উত্তরণ




উত্তরণ

মুহাম্মাদ রাহাতুল ইসলাম 


আজকের সকালটা বেশ মনোরম। সাদা ধূতি পরে খালি গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে পুকুর ঘাটে বসে আছেন হেমাকান্ত রায়। অন্য অন্য দিন মাছ ধরার বড়শি সাথে থাকলেও আজকে বসে আছে একদম খালি হাতেই। পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে ভাবছেন কিছু একটা। হঠাৎই সাইকেলের ক্রিং ক্রিং বেল শুনে পিছনে তাকালেন। একগাল হেসে বলে উঠলেন ; আরে ফরিদ না-কি? কি অবস্থা তোমার? চিঠি পত্র আসলো না-কি কিছু? ফরিদ উত্তর দেয়; আজ্ঞে হ্যা। উপর ওয়ালার ইচ্ছায় ভালোই আছি। হেম বাবুর হাসির সাথে তাল মিলিয়ে একটু হেঁসে নিলো পোস্টমাস্টার ফরিদ। গাছের সাথে সাইকেল দাঁড় করিয়ে হেমাকান্ত রায়ের পাশে এসে দাড়ায়। তারপর পুরাতন সেই ব্যাগ হাতড়ে হেম বাবুর হাতে তুলে দিলো একখানা হলুদ খামের চিঠি।

চিঠিটা হাতে নিতেই কেন জানি ফ্যাকসে হয়ে গেলো হেমাকান্ত রায়ের হাস্যজ্বল মুখ। একটু আগেই যা প্রভাতের প্রথম রশ্মির ন্যায় চকচক করছিলো। তিনি চিঠি পড়তে জানেন। এমনকি গুছিয়ে লিখতেও পারেন। তবুও কিছুটা শঙ্কিত হয়ে জিগ্যেস করলেন; রফিক! চিঠিটা কে পাঠিয়েছে? হাসির রেখা স্বস্থানে রেখে উত্তর দেয়; ঐতো শষীভূসন আছে না আমাদের নিমাই বাবুর ছেলে, ভিলেতে থাকে সে। কিছুটা স্থির হওয়ার ভান করলেন কিন্তু পুরোপুরি ব্যার্থই হলেন হেম বাবু। এই পর্যন্ত তিন তিনটি চিঠি এসেছে এই একই নামে। তিনি বহু চেষ্টা করেও এই নামের কারও চেহারা স্মরণে আনতে পারলেন না। তবে এই নামে নিমাই ঘোষের একটা ছেলে আছে তা তিনি জানেন লোকমুখে। কখনো চোখে দেখা হয়েনি। যে নিমাই ঘোষকে খাজনা না আদায় করার দায়ে প্রহার করে মেরে ফেলেছিলেন।

অজানা আশঙ্কা আর ভয় নিয়ে তিনি চিঠি খুললেন। খুব বেশি লেখা নয়। হাতের লেখা পরিস্কার। দেখেই বুঝা যায় লেখক লেখালেখিতে বেশ সিদ্ধহস্ত। গোটাগোটা অক্ষরে লেখা আছে। প্রিয় হেমাকান্ত বাবু! আজকে আপনার মহান জমিদারির তৃতীয় বর্ষ সমাপ্ত হলো। চতুর্থ বর্ষ শুরুর প্রথম প্রহরে আপনার প্রতি আমার এই শুভেচ্ছা ও সতর্ক বার্তা। ধুক করে হেমকান্ত রায়ের ভিতরটা কেপে উঠে। কে এই চিঠি দাতা। আর তার মতলবটাই বা আসলে কি। তখনও সামনে দাঁড়িয়ে আছে পোস্টমাস্টার ফরিদ। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হেমবাবুর দিকে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না। চুপচাপ সাইকেল নিয়ে চলে গেলো। ফরিদের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছেন হেমকান্ত রায়। বারবার তার মনে হচ্ছে এই চিঠি দাতা আর কেউ নয় রফিক নিজেই। কিন্তু রফিকে সন্দেহ করার তেমন কোনো কারণও খুঁজে পান না তিনি। সামান্য পোস্টমাস্টার। সে আর কিই বা করতে পারবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ভিতর বাড়ি চলে আসেন জমিদার হেমকান্ত রায়।


ঋাদ্র মাসের শেষ দিক। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত কড়া রোদ। অপ্রয়োজনে কেউ বাহিরে বের হয় না। বেলা প্রায় তিনটার কাছাকাছি। মুখ গম্ভীর করে চুপচাপ বসে আছেন জমিদার বাবু। উত্তর পাড়া হতে গত দুই মাসে এক পয়সাও খাজনা আসেনি। পুরো গ্রামবাসী এক জোট হয়েছে। নতুন ধান ঘরে না আনা পর্যনত তারা এক সিকিও খাজনা দিবে না। তাও তাদের দাবীদাওয়া আদায়ের পর। না দিক সেটা অন্য বিষয়। কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়। জমিদারির নিকটবর্তী এলাকায় এমন জোট তৈরি হলে দূরবর্তীরাও উস্কানি পাবে। ফলে বিদ্রোহের আশংকা আরও প্রবল হয়ে উঠবে। হেমবাবু পত্র লেখককে ডাক দেয়। সমানে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী মহোৎসব। যে ভাবেই হোক প্রত্যেক প্রজার যথাযথ খাজনা আদায় করতে হবে। দাবীদাওয়া যা আছে উৎসবের পর মিমাংসা করা হবে। এই মর্মে ঘোষণা পত্র লেখার জন্য। এরপর অতিদ্রুততার সাথে এই ঘোষনাপত্র পাঠানো হলো জমিদারির আওতাভুক্ত সকল এলাকায়।


দেখতে দেখতে বিকেল, সন্ধা। তারপর রাত গভীর হয়। কিন্তু সামান্যতম ঘুম আসছে না জমিদার হেমকান্ত বাবুর চোখে। বারবার সকালের সে চিঠির কথা মনে পরছে। চিঠির ভাষা এবং প্রজাদের উৎপাত তো প্রায় একই। তাহলে কি অতিসত্বর খারাপ কিছু ঘটে যাবে। নাহ আর ভাবতে পারছে না হেমকান্ত রায়। গত তিন বছর কোম্পানিকে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করেছেন তার অর্ধেকও তুলতে পারেননি। জেল জুলুম কম করেননি প্রজাদের উপর। কিন্তু কাজ হয়নি। বেদম পেটালেই তো আর পয়সা বের হয় না। এই বন্যা তো এই খড়া। ফসলই যদি ঘরে আনতে না পরে ওরা তবে খাজনা দিবে কোত্থেকে। জানের ভয় তো সবারই আছে। খাজনা দিতে পারলে কেউই না দিয়ে মাইর খেয়ে মরতে চাইতো না। 


রাত প্রায় শেষের দিকে। এই পুরো রাতে একমুহূর্তে জন্যও চোখের পাতা বন্ধ করেননি জমিদার হেমকান্ত রায়। নিরাপত্তা চেয়ে কোম্পানির কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা যেতো। কিন্তু এখন সেটাও সম্ভব না। কোলকাতা মুর্শিদাবাদ সহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্রোহীরা মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠেছে। আর এখন কোনো জাত ধর্ম বিচার করছে না। হিন্দু মুসলিম সব প্রজারাই একজোট। এই মুহুর্তে কখন কি হয় বলা যায় না। কালসকালেই নতুন কোনো প্লান তৈরি করতে হবে। যে করেই হোক বিদ্রোহ দমিয়ে জমিদারি রক্ষা করতে হবে।


হেমকান্ত রায়ের পূর্ব পুরুষ কেউই জমিদার ছিলেন না। তবে অর্থ সম্পদ একদমই কম ছিলো না। তারা ছিলো কোলকাতার বামুন হিন্দু। হেমকান্ত রায় ছিলেন কোম্পানির চিফ জেনারেল। বয়স হওয়ায় সেখান থেকে অবসর নিয়ে এপার বাংলায় এসে জমিদারি কিনেন। এবং প্রজাদের উপর চালান অকথ্য নির্যাতন। যে হেমাকান্ত রায় একাধিক কোম্পানি বিদ্রোহীকে সায়েস্তা করেছেন সে এখন নিজেরই জমিদারি টিকিয়ে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। সকাল সকাল একটু ঘুম হলো জমিদার বাবুর। তিনি ঘুম থেকে উঠলেন সকাল এগারোটা নাগাদ। বেশ ফুরফুরে লাগছে। মেঘনার কোল ঘেঁষা এই বিস্তীর্ণ জমিদারিতে এসে তিনি সর্বদায় আমোদ প্রোমোদে থাকেন। জমিদারি রক্ষণাবেক্ষণেই তার সারাদিন কেটে যায়। বারান্দায় পায়চারি করছেন জমিদার হেমকান্ত রায়। হঠাৎই তার চোখে পরলো কয়েকটি হুতুমপেঁচা মরে পরে আছে। শরীরের লোম দাড়িয়ে গেলো জমিদার বাবুর। একোনো আসন্ন বিপদ সংকেত নয় তো। অন্য দিন হলে তিনি ঝি চাকরদের ডাকাডাকি করতেন। বকাঝকা করতেন। আজ কিছুই করলেন না চুপচাপ গিয়ে নিজের ঘরে বসে রইলেন। 


হঠাৎই প্রহরী দৌড়ে এসে তার কাছে উপস্থিত হয়। হাঁপাতে হাঁপাতে তাকে সংবাদ দেয় গেটের বাহিরে পরে আছে চার চারটি লাশ। এবং সেগুলো তারই নিযুক্ত বিভিন্ন এলাকার সর্দারদের। হেমকান্তরায় বিচক্ষণ মানুষ। তার বুঝতে বাকি রইলো না। প্রজারা বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছে। তার আর একমুহূর্তও এখানে থাকা নিরাপদ নয়। কিন্তু সে চলে যাওয়ার আগে শুধু এইটুকু জানতে চান বিদ্রোহীরা আসলে কারা? তারা কোনধর্মে লোক। তৎক্ষনাৎ সপরিবারে গা-ঢাকা দেন জমিদার হেমকান্ত রায়। তারপর রাতের আঁধারে দূর হতে তিনি দেখতে পান। হিন্দু মুসলিম সব প্রজারা একত্র হয়েই হামলা করছে তার সখের প্রাসাদে। কিছুক্ষনের মধ্যেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে। তিনি নিজেও জানেন এই আগুন ক্ষোভের, প্রতিশোধের, ঘৃণার। আর তাদেরকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পোস্ট মাস্টার ফরিদ।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট