো।

পায়ের পিস্টনের পরীক্ষা শেষ করে যখন ভিটায় পৌঁছুলাম, ততক্ষণে আমার অবস্থা তথইবচ। একে তো ট্রেকিংয়ের অভ্যাস নেই, তার উপর ঘুমটা পুরা করতে পারিনি। ভিটার সমতল জায়গাটার পর পাহাড় নিজের গতিতে খাঁজকাটা দেহে সজারুর মতো উপরের দিকে উঠে গেছে। পাহাড়শ্রেণির মাথা মেঘ তার শুভ্রহাতে ছুঁয়ে রেখেছে। সাঙ্গু ডান দিক থেকে এসে বা দিকে কিছু দূরে গিয়ে বাঁক নিয়ে হারিয়ে গেছে পাহাড়েরর পেছনে। কী যেন, হয়তো সেখানে সে তার মনের মানুষটি খুঁজে পেয়েছে।

  পরাগদার আতিথেয়তার নমুনা বলে শেষ করা যাবে না। পাহাড় ঘেষা ঘরটা একপাশ থেকে ইংরেজি অক্ষর এলের সমানতরালে তৈরি। মধ্যে মধ্যে কাঠের বেড়া দিয়ে রুম করা। নদী থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠে পথের মুখে বাড়ির সামনের দিকেই চা-বিস্কুটের দোকান, সঙ্গে হাতে তৈরি চাদরসহ স্থানীয় সব ধরণের কাপড়-চোপড় রাখা। 

কাছাকাছি হতে পরাগদা পাহাড়ি সৌজন্যের হাসি দিলেন। অনেকটা পাহাড়ের গা বেয়ে লাফিয়ে নামা পাথরের টুকরোর মতো। আমার মনে হলো, এতে সৌন্দয্য আছে, সৌহার্দ্য নেই। 

পরে জেনেছি আসলে আমার এ ধারণা একদম ভুল ছিল না। কারণ তাদের সৌহার্দ্য থাকে আরও ভেতরে, গভীরতর জায়গায়। ঝরনার উৎসের মতো তার অনুসন্ধান করতে হয়, তবেই মেলে।

ভিটায় ওঠে আসতেই দোকানে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলেন পরাগদা। ওষ্ঠাগত প্রাণে যেন পানি পেল, তারপর এককাপ চা। কড়া লিকারের। অতঃপর বাঁশের খোলে ভাত, মুর্গি, সবজিÑ কত কিই না খাওয়া হলো। 

  সঙ্গে সকালের রোদের মতো মেয়েটি। বারবার এট-ওটা এগিয়ে দিল। কখনো পানি, কখনো সিগারেট, কখনো কেবল হাসি।

  হাসি তো না যেন পাহাড়ের চূড়া থেকে ঝড়ে পড়া শিউলি বৃষ্টি। এই হাসির জন্য, কেবল এই হাসির জন্যই আমি এই সকল সৌন্দর্য, পাহাড় শ্রেণি ধসিয়ে দিতে পারি।  

  সেই থেকে পাহাড়ে নিয়মিত হয়ে গেলাম। 



সেই যে আসা-যাওয়া শুরু হলো। সেই থেকে রাজধানীতে এখন আমার তৈজস-পত্র, পোশাক-আশাক থেকে আদিবাসী যাবতীয় জিনিসের বিরাট শো-রুম। শহরের এক বিখ্যাত আদিবাসী পণ্য ব্যবসায়ী আমি। 

  এর সবকিছু পরাগদার কল্যাণে। তার হাত ধরেই আমার এই ক্ষুদ্র ব্যবসা ধীরে ধীরে বিরাট আকার ধারণ করেছে। এখন কেবল ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। পাহাড়ে আসা-যাওয়ার মধ্যেই আমাকে থাকতে হয়। এই সব ব্যস্ততার মধ্যেও রুবীর সকালের রোদের মতো মিষ্টি হাসিটি কম পক্ষে একশ’ বার না শুনলে আমার দিন অপূর্ণই থেকে যায়। 

   একদিন রুবী বলেছিল, ‘তুই আমার এথ ভালোবাসো কেন? দাদা জানলে থো মাইরা ফেলব?’

   আমি বলেছিলাম, ‘মারুক। এখনই মারুক।’ বলে ষাড়ের মতো তেড়েফুড়ে আমি রুবীর দাদা পরাগদার মুখোমুখি যেতে শুরু করলাম। সেদিন রুবী আমাকে চেপে ধরে ফিরিয়েছিল। না হয়তো, সেদিনই হতে পারতো এই পৃথিবীতে আমার শেষ দিন।

    ‘বোকা নাকি থুমি। তরে মাইরা ফালাইলে আমি কি বাঁচব, ক! ওমন করিস না। আমাদের কুশলি হতে হব। বুঝছো ঘোরার ডিম। পাগলামী করলে হব না।’

   সেদিন রুবীর কথা শুনে মনে হয়েছিল, আসলে নারীরাই শ্রেষ্ঠ। তারা বাস্তববাদী, পরিস্থিতি বুঝে কাজ করতে জানে; আর পুরুষরা আবেগ সর্বস্ব, তাদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। নারীরা যদি পুরুষদের প্রত্যাক্ষাণ করে চলত আমার মনে হয়, বেশির ভাগ পুরুষের পাতকূয়োর ভাঙা হাড়িকুড়ি হয়ে পড়ে থাকতে হতো। 

   সাঙ্গুতে ট্রলারের খিট্খিট্ আওয়াজের ভেতর রিঝুক ঝনার দিকে যাচ্ছি আর এসব ভাবছি। কারণ আজকের যাওয়া আমার অন্যান্য দিনের যাওয়ার মতো না। আজকে যাওয়া আমার বিশেষ, বিশেষতর। 

  আজকের আসা আমার কোনো পণ্যের জন্য নয়। মনের আয়নার ভাসছে কেবল সেই মুখটি, ভাবছি, সেই শিউলি বৃষ্টির হাসির কথা; আর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে যে হাসির উৎস চিরদিনের জন্য আমার হতে যাচ্ছে।


সাঙ্গুকন্যা রুবী গতকাল সকালে ফোন দিয়ে বলল, কবে আসছস?

  আমি বললাম, আগামী পরশু।

  ‘আজকেই আসেন...’ বলে রুবী ফোন কেটে দিল। তার এই আধো বোলে বাংলা বলার ঢংটা আমাকে আরও পাগল করে দেয়। এভাবে যখন সে কথা বলে তাকে শিশুর মতো মনে হয়। তুই-তুমি-আপনি মিশিয়ে সে এক মমতার তৈরি করে; যার জন্য আমি কি-না করতে পারি!

আমি রুবীর কেটে দেওয়া ফোনে ঠোঁট লাগিয়ে বললাম, ঠিক আছে। আমি আসছি। তুমি রেডি থেকো। 

পাহাড় ডেকেছে আমায়। পাহাড়েরর ডাক কি আমি উপেক্ষা করতে পারি? 


পল্টন, ঢাকা।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট