নীলচে ফড়িং
সুজন সাজু
রুমার আজকে কেন জানি অন্যরকম লাগছে। মনের ভিতর কে যেন তাড়া দিচ্ছে। কে আবার সেই? কাউকে কিছু বলতেও পারছেনা খুলে। মা, টাও কেন জানি কিছু বললে পছন্দ মত উত্তর পেয়ে মনকে একটু হালকা করবে তেমন নই। আরো উল্টো বকাঝকা শুরু করে দেবে। এই ভয়ে নিজেকে একাকীত্বে আবদ্ধ রাখতেই সাচ্ছন্দ বোধ করে। মাকে যা কিছু বলে না কেন, উনার শাসন বার্তা হরহামেশা শুনেই থাকে রুমা। সেই নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, আচ্ছা সব মা কি এমন হয়? আবার নিজেই উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করে, আসলে সব মা-বাবাই চায় সন্তানের মঙ্গল কামনা। আরে বাবু, ভালো চায় তো বুঝলাম, তাই বলে কী বনের পশুর মত কাছা ঘরের মতো বন্দী থাকা? মেয়ে বলে কী স্বাধীনতা শব্দটা আমার ব্যবহারের উপযোগ্য নয়? এমন কত হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ইয়ত্তা নেই। সবে মাত্র এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছে রুমা। কখন পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে ? তারপর পাশ করলে, কলেজে ভক্তির পর বাইরের মুক্ত হাওয়ায় নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পাবে,এই ভরসায় প্রতিক্ষার প্রহর গুনছে রুমা। বাবা পড়ানোর আগ্রহী হলেও মা কিন্তু বাবাকে না পড়ানোর উৎসাহটা দিতে কার্পণ্য করে না সবসময়। শেষ পর্যন্ত জানি না কে জয়ী হয়। মা জয়ী হলে তো আরো স্থায়ী সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা রুমার। আর বাবা জয়ী হলে তো কথায় নেই। তবে রমার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত বাবাই এগিয়ে থাকবে। কারণ বাবা যেটা ভালো মনে করে ওটা করতে পিছ পা হয়না। বাবার এ গুণটাই রুমাকে আশান্বিত করছে। বাবার লেখাপড়ার চেয়ে মা’র বেশি, বেশি মানে মা এইচ এস সি শেষ করেছে। বাবা কিন্তু এস এস সি ও শেষ করেনি। তবুও মেয়েকে লেখাপড়ার দিকে ধ্যান ধারনার লক্ষণটা বাবারই বেশি। মাঝে মাঝে অন্য রকম প্রশ্ন জাগে রুমার মনে। মা, এতটুকু লেখাপড়া করলেও কেন তিনি মেয়েকে বেশি লেখাপড়া করার আগ্রহী নয়? হতে পারে উনার শিক্ষা জীবনে কোন অপছন্দনীয় অনাকাক্সিক্ষতস্মৃতি জড়িয়ে আছে। হয়ত কোন আঘাতের ফল উনার ভিতর জমাট বেঁধে আছে। যেই আঘাত উনার মেয়েকে বিদ্ধ করতে না পারে, এমনটাই কাজ করছে মা’র ভিতর।মাকে এমন কিছু জিগ্যেস করার মত সাহস তৈরী হয়নি রুমার। শুধু এটি নীরব ভাবনা হয়ে দোলা দেয় রুমার হৃদয়ে। আর রুমা তো এমন কিছু করেনি যে, যার অপরাধে অপরাধী হিসাবে বিবেচনায় আনবে মা-বাবা। নিজে সবসময় পরিশুদ্ধ থাকতে চেষ্টা করেছে। অন্য বান্ধবীদের দেখেছে ছেলে বন্ধুদের সাথে ছুটির পর কত আনন্দ করে ঘুরে বেড়াই। নিজের ইচ্ছে হলেও সেদিকে কখনো পা বাড়ায়নি রুমা। সোজা ঘর আর স্কুলেই সীমাবদ্ধ ছিল স্কুল জীবনটা।তবুও মা’টা কী ভাবছে, বোধগম্য নয় রুমার কাছে। স্কুলের সহপাঠি শুভ নামের এক বন্ধুকে ভীষণ ভালো লাগে রুমার। কিন্তু এই ভালো লাগাটা কখনো প্রকাশ করেনি রুমা। শুধুমাত্র মনের কোনেই জমা করে রেখেছে এই ভালো লাগাটা। শুভ এবার পরীক্ষা দিয়েছে একই সাথে। হয়ত উপরের ক্লাসে উঠলে শুভ ও থাকবে একই ক্লাসে। কাছাকাছি দেখবে, আনন্দ করবে ঘুরে বেড়াবে আরো কত কী স্বপ্ন। স্কুলের অন্য বান্ধবীরা এই নিয়ে কত না ঠাট্টা মসকরা করত। সেই দিকে কোন কর্ণপাত করত না রুমা। শুধুমাত্র মা-বাবার কাছে অভিযোগ যাবার ভয়ে। কিন্তু শুভকে যে কত ভাল লাগে তা খুলে বলার মত মাধুর্র্য ভাষা রুমার কাছে জানা নেই। শুধু শুভর ভালোবাসাটাই নীরবে লালন করেছে বুকে। এদিকে পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। যদি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট হয়,তখন বাবার ইচ্ছায় আবারও কলেজে ভর্তি হবে। পরীক্ষা সবই ভালো হয়েছে, পাশ না করবে এমন নই।তবুও একটু ভয় জাগছে মনে। বাড়ি থেকে মাইল দুয়েক দূরত্ব কলেজের। স্কুল আর কলেজ জীবনটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। স্কুলে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হয়েছে শিক্ষকদের ভয়ে। কলেজে তো সেই ভয় নেই। তবুও নিজে যে, ভুল পথে পা বাড়াবে এমন কোন ভাবনা মাথায় কাজ করছে তেমনও নয়। নিজের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে এটাই। কাল বিকেলে পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ হবে। মনের ভিতর কেমন জানি লাগছে। সেদিন বাবাকে বলতে শুনেছে, মেয়ে তো এবার কলেজে পড়বে। খরচটা একটু বাড়বে। উত্তরে মা বলল, কী দরকার আর পড়ানোর? ভালো একটা পাত্র দেখে বিয়েটা সেরে ফেললেই ভালো। আজকাল সময়টা সকলের পক্ষে দাঁড়ায় না। বাবা বললো, বিয়ে তো দিতে হবে এটা জানি। মেয়েকে যদি সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি,তাহলে সেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা কুটি পাবে। নিজের মনোবল শক্ত থাকবে। এই যে তুমি বললে, সময়টা আজকাল সবার পক্ষে না। ভালো পাত্র দেখে দেব আমরা।কিন্তু কর্মের ভাগিদার তো সৃষ্টিকর্তা। মা বললো তোমার যা খুশি। এটা শোনার পর রুমার ভিতর একটা আনন্দ কাজ করছে। তাহলে বাবার কথায় থাকবে। আজকে রেজাল্ট দেবার কথা, রুমা স্কুলে যায়নি। পাশ্ববর্তি অন্য একজন সুখবরটা নিয়ে এলো,রুমা ৪.২ পেয়েছে। খুশি আর রাখে কই? রুমার মা’র মেয়ের পাশের খবরে তেমন কৌতুহল নেই। বাবা আসবে রাত্রে চাকরী শেষে। যদিও মিডিয়ার বদৌলতে পাশের খবর পেতে অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। বাবাই খুশিটা বেশি হবে। রাত যখন ঘড়ির কাটা আটের ঘরে পৌঁছে মিনিট বিশ হলো তখন ঘরের দরজায় টোকা পড়ল, রুমা দৌঁড়ে গিয়ে খুলে দিল দরজা। যদিও খবরটা আগেই জানল মোবাইলের কল্যাণে। তবুও নিজের মুখে বাবাকে বলা তো আনন্দের রুমার কাছে। বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম করে পাশের খবরটা বলল। ¯েœহের পরশে ভরিয়ে দিল মেয়েকে।মেয়েও বাবার আদরে খুশি। বাবা বলল, ভালো করে পড়ো, আরো ভালো করতে হবে তোমাকে। আপনার দোয়া থাকলে অবশ্যই পারব বাবা। তার মানে কলেজে যাচ্ছে রুমা। এটা বাবার কথায় বুঝতে কষ্ট হয়নি। পরদিন খবরটা অন্য বান্ধবীদের জানিয়ে দিল, সেইও কলেজে ভর্তি হবে। পাশাপাশি খবর নিল, শুভ’র কী অবস্থা ? শুভ এমনিই ভালো ছাত্র। এক বান্ধবীর কাছে শুনল শুভ নাকি শহরের এক ভালো কলেজে ভর্তি হবে। শুনে মনটা কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে গেল রুমার। তাহলে যাকে নিয়ে এত স্বপ্ন তাকে আর কাছে দেখার সুযোগটা হচ্ছে না। পাশ করার আনন্দের চেয়ে শুভর এই খবরে বেদনার কাঁটাই বিদ্ধ করল হৃদয়ে। আহা, আমিও যদি শহরে ভর্তি হতে পারতাম শুভর মতো। কী না আনন্দ হতো। রুমার ভিতর শুভর ভাবনাই কাজ করছে বেশি।কী আর করা,কিছুই করার নেই। ঠিক ঠিক একদিন কলেজে যাবার পথে শুভর সাক্ষাত মিলল। আগে দুই একবার কথা হলেও দূরত্ব বজায় রাখতো রুমা। আজকে সরাসরি জিগ্যেস করলো শুভকে,তুমি নাকি শহরে ভর্তি হচ্ছো। কে বলল তোমাকে?শুনছি। শুভ বলল, বাবা বলল শহরে ভর্তি হতে। আমার ইচ্ছা এখানেই ভর্তি হওয়ার।ভালো এখানেই হও। দেখি,বাবার ইচ্ছাকেও তো প্রাধান্য দিতে হবে। তা ঠিক। কলেজে ক্লাস শুরু হবে কিছু দিনের মধ্যেই। ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ। ক্লাস শুরুর প্রথম দিন ক্লাসে যায়নি রুমা। দ্বিতীয় দিন কলেজে গিয়ে রুমা আচমকিত! দেখে শুভ ক্লাসের টেবিলে বসা। তাহলে শুভ এখানেই ভর্তি হলো ? জিগ্যেস করলে শুভ উত্তরে বলল,শহরে খরচের টাকাটা বেশি,শেষ পর্যন্ত বাবা বলল, এখানেই ভর্তি হতে। ভালো, শুভ ভালো। হাসে রুমা, হাসে শুভ। এভাবে হাসাহাসিতে কেটে গেল বছর। একদিন শুনতে পেল রুমাকে দেখতে আসবে ইতালী প্রবাসী এক পাত্র। মায়ের ইচ্ছে বিয়েটা দ্রুত শেষ করে ফেলতে হবে। পাত্র দেখে রুমাকে পছন্দ করে ফেলল। শুনে চোখে অশ্রু ঝরাচ্ছে রুমা। স্বপ্ননা অধরা’ই থেকে গেল ।