ঘটনাক্রমে মানুষ এবং আমুর একজীবন
ইয়াকুব শাহরিয়ার
আমি একটি অবরুদ্ধ ঘোড়া কিংবা সাদা কবুতরের মতো। কথাটি কেনো বললাম তার একটু ঘোর থেকে যাক্। চালাক কিংবা ‘সমজদার’ পাঠকেরা সেটা বুঝে নিবেন নিজ দায়িত্বে। নিজেকে নিয়ে ইদানিং আমি যা-তা মন্তব্য করে ফেলছি। আগ-পিচ কিছুই ভাবছি না। যেমনটি ভাবেননি বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, আইনজ্ঞ ও ‘টকিস্ট’ জনাব মিরা হামিদ। মিরা একটি মেয়েলি নাম কিন্তু এখানে মি. মিরা একজন পুরুষ। টকিস্ট মানে টকশোতে যিনি নিয়মিত কথা বলে থাকেন। একবার দেশের নামকরা সব সাংবাদিকদের সামনে বলে উঠলেন ‘কিছু মানুষ ঘটনাক্রমে মানুষ হয়ে জন্মেছেন, হয়তো তার পশু হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কোনো এক ঘটনার পটভূমিতে তিনি মানুষ হয়ে জন্মেছেন। বর্তমানে তার অবয়ব টিক মানুষের মতো। হতে পারে তার পেশাগত পরিচয় শিক্ষক, সাংবাদিক কিংবা ডাক্তার। কিন্তু সে মানুষ। তার হাত আছে। পা আছে। মাথা, মাথার চুল, বড় বড় গোঁফ, পাওয়ারফুল চশমা অনেক কিছুই আছে। আর এসব কারণেই সে মানুষ।’ মাথায় মগজের জায়গায় যদি ‘মানুষের বিষ্টা’ অথবা গোবর থাকে তাও সে মানুষ। মি. মিরা’র অনেক কথাই কানে এসেছিলো সেদিন, কিন্তু একটি কথা আমার কানে আজও বাজে। ‘মানুষ কখনো কখনো ঘটনাক্রমে মানুষ হয়ে জন্মায়।’
আমার মনে এসব দর্শন তত্ত্বের কথাবার্তা উদ্রেক হওয়ার কোনো কথা না। আমি সাধারণ একজন মানুষ। চৌহাট্টায় বসে থাকি। রিকশা গুনী। মানুষের হাটাহাটি দেখি। লেবু মিয়ার আদা-চিনি মিশ্রিত রং চা খাই। চায়ে হাল্কা লবণের ফ্লেভার থাকে। কুকুর দেখি। মাঝে মাঝে মানুষ দেখি। আমার দেখার শেষ নেই। দেখতে দেখতেই আমি ক্লান্ত প্রাণ এক। দার্শনিক চিন্তার সময় কোথায়? মাঝে মাঝে ভাবি বই পড়বো। কখনো ভাবি পত্রিকা পড়বো। কিছুই করা হয় না আমার। এই ভাবনা পর্যন্তই আটকে থাকে আমার ভাবনার জগত। আবার কখনো চিন্তা করি ‘মাস্টার সাহেব’ হয়ে যাই। পরক্ষণেই আবার এই চিন্তা থেকে বেড়িয়ে আসি। এ পেশায় যাওয়া যাবে না। এই পেশার অনেক ওজন। যাচ্ছে তাই মানুষ মাস্টারিতে গেলে পেশার ওজন কমে। তাই আমার মতো পাতলা মানুষ ভারী এ পেশায় যাওয়া যাবে না। যেমন-তেমন নীতি হীন বা লাজ লজ্জাহীন মানুষ এই পেশায় ঢুকেছে বলেই পেশাটার এমন দশা! নীতিনৈতিকতার স্খলন ঘটেছে মাতরাত্মকহারে, ছাত্ররা শিক্ষক পেটায়। তাই ভাবছি এই পেশায় যাওয়া যাবে না। আমি বরং চৌহাট্টাতেই বসে থাকি। এখানে বসে গান গাই, রিকশা গুনী। লেবু মিয়ার রং চা খাই।
হঠাৎ করে বিমানের স্পীডের মতো ধুম করে আমার সামনে এসে একটি রিকশা থামলো। রিকশাটির হুড তোলা ছিলো। রিক-াবী বাজারে দিক থেকে এসেছে। হুড ফেলে রিকশাতে থেকেই কুসুম বলছে ২৫ টাকা দাও। আমার কাছে টাকা আছে কিন্তু বললাম নাই। মন মরা হয়ে বসে আছি। ড্রাইভার মামা ২ শ’ টাকার নোট ভাংতি করে ৩০ টাকা রেখেছে। কুসুম এসেছে নবাব রোড থেকে। কুসুম আমার প্রেমিকা। আমাকে সে ভালোবাসে আবার বাসে না। আমিও তাকে ভালোবাসি আবার বাসি না। এসব কথার মানে হয় তো সাধারণ পাঠকরা বুঝবেন না। যারা বুঝেন তারা অস্বাধারণ পাঠক। ঊর্ধ্ব শ্রেণিক পাঠক হওয়ার জন্য তাঁদেরকে একটি বিশেষ সম্মাননা দেওয়া উচিৎ, তবে আমি দিতে পারবো না। কারণ আমার টাকা নাই। টাকা ছাড়া কি আর সম্মাননা দেওয়া যায়? আমার প্রথম এবং দ্বিতীয় সত্তা বলবে, সম্মানের প্রশ্নে টাকা কোনো কিছুতেই মেটার করে না। কিন্তু মি. মিরা হয়তো টাকাকে প্রাধান্য দেবেন। কারণ তিনি আইনজ্ঞ কিন্তু মিথ্যা ছাড়া আদালতে তার দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। তিনি বুদ্ধিজীবী তার মানে তিনি মিথ্যা কথা প্রায় বেশিরভাগ সময় শিল্প রূপ দিয়ে বলেন। তিনি টকিস্ট মানে টাকার বিনিময়ে কোনো একটি পারপাস তিনি সার্ভ করেন। স্বার্থ হাসিল করে টিভি টেলিভিশনে এসে জাতিকে ছাত্র বানিয়ে দক্ষ শিক্ষকের মতো তিনি নৈতিক কথাবার্তার আড়ালে অনৈতিকতার চাষবাস করেন। মি. মিরা’র মতো টাকা হলে আমি দক্ষ পাঠকদের পুরষ্কৃত করবো।
কুসুম আজ আর থাকবে না। আমার হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে চলে যাবে। আমি তাকে যেতে দিবো না। কারণ সে আজ আমার পছন্দের নীল শাড়ি পড়েছে। হাতে নীল চুড়ি, খোঁপায় গাঁদাফুলের মালা। পায়ে কিছুটা হাই হিলের জুতা। আজ তাকে অসম্ভব সুন্দরী লাগছে। হাতে আল মাহমুদের সোনালী কাবিন। পড়েছে কি না সে কথা জানি না। এ যুগে এসে মেয়েরা বই নিয়ে হাটে ভাবতেও ভালো লাগে। কুসুম মি. মিরাকে পছন্দ করে না। কারণ বুদ্ধিজীবী টাইপের এই লোকটা আসলে বুদ্ধিজীবী না। খাটাশ। খাটাশ একটা গালি। বেতালা রকমের অপমানজনক ভদ্র গালি। আরো অনেক ভালো মানের গালি আছে কিন্তু সব গালি সবাইকে দেওয়া যায় না। যেমন ধরুন, কুকুর। কাউকে কুকুর গালি দিলে কুকুর জাত খুশি হয়। কিছু বলে না। কিন্তু মি. মিরা টাইপের খাটাশ প্রকৃতির ছদ্মবেশী লোকদের কুকুর গালি দিলে শহরের কুকুরগুলো আবার প্রতিবাদ করে উঠবে। বলবে, আমরা নিকৃষ্ট প্রাণি হতে পারি, কিন্তু কিছু কিছু মানুষের চেয়ে আমরা ভালো। তাদেরকে গালি দিতে চাইলে আমাদের সাথে তুলনা করতে পারবেন না।
কুসুম দাঁড়িয়ে আছে। আমি রিকশা মামাকে ডাক দিলাম। দু’জন উঠে বসলাম রিকশায়। হুড তুলতে চাইলাম কিন্তু কুসুম তুলতে দিলো না। আমাদের রিকশা ছুটে চললো দাড়িয়ার পাড়ার ছোট গলি হয়ে ক্বীনব্রিজের দিকে। সেখানে সুরমাপাড়ে বসে সুরমার গোলা পানিতে দেখবো তথাকথিত স্বচ্ছ মানুষদের নোংরা চেহারা। কুসুম তখন গপাগপ পুচকা গিলতে থাকবে। আমি মনের বেখেয়ালি হয়ে চটপটি খেতে থাকবো। কারণ, আমি মনে করি পুচকা মেয়েলি খাবার আর চটপটি পুরুষালি। অনেক কিছুরই কারণ থাকে না। আমরা এই ভাবনারও কোনো কারণ নেই।
সুনামগঞ্জ