আমি রনাঙ্গণের কথা বলছি



আমি রনাঙ্গণের কথা বলছি
ইকরামুল হাসান শাকিল

রমজানের প্রথম প্রহর। চারপাশ অন্ধকার। এখনো মুয়জ্জিনের কণ্ঠে ফজরে “আল্লাহু আকবার” ধ্বনী উচ্চারিত হয়নি। গ্রামের নিরীহ মানুষগুলো যে যা পারছে তাই দিয়েই রমজানের প্রথম সেহরী খাচ্ছে। ভয়ে কেউ বাইরে বের হচ্ছে না। আমরা আমাদের দীর্ঘ একটি রাত পার করছি আমাদের বয়ড়াতল ক্যাম্পে। ১নং কোম্পানী কমান্ডার লোকমান হোসেনের নেতৃত্বে যুদ্ধ করছি। রাত জেগে নানান পরিকল্পনা আর আর্মস্ প্রস্তুত করছি। আজ ভোরে বল্লা পাক আর্মি ক্যাম্পে আক্রমণ করবো। কোম্পানী কমান্ডার লোকমান হোসেনের নির্দেশ মতো আমির হোসেনের নেতৃত্বে আমরা ২৫ জনের একটি দল আক্রমণের জন্য প্রস্তুত।
আমির হোসেন পাক আর্মি হাবিলদার ছিলেন। তিনি সেখান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। নকিল বিলের খাল দিয়ে নৌকায় করে আমাদের বল্লার কাছাকাছি নামিয়ে দেয়া হলো। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে যাই। একটি দল পাক আর্মি ক্যাম্পের উত্তর পাশে গোরস্থানে পজিশন নেয়। অপর দলটি বেলাবাড়ি পজিশন নেয়। আমি ছিলাম বেলাবাড়ির দলে। আমাদের কাজ ছিলো, আমরা এ পাশ থেকে ডিফেন্স করবো। আর অপর দলটি উত্তর পাশ থেকে আক্রমণ করবে।
চারপাশ অন্ধকার। ফজরের আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে কানে। আমরাও প্রস্তুত। কমান্ড পেলেই ফায়ারিং শুরু করবো। আমাদের কাছে এল.এম.জি, রাইফেল, টু/থ্রি ইঞ্চি মর্টার, রকেট লংসার ও গ্রেনেড। আমার কাছে এল.এম.জি। আযান শেষে আমির হোসেন আমাদের কমান্ড দিলেন। আমরা ফায়ারিং শুরু করলাম। পাক সেনারাও পাল্টা ফায়ারিং করছে। চলছে তুমুল যুদ্ধ। চারপাশ গুলাগুলির শব্দে কাঁপছে। বারুদের গন্ধ আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছ।
আমাদের দলে আমিই সব থেকে কমবয়সী ছিলাম। সেই কারণেই হয়তো আমির হোসেন আমাকে তার পাশেই রেখেছিলেন। যাতে করে আমি সাহস পাই। ফায়ারিং করতে করতে হামাগুড়ি দিয়ে আমরা সামনে এগুচ্ছি। আমার বাম পাশে আমির হোসেন। হঠাৎ একটি বুলেট এসে আমির হোসেনের বুকের বামপাশে মিশে গেলো। সাথে সাথে তার শাদা শার্ট রক্তে লাল হয়ে গেলো। আমি তাকিয়ে দেখি আমির হোসেন আমার দিকে জলজ চোখে কি এক অমুগ বেদনায় তাকিয়ে আছে। আমিও ফায়ারিং থামিয়ে তার মাথা তুলে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি শুধু আমাকে একটি কথাই বললেন। ফায়ারিং।  
দু’পাশ থেকে আমরা আক্রমণ করছি। চারপার দিনের আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে। আজো পাখির ডাকে ভোর হলো। কোনো অনিয়ম নেই। গাছের পাতারা ভোরের শীতল বাতাসে গা দুলিয়ে দুলতে থাকলো আপন মনে। মনে হলো এরাও জয়ের আনন্দে মাতম করছে। যুদ্ধ থেমে গেলো। আমরা বল্লা শত্রুমুক্ত করে ফেললাম। ছ’জন পাক আর্মি মারা যায়, দু’জন আহত আর বাকিরা সবাই পালায়। আমরা জয়বাংলা ধ্বনিতে চিৎকার করে উঠলাম।
এই যুদ্ধে আমরা দু’জন সহযোদ্ধাকে হারায়। আমির হোসেন ও রকেটকে। দিনের প্রথম আলোতে বাংলার সবুজ ঘাস বারুদে পোড়া লাল রক্তে রাঙিয়ে সহযোদ্ধাদের প্রাণহীন দেহ কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলছি। যুদ্ধের এই কয়েক দিনে কত আপন হয়ে গিয়েছিলো তারা। আগে কারো সাথেই পরিচয় ছিলো না। আর আজ বুকের ভেতরটা ভাই হারানোর ব্যাথায় নিরব অশ্রুক্ষরণ করছে। যুদ্ধ ক্ষেত্র বলে চিৎকার করে কাঁদতে পারছি না। শুধু প্রাণহীন দু’টি দেহ নিয়ে ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে চলছি। কুয়াশা ভেজা সকালে আমরা বেতুয়া চলে আসি। এখানেই তাদের সমাহিত করে  আবার ক্যাম্পে চলে এলাম।   
দশম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় ১৯৬৬ সালে আয়ুব বিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতিতে ঢুকে পরি। তখন থেকেই মিটিং মিছিলে যুক্ত হই। এই মিটিং মিছিল আন্দোলনের কারণে পড়া-লেখার উপর প্রভাব পরে। সেজন্য বাবা-মার অনেক কথাও শুনতে হয়েছে। স্কুল জীবনেই যেহেতু ছাত্র রাজনীতি করেছি। কলেজে এসে থেমে থাকি কি করে। যেখানে পাকিস্তানীদের শাসন-শোষণে, বৈশম্যের স্টীমরোলার চলছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ছোট্ট দেশটির উপর। সেখানে চুপ করে বসে থাকি কি করে? দেশটাতো আমার। তাই দেশকে রক্ষার দায়িত্বও আমার। তাই প্রতিবাদ করতে হলে রাজনীতি বাধ্যতামুলক। একা কোন বৃহত্তর স্বার্থের আন্দোলন হয় না।
শুরু হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার সোনার ছেলেরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে এলো মায়ের আঁচল থেকে, বেরিয়ে এলো প্রিয়তমা স্ত্রীর ভালোবাসা থেকে, বেরিয়ে এলো বাবা সন্তানের ভালোবাসা থেকে, বেরিয়ে এলো নারী দেশকে ভালোবেসে। তেমনি করে সেদিন আমিও ঘর থেকে বাবা মা ভাইবোনদের রেখে বেরিয়ে এসেছিলাম। বসে থাকতে পারি নাই। যদিও প্রথমে আমি আমার পরিবারে না জানিয়ে পালিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। কিছুদিন পর ফিরে এসে আবার পরিবারের অনুমোতি নিয়েই গিয়েছিলাম যুদ্ধে।
অনেক দিন হলো যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। মা বাবাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কমান্ডার লোকমান হোসেনকে বাড়ি যাওয়ার কথা বললাম। আমাদের কোম্পানীতে আমিই বয়সে তরুণ ছিলাম। লোকমান হোসেন আমার পিঠ চাপড়ে মুচকি হাসি হেসে বলো যাও। তবে সাবধানে যেও। আমি রাতে বাড়ি এলাম। আমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ছিলো। তবে সেদিন গলা ছেড়ে কাঁদতে পারেনি মা। তার চেপে রাখা সেই কান্নার মধ্যে যে কষ্ট ছিলো তা আমাকে আরো সাহসী করে তুলেছিলো। মা তার আঁচল দিয়ে আমার মুখের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলেছিলো-“আমি তোমার এই স্বাধীন দেশ দেখেই যাবো।”
একবার আমরা চাপরি বাজারে আক্রমণে যাই। সেখানে যাওয়ার আগেই রাজাকাররা খবর পেয়ে যায়। তাই আমরা সেখানে সফল হতে পারি নাই। পরে যুদ্ধ শেষের দিকে সেখানে থাকা তিনজন রাজাকারকে আমরা বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মায়ের কাছে ফিরে আসি। আমার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমানও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসে।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট