কয়েকটি ভয়ংকর রাত



 কয়েকটি ভয়ংকর রাত
সৌরভ হাসান

মিতু ইদানিং রাতে ঠিকমতো ঘুমুতে পারেনা। অদ্ভুত একটা ভয় কাজ করে সবসময় মিতুর ভেতরে। ভয়টা নিয়ে কারো সাথে আলোচনা পর্যন্ত করতে পারছেনা। যাকেই এই ঘটনা বলুক না কেন সবাই হেসে উড়িয়ে দিবে। কেউ মিতুর কথা বিশ্বাস করবেনা। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে মিতুর কাছে।

কিছুদিন আগের ঘটনা।
মিতু ঘুমুচ্ছিলো। জানালার পাশেই সবসময় ঘুমায় মিতু। গরমে জানালা পুরোটা খুলে দিয়ে ঘুমুচ্ছিলো। হঠাৎ মিতু বুকে ভারী কিছুর উপস্থিতি লক্ষ করলো। একটা হিম শীতল হাত মিতুর বুক-পেটে দৌড়ে কি যেন খুঁজছে। মিতু ভেবেছিলো হয়তো এটা কোন দুঃস্বপ্ন। কোনরকম চোখ খুলে জানালা বন্ধ করে পানি পান করলো। সে রাতে আর ঘুমুতে পারেনি মিতু।

সেই রাতের পর প্রতি রাতেই মিতুর ঘুম ভাবে একটা অশরীরী হাতে স্পর্শে। যেটা মিতুর নাক থেকে ক্রমশই নিচে নামতে থাকে। ঘুম ভেঙে গেলে মিতু চিৎকার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কোনভাবেই হাতটা সরাতে পারেনা মিতু। যে কোন ধর্ষক ধর্ষণ করতে চাচ্ছে মিতুকে। মিতুর মুখ আটকে যায়। মিতুর মনে হয় ওর মুখ কেউ সুপার গ্লু দিয়ে আটকে দিয়েছে। কথা বলার শক্তি থাকেনা এতটুকুও। হাতটার মজা নেওয়া শেষ হলে হাতটা অদৃশ্য হয়ে যায়। বিছানায় লুটিয়ে পরে মিতুর ক্লান্ত শরীর।

যত দিন যাচ্ছিলো, হাতটার পরিধি ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। এখন প্রতিরাতে হাতের সাথে একটা অস্পষ্ট মুখ ও শরীরের কিছুটা অংশ দেখা যায়। মিতু প্রতিরাতে শব্দহীন চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জাগে।

প্রতিরাতে চেষ্টা না ঘুমিয়ে জেগে থাকতে। কিন্তু শরীর সেটা বুঝেনা। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে মিতুও ঘুমিয়ে যায়। আবারও সেই দেহটা আসে। মিতুকে ভক্ষণ করতে চায়। মিতুর শরীর চায়। মিতু বুঝতে পারে, তার সাথে কি হতে চলছে। অথচ তার করার কিছুই থাকেনা।

এখন প্রতিরাতে মিতু ইচ্ছের বিরুদ্ধে জেগে থাকে। ঘুম আসার ভয়ে বিছানায় যায়না। সারারাত বারান্দায় বসে অথবা রুমে বসেই কাটিয়ে দেয়। যে রাতে ঘুমায় না  সে রাতে মিতুর ঘরে কিছু আসেনা। শুধু মাঝে মাঝে উঠানে একটা বিড়ালের ডাক শুনতে পায়। সাধারণ বিড়ালের ডাক নয়, অতীব ভয়ংকর সেই ঢাক। গা হিম হয়ে যায় মিতুর। নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। পিপাসায় বুক ফেটে  যেতে চায়। ফ্রিজে রাখা বোতলের সবটুকু পানি যেন এক ঢোকে গিলে ফেলে।

মিতুর বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর থেকে মিতু একাই থাকে বাসায়। আত্মীয়-স্বজন তেমন নেই। ছিলো না কখনোই। তখন থেকেই একা থাকার অভ্যাস। পুরোনো জংলার পাশে এমন রাজপ্রাসাদ খুব কম আছে দেশে। তবুও মিতু সাহস করে একাই থাকে। কত কত ছেলে মিতুর পেছনে ঘুরঘুর করে। এসবে পাত্তা দেয়না ও।

এলাকার মানুষ তাকে বিয়ের কথা বললে সে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করে। সে একা থাকতে চায়। খুব একা। অন্যকারো জীবনের সাথে নিজেকে জড়াতে চায়না।

গত কয়েকদিন ঘুমায়নি মিতু। তাই গতকাল রাতে চোখে যেন সুপার গ্লু লেগে গিয়েছিলো। কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারেনি। তাই ঘুমিয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। রাত গভীর হচ্ছে। অশরীরী সেই আত্মাটা এসেছে মিতুর ঘরে। না, আজ শরীরে হাত দেয়নি। মিতুকে ডাকতে লাগলো। তার গলার কণ্ঠটা এমন ভয়ংকর! মিতু একলাফে বিছানা থেকে উঠে গেল। চিৎকার মিশ্রিত শব্দ বেরুলো মুখ থেকে,
-কে কে! এখানে কে?
-শান্ত হও মিতু। আমি!
-আপনি কে?  কি চাই আমার কাছে?
আত্মাটা একটু একটু করে এগিয়ে আসছে মিতুর দিকে। মিতু লাফিয়ে নেমে গেল বিছানা থেকে। তখন আত্মাটা বলল,
-আমি তোমাকে চাই মিতু। শুধু তোমাকে চাই।
-দেখুন আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছি খুব।
-কাছে এসো মিতু।
এটা বলেই আত্মাটা মিতুর দিকে এগিয়ে গিয়ে মিতুর গলায় হাত রাখলো। মিতু জ্ঞান হারালো।

পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো মিতুর। সারা শরীর ব্যথা। জ্বর এসে গেছে। কোনরকম কোঁকাতে কোঁকাতে ঘর থেকে বের হয়ে এলো মিতু। এই বাড়িতে আর থাকবে না সে। কোনদিন থাকবেনা। বাড়ি-ঘড় বিক্রি করে দিয়ে চলে যায় মিতু।

এই ঘটনার ১৫ বছর পার হয়ে গিয়েছে। মিতু এখন দুই বাচ্চার মা। বড় মেয়ে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ছোটমেয়ে এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। মাঝে মাঝেই ওরা ভূতের গল্প শুনতে চায়। মিতু খুব আগ্রহ ও কিছুটা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেই গল্প বলে। বাচ্চারা আনন্দ পায়। মিতুর চোখে একই সাথে ভয় ও আনন্দের জল ঝরে।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট