গল্প : উত্তরণ



উত্তরণ
কবির কাঞ্চন

ওমায়েরের মনটা আজ ভীষণ রকমের খারাপ। ওর কিছুই ভাল লাগছে না। দিন-রাত বই নিয়ে পড়ে থাকে । কিন্তু একদিনও স্কুলে স্যারদের কাছে পড়া দিতে পারে না। প্রতিদিন স্যারদের বকা খেতে হয়। আজ তো গণিতের স্যাার ওর পিঠ ফাটিয়েই দিয়েছেন। মাঝে মধ্যে ওর নিজের প্রতি ঘৃণা হয়। স¤্রাটরা একটু বইয়ে চোখ রেখেই স্যারদের পড়া বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারে। ফয়সালটা তো বড়ই ফাজি। কিন্তু একদিনও ও স্যারের মার খায় না। স্যারকে আসতে দেখলে অমনি মনোযোগী ছাত্রের মতো পড়াশুনা শুরু করে দেয়। স্যাররাও ওর ফাজলামো ধরতে পারেন না। আবার স্যাররা পড়া নেয়ার আগে কয়েরক মিনিট পড়ার সুযোগ দিয়ে থাকেন। এই স্বল্প সময়ে ওরা জোরে জোরে শব্দ করে পড়ে। আর স্যার পড়া ধরলে ঝটপট বলতে পারে। ওমায়ের আবার ভাবে -নাকি ওরা কোন যাদু-মন্ত্র জানে! বিদ্যা-শিক্ষাকে সহজে আয়ত্বে আনার কোন যাদু সত্যি আছে কী! ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে কখন যে ছুটির ঘণ্টা বেজেছে সে দিকে ওর একদম খেয়ালই ছিল না। শেষে ক্লাশরুমের দরজায় তালা দিতে এসে স্কুলের পিয়ন মাওলা ভাই ওকে দেখে বলেন,
-কী করছেন, ওমায়ের ভাই?
ওমায়ের অপ্রস্তুতভাবে বলল, না কিছু না। এমনিতেই আজ ক্লাশ শেষে বসে বসে ভাবছিলাম।
-কী ভাবছিলেন?
ওমায়ের রাগত স্বরে বলল,
-ওটা তোমাকে বলে কোন কাজ হবে না, বুঝলে?
ওর কথায় মাওলা ভাই খুব কষ্ট পেয়েছেন। উনার চোখেমুখে তা স্প্ষ্ট। ওমায়ের জানে, এই মাওলা ভাই স্কুলের পিয়নের চাকরি করলে কী হবে। নিজে এই স্কুলেরই একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এসএসসি, এইচএসসিতে জিপিএ-ফাইভও পেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর অভাবের সংসারে যেখানে ছোট ভাই-বোনদের ভরণ-পোষণই চলছিল না সেখানে উচ্চ শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার কথা  তো ভাবাই যায় না। ওদের আত্মীয়দের অনেকেই  বিত্তবান ছিলেন। কিন্তু কেউই তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এই ¯কুলের স্যাররা ওকে খুবই আদর করতেন। বিশেষ করে হেডমাষ্টারের প্রিয় ছাত্রদের তালিকায় ও ছিল এক নাম্বার। সব সময় ওকে নিয়ে ক্লাশে উচ্চ বাক্য করতেন। বলতেন এই মাওলা-ই হবে আমাদের এই স্কুলের গর্ব।
অবশেষে কী আর করা! লেখাপড়া ছাড়া যে আর কোন কাজ ও শিখেনি। তাই নিরুপায় হয়ে স্কুলের হেডস্যারের সাথে দেখা করে। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা খুলে বলে সে। শেষে স্যারের পায়ে পড়ে বলে, স্যার আপনি আমার জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিন। যাতে করে আমি আমার মা ভাই-বোনদের খেয়ে-পরে কোনমতে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। অন্যথায় আমি মরেও শান্তি পা না। আমি যে সংসারের বড় ছেলে।
এই কচি বয়সের একটি ছেলে নিজের মা ভাই-বোনদের বাঁচিয়ে রাখতে নিজের সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখা জীবনের ইতি টানতে চাইছে। হেডমাষ্টার সাহেব ভাবেন, এই মুহূর্তে আমার পক্ষেও তো ওর পরিবার চালিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। আজ যদি ওর পরিবারে সচ্ছলতা থাকতো তাহলে যত কষ্টই হোক না কেন আমি ওর পড়াশুনার খরচ চালিয়ে যেতে পারতাম।  কারণ এমন ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারলে এরা এক সময় সম্পদে পরিণত হবে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এখানেই বর্হিবিশে^র সাথে আমাদের তফাৎ। এমন মেধাবীদের সাহায্যার্থে ধনী লোকেরা এগিয়ে আসতো। কিংবা রাষ্ট্র তার সকল ব্যয়ভার বহন করতো। ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে স্যার মাওলার মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। এরপর বললেন, দেখ মাওলা, তুমি খুব মেধাবী ছেলে। এ আমি জানি। কিন্তু সবেমাত্র এইচএসসি পাস করেছ। এখন তোমার উচ্চ শিক্ষা অর্জনের সময়। আমার স্কুলে আমি আপাতত তোমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারি । তাতে তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে।

মাওলা চোখের জল মুছতে মুছতে বলতে লাগল-স্যার, আমার কোন আপত্তি থাকবে না। আমি আমার বাবাকে হারিয়ে অভিভাবক শূন্য, স্যার । আপনি আমার স্যার। আমার অভিভাবক । আপনি যা করতে বলবেন আমি তা-ই করবো।
স্যার বললেন, তাহলে আপাতত তুমি আমাদের স্কুলের পিয়নের একটা পদ খালি আছে। ওটাতে যোগ দাও। আর চাকরির পাশাপাশি আমিই তোমার পড়াশুনা চালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেব। পড়ালেখা শেষে বাইরে ভাল কোন চাকরি না হলে এই স্কুলেই শিক্ষক পদে তোমাকে আমি নিয়োগ দিয়ে দেব। আমার মনে হয় এই মুহূর্তে এইটাই তোমার জন্য ভাল হবে।
মাওলা স্যারের প্রস্তাবে আনন্দে রাজি হয়ে যায়। এরপর থেকে মাওলা এখন এই স্কুলের একজন আদর্শ পিয়ন। নিয়মিত লেখাপড়া আর চাকরির মধ্যে নিজেকে ডুবে রেখে ও এখন বিএসসি ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে।  পিয়ন হলে কী হবে স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রী ওকে বেশ পছন্দ করে। ওমায়েরও ওকে পছন্দ করে। হঠাৎ সে ভাবে, আজ এভাবে খোচা মেরে কথা বলা-টা মনে হয় ঠিক হয়নি। তাই তড়িগড়ি করে বলল,
-মাওলা ভাই ,শুনেছি আপনি  এক সময় খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। স্যাররা আপনাকে খুব ভালবাসতেন।
মাওলা দীর্ঘ একটা নিঃশ^াস ছেড়ে বলল,
হ্যাঁ, ওমায়ের ভাই আপনার কথা ঠিক। কিন্তু বাবাকে হারানোর পর আমার সব তছনছ হয়ে গেছে। এখন বলুন, আপনার সমস্যাটা কী?
-আমার তো মহা সমস্যা।
-আগে আমাকে একটু বলে দেখুন না।
-তুমি তো জান, আমার বাবা একজন বড় ব্যবসায়ী। আমাদের টাকা-পয়সার কোন অভাব নাই। আমার বাবা-মার একটাই চাওয়া যেকোন মূল্যে আমি যেন ভাল রেজাল্ট করি। এই জন্য বাসায় লজিং মাষ্টারসহ বেশ কয়েক জায়গায় প্রাইভেটও পড়াচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আমি পড়া মনে রাখতে পারি না। রোজই স্যারদের বকা খেতে হয় আমাকে। আজ তো মোক্তার স্যার মেরে আমার পিঠই ফাটিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য স্যারের উপর আমার একটুও রাগ নেই। দোষটা তো স্যারের না। রোজই আমি পড়া দিতে পারি না। এভাবে একদিনও পড়া না পারলে তো মারবেনই।
-আপনার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে আপনি চাইলে মেধাবী ছাত্রে পরিণত হতে পারবেন।
-কিভাবে!
-স্যার আপনাকে মেরে পিঠ ফাটিয়ে দিয়েছেন। তারপরও আপনি বলছেন স্যার সঠিক কাজটি করেছেন। তার মানে আপনি নিজের প্রতি মূল্যায়ন করতে পারেন। আর যে নিজের কাজের মূল্যায়ন করতে জানে সে কখনও পিছিয়ে থাকে না। আপনিও পিছিয়ে থাকবেন না।
-তাহলে উপায়টা বল কিভাবে আর কী করলে আমি মেধাবী ছাত্র হতে পারবো। স্যাররা আমাকে আর বকা দিবেন না। আর মারবেন না। আমাকে দেখে পাড়ার দুষ্ট ছেলে! ডামিস ডামিস! বলে কেউ আর শ্লোগান দিবে না। আর মাওলা ভাই, আপনি আমার বয়সে বড়। এখন থেকে আপনি আমাকে তুমি করে বললে আমি খুশি হব।
-তাহলে শোন। প্রথমে তোমাকে তোমার সাথের বন্ধুদের পাল্টাতে হবে। তুমি কী তা পারবে না?
-অবশ্যই পারব।
-সাথে সাথে তোমার সবগুলো প্রইভেট বাদ দিতে হবে।
-দেব।
-তুমি আমাদের স্কুলের যে যে স্যারকে তোমার খুব ভাল লাগে মানে যাদের কথা শুনতে তোমার খুব ভাল লাগে তাঁদের সাথে কথা বলে তাঁদের কাছে প্রাইভেট পড়বে।
-পড়বো। আর----
-আর, আমি জানি তুমি একজন ভাল ছেলে। কিন্তু তুমি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় কর না। তোমাকে নিয়মিত নামাজ আদায় করতে হবে। ¯্রষ্টার পথে চললে কাজে বরকত থাকে, বুঝলে?
ওমায়ের মাথা নেড়ে বলে উঠে, তুমি ঠিক বলেছ, মাওলা ভাই। আমি তোমার সবগুলো কথা ভেবে দেখেছি। আমি যাদের সাথে চলি তারা কেউ-ই নামাজ পড়ে না। লেখাপড়ার পথে হাঁটে না। আর যে স্যারদের কাছে পড়ি উনাদের ‘ভাইয়া’ বলে ডাকি। উনাদেরকে  আমি ভয় করি না। ফলে উনাদের পড়া শিখতে বসি না। লজিং মাষ্টার পড়ার জন্য মারেন বলে রোজই তার বিরুদ্ধে মিথ্যে মিথ্যে কতো নালিশ করি। কিন্তু বাবা উল্টো আমাকে বলেন, যত অভিযোগই কর না কেন এই মাষ্টারের কাছেই তোমকে পড়তে হবে। আমি এখন বুঝতে পেরেছি তখন কেন আব্বু-আম্মু আমার কথার  গুরুত্ব দিতেন না। আর মাওলা ভাই, আমি আপনার কাছে একটা আবদার করবো যদি আপনি কোন কিছু মনে না করেন।
মাওলা আরও উৎস্যুক হয়ে বলল,
-না, কিছুই মনে করবো না। এই তোমাকে কথা দিচ্ছি। বল, কী তোমার আবদার?
-আগে বল, তুমি আমার কথা রাখবে।
-এই কথা দিলাম, তোমার কথা রাখবো।
-আমি জানি, তুমি প্রাইভেট পড়াও। আমি চাই, তুমি আমাকে তোমার থেকে একটু সময় দেবে। আমি ভাল ছাত্র হতে চাই। আজ থেকে তুমি যেভাবে বলবে আমি ঠিক সেভাবে চলবো।
মাওলা আনন্দে রাজি হয়ে যায়। ও ভাবে, আমার সামান্য উৎসাহে যদি একটি ছেলে মানুষ হতে পারে তবে সে অনেক ভাল।


এই সব ভাবতে ভাবতে ক্লাশরুম বন্ধ করে মাওলা। তারপর মাওলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে ওমায়ের। রাতে বাবা-মার কাছে সব খুলে বলে। ওমায়েরের বাবা মাওলার গল্প বেশ আগে থেকেই ভালভাবে জানেন। তাই ছেলের আনন্দকে নিজের মনে রাঙিয়ে বললেন, এতদিন পরে আমাদের ছেলের মাথায় বুদ্ধি-সুদ্ধি হয়েছে। ঠিক আছে তাহলে কালকে থেকে তোমার ভাল ছাত্র হবার মিশন শুরু কর।
শুরু হলো ওমায়েরের ভাল হওয়ার সংগ্রাম। মাওলার কথামতো চলতে শুরু করে সে। স্কুলের তার প্রিয় স্যারদের সব খুলে বলে প্রাইভেট শুরু করে। নিজের বখাটে বন্ধুদের ছেড়ে স্কুলের ভাল-মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাথে পথ চলতে শুরু করে। যেখানে যায় শুধু পড়াশুনা আর আল্লাহর অপার মহিমা আর নেয়ামতের শোকরান করেই সময় কাটে তার। মাওলাও তার ব্যস্ত জীবনের মধ্য থেকে এক দুই ঘণ্টা করে প্রতিদিন সময় কাটায় ওমায়েরের সাথে।
ওমায়ের এখন পড়াশুনা ছাড়া কিছুই বোঝে না, খোঁজে না। পাল্টে গেছে ওর পড়াশুনার পরিবেশ। আর পাল্টে গেছে ওর প্রতি চারপাশের মানুষের মূল্যায়ন। ইতোমধ্যে স্কুলের অভ্যন্তরীন  পরীক্ষায় ওমায়ের ভাল করেছে। স্যাররাও ওকে এখন অনেক আদর করেন। ডামিসের অপবাদ ধীরে ধীরে তার উপর থেকে সরে গেছে। বাবা-মাও ওকে নিয়ে এখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছেন। মাওলাও ইতোমধ্যে বিএসসি পাশ করে এই স্কুলেরই সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দিয়েছে। মাওলাকে শিক্ষক হতে দেখে ওমায়েরের সে কী আনন্দ! যে তার মতো দুর্বলের জীবনের অধ্যায়কে পাল্টে দিতে পারে সেই মানুষটি শিক্ষক হতে পারলে কার না আনন্দ হয়! সেল্যুট তোমাকে মাওলা ভাই।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট