ডাকনাম

 

    


ডাকনাম

রফিকুল নাজিম 


চায়ের কাপে ঠোঁট দিয়েই মুচকি একটা হাসি ঝুলে গেল আমার ঠোঁটের কোণে! কী অদ্ভুত ব্যাপার! মনের ভেতর মন না থাকা বড্ড বিড়ম্বনার ব্যাপার। কখন কী ঘটে যায়- বলা মুশকিল। রমিজেরও এখন মনের ভেতর মন নেই। হয়তো গত রাতে বউয়ের সাথে তুমুল ঝগড়া করেছে। হতে পারেই। রমিজদের ঘরের ফাঁকফোকরে হা করে অপেক্ষা করে অভাব। সেই অভাবগুলো একটু সুযোগ পেলেই হামলা করে। অভাবেরা ঝগড়া বাধায়। মারামারি বাধায়। রমিজেরও হয়তো তাই হয়েছে- তা না হলে আজকে রমিজের হাতের চা এতো বিস্বাদ হবে কেন! চায়ে চিনি নেই। দুধের অনুপাতও ভয়ংকর রকমের কম। অথচ এই রমিজের চায়ের সুখ্যাতি চারিদিকে। আমাকে সপ্তাহে দুইদিন মাধবপুর আসতে হয়। সুরমা চা বাগানে বিশেষ শিক্ষা প্রোগ্রাম চলছে। পাঁচ বছরের প্রোগ্রাম। আসা যাওয়ার পথে রমিজের টং দোকানের চার কাপ চা গেলার জন্য মুখিয়ে থাকি। কী দুর্দান্ত কম্বিনেশনে চা বানায় রমিজ! 

- কী মিয়া, মনটা আজ কই রাইখ্যা আইছো? আজ চা তো চা হয় নাই।

- কন কী, স্যার।

- হ। চায়ে দুধ চিনির কোনো কিছুই ঠিক হয় নাই। চায়ের পাতিও পানির তুলনায় কম মনে হইলো! আগের ফ্লেভার নাই।

- আইচ্ছা, স্যার। বহেন আপনে। আমি আরেক কাপ চা বানাইয়া দিতাছি।


কথাগুলো অন্যমনস্ক হয়েই বলছিল রমিজ। স্টেশনের চারদিকে তার চোখ ঘুরছে। স্টেশন ভর্তি লোকজন। খুব শোরগোল। কুলিদের চিৎকার চেঁচামেচি। হকারদের হাঁক-ডাক। চারদিকে কেবল শব্দ বোমা ফাটছে। আমি রমিজকে বোঝার চেষ্টা করছি। রমিজের চোখ স্টেশনে কী খুঁজছে? প্রিয় কোনো মুখ? নাকি পরিচিত কোনো চায়ের কাস্টমার? অথচ আমাকেও এই ট্রেন ধরেই ঢাকা যেতে হবে। কালনি এক্সপ্রেস ক্রসিংয়ে পড়েছে। সময় লাগবে। তাই আমার মধ্যে কোনো তাড়া নেই। মনে হচ্ছে রমিজের হাতের চা না খেয়ে আমি যেতেই পারবো না। চায়ের প্রতি আমার নেশাটা বরাবরই বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত। আমি রমিজের চোখের রেটিনা ধরে দেখার চেষ্টা করছি- সে কী দেখছে?

- ঐ মিয়া, তুমি কী যেন খুঁজতাছো? কও আমারে। আমিও তোমারে সহযোগিতা করি।

- না, স্যার। তেমন কিছু না। তয় কিছু একটা ঘটতেও পারে। 

- কই- কী ঘটতে যাইতাছে। আমারেও দেখাও। আমিও মজা লই।

- না, মজা না। মনে হইতাছে বিপদ।

- কও কী, মিয়া!


রমিজ আমারে আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় দেখালো। একটি যুবক। খুব উসকোখুসকো। লম্বা চওড়া যুবকের কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলানো। মাথার ক্যাপ দেখতে দারুন। ভ্যাগিক্যাপ। বিদেশীদের পড়তে দেখেছি। ফ্যাড জিন্স পরা যুবকটার গায়ে চে গুয়েভারার ছবি সংবলিত টি-শার্ট। বাম হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে একটা সিগারেটের অপমৃত্যু হচ্ছে। অথচ যুবকটা সিগারেটে টান দিচ্ছে না। পুড়ে পুড়ে সিগারেটটা ভস্ম হয়ে যাচ্ছে নীরবে। অথচ এই যুবক একমনে তাকিয়ে আছে একটা মেয়ের দিকে। মেয়েটার হাতে আইফোন। বেশ কিছু সময় ধরে মোবাইলে কথা বলছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি মোবাইলের ওপর প্রান্তের মানুষটার ওপর বিরক্ত। মাথাটা নিচু করে সেই যুবক মেয়েটার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। তার হাঁটা চলাফেরা রহস্যজনক। রহস্যজনক না বলে সন্দেহজনক বললে ভুল হবে না। আচ্ছা- মেয়েটা কি যুবক এই ছেলের সন্দেহজনক গতিবিধি খেয়াল করেছে? হয়তো। এমনও হতে পারে- খেয়াল করলেও পাত্তা দিচ্ছে না। মেয়েরা এমনটা ঠিকঠাক ভাবে পারে। মনে যা মুখে তার ছাপ না রেখেই অভিনয় করতে পারে। কয়েকবার ছেলেটা প্ল্যাটফর্মের এমাথা থেকে ওমাথা হেঁটে যাচ্ছে। অথচ একমনে মেয়েটা মোবাইলে কথা বলেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে রমিজের কথাই সত্য। আপাততঃ যুবকের গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছে- মেয়ের হাতের মোবাইলই তার টার্গেট। তাই আমি একটুকুন এগিয়ে গেলাম। সিনেমায় এমন দৃশ্যে নায়কের আগমন ঘটে। হিরোয়িক একটা ব্যাপার-স্যাপার থাকে। তাই মেয়েটার সামনে হিরো হবার এমন সস্তা চান্স আমি হাত ছাড়া করার মত বোকা নই। তাই আমি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি- কী ঘটতে যাচ্ছে। ছেলেটা এবার সামনের দিকে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে দেখছে। ছেলেটার তাকানোর ভেতর এক সাগর তৃষ্ণা দেখেছি। কলি কালের চোরও কত রোমান্টিক হয়! শালার আমিই কেবল বেখাপ্পা রসকষহীন মানুষ। বউয়ের কাছে একটা কাঠখোট্টা যন্ত্র বিশেষ মাত্র। 


মেয়েটা কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে রাখতেই একজন সুদর্শন পুরুষ তার পাশে এসে দাঁড়ালো। পুরুষটার কোলে চার পাঁচ বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। একদম পরীর মত। পুরুষটার কোলে বসে পুচকিটা বাবা বাবা বলে কথা বলছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা কটমট করে কিছু বলছে সাথের পুরুষকে। মনে হচ্ছে পুরুষটা অসহায়ভাবে মেয়েটার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আমি বেশ উপভোগ করছি ঘটনাটি। বেশ থ্রিলার টাইপ মনে হচ্ছে। এই যাত্রাপথে কত ঘটনার রাজ স্বাক্ষী আমি। দেখে মনে হচ্ছে তারাই পৃথিবীর সুখী পরিবার।


মেয়েটা মোবাইলটি তার পার্সে রেখেছে। পরীকে কোলে তুলে নিয়েছে। সেই সুদর্শন পুরুষ ব্যাগ দুটো নিয়ে ট্রেনের এগিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের ‘ট’ বগির দিকে যাচ্ছে। আমার চোখ ছেলেটার ওপর। হঠাৎ খেয়াল করলাম ছেলেটা মেয়ের পিছু নিয়েছে। তাই আমিও ছেলেটার পেছন পেছন যাচ্ছি। ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে ওঠে গেল মেয়েটার পার্টনার। মেয়েটা বগিতে ওঠতে যেতেই ছেলেটা দৌড়ে মেয়ের কাছে গেল। মাথার ক্যাপটা আরেকটু টেনে বলল, ‘মিথি, ভালো থেকো।'’- কথাটা বলেই ছেলেটা ঘুরে দ্রুত পায়ে স্টেশনে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল। ছেলেটাকে আমি স্টেশনের কোথাও দেখছি না। শান্ত সৌম্য সেই মেয়ের বুকে তখন মেঘেদের গুড়–ম গুড়–ম নিনাদ। চৈত্রের খরা মুছতে বৃষ্টির অপেক্ষায় এলোপাতাড়ি ওড়ছে মেঘ। 


মনে হচ্ছে- মেয়েটা হঠাৎ ডাকে ভড়কে গেছে। মনে হলো হঠাৎ হারিয়ে ফেলা মূল্যবান কিছু একটা পথে খুঁজছে। মেয়েটা ট্রেনের বগিতে না ওঠে অস্থির চোখে সেই কণ্ঠটা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। হঠাৎ এমন ডাকে তার চোখে বান ে ডেকেছে। অথৈ জলের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ এসে পাড় ভাঙছে। এইদিকে ট্রেনের হুইশেল বাজছে। সাথে সুদর্শন পুরুষের আচমকা ডাকে মেয়েটার সম্বিৎ ফিরে এসেছে। মেয়েটা বগিতে ওঠেছে। আমিও পেছন পেছন ওঠলাম। কী দৈব এক ঘটনা! আমার সিট পড়েছে মেয়েটার একদম সামনে। মুখোমুখি আসন। জানালার পাশে বসা মেয়েটি মুখ বাড়িয়ে স্টেশন চত্বরে কিছু একটা খুঁজছে। ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে। 


আজ নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। এমন লাস্যময়ী মেয়েকে আড়চোখে দেখতে দেখতে গন্তব্যে যাওয়া যাবে। সুযোগ পেলে মেয়েটার সাথে ছেলেটার সম্পর্কের রূপরেখাও আবিষ্কার করা যেতে পারে। ভাবতে ভাবতেই সুযোগটা এসে গেল। সুদর্শন পুরুষটা পরীর জন্য চিপস আনতে গেল। মেয়েটা তখনও ট্রেনের জানালায় মুখ রেখে কোথায় যেন ডুবে আছে। পাশের ছোট্ট পরীর দিকে তার কোনো মনোযোগ নেই। বড্ড এলোমেলো লাগছে মেয়েটাকে।

- হ্যালো- আপনি কি মিথি? 

- এই নাম আপনি কি করে জানলেন?

- না মানে আপনাকে উদ্দেশ্য করে একটা যুবক এই নামে ডাকতে শুনলাম! সুন্দর একটা নাম।

- তার মানে আমি ভুল শুনিনি! সেটা তমালই ছিল? কত বছর পর এই নামে সে ডাকলো!


অস্পষ্ট স্বরে মিথি এই কথাগুলো বলে যাচ্ছে। আমি শোনার চেষ্টা করছি। বাকি কথাগুলো ট্রেনের কু ঝিকঝিক শব্দের সাথে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। মিথির চোখে বৃষ্টি নেমেছে। আমি সেই বৃষ্টি দেখছি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে- তমাল নামটি কি মিথির দেয়া কিনা? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মত অবস্থায় সে নেই। জানালায় মুখ রেখে মিথি কাঁদছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে- তমালও কি মিথির মত এখন কাঁদছে? ট্রেনের ভেতরে তুমুলভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ প্রকৃতিতে হবু শীতে মিষ্টি রোদের চাষবাস চলছে।


রফিকুল নাজিম 


চায়ের কাপে ঠোঁট দিয়েই মুচকি একটা হাসি ঝুলে গেল আমার ঠোঁটের কোণে! কী অদ্ভুত ব্যাপার! মনের ভেতর মন না থাকা বড্ড বিড়ম্বনার ব্যাপার। কখন কী ঘটে যায়- বলা মুশকিল। রমিজেরও এখন মনের ভেতর মন নেই। হয়তো গত রাতে বউয়ের সাথে তুমুল ঝগড়া করেছে। হতে পারেই। রমিজদের ঘরের ফাঁকফোকরে হা করে অপেক্ষা করে অভাব। সেই অভাবগুলো একটু সুযোগ পেলেই হামলা করে। অভাবেরা ঝগড়া বাধায়। মারামারি বাধায়। রমিজেরও হয়তো তাই হয়েছে- তা না হলে আজকে রমিজের হাতের চা এতো বিস্বাদ হবে কেন! চায়ে চিনি নেই। দুধের অনুপাতও ভয়ংকর রকমের কম। অথচ এই রমিজের চায়ের সুখ্যাতি চারিদিকে। আমাকে সপ্তাহে দুইদিন মাধবপুর আসতে হয়। সুরমা চা বাগানে বিশেষ শিক্ষা প্রোগ্রাম চলছে। পাঁচ বছরের প্রোগ্রাম। আসা যাওয়ার পথে রমিজের টং দোকানের চার কাপ চা গেলার জন্য মুখিয়ে থাকি। কী দুর্দান্ত কম্বিনেশনে চা বানায় রমিজ! 

- কী মিয়া, মনটা আজ কই রাইখ্যা আইছো? আজ চা তো চা হয় নাই।

- কন কী, স্যার।

- হ। চায়ে দুধ চিনির কোনো কিছুই ঠিক হয় নাই। চায়ের পাতিও পানির তুলনায় কম মনে হইলো! আগের ফ্লেভার নাই।

- আইচ্ছা, স্যার। বহেন আপনে। আমি আরেক কাপ চা বানাইয়া দিতাছি।


কথাগুলো অন্যমনস্ক হয়েই বলছিল রমিজ। স্টেশনের চারদিকে তার চোখ ঘুরছে। স্টেশন ভর্তি লোকজন। খুব শোরগোল। কুলিদের চিৎকার চেঁচামেচি। হকারদের হাঁক-ডাক। চারদিকে কেবল শব্দ বোমা ফাটছে। আমি রমিজকে বোঝার চেষ্টা করছি। রমিজের চোখ স্টেশনে কী খুঁজছে? প্রিয় কোনো মুখ? নাকি পরিচিত কোনো চায়ের কাস্টমার? অথচ আমাকেও এই ট্রেন ধরেই ঢাকা যেতে হবে। কালনি এক্সপ্রেস ক্রসিংয়ে পড়েছে। সময় লাগবে। তাই আমার মধ্যে কোনো তাড়া নেই। মনে হচ্ছে রমিজের হাতের চা না খেয়ে আমি যেতেই পারবো না। চায়ের প্রতি আমার নেশাটা বরাবরই বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত। আমি রমিজের চোখের রেটিনা ধরে দেখার চেষ্টা করছি- সে কী দেখছে?

- ঐ মিয়া, তুমি কী যেন খুঁজতাছো? কও আমারে। আমিও তোমারে সহযোগিতা করি।

- না, স্যার। তেমন কিছু না। তয় কিছু একটা ঘটতেও পারে। 

- কই- কী ঘটতে যাইতাছে। আমারেও দেখাও। আমিও মজা লই।

- না, মজা না। মনে হইতাছে বিপদ।

- কও কী, মিয়া!


রমিজ আমারে আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় দেখালো। একটি যুবক। খুব উসকোখুসকো। লম্বা চওড়া যুবকের কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলানো। মাথার ক্যাপ দেখতে দারুন। ভ্যাগিক্যাপ। বিদেশীদের পড়তে দেখেছি। ফ্যাড জিন্স পরা যুবকটার গায়ে চে গুয়েভারার ছবি সংবলিত টি-শার্ট। বাম হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে একটা সিগারেটের অপমৃত্যু হচ্ছে। অথচ যুবকটা সিগারেটে টান দিচ্ছে না। পুড়ে পুড়ে সিগারেটটা ভস্ম হয়ে যাচ্ছে নীরবে। অথচ এই যুবক একমনে তাকিয়ে আছে একটা মেয়ের দিকে। মেয়েটার হাতে আইফোন। বেশ কিছু সময় ধরে মোবাইলে কথা বলছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি মোবাইলের ওপর প্রান্তের মানুষটার ওপর বিরক্ত। মাথাটা নিচু করে সেই যুবক মেয়েটার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। তার হাঁটা চলাফেরা রহস্যজনক। রহস্যজনক না বলে সন্দেহজনক বললে ভুল হবে না। আচ্ছা- মেয়েটা কি যুবক এই ছেলের সন্দেহজনক গতিবিধি খেয়াল করেছে? হয়তো। এমনও হতে পারে- খেয়াল করলেও পাত্তা দিচ্ছে না। মেয়েরা এমনটা ঠিকঠাক ভাবে পারে। মনে যা মুখে তার ছাপ না রেখেই অভিনয় করতে পারে। কয়েকবার ছেলেটা প্ল্যাটফর্মের এমাথা থেকে ওমাথা হেঁটে যাচ্ছে। অথচ একমনে মেয়েটা মোবাইলে কথা বলেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে রমিজের কথাই সত্য। আপাততঃ যুবকের গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছে- মেয়ের হাতের মোবাইলই তার টার্গেট। তাই আমি একটুকুন এগিয়ে গেলাম। সিনেমায় এমন দৃশ্যে নায়কের আগমন ঘটে। হিরোয়িক একটা ব্যাপার-স্যাপার থাকে। তাই মেয়েটার সামনে হিরো হবার এমন সস্তা চান্স আমি হাত ছাড়া করার মত বোকা নই। তাই আমি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি- কী ঘটতে যাচ্ছে। ছেলেটা এবার সামনের দিকে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে দেখছে। ছেলেটার তাকানোর ভেতর এক সাগর তৃষ্ণা দেখেছি। কলি কালের চোরও কত রোমান্টিক হয়! শালার আমিই কেবল বেখাপ্পা রসকষহীন মানুষ। বউয়ের কাছে একটা কাঠখোট্টা যন্ত্র বিশেষ মাত্র। 


মেয়েটা কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে রাখতেই একজন সুদর্শন পুরুষ তার পাশে এসে দাঁড়ালো। পুরুষটার কোলে চার পাঁচ বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। একদম পরীর মত। পুরুষটার কোলে বসে পুচকিটা বাবা বাবা বলে কথা বলছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা কটমট করে কিছু বলছে সাথের পুরুষকে। মনে হচ্ছে পুরুষটা অসহায়ভাবে মেয়েটার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আমি বেশ উপভোগ করছি ঘটনাটি। বেশ থ্রিলার টাইপ মনে হচ্ছে। এই যাত্রাপথে কত ঘটনার রাজ স্বাক্ষী আমি। দেখে মনে হচ্ছে তারাই পৃথিবীর সুখী পরিবার।


মেয়েটা মোবাইলটি তার পার্সে রেখেছে। পরীকে কোলে তুলে নিয়েছে। সেই সুদর্শন পুরুষ ব্যাগ দুটো নিয়ে ট্রেনের এগিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের ‘ট’ বগির দিকে যাচ্ছে। আমার চোখ ছেলেটার ওপর। হঠাৎ খেয়াল করলাম ছেলেটা মেয়ের পিছু নিয়েছে। তাই আমিও ছেলেটার পেছন পেছন যাচ্ছি। ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে ওঠে গেল মেয়েটার পার্টনার। মেয়েটা বগিতে ওঠতে যেতেই ছেলেটা দৌড়ে মেয়ের কাছে গেল। মাথার ক্যাপটা আরেকটু টেনে বলল, ‘মিথি, ভালো থেকো।'’- কথাটা বলেই ছেলেটা ঘুরে দ্রুত পায়ে স্টেশনে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল। ছেলেটাকে আমি স্টেশনের কোথাও দেখছি না। শান্ত সৌম্য সেই মেয়ের বুকে তখন মেঘেদের গুড়–ম গুড়–ম নিনাদ। চৈত্রের খরা মুছতে বৃষ্টির অপেক্ষায় এলোপাতাড়ি ওড়ছে মেঘ। 


মনে হচ্ছে- মেয়েটা হঠাৎ ডাকে ভড়কে গেছে। মনে হলো হঠাৎ হারিয়ে ফেলা মূল্যবান কিছু একটা পথে খুঁজছে। মেয়েটা ট্রেনের বগিতে না ওঠে অস্থির চোখে সেই কণ্ঠটা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। হঠাৎ এমন ডাকে তার চোখে বান ে ডেকেছে। অথৈ জলের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ এসে পাড় ভাঙছে। এইদিকে ট্রেনের হুইশেল বাজছে। সাথে সুদর্শন পুরুষের আচমকা ডাকে মেয়েটার সম্বিৎ ফিরে এসেছে। মেয়েটা বগিতে ওঠেছে। আমিও পেছন পেছন ওঠলাম। কী দৈব এক ঘটনা! আমার সিট পড়েছে মেয়েটার একদম সামনে। মুখোমুখি আসন। জানালার পাশে বসা মেয়েটি মুখ বাড়িয়ে স্টেশন চত্বরে কিছু একটা খুঁজছে। ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে। 


আজ নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। এমন লাস্যময়ী মেয়েকে আড়চোখে দেখতে দেখতে গন্তব্যে যাওয়া যাবে। সুযোগ পেলে মেয়েটার সাথে ছেলেটার সম্পর্কের রূপরেখাও আবিষ্কার করা যেতে পারে। ভাবতে ভাবতেই সুযোগটা এসে গেল। সুদর্শন পুরুষটা পরীর জন্য চিপস আনতে গেল। মেয়েটা তখনও ট্রেনের জানালায় মুখ রেখে কোথায় যেন ডুবে আছে। পাশের ছোট্ট পরীর দিকে তার কোনো মনোযোগ নেই। বড্ড এলোমেলো লাগছে মেয়েটাকে।

- হ্যালো- আপনি কি মিথি? 

- এই নাম আপনি কি করে জানলেন?

- না মানে আপনাকে উদ্দেশ্য করে একটা যুবক এই নামে ডাকতে শুনলাম! সুন্দর একটা নাম।

- তার মানে আমি ভুল শুনিনি! সেটা তমালই ছিল? কত বছর পর এই নামে সে ডাকলো!


অস্পষ্ট স্বরে মিথি এই কথাগুলো বলে যাচ্ছে। আমি শোনার চেষ্টা করছি। বাকি কথাগুলো ট্রেনের কু ঝিকঝিক শব্দের সাথে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। মিথির চোখে বৃষ্টি নেমেছে। আমি সেই বৃষ্টি দেখছি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে- তমাল নামটি কি মিথির দেয়া কিনা? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মত অবস্থায় সে নেই। জানালায় মুখ রেখে মিথি কাঁদছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে- তমালও কি মিথির মত এখন কাঁদছে? ট্রেনের ভেতরে তুমুলভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ প্রকৃতিতে হবু শীতে মিষ্টি রোদের চাষবাস চলছে।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট