বাস্তুতন্ত্র
আহাদ আদনান
বন্যার জল আর আটকানো গেলো না। প্রতিবারই বাড়ির সামনের মাঠটা ডুবে যায়। এবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে জ্যৈষ্ঠ থেকে। উপোষী মাঠটা আষাঢ়ের গোড়াতেই টুইটুম্বুর। কাচপুরের পাশের খালটা বেয়ে জল চলে যায় শীতলক্ষ্যায়। গত শীতেই যখন ড্রেজার দিয়ে খাল ভরাট হচ্ছিল তখনই কুসুম তার স্বামী আয়নালকে বলেছিল, ‘এইবার বর্ষা আইলে ঘরে পানি ঢুকব, দেইখো তুমি। পানি নামার রাস্তা দিতাছে বন্ধ কইরা। ঘর পাল্টাইবা নাকি এইবার’?
‘এত কম খরচে ঘর পাবি কই তুই? সপ্তাখানেক ইট দিয়া ঠ্যাক দিলেই চলব’।
ঘরটা আসলেই সস্তা এই বাজারে। যাত্রামুড়ার মহাসড়কের ডান পাশ দিয়ে গেছে ছোট গলির মত এক রাস্তা। এটা মিলবে ভুলতার বড় রাস্তার সাথে। রাস্তার দুই পাশে খোলা মাঠ, ধানের জমি। আরেকটু এগুলেই ময়লার ভাগাড়। রাজধানীর বাড়িতে বাড়িতে জমে থাকা আবর্জনা প্রতিদিন নিয়ে আসে সিটি কর্পোরেশনের গাড়িগুলো। ফেলে দিয়ে যায় এই খোলা আকাশের নিচে। পচে পচে এরা দুর্গন্ধ ছড়ায়। বংশবিস্তার করে অতি উর্বর জীবাণুর দল। মাছি এসে পাখায়, পায়ে করে এই দূষিত কণা পৌঁছে দেয় বাসনে বাসনে। এই আবর্জনা যেন স্বাদ বাড়িয়ে দেয় পথের ধারের খুপরি দোকানগুলোর পুড়ি, চপ, চটপটি, ফুচকার। ছেলেদের দল হাঁক দেয়, ‘মামা, ফুচকার লগে টক মারো বেশি কইরা’।
আলতাফ চৌধুরী থাকেন তারাবোতে। প্রধান সড়কের পাশেই তার পাঁচতলা বাড়ি। কয়েক বিঘা ধানের খেত আছে এই মাঠের সাথেই। এর মাঝেই একটা একতলা ঘর বানিয়ে রেখেছেন। শরিকের জমি। গ-গোল লেগেই থাকে। বাড়িটা তাই এক ধরণের জমি দখলই বলা যায়। দুইটা থাকার ঘর, একটা রান্না ঘর আর একটা টয়লেট। পূব দিকের ঘরে থাকে বজলু। এক ছেলে আর বউ নিয়ে তিন জনের সংসার। বরপা’তে একটা ‘বাংলার তাজমহল’ তৈরি হয়েছে, তার পাশেই একটা চায়ের দোকান তার। আর পশ্চিম দিকের ঘরটা আয়নালের। পরিবারের সদস্য একজন বেশি, কিন্তু আয় কম। সুদের টাকায় একটা অটো-বাইক কিনে সে এই পথেই চালায়। কিস্তির টাকা দিয়ে হাতে থাকে সামান্যই। পাঁচ মাসের বাচ্চাটা রেখে তার বউ কুসুম ছুটা বুয়ার কাজ নিয়েছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যাত্রামুড়া তিনটা ফ্ল্যাটে কাপড় কাঁচা আর ঘর মুছা। বড় মেয়েটার বয়স এগারো বছর। ছোট বোনকে সে দেখে রাখে ভালো মতোই। করোনার জন্য স্কুল বন্ধ। সারাদিন কাটে তার বোনের সাথে খেলা করে।
বোনটা খুব ঠা-া মিষ্টি’র। মীনা কার্টুন দেখে আর নিজের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখে দিয়েছে মিঠু। মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘কও, মিঠু। আমার নাম মিঠু’। মিঠু অবশ্য শুনে কিনা এটা নিয়ে সন্দেহ আছে যথেষ্টই। বাড়িতে ডেলিভারি করতে গিয়ে আটকে ছিল অনেকক্ষণ। জন্মের পর কান্না করেছে অনেক দেরিতে। খিঁচুনি হয়ে মরতে বসেছিল বাচ্চাটা। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বেঁচে গেলেও সারা জীবনের জন্য পিছিয়ে পড়েছে পাঁচ মাসের মিঠু। এখনও তার ঘাড় শক্ত হয়নি। মুখ দিয়ে কোন শব্দও করেনা। আয়নাল তিনটা মাজার থেকে তাবিজ এনে বেঁধে দিয়েছে গলায়, বাহুতে আর কোমরে। ফলাফল লবডঙ্কা।
আষাঢ়ের মাঝামাঝি। বৃষ্টি হচ্ছে বিকেল থেকে। বজলু ডাক দেয় আয়নালকে।
‘আয়নাল ভাই, এই পুরা বাড়ি তোমারে দিয়া দিলাম। এক তারিখেই আমি ঘর ছারুম। আর পোষাইতাছে না’।
‘ক্যান, কী অইছে? যাইবেন কই’?
‘দোকান বন্ধ হইতে হইতে মাঝ রাইত হয়া যায়। কাছাকাছি একটা বাসা নিছি। এই বাড়িতে মানুষ থাকে? জন-মানব নাই, দোকান-পাট নাই। সারাদিন গুয়ের গন্ধ আর মাক্ষি ঘুরঘুর করে। কোনদিন রাইতে চোর নাইলে ডাকাত আইয়া ল্যাংটা কইরা ফালায়া রাখব। আষাঢ় শেষ না হইতেই সিঁড়িতে পানি আইছে। এইবার ঘর ডুইবা যাইবই। ঘরে পানি হান্দাইলে যাইবা কই মিয়া’?
‘কথা ঠিকই কইছেন। তা আপনার আয় রোজগার মাশাল্লাহ ভালা। আমি এই বেজন্মা কিস্তির ফান্দে পইড়া গেছি। পানি উঠলে ইট দিতে হইব। কয়টা দিনের ব্যাপার’।
বিপদ এবার সব দিক থেকেই আসলো। করোনার জন্য আয় কমে গেছে আগে থেকেই, সাথে যোগ হয়েছে বন্যা। আষাঢ়ের শেষের দিকে ঘরে জল ঢুকে পড়ে। ইট দিয়ে খাট, টেবিল আর ওয়োরড্রৌব উঁচু করে দিয়েছিল আয়নাল। প্রথমে দুটো করে ইট। তারপর চারটা করে। রাতের আঁধারে তারাবো ইটের খোলা থেকে সে চুরি করে আনত ইট। শ্রাবণের বারো তারিখে স্বপরিবারে আয়নাল বাসা বাঁধে বাড়ির ছাদে।
চৌধুরীর কাছে গিয়েছিল আয়নাল। একটা নৌকা, মই আর ত্রিপলের জন্য। শুধু একটা মই দিয়ে দূরদূর করে তাকে বিদেয় করেছে চৌধুরী। নদীর মাঝখানে চরের মত জেগে থাকে বাড়ির ছাদটা। ত্রিপল জোগাড় করতে না পেরে সে লাগিয়ে নিয়েছে পলিথিন। ওঠানামা চলে মই দিয়ে। রোজ সকালে কাছা দিয়ে সাঁতার কেটে সে উঠে জেগে থাকা সড়কে। সাথে পলিথিনে থাকে শুকনো জামা আর লুঙি। সমস্যায় পড়ে কুসুম। ভেজা শাড়িতে ড্যাবড্যাব করে চোখ দিয়ে তাকে ছিঁড়ে খায় পুরুষের দল। এই বিপদে সেও জুটিয়ে ফেলে কালো পুরনো একটা বোরকা। সাঁতার শেষে পথে উঠেই ব্যাগ থেকে বোরকা বের করে নিজেকে দেয় সে ঢেকে। কাজের বাড়ির ম্যাডামকে বলে সে তার আরেকটা শুকনো জামা ওই বাসাতেই রাখার অনুমতি নিয়ে নেয়।
মিষ্টি এখন যেন আরও বড় হয়ে যায়। কত দায়িত্ব ছোট কাঁধে! বোনকে নিয়ে তার কত গবেষণা! মা বলেছে পানি গরম করে দুধ বানাতে হবে। এখনতো মাটির চুলার জ্বালানি পাওয়া কঠিন। কেরোসিনের স্টোভ কিনে ফেলেছে তাই আয়নাল। পানি কতটুকু গরম করতে হবে? বেশি গরম করলে মুখ পুড়ে যাবে মিঠু’র। মা বলেছে সাথে মিছরি দিতে। আজ একটু চিনি মেশালে কেমন হয়? মা বলেছে তিন ঘণ্টা পরপর খাওয়াতে। আচ্ছা, মাঝে আরেকবার দিলে কেমন হয়? বন্যার দিনগুলোতে মিষ্টি যেন মিঠু’র মা হয়ে যায়।
তার গবেষণার মূল বিষয়বস্তু অবশ্য মিঠু’র থাকার জায়গা। বৃষ্টি লেগেই থাকে সারাদিন। জোরে বাতাস ছাড়লে পলিথিন ছিঁড়ে যেতে চায়। বৃষ্টির ছিটা এসে ভিজিয়ে দেয় ওদের। এই বৃষ্টির জল গায়ে লাগলেই জ্বর, ঠা-া লাগবে। ওষুধ কিনতে হবে। এত টাকা বাবা কোথায় পাবে? ভেবে ভেবে একটা বুদ্ধি বের করে ফেলে মিষ্টি। ওয়োরড্রৌবের ভেতর পিচ্চিটাকে ঢুকিয়ে রাখলে কেমন হয়? এর চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর হয়না। কাঠের ওয়োরড্রৌব। চারটা ড্রয়ার, একটার নিচে আরেকটা। পাশে আরেকটা লম্বা খুপরি। ওটাতে শীতের কম্বল, মশারি রেখে দিয়েছে কুসুম। চারটা ড্রয়ারের একটাতেই রাখতে হবে মিঠুকে।
ছোটখাটো মিষ্টি’র জন্য নিচের ড্রয়ারটাই সবচেয়ে সহজ। উপরেরটা সে নাগাল পেলেও উঁকি মেরে দেখতে পারে না। মিঠু কখন জাগবে, খাওয়াতে হবে, প্র¯্রাব করেছে কিনা সেটা বোঝা কঠিন হয়ে যাবে। তাছাড়া একবার প্রস্রাব করে দিলে কাঠ বেয়ে বেয়ে নিচের ড্রয়ারগুলোতে চলে যাবে। কিন্তু নিচের ড্রয়ারটা ইঁদুরের আস্তানা। পুরনো ওয়োরড্রৌবের নিচের দিকে খুপরিতে ওরা থাকে। কোনভাবেই ওদের উৎপাত থেকে বাঁচা যায়না। এই বন্যাতেও ওরা যেন মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসে। ওরা নিশ্চয়ই মিঠুকে কামড় দিবে। নিচের ড্রয়ারে রাখা যাবে না ওকে।
নিচ থেকে দ্বিতীয় ড্রয়ারটাতে আবার প্রচ- আরশোলার উপদ্রব। ফ্রক বের করে পরার আগে মিষ্টি ভালো করে ঝেড়ে নেয় আগে। কালো কালো শুকনো আরশোলার বিষ্ঠা ছড়িয়ে থাকে মেঝেতে। এই বিষ্ঠা মিঠু’র পেটে গেলে নির্ঘাত ডায়রিয়া হবে। এর ঠিক উপরের ড্রয়ারেও আরশোলা হানা দেয়, তবে প্রতিদিনের পরার জামা সেখানে থাকে বলে খুব বেশি বিষ্ঠা জমেনা ওখানে। তবে সমস্যা হচ্ছে ওটাতে মিঠু প্রসাব করলে নিচের দুইটা ড্রয়ারেও চলে যাবে। অনেক চিন্তা করে মিষ্টি পলিথিন কেটে, আর ভাত ডলে ডলে আঠা বানিয়ে একটা ব্যাবস্থা করে ফেলে। হাফপ্যান্টের মত করে পলিথিন প্যাঁচিয়ে দিলেই নিশ্চিন্ত। কিছুক্ষণ পরপর দেখলেই হবে পলিথিনে মূত্র জমেছে কিনা। কোনো জামার সাথে প্র¯্রাবের মাখামাখি হওয়ার চিন্তা থাকবে না।
কত বড় একটা আবিষ্কার করে ফেলেছে সেটা মিষ্টি প্রথমে বুঝতে পারেনি। আগে ঝড়ো বৃষ্টি হলে বোনটাকে আগলে রাখতে বেশ বেগ পেতে হত তাকে। এখন ড্রয়ারে রেখে ড্রয়ারটা বন্ধ করে দিলেই খালাস। একটু অবশ্য ফাঁকা রাখতে হয়, না হলে দমবন্ধ হয়ে মরে যেতে পারে। তবে বৃষ্টির জলের একটা অণুও মিঠু’র গায়ে লাগার সম্ভাবনা নেই। আবার ওখানে রেখেই পানি গরম করা, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া, কিংবা ছাদে একা একা এক্কাদোক্কা খেলা সব সহজ হয়ে গেছে।
দুই দিনের দিন মিষ্টি কুসুমকে বলে তার কীর্তির কথা। কুসুম শুনে অবাক হয়।
‘কী কস তুই? পইড়া গেলে’?
‘পড়ব ক্যামনে? এইটাতো নড়েও না, চড়েও না। চিত হইয়া হুইয়া থাকে সারাদিন’।
‘দম বন্ধ হইয়া মইরা যায় যদি’?
‘তোমারে কইছে? আমি একটু ফাঁক রাখি বাতাস যাওয়ার লেগা। দম ঠিকই নেয় মিঠু’।
‘ফাঁক রাখস, আরশোলা ঢুকবোতো ভিতর। হাইগা নষ্ট করব সব’।
‘তুমি তো লাগাইয়া রাখো, তারপরও আরশোলা আটকাইতে পারছো? আমি বরং বইয়া বইয়া আরশোলা মারি। তুমি ড্রয়ার খুঁইজা দেখো। আরশোলা পাইবা না একটাও। কালো গু’ও নাই। সবকিছু আমিই পরিষ্কার কইরা রাখি’।
‘মুত লাইগা কাপড় গান্ধা হইয়া গেলে কিন্তু তোর বাপে চিল্লাইবো। আর হাগলে কী করছ তুই’?
মিষ্টি তার মাকে পলিথিনের ন্যাংটির মত জিনিসগুলো দেখায়। এই দেশে পলিথিনের মত সহজলভ্য বস্তু আর নেই। মানুষজন ইচ্ছেমতো পলিথিন ব্যবহার করে আর ফেলে দেয় যেখানে সেখানে। বন্যার জলে সেই পলিথিন ভেসে আসে। নিচে নামলেই শত শত পলিথিন। মিঠু’র পলিথিনের ন্যাংটিও তাই অসংখ্য। এতক্ষণে কুসুমের মুখে স্বস্তির হাসি আসে। সে এর মধ্যে বিকেলেও কাজ নিয়েছে। মেয়েটা না থাকলে, এত বুদ্ধি না থাকলে সমস্যায়ই পড়ে যেত সে।
দুই সপ্তাহেও বন্যার জল নামার নাম নেই। আয়নাল সেদিন বলছিল বন্যা এবার রেকর্ড করছে। এত বেশি দিন জল জমে থাকার নজির নেই গত ত্রিশ বছরে। তাদের সমস্যা হচ্ছে এই জল বদ্ধ জল। সহজে নামবে না। ছাদে বসবাস তাই চলতেই থাকে। সেদিন দুপুরের দিকে মিষ্টি নেমেছিল প্রাকৃতিক কাজ সারতে। একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। এসে প্রথমেই ড্রয়ারে দেখতে গিয়েছে মিঠু প্রস্রাব করেছে কিনা। ড্রয়ার টান দিতেই সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। কালো একটা বিড়াল গুটিসুটি পাকিয়ে শুয়ে আছে মিঠু’র ঠিক পাশেই। ওর চিৎকার শুনেই এক লাফ দিয়ে পালালো চতুষ্পদ জন্তুটা। বিড়ালটা এলো কিভাবে? ওরা কি সাঁতার জানে? নাকি নিচের ঘরেই লুকিয়ে ছিল? এসব ভাবতে ভাবতেই সে মিঠু’কে কোলে নিয়ে উলটেপালটে দেখে। কামড় দেয়নি তো জানোয়ারটা? এই বোকা পিচ্চিতো কাঁদেও না। অক্ষত মিঠু’কে দেখে মিষ্টি হাফ ছেড়ে বাঁচে।
মিষ্টি দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। এত শত্রু চারদিকে। ইঁদুর, আরশোলার সাথে যোগ দিয়েছে বিড়াল। এত শত্রু থেকে বেঁচে থাকতে হয় মানুষকে। এটাই বাস্তুতন্ত্রের আদি সূত্র। এদের চেয়ে বড় শত্রু বন্যার জল। মিঠু ঘুমিয়ে গেলে মিষ্টি ছাদে বসে দেখে চারদিক। তাদের ছাদটাকে মনে হয় দ্বীপের মত। আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে। বৃষ্টি হবে যেকোনো সময়। মিঠু’কে আরেকবার দেখতে আসে সে। ঘুমিয়ে আছে লক্ষ্মী হয়ে। ভালো করে পলিথিন প্যাচিয়ে আবার আসে সে ছাদের কিনারায়। তাদের ঘরের সামনে একটা নৌকা ভিড়েছে। নৌকায় মাঝির সাথে একটা লোক। লোকটাকে ভালো করে চিনে মিষ্টি। চৌধুরী, ওদের বাড়ির মালিক। বিড়াল দেখার চেয়ে বেশি চমকে উঠে মিষ্টি। আতঙ্ক গ্রাস করে এগারো বছরের একলা মেয়েটাকে।
গত শীতের কথা। ওদের ক্লাসেই পড়ত সোনিয়া। বরপা’র এক বস্তিতে থাকত ওরা। একদিন রাতে হইচই পড়ে গেল। সন্ধ্যা থেকে পাওয়া যাচ্ছে না মেয়েটাকে। এদিকে সেদিকে কত খোঁজাখুঁজি হলো। মসজিদের মাইকে মাইকে ঘোষণা হলো। ‘একটি নিখোঁজ সংবাদ। সোনিয়া নামের একটি দশ-এগারো বছরের মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটি দেখতে ফর্সা, চেহারা গোলগাল। উচ্চতা চার ফুটের কাছাকাছি। মেয়েটির পরনে ছিল লাল ফ্রক আর সবুজ পায়জামা। কোন সহৃদয় ব্যক্তি সোনিয়াকে খুঁজে পেলে কাছাকাছি যেকোনো মসজিদের ইমামের সাথে যোগাযোগ করবেন’। মাঝরাতে খুঁজে পাওয়া গেলো মেয়েটাকে। সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ভাগাড়ের পিছনে পড়ে ছিল নিথর দেহ। গায়ে একটা সুতোও নেই। পেশাবের জায়গাটা রক্তাক্ত আর ফোলা। জনস্রোতের সাথে দৌড়ে মিষ্টিও চলে গিয়েছিল সেখানে। রক্তাক্ত, ফোলা আর ছিঁড়ে যাওয়া পেশাবের রাস্তায় মাছি উড়ছিল ভনভন করে। সাথে সাথে বমি করে দিয়েছিল সে।
সে রাতে কাঁপিয়ে জ্বর আসে মিষ্টি’র। এরপরে আর কিছু মনে নেই। পরে শুনেছিল রাতে পুলিশ এসেছিল। ওর চাচাতো এক ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সোহাগ ভাই। ওকেতো চিনে মিষ্টি। ক্লাস নাইনে থাকতেই স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল। গত ঈদে সোনিয়ার সাথে ওকেও আইসক্রিম কিনে দিয়েছিল। সেই সোহাগ ভাই এমন করে সোনিয়াকে ‘মারল’। এমন বিবস্ত্র করে ‘মারা’কে কী বলে জানত না সে। ক্লাসের ইঁচড়ে পাকা কয়েকটা মেয়ে ওকে পরে বুঝিয়ে বলেছে। এটাকে বলে ‘ধর্ষণ’। পুরুষ মানুষ খুব ভয়ঙ্কর ধরণের জন্তু। একলা পেলেই এরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েদের উপর। ছিঁড়েফুঁড়ে রক্তাক্ত করে ফেল দিয়ে যায় আবর্জনার ভাগাড়ে।
চৌধুরী লোকটাকে মিষ্টি ভয় পায় খুব। যে কয়বার ওদের এখানে এসেছে মিষ্টিকে আদর করেছেন তিনি। প্রতিবার বুকের এখানে আঙুল দিয়ে টিপে দিয়েছেন। ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়েছে মিষ্টি। ওর বাবা আর মা দেখেনি এসব। জানেনা কিছুই। শেষবার সিঁড়িতে মিষ্টিকে ডেকে নিয়ে আঙুল দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়েছিল ওর পেশাবের রাস্তার উপরে। কুসুম লোকটার কথা উঠলেই বলে, ‘খানকির পুত একটা লুইচ্চা। নজর খারাপ শুয়ারের বাচ্চার’। ‘লুইচ্চা’ কথাটার মানে ততোদিনে শিখে গিয়েছে মিষ্টি। ওর মা কিভাবে জানে এসব? ভেবে কূল পায়নি মিষ্টি। ওর মা’কেও চৌধুরী ‘আদর’ করেনিতো? সেও তো একটা মেয়ে মানুষ।
আজ বাসায় মা’ও নেই, বাবা’ও নেই। সিংহের সামনে একলা খরগোশের গল্পটা জানে মিষ্টি। সে ভয়ে কাঁপতে থাকে। সোনিয়ার চেহারা বারবার চোখে ভাসে তার। দুই মাস সে ভাত খেতে পারেনি। ভাতের বাসনের সামনে মাছি দেখলেই মনে হতো এই বুঝি সোনিয়ার পেশাবের রাস্তা চেটে এসেছে। বমি আসত মুখ ভরে। সে যেন কানে শুনতে পায় সেই ভনভন শব্দ। নাকে ভেসে আসে ভাগাড়ের গন্ধ। শরীরে স্পর্শ পায় ভয়ঙ্কর কোন বিষাক্ত আরশোলার।
চৌধুরী মই বেয়ে চলে আসে ছাদে। আয়নালকে সে দেখে এসেছে অটো চালাতে। কুসুম নেই সেটাও জানে ভালো করে।
‘মিষ্টি মামনি, ও মিষ্টি মামনি। কই গেছো আম্মা? তোমার জন্য চকোলেট আনছি। খাইবা না। ক্যাডবারি চকোলেট। চুইষা চুইষা খাইতে হয়। কই পলাইছো আম্মা’?
ওয়োরড্রৌবের পাশের লম্বা খুপরিতে লেপ আর মশারির ভাঁজে লুকিয়ে আছে মিষ্টি। ভয়ে তার বুক কাঁপছে। চৌধুরীর প্রতিটা পায়ের শব্দ, শ্বাসের ফোঁসফোঁস শুনতে পাচ্ছে সে। পাশের মিঠু’র ড্রয়ারটাও সে বন্ধ করে দিয়ে এসেছে। দম হয়তো বন্ধ হবেনা। কিছুটা বাতাসতো আছেই। বিড়াল, ইঁদুর আর আরশোলার মত জন্তুদের উপদ্রবের কথা সে ভুলেই গেছে।
একটা দোপেয়ে, মানুষের মত দেখতে জঘন্য অশ্লীল এক জানোয়ার গর্জন করছে তার কয়েক হাতের মধ্যে। পৃথিবীটা খুব ছোট হয়ে আসছে মিষ্টি’র। প্রতিটা সেকেন্ডের ভগ্নাংশে সে কুঁকড়ে যেতে থাকে।
মাতুয়াইল, ঢাকা।