গল্প : সে কি ভার্সিটির মেয়ে?


 সে কি ভার্সিটির মেয়ে?
সিরাজ অনির্বাণ

পৃথিবীতে মানুষের সহযোগিতায় মানুষ ধর্ম-কর্ম সবকিছুতেই প্রেরণা লাভ করে থাকে। এক মানুষ অন্য মানুষকে পথ দেখায়, অজানাকে জানায় আবার দুর্বলকে করে সাহসী। এই পরিক্রমায় চলে আমাদের সমাজ। এখানে কারো সহযোগিতা ছাড়া কেউ কিছু করতে পারে না হোক সেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ।

রুবেল। মাথাগরম একটি ছেলের নাম। সে উল্টাপাল্টা কিছু দেখতে পারে না, সইতেও পারে না। কেউ তার সাথে অন্যায় বা অনিয়মের কিছু করলেই বাঘের মতো গর্জে ওঠে। গর্জে ওঠাই তার স্বভাব। এরই জন্য এলাকায় সে ‘বাঘা রুবেল’ নামে পরিচিত। তবে বাঘের মতো সে হিং¯্র নয়। অনেকে তাকে ‘বাঘাই’ বলেও ক্ষেপায়। ‘বাঘা রুবেল’ না বলে শুধু ‘বাঘাই’ বললে সে মাইন্ড করে। সহজ-সরল লোকগুলো একটুমোটা মাথাওয়ালা হয়। লোকের কথায় কখনো প্রচ- ক্ষেপে যায়।

বন্ধুদের মাঝে টিপু বেশ রহস্য জনক। মাঝে-মাঝে কোথায় যায়, কী করে রুবেল জানেও না। রুবেলকে সাথে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু তাকে একবারও নিতে পারেনি টিপু। আজ রুবেলকে সে এমন করে ধরেছে যে রুবেল তাকে ‘না’ করতে পারেনি।

রুবেল আর টিপুকে নিয়ে রিকশা গিয়ে একটি বহুতল ভবনের নিচে থামে। রুবেল রিকশা থেকে নেমে আশপাশে তাকিয়ে বলে, ‘কীরে এ কোথায় নিয়ে এলি?’টিপুর হাস্যোজ্জ্বল জবাব, ‘আরে চল। এখানে আমার এক ফ্রেন্ড ঢাকা থেকে এসেছে। ওর সাথে দেখা করব।’

রুবেলের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায় টিপু। লিপ্টে করে তারা উঠে যায় পাঁচতলায়। দুইজন সুপারভাইজার রয়েছে ওখানে। তারা পুরো ফ্লোর দেখাশুনা করে। পুরো ফ্লোরে বিশটা রুম।তাদের দুইজনের সাথেই টিপুর খুব সখ্য। এখানে নতুন মেহমান আসামাত্রই তারা টিপুকে জানায়। টিপুও তাদের ডাকে এখানে এসে সময় কাটায়।তারা টিপুকে পেয়ে খুশি হয়। হাতে হাত মেলায়। সুপারভাইজার একজন টিপু ও রুবেলকে সাথে নিয়ে একটা রুমে ঢোকে।

এখানে রুবেল কোনোদিন আসেনি। তার কাছেরুমের ভেতরটা বিরক্তিকর মনে হয়। সুপারভাইজার ভেতরে গিয়ে ‘ঠিক আছে? আপনারা কথা বলেন, আমি বাইরে আছি’ বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রুবেল টিপুর সাথে ভেতরে ঢুকতেই খাটের ওপরে বসা এক সুন্দরী মেয়ে দেখতে পায়। মেয়েটি বেশ পরিপাটি। রুমের ভেতরে চেয়ার-টেবিল ও টিভি রয়েছে। খুব উন্নতমানের রুম। মেয়েটি দেখতে পরীর মতো।কাঁধ পর্যন্ত স্টাইল করে নায়িকাদের মতো কাটা চুল। পরনেতার লাল রঙের আটসাঁট সালোয়ার-কামিজ আর বুকের একপাশে পাতলা একটা ওড়নাতৈরি করেছে এক চৌম্বকীয় দৃশ্যের। টেবিলের ওপরে ডিগ্রি-ক্লাসের সমাজবিজ্ঞান ও দর্শনের দুইখানা বই এবং একটি ব্যাগপ্যাক পড়ে রয়েছে। ধবধবে সাদা বেডের ওপরে এক কোণায় পড়ে রয়েছে একটি কালো বোরকা, হিজাব ও কালো চশমা। মেয়েটি টিপুকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলে, ‘ভাইয়া কেমন আছেন?বসেন ভাইয়া।’

‘এই তো ভালো আছি। কেমন আছো শান্তা?’ টিপুর জবাব। শান্তা একটু নড়ে চড়ে বসে টিপুকে জবাব দেয়, ‘ভালো আছি ভাইয়া।’ টিপু রুবেলকে দেখিয়ে শান্তাকে  বলে, ‘আমার বন্ধু রুবেল। ভালো ছেলে। তবে একটু রাগী কিন্তু। খুশি করার চেষ্টা করবা, ঠিক আছে?’

এরপরেশান্তাকে দেখিয়ে রুবেলকে বলে, ‘রুবেল, ও শান্তা।আমার বান্ধবীর বোন। খুব ভালো মেয়ে। এখানে খুবই কম আসে। আমি তোর কথা বলাতে ও ঢাকা থেকে এসেছে। আশা করি তুই খুব দারুণ সময় কাটাবি।’

রুবেলের চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। কোনো কথা বলে না।টিপু রুবেলের কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘কী চিন্তা করছিস? খারাপ লাগছে? আরে খারাপ লাগার কিছু নেই। এই দেখ, কত সুন্দর জায়গা। এসি রুম। দেখেছিস কত সাজানো-গোছানো বিলাসী রুম! কত আরামদায়ক বেড! এখানে সবাই আসতে পারে না। এখানে আসতে পারাটাও ভাগ্যের ব্যাপার! আমার বিশ্বাস এখানে কিছুক্ষণ থাকলে তোর মনে কোনো বেদনা-ই থাকবে না। মাঝে-মাঝে বেদনা ভুলে যাবার সাধনা করতে হয়। এটা সেই সাধনা করার একটা জায়গা। এখানে সুখের শেষ নেই।’

রুবেল এবার মুখ খোলে, ‘আমি কি তোরে বলেছি আমার সুখের খুব অভাব? তুই আমারে সুখের কোনো এক জায়গায় নিয়ে যা।’
-‘ঠিক তা বলিসনি। তবে মৌ তোরে যে আঘাত দিয়েছে তা তো আমি জানি। বিনা দোষে তুই সে আঘাত সইতে না পেরে ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে মরে যাচিছস। কোনো কাজে মন বসাতে পারছিস না। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস না।বন্ধু হয়ে আমি তোর এই অবস্থা কেমনে দেখি বল? এবার তোর সব জ্বালাযন্ত্রণা দূর হয়ে যাবে। একবার এই সুখের সাগরে ডুব দিয়ে দেখ! আরে, মৌ এর থেকে শান্তা অনেক বেশি শিক্ষিত। মেলামেশা করলে উচ্চ শিক্ষিত মেয়েদের সাথে করতে হয়। ও কীসে পড়ে জানিস?’

-‘আমার জানার দরকার নেই টিপু। প্লিজ চল, চলে যাই।’

-‘আরে শোন। ও ভার্সিটির মেয়ে, অনার্সে পড়ে। এবছর সেকেন্ড ইয়ারে! একদম ফিটফাট! তোরে একদিন বলেছিলাম না, ভার্সিটি পড়–য়া মেয়েরা এ লাইনে অনেক আছে। তোরে বলেছিলাম, একদিন তোরে ভার্সিটিপড়–য়া এ লাইনের মেয়েদের দেখাব। এই দেখ সেই প্রমাণ! তুই তো আমার সে-কথা উড়িয়েই দিয়েছিলি। বিশ্বাসই করলি না। এবার নিজের চোখে দেখলি তো।’

শান্তাকে আবারো হাত দিয়ে দেখিয়ে দেয় টিপু।হ্যাঁ, ঘটনা সত্য। রুবেল মৌ’কে খুব গভীর করে ভালোবাসত। মৌ তাকে ফাঁকি দিয়ে রোমেনকে বিয়ে করেছে। মৌ রুবেলের ভালোবাসার মূল্যায়ন করেনি। সরলতার সুযোগে তার কাছ থেকে অনেক দামি গিফট, টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে গেছে। মৌ ছিল দুনিয়ার স্বার্থপর। স্বার্থপর এমন একটি মেয়ের কাছ থেকে প্রতারণার শিকার হয়ে রুবেল ভীষণ আঘাত পেয়েছে। নিজেকে শেষ করে দিতে তার মনে চেয়েছে বারবার। শুধু আত্মহত্যা মহাপাপ মনে করে তা করেনি। বিষণœদিনাগুলোতে টিপু তাকে সিগারেট ওরঙিন পানি খাইয়েছে।

একরাতে টিপুদের বাসার ছাদে টিপু ও রুবেল বসে গল্প করছিল। কথার মাঝে টিপু রুবেলকে  এ লাইনে ভার্সিটি পড়–য়া মেয়েদের কথা বলে। রুবেল বিশ্বাস নাকরে বলে, ‘ধুর, আমার বিশ্বাস হয় না, টিপু। আমার মনে হয় ওরা মিথ্যা বলে। কাস্টমারের কাছে নিজেদের দাম বাড়ানোর জন্য এটা হতে পারে ওদের চাপাবাজি।’

টিপু বলে, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে দোস্ত। তোরে আমি সরাসরি একদিন দেখাব। তাহলে বিশ্বাস করবি তো?’ রুবেল ‘ঠিক আছে’ বলে সেই গল্পে ইস্তফা দেয়। টিপু তার কথা রাখার জন্যই আজ রুবেলকে নিয়ে এখানে এসেছে। রুবেলের হাত ধরে টিপু শান্তার পাশে বসায়। শান্তা রুবেলকে বসতে বলে। রুবেল মুখ কালো করে পা ঝুলিয়ে খাটের ওপরে বসে। টিপু বলে, ‘বিল-টিলের কোনো চিন্তা করিস না। ওসব আমি দেখব, কেমন? তুই থাক।’

টিপু মুখে মৃদু হাসির রেখা নিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। মেয়েটি বেড থেকে উঠে রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে রুবেলের পিঠের ওপরে হাত রাখে। রুবেল শান্তার দিকে বেশ কয়েকবার তাকায়। এতো সুন্দর মেয়ে সে এর আগে আর দেখেছে বলে মনে হয় না। রুবেল সবকিছুবুঝতে পারে। শান্তা রুবেলকে বলে, ‘ভাইয়া তৈরি হয়ে নিন। আর বকশিসটা দিন, প্লিজ।’

রুবেল বলে, ‘বকশিস! কীসের বকশিস?’ এ লাইনে কাজ করার আগে ওরা বকশিস নেয়, রুবেল এটা জানে না। পৃথিবীতে এটাই মনে হয় বকশিস নেয়ার একমাত্র উল্টো রীতি। এই রীতি তার জানার কথাও নয়। কারণ, সে এখানে নবাগত। এখানকার নিয়ম-কানুনে সে পুরোটাই অজ্ঞ।শান্তা রুবেলকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আহারে কচি খোকা! কিচ্ছু বোঝে না দেখো। এখানে এসে কাজ করলেবকশিস দিতে হয়।’

রুবেল ধাক্কা মেরেশান্তাকে গায়ের ওপর থেকে ফেলে দিয়ে বলে, ‘ধুর আমার এসব ভালো লাগে না। গায়ে হাত দেবে না বলছি।’
পুরুষের মনে দুর্বলতা সৃষ্টি হয় এমন সুরে শান্তা বলে, ‘হাত দিব না মানে! আমি হাত না দিলে গায়ে কে হাত দেবে শুনি? আর এখানে এলে সবারই এই কাজ করে যেতে হয়। এবার ভদ্রলোকের মতো ভালোয় ভালোয় বকশিসটা দিয়ে দিন।’ শান্তা আবার রুবেলের কাছে আসতে থাকে। রুবেল বাধা দিয়ে বলে, ‘দূরে দাঁড়াও। কাছে এসো না।’

শান্তারুবেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। রুবেল বলে, ‘তুমি কী করো সত্যি করে বলো।’শান্তা জবাব দেয়, ‘ভার্সিটিতে পড়ি। কেন বিশ্বাস হয় না?’ রুবেল ভেতরে একটা উত্তাপ অনুভব করে। কণ্ঠ তার চড়া হয়ে ওঠে। বলে, ‘কী বললে তুমি, ভার্সিটি! কোন ভার্সিটিতে পড়ো বলো।’ শান্তা বলে, ‘ওটা তো বলা যাবে না। যা করতে এসেছেন, তা করে যান।’

শান্তানিজেকে কাপড়ের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে। রুবেলের ভেতরে উত্তেজনা আরো বাড়তে থাকে। বলে, ‘সব বানোয়াট। মিথ্যাবাজি। তুমি ভার্সিটি তো দূরের কথা, হাইস্কুলেও পড়োনি। দাম বাড়ানোর জন্য তুমি মিথ্যা বলছো। ভার্সিটিতে আমি না পড়লেওস্কুল-ভার্সিটিপড়–য়া মেয়ে আমি চিনি। আমাকে মেয়ে চেনাতে হবে না। এ লাইনে আবার ভার্সিটি কীসের? ভার্সিটির মেয়েরা এসব করেনা।’

শান্তা মুহূর্তেই ক্ষেপে উঠে বলে, ‘সবাইকে কি রাস্তার মেয়ে মনে হয়? আমি ভার্সিটিতে পড়ি,পাড়ার সস্তার মেয়ে আমি নই। পাড়ার মেয়েদের কাছে যেতে যেতে সবাইকে আপনার পাড়ার মেয়ে বলে মনে হয়, তাই না? বিশ্বাস না হলে চলে যান। বিশ্বাস না হলে এসব করতে এসেছেন কেন?ভার্সিটির কয়জন মেয়ে দেখতে চান? এ্যাভেইল্যাবল আছে।’

‘তোরা কাস্টমারের কাছে ভার্সিটির মেয়ে বলে পরিচয় দিস বলে তারা ভার্সিটির মেয়েদের খারাপ ভাবে’ বলেই রুবেলশান্তার গালে জোরে একটা চড় বসিয়ে দেয়। শান্তা আগুনের মতো জ্বলে ওঠে,চোখ গরম করে রুবেলের দিকে তাকায়।রুবেলের শার্টের কলার ধরে। রাগে রুবেলের রক্ত মাথায় উঠে যায়। ‘অসভ্য বেয়াদব!’ বলে রুবেল আরেকটা চড় ও ধাক্কা মেরে শান্তাকে ফেলে দেয়। শান্তা ফ্লোরে উপুড় হয়ে পড়ে। রুবেল শান্তার নিতম্বে একটি লাথি মারে। শান্তা চিৎকার করে ওঠে। রুবেল দরজার সিটকানি খুলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দরজার সামনে সুপারভাইজার দুইজন দৌড়ে এসে হাজির হয়। বয়সে বড় সুপারভাইজার এসে রুবেলের শার্টের কলার ধরে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘এই শালা, মাস্তানি করার জায়গা এটা?’

টিপু ‘ভাই থামেন, থামেন। আমি দেখছি’ বলে দুজনকে ছাড়িয়ে দিয়ে রুবেলকে দূরে সরিয়ে দেয়। সুপারভাইজার বলে, ‘ভাই এটা আপনি কী করলেন? এ রকমপাগল-ছাগল কেউ এখানে নিয়ে আসে?’

টিপু তাকে সান্ত¦না দিয়ে বলে, ‘ভাই সোরি, এক্সট্রিমলি সোরি। আমি ওকে দেখছি।’রুবেল দূরে দাঁড়িয়ে সাপের মতো ফুঁসছে। হাত মুঠ করছে আবার খুলছে। চোখেমুখে আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠছে তার। টিপু রুবেলের অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে রুবেলের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে বলে, ‘তুই এরকম করবি জানলে এখানে তোরে আনতাম না। আমি সোরি দোস্ত।’

রুবেল টিপুর সাথে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে টিপুকে বলে, ‘তুই তো জানিস আমি ধাপ্পাবাজি, চাপাবাজি একদম সহ্য করতে পারি না।ওদের কাছে মিথ্যা শুনে শুনে ভার্সিটির নির্দোষ মেয়েদের মানুষ খারাপ ভাবে। ভার্সিটি তো দূরের কথা, ওতো স্কুলের চৌকাঠ পেরোয়নি! ওকেনা মেরে পারা যায়?শালির নটি কোথাকার! এখন মনে চায় তোরেও একটা লাথি মারি শয়তান।’

তাদের দুইজোড়া পা ধপধপ শব্দে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট