ও পাহাড়, তুমি মানুষের গান গাও...



ও পাহাড়, তুমি মানুষের গান গাও...
মিসির হাছনাইন

‘ও মেঘের দেশের পাহাড় তোমার কাছে,
আসছি তবে মেঘের ভিতর আদিবাসী হইয়ে’

রাতের মরা ঘুমে স্বপ্ন দেখছিলাম....

     সাত আগষ্ট সকাল। জানালায় কাক ডাকে। দূরের নির্মলা আকাশ তাকিয়ে আছে ছাই বর্ণের মেঘ নিয়ে। মেঘের কাছে বলে দিলাম, ও মেঘ আমরা আসছি তবে ছুঁয়ে দেখবো তোমার শরীর! সারাটা দিন কেটে গেল মেঘদের সংসার আর পাহাড়ের গল্প ভাবতে ভাবতে। পাহাড় নিয়ে কত আগ থেকে তো ভাবছি-
‘ভাবছি, পাহাড়ে চলে যাবো, ঐ দূর পাহাড়ের চূড়ায়; যেখানে কালো মেঘ জড়ো হয়ে ঝর্ণা নামে শরীর ভিজে, নাগরিক নিয়ন আলোয় তোমাকে ভুলে গিয়ে পাহাড়ের পাতায় পাতায় চনের মাচাং ঘর বানাবো সকাল বিকাল সন্ধ্যা রাতে... মহুয়া ফুলের গন্ধ শুকে শহরের মানুষের ভীড় ঠ্যালে নষ্টে যাওয়া জীবন দেখবো আদিবাসী জনপদে । নিজকে চিনবো পাহাড়ী গাছের ভিতর সুবজের গায়ে এলোমেলো জীবনের লেনদেন  পুড়ে যাবে অতীত, পুরানো সব ছেঁড়া খাতা। বুনোফুল ফুটে আছে এদিক ওদিক ।  ভুলে যাবো শহরের রাস্তা অলিগলি। এক পৃথিবী রঙ নিয়ে শুরু করবো- মানুষের মিছিলে নতুন মানুষ আঁকা জীবনের আঁকাবাঁকা রাস্তায় সারস পাখির ডানায় খুব ধীরে ধীরে মানুষ হারিয়ে যায়, নাগরিক জীবনের সোডিয়াম আলোয়। পাহাড়ের চূড়ায় ভাঙা মাচায় বসে রাতের জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে... দেখবো আকাশের তারায় তারায় কত জীবন ঝুলছে আহা! শহরের মানুষ ভালোবাসা বুঝে না। বুঝে না জীবনের সুন্দর, বুঝে না মানুষ। যে মানুষ ভালোবাসতে জানে না, সে আকাশের নক্ষত্র দেখতে জানে না, সে জানে না জীবন এক সুন্দর নক্ষত্র রাতের যে নক্ষত্র নামে তাঁর ঘরে শহরের শক্ত ব্যালকনিতে বসে খোলাচুলে চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে তুমি দেখেছো মেঘ উড়ে যায়... ঐ পাহাড়ের চূড়ায় এবং উড়ে যায় পুবে- সাদা বকের সার, একলা আকাশের শহুরে কোলাহল
অতীতের হাজার হাজার ক্ষত নিয়ে তোমার ভেতর বেড়ে উঠছে এক পাহাড়; সে পাহাড়ে ঝর্ণা নামে...গা ভিজিয়ে আকাশে তাকিয়ে যে ছবি আঁকি ভুল করে নারীর শরীর। শুকনো শরীরে হেঁটে চলে ক্লান্ত পা ধীরে ধীরে... নরকের অতল গহ্বরে কালো অন্ধকারে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে ফুটে আছে ফুল এদিক ওদিক; পাহাড়ী জনপদ; জীবন এক বুনোফুল মাচাং ঘরে ঝুলছে । প্রাচীন অলিম্পাসের দেবতা জিউস । মানুষের উপকারী দেবতা প্রমিথিউস । পাহাড়ের গল্পে গেঁথে আছে গ্রীক মিথ। পাহাড়ের পাতায় পাতায় আগুন জ্বলে; জ্বলছে মিটিমিটি আঁধারের জোনাক, কেরোসিনে পোড়া কুপি বাতির আলোয় সুন্দর এক জীবনের উদ্দেশ্যে... ভাবছি, সবকিছু ছেড়ে পাহাড়ে চলে যাবো।


আট আগষ্ট ভোর ছয়টা। গাড়ি চলছে পাহাড়ের পাশ দিয়ে। ভোরের ঐ দূরের পাহাড়ে দেখা যায় উড়ছে পাখি, পাহাড়ী জুমে। মনে হচ্ছিল- ‘পাহাড়গুলোও চলছে আমাদের পথে’। আকাশটা মিশে গ্যাছে যে পাহাড়ে, সেই পাহাড়ের ঘরে আমাদের অভিনব যাত্রা। চলতে চলতে কখন যে চলে আসলাম পাহাড়ের ঘরে একটু টেরও পেলাম না! আমরা গাড়ি থেকে নামলাম।
সূর্য অনেকটা ওঠে গেছে। আট তারিখ সকাল। ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তায় আমাদের পাহাড়ের দেশের মাটিতে যাত্রা শুরু পায়ে হেঁটে। হাঁটতে হাঁটতে  আমরা দেখে নিলাম ছিমছাম শান্ত পাহাড়ের শহর। কড়া রোদে আমরা এসে পৌঁছলাম ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ইনস্টিটিউটে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম আদিবাসী অডিটোরিয়ামের সুন্দর করে সাজানো মাচাং মঞ্চখানা এবং আদিবাসী জাদুঘরে ঢুকে একে একে দেখতে লাগলাম বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীন সব নিদর্শন। আদিবাসী নারী-পুরুষ তাদের ব্যবহৃত সোনার ঘামে গড়া তৈজসপত্রের সাথে বাঙালিদের পরিচয় করিয়ে দেয়, বাঙালিদের ঘামে হারিয়ে যাওয়া বহু কালের পুরানো সব লোকজ শিল্প-সংস্কৃতি । পাহাড়ের চূড়ায় বান্দরবান শহর, শহরের জাদুঘরে দেখলাম পাহাড়ের প্রাণগুলো এখনও তাকিয়ে আছে জলজল চোখে। পাহাড়ী তরুণী’রা স্নান করে সুমেশ্বীর জলে। কাঠের নৌকায় আঁকাবাঁকা নদীতে কোন পুরুষ পথ হারায়।


আদিবাসী দেবতা পান করে পাহাড়ী চু। খোলা গায়ে তামুক খায় জুম চাষী কৃষক উঠানের পিঁড়িতে। শাড়ি বুনে গুন গুন গানের সুরে কোন জিপসি রমণী। দেবতা পূজায় আমরাও মাতাল হই স্বর্গের অমৃত শরাবে, গাই পাহাড়ী গান।
পাহাড়ের উৎসবে বাঙালি কৃষক হাল চাষ করে দুপুরের রোদে। ভাঙা কুলায় ধান উড়ায় কৃষাণী, দক্ষিণের মহুয়া বাতাসে। জাদুঘরে বাস করে আদিম বাঙালি।
বাঙালির রক্ত মিশে আছে, পাহাড়ী জনপদে।

দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা উঠলাম চান্দের গাড়িতে। চান্দের গাড়ি চলছে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে। হঠাৎ উঁচুতে আর নিচুতে নেমে আমরা চলে আসছি পাহাড়ের মন্দিরের সোনায় গড়া ঈশ্বরের দরজায়। স্বর্ণমন্দিরের দেবতাদের চরণে ফুল রেখে আমরা শুরু করলাম পাহাড়ের পথে যাত্রা। আদিবাসী মানুষ দুই হাতে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে আমাদের। আমরা বুঝে নিলাম, ওনারা বলছেন- ‘পাহাড়ের দেশে আপনাদের স্বাগতম’।
মেঘলা পৌঁছলাম বিকাল সাড়ে তিনটায়। মেঘলার ঝুলন্ত ব্রিজ, লেক, পাহাড়, মিনি চিড়িয়াখানা, ক্যাবল কার, পাহাড়ী চু, পাহাড়ী ফুলের ঘ্রাণ আর ছোট্ট সেই ঘূর্ণিটা আমাদের নিয়ে গিয়েছিল অন্য এক জগতে। পুরো ভালো লাগাটুকু  ব্যাগ ভরতি করে স্বর্গের মতন মেঘলা ছেড়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম, গাড়ি চলছে নীলাচলের পথে...
‘নীলাচলে আমরা মেঘ হয়ে গিয়েছিলাম, আপনাদের কাছে। আমরা গেয়েছিলাম পৃথিবীর গান, বৃষ্টিতে ভিজে গেলেন আপনারা, ভিজে গেলো পাহাড়ী ফুল, চাকমা তরুণীর ভেজে গা, পাহাড়ের বুকের পাথর। আপনারা অবাক হবেন, পাহাড়ের চোখ দিয়ে আমরা ভিজে গেছি, অথচ, আপনারা দেখেছেন আকাশে উড়ে যাওয়া এক খন্ড মেঘমালা।
আমরা হাসি কারণ, আদিবাসী নারীর ওড়না থাকে নাহ। আপনারা তাকিয়ে আছেন এবং মনে মনে বলেন আহা! কি সুন্দর ফুল!

বাবা কয়েছিলেন- মাঝে মাঝে পৃথিবীতে কিছু অদ্ভূত জিনিস ঘটে! তবে, হ্যা এ কথা সত্য যে, সবাই সেই অদ্ভুত কাজটা খুঁজতে খুঁজতে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস ঘটিয়ে পৃথিবী থেকে চলে যান পাহাড়ের জীবন কত সহজভাবে উড়ে মেঘদের মাঝে!
আমরা যখন আপনাদের কথা ভাবতে যাই, কেমন যেন নেশা লাগে ঘুরতে থাকে মাথা, দেখি- কত অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে আপনাদের চোখ। সবুজের দোষ দিয়ে আপনারা দেখেন ভোরের উঠানে ফুটছে যেসব লাল লাল জবা।
পাহাড়ের জীবন আপনাদের খুব প্রয়োজন!
পাহাড় যে মানুষের কথা বলে, পাহাড় যে মানুষের গান গায়।
মানুষের জীবন সেতো পৃথিবীর খোলা মাঠ থেকে উড়ে যাওয়া শেষ বিকেলের চিল।
নয় আগষ্ট সকাল। রোয়াংছড়ি পাহাড়ের উপর দিয়ে চলছে আমাদের চান্দের গাড়ি। রোয়াংছড়ির কচ্ছপতলা বাজারের মধ্য দিয়ে আমরা পাহাড়ের পথে হেঁটে হেঁটে পৌঁছলাম শিলবাঁধা ঝরনায়। পাহাড়ী ঝরনায় ভিজে গেলাম আমরা সবাই। পাহাড় সে তো ভিজিয়ে দিতে জানে, জানে মানুষের ভিতরের দুঃখকে ধুয়ে নদী করে দিতে। নদীর দু-পাশের পাহাড়ে আদিবাসী মানুষের ঘর।

‘পাহাড় নিয়ে গল্প লিখছি, গল্পের ভিতর জন্ম নিয়েছে এক কুমারী পাহাড়। সে পাহাড় থেকে ঝরনা নামে...
বাপে কয়- পাহাড়ে গেলে দুঃখ মোছা যায়, সেই দুঃখ বয়, এক নদী হয়ে সে তাকিয়ে আছে। আমরা ভিজে যাই তাঁর চোখ দিয়ে, শরীরভর্তি দুঃখ নিয়া যখন ডুব দেই পাহাড়ী ঝরনায়, দেখা দেয়- এক মারমা তরুণী, তাঁর সাথে আমার কথা হয়। ‘এই যে পাহাড়, এখানে রেখে যান আপনার যৌবন!
আকাশের মেঘের ভেলায় আমরা যখন উড়ছি আপনাদের শহরের আকাশে। পাহাড় তখন তাকিয়ে থাকে মারমা তরুণীর চোখে, সে জন্ম দেয় এক বাঙালি শিশু।
যৌবনের সাদামেঘে উড়ছে মারমা শিশু  কুমারী পাহাড়ে আদিবাসী বাঙালির ঘর নদীতে ভাসছে পাহাড়ী সাদা বেলিফুল... মেঘের ভিতরে ঘর, ডাকছে মারমা নারী।
ভিজে গ্যাছে শরীর। কুমারী পাহাড়ের চোখের ভিতর হেঁটে যায় শত শত মারমা তরুণী’।
দশ আগষ্ট সকাল। আমরা চলছি থানচির পথে চান্দের গাড়ির ছাদে বসে বসে ভাবছি-
‘পাহাড়ের কোলে একটা ঘর বানাইছি, ঘরটায় থাইক্যা দেখা যায় ঐ দূর শহরে তোমার ঘর। আয়নায় দাঁড়িয়ে তুমি দীঘল কালো চুলে সুগন্ধী মাখো, জানালা দিয়ে ঢুকে যায় কালো মেঘ। পাহাড়ী মহুয়ার গন্ধ, ঘর মৌ মৌ করে। আর, আমি ভাসি তোমার শহরের আকাশে। বাপে কইত- ছোড এই জীবনটা কতকিছুই তো চায়, মনভক্তি দিয়া চাইলে সবকিছুই পাওন যায়। মন থাইক্যা চা, তুইও তারে পাবি!


তারপর থাইক্যা সকাল-বিকাল তাঁরে আমি পূজা করি, সে এখন বাস করে আমার ঘরে।
পাহাড় যে নদীখান জন্ম দিছে, তাঁর ভিতর কাঠের নৌকা ভাসাই, পাহাড়ের মাঝখান দিয়া বইয়া যায় খালের মতন আঁকাবাঁকা নদী। হঠাৎ করে দেখি- উড়ে যায় একটা সন্ধ্যা পাখি, কোন শহরের জানালায়! জীবন সেতো উড়ে পাখিদের ডানায়...
দুপুরের রোদে যৌবন ঝরে। বাপ শুনায় তাঁর যৌবনের কিচ্ছা। পাহাড়ী ফুল ফুটে, খোলা গায়ে অংকন করি পাহাড়ী জুম। মেঘের ভিতর দেখা যায় আমার আর তোমার সাদাকালো সংসার।
শহরের আকাশে মেঘ জমে, নাগরিক মানুষ একদিন শহর ছেড়ে পাহাড়ে বানাবে ঘর।
আমার জানালায় উড়ে আসে একটা শহরের পাখি। 


আমরা চলে আসলাম উঁচুনিচু, আঁকাবাঁকা পাহাড়ের দেশ থানচিতে। থানচির আলিকদম সড়কে উঠছে আমাদের চান্দের গাড়ি, মনে হচ্ছিল- খাঁড়া দেয়াল বেঁয়ে বেঁয়ে উঠছে পিঁপড়ের দল’। পাহাড়ের বিশাল চূড়ায় আমরা খুলে খুলে দেখছি আমাদের জীবন এবং যৌবন। পাহাড়, সেতো জীবনের গান গায়।
ডিম পাহাড় থেকে যখন আকাশ দেখি, মনে হয়- ইশ! একটু দূরের ঐ পাহাড়ে উঠলেই আকাশ ছোঁয়া যেত। চারদিকের পাহাড়ে সবুজ খেলা করলে আমরা গাই পৃথিবীর গান, ‘সোনা বন্ধে আমারে পাগল বানাইল...
পাহাড় থেকে আমরা যখন পিঁপড়ার মতো নামছি, আপনারা দেখছেন- বিকেলের আকাশে মেঘের ছুটাছুটি।
ডিম পাহাড়ে রেখে এসেছি আমার যৌবন। পাহাড় তুমি তারে যতন করে রাখো তোমার বুকের ভিতর, সেখান থেকে জন্ম নিক এক ষোড়শী পাহাড়।

সন্ধ্যায় আমরা ঢুকে গেলাম মেঘের ভিতর, মেঘের ভেলায় ভাসছে চান্দের গাড়ি। সেই মেঘে আমরা হই পৃথিবীর আকাশের কোন এক যুবক-যুবতীর চোখের মেঘ; হয়তো হয়েছি কৃষকের চোখের কালো মেঘ; আবার হয়তো হয়েছি পশ্চিমাকাশের অনন্ত যৌবনার মেঘ। হিম শীতল চারপাশটায় মনে হয় ঢেকে গেছে শীতের কুয়াশায়, দেখা যাচ্ছে না পাহাড়ী পথ, বহুদূরের পাহাড় যেখানে আকাশ ছোঁয়া যায়। চিম্বুক পাহাড়ের উপর দিয়ে নীলগিরিতে কিছু সময় আড্ডায় আর পাহাড়ীদের জীবন নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে চিৎকার করে গাই-
‘ও পাহাড় তুমি তো মানুষের গান গাও’
ঘুম ভাঙে। এগারো আগষ্ট মধ্যরাতে। একটা ছোট্ট স্বপ্নের ভিতর দিয়ে ঘুরে এলাম স্বর্গের মতন বান্দরবান।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট