ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০২



(গত সংখ্যার পর)
০২.
বাস থেকে নামতেই প্রায় সন্ধ্যা। নগরের আলোকোজ্জ¦ল বাহার দেখে বিস্ময়ের সীমা নেই উর্মিলার। তারপর সারাপথে শঙ্কা। অপরিচিত সবকিছু। নানা ভাবনায় নিজেকে দুর্বল মনে হয়েছিল। একা একা শুভপুর থেকে এ নগরে এসেছে! অচেনা সবকিছুই ভীতিকর। তারপরও উর্মিলার কেন যেন মনে হয়েছিল বেবী আপার নিকট পৌঁছুতে পারলে সবকিছু সহজ হয়ে যাবে।
মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশা নিয়ে নাখালপাড়া ‘নারী মুক্তি কেন্দ্র’ অতি নিকট। বেবী আপা ওইভাবে লিখেছে সব ব্যবস্থাই করা থাকবে।
নারী মুক্তি কেন্দ্রের সামনে রিকশা থেকে টিনের ট্রাঙ্ক নামাতে গিয়ে উর্মিলার একবার মনে হয়েছিল রিকশাওয়ালা ঠিক জায়গায় নিয়ে এসেছে তো? গেটের কাছে এক মধ্যবয়সী লোক উর্মিলাকে নিয়ে গেল দু’তলায়।
ওর বয়সী এক মেয়ে বলল, ‘আমি রুবী। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া বাড়ি। বেবী আপা আমাকে নিয়ে এসেছে। তিন মাস ধরে এখানে আছি। তোমার স্থান হয়েছে আমার রুমে।’
পাশাপাশি দুটো বড় আয়রনের খাট। খাটের পাশে ট্রাঙ্ক রেখে উর্মিলা অনুভব করল ওর প্রচ- ক্ষুধা লেগেছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় নানা উৎকণ্ঠায় কিছুই খাওয়া হয়নি। তারপর এতটা পথ জার্নি।
এ সময় রুবী বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি। যেদিন প্রথম এলাম আমারও তোমার মতো মনে হয়েছে। হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিংয়ে গিয়ে খেয়ে আসো। তারপর লম্বা ঘুম দাও। এ নগরকে চিনতে কিছুতো সময় লাগবে।’
উর্মিলা অবাক হয়। সবকিছু কেমন সুবেশ। বাবার কথা মনে হয়। বাবা কী ভাবছে ওর কথা? ভাববেই তো। বাবা যে একা! উর্মিলা ছাড়া কে আছে তার। আজ থেকে বাবা একজন নিঃসঙ্গ দুঃখী পিতা।
রুবীর সঙ্গে ভালো করে পরিচয় হওয়ার আগেই জাঁকিয়ে ঘুম এল ওর। কখন ওরা ঘুমিয়ে পড়ল তা কেউ জানতে পারল না। শুধু উর্মিলার একবার মনে হয়েছিল, বাবা কী জেগে আছে। শুভপুর কী ওর জন্য অপেক্ষা করবে?

উর্মিলার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি। পথশ্রান্ত উর্মিলার ঘুম ভাঙে সকাল আটটার পর। রুবী তখন অফিসে  চলে গেছে। উর্মিলাকে জানায়নি। যাওয়ার আগে টেবিলে চিরকুট রেখে গেছে। ‘দশটার দিকে বেবী আপা তোমাকে নেওয়ার জন্য লোক পাঠাবে। প্রস্তুত থেকো।’ দরজা গলিয়ে এক চিলতে তেসরা আলো। দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকায় উর্মিলা। আটটা সাঁইত্রিশ। বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে রুমের ঈষৎ আলো-আঁধারিতে সমান্তরাল আলোর বলের নাচন অনুভব করে চোখের মণিতে। শরীরের প্রতি অঙ্গ ব্যথায় টনটন করছে। শুভপুর থেকে রাজধানী ঢাকা। একশ’ সতেরো কিলোমিটারের পথ। রাস্তার জ্যাম আর গরমে অতিষ্ঠ। তারপরও ভালোভাবে বেবী আপার কাছে পৌঁছাতে পেরেছে তাতেই উর্মিলার আনন্দের সীমা নেই। ঘড়িতে আটটা পঞ্চাশ। তড়িঘড়ি করে উঠে বাথরুমে ঢোকে। একবারে গোসল করে তৈরি হয়ে বের হয়। জানালা খুলতেই হুইসেল বাজিয়ে তেজগাঁও-এর দিকে ট্রেন ছুটে যেতে দেখে। চৈত্র মাসের ঝকমকে সকাল। ট্রাঙ্ক থেকে এসএসসি মার্কশিটসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের মোটা ফাইল বের করে টেবিলে রাখে। নতুন সেলোয়ার কামিজ সঙ্গে উড়না জড়ায়। রুবীর টেবিলের আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তাই তো! সত্যি আজকে অন্যরকম মনে হচ্ছে উর্মিলাকে। বেবী আপার পছন্দ হলে সব ঠিক। আবার বেবী আপা যদি ভাবে গ্রামের মেয়ে, রাজধানীর জন্য অনুপোযুক্ত। এমন ভাবনাগুলো নিয়ে ডাইনিং টেবিলে আসে। নাস্তা খেয়ে রুমে এসে অপেক্ষা করতে থাকে। দশটায় বেবী আপা লোক পাঠাবে। কী কাজ দিয়ে শুরু হবে ওর জীবন? লেখাপড়ার সুযোগ আছে তো? বেবী আপা তো লিখছে, ‘মনে রাখিও শিক্ষাই মেয়েদের বড় শক্তি।’ রুবীর সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। তিন মাস আগে এখানে এসেছে। ওর অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে হবে।
ঠিক দশটায় দারোয়ান ডাকতে এল। বেবী আপা লোক পাঠিয়েছে। রুমের চাবি বুয়ার হাতে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচ তলায় নামতে থাকে। হাতে কোর্ট ফাইল কাঁধে ঝোলানো সাধারণ ভ্যানেটি ব্যাগ। গাড়িতে উঠে নিজেকে খুব অলৌকিক মনে হয়। এত সুন্দর গাড়ি! ড্রাইভারকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই কারওয়ানবাজার বেবী আপার অফিসের সামনে এসে গাড়ি পার্ক করে। গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করে ড্রাইভার। গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘ওই দিকে লিফট। সাত তলা।’
দুরু দুরু বুক কাঁপছে উর্মিলার। এর আগে বাবার সঙ্গে দু’বার ঢাকায় এসেছিল। বাবা ঘুরে ঘুরে ঢাকার শহর দেখিয়েছিল। রমনা পার্ক, গুলিস্তান সিনেমা হল, জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, হাইকোর্ট, শাহবাগ, রেসকোসর্, ইউনিভার্সিটি দেখা হলেও লিফটে ওঠা হয়নি।
লিফটম্যান বলে, ‘ম্যাডাম ক’তলা।’
‘সাত তলা। বেবী আপার অফিস।’
লিফটম্যান বোতামে টিপ দেয়। লিফট চলার সঙ্গে সঙ্গে উর্মিলার বমি বমি ভাব হলো। হঠাৎ করে মাথা শূন্য হয়ে গেল। তা খুব অল্প সময়ের জন্য।
লিফট থেকে নামতেই রুবীর সঙ্গে দেখা।
‘তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। বেবী আপা দু’বার খোঁজ করেছে। ওই সোফায় বসে রেস্ট নাও। তারপর আপার রুমে যাও।’
এইটুকু সাহায্যের জন্য রুবীর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। উর্মিলার হাত কাঁপছে, বুক কাঁপছে। হঠাৎ করে ওর প্রচ- শীত অনুভূত হলো। সারা অফিস হিমশীতল। তারপরও তৃষ্ণা পায়। রুবীর কাছ থেকে চেয়ে পানি খায়। রুবীর মতো আরও দু’তিনটি মেয়ে বেশ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়ে উর্মিলাকে দেখে। কারো দিকে তাকাতে চায় না উর্মিলা। বেবী আপার মুখ মনে করে।
রুবীÑবেবী আপার রুম পর্যন্ত উর্মিলাকে নিয়ে যায়। রুমে ঢুকে অবাক হয় উর্মিলা। বেবী আপা অনেক ভারিক্কি হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে মানুষ এত বদলে যেতে পারে!
‘আপা, উর্মিলা।
‘তুমি তো অনেক সুন্দর হয়েছ। তোমার বাবা কেমন আছেন?’
উর্মিলা বেবী আপার মুখোমুখি চেয়ারে বসে পড়ে।
‘জ্বি  আপা, বাবা ভালো আছেন।’
‘শেষ পর্যন্ত তুমি বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারলে তাতেই আমি খুশি হয়েছি।’
‘আমি তো আপনার কথা বিশ্বাস করেছি।’
উর্মিলা সরল উত্তর দেয়।
‘তাই! ঠিক আছে। নিয়ম-কানুনগুলো শিখে নাও। সময় লাগবে। আমি তো কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করব। সময় হলে কাজের প্যাটার্ন তুমিই বুঝে যাবে।’
উর্মিলা অপলক তাকিয়ে থাকে বেবী আপার দিকে।
‘আপাতত তোমার কোনো কাজ নেই। রুবী তোমার আগে এসেছে। ওর নিকট জানার চেষ্টা করবে। রাজধানী শহর। তোমার কতো কী জানার আছে?’ বেবী আপা বেশ গুছিয়ে কথাগুলো বলে।
উর্মিলার মনে হয় ও কোনো দেবীর সঙ্গে কথা বলছে। ওর মধ্যে একধরনের মুগ্ধতা কাজ করে।
পিয়ন চা নিয়ে আসে। এক  কাপ উর্মিলার দিকে এগিয়ে দেয়।
‘চা খাও। রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। সময় হলে অফিস তোমাকে ডাকবে।’
উর্মিলা ধূমায়িত চায়ে চুমুক দেয়। ইতোমধ্যে ফাইল নিয়ে আসে একজন। ফাইল পড়ে গাইড লাইন দিয়ে টেলিফোনে কথা বলে। উর্মিলার চা শেষ হয়ে যায়।
‘উর্মিলা, বৃদ্ধ বাবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। শুভপুর গিয়ে তোমার মধ্যে আমি লড়াকু চরিত্র পেয়েছি। ধৈর্য অনেক বড়ো ব্যাপার। অপেক্ষা করতে হয়। তুমি পারবে।’ বলতে বলতে বেবী আপা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। এতক্ষণ পর উর্মিলার কান্না পায়। চোখ জলে ভিজে ওঠে। কেন এ কান্না উর্মিলা জানে না।
লাঞ্চ আওয়ারে রুমে ফিরে আসে উর্মিলা। টেবিলে রাখা দুপুরের খাবার খায়। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই জাঁকিয়ে ঘুম এল। সাত-পাঁচ ভাবার আগে ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভাঙে বিকেল বেলায়। পাঁচটার পর রুমজুড়ে অন্ধকার। সূর্য গাছ-গাছালি, দালান-কোঠার আড়ালে। চারদিক ছায়া ছায়া। দুপুরের মতো উত্তপ্ত নয়। তারপরও গরমে ভিজে গেছে। বিন্দু বিন্দু স্বেদ রোমকূপের গোড়ায়। ব্রা জ্যাবজ্যাবে ঘামে ভেজা। বাথরুমে ঢুকে একদম ফ্রেশ হয়ে বের হয়। আর এ সময় রুবী আসে।
কোনোকিছু বলার আগে বাথরুমে ঢুকে যায়। বের হয় একটু দেরি করে। উর্মিলার উৎকণ্ঠা বাড়ে। বেবী আপা কী রুবীকে কিছু বলেছে। বলতে পারে। রুবী তো এখন গার্ডিয়ান। বেবী আপা তাকে দায়িত্ব দিয়েছে। উর্মিলার প্রাথমিক দেখভাল করার। তাছাড়া রুবী তিন মাস আগে এসেছে। বেবী আপাসহ অফিসের মানুষ সম্পর্কে ওর তো প্রাথমিক ধারণা থাকবেই। এ কারণে কৌতূহল।
‘রেললাইন ধরে হেঁটে এলাম। গরমে অস্থির লাগছে। পথ বেশি না। তারপরও।’
রুবী গরগর করে বলে যায়।
উর্মিলা বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে, ‘হেঁটে কেন?’
‘রাস্তা অল্প। টাকাও বাঁচানো।’
‘ও তাই! রুবী, আমার খুব খারাপ লাগছে।’
‘প্রথম প্রথম আমারও তাই হয়েছিল।এখন সয়ে গেছে। তোমারও যাবে।’
‘ধোবাউড়াতে কে আছে?’
‘বাবা-মা আর তিন বোন।’
‘আমার শুধু বাবা।’ উর্মিলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে।
‘তাইলে তো পিছুটান কম। সামনে শুধু এগিয়ে চলা।’
‘রুবী তুমি এমন করে বলো যেন সামনের পথ খুব সহজ।’
‘তোমার জন্য সহজ।’
‘কেন?’
বেবী আপা তোমাকে পছন্দ করে। সারা অফিস জানে তুমি এসেছ। সবাইকে তোমার প্রতি নজর রাখতে বলেছে।’
উর্মিলা হঠাৎ করে কথা শূন্য হয়ে পড়ে। লাজুক চোখে রুবীর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।
এ সময় আজান পড়ে। সূর্য ডুবে গেছে। তার একটু পরে চা নিয়ে বুয়া আসে। উর্মিলা বলে, ‘আমি এত চা খাই না। অফিসে খেয়েছি।’
রুবী বলে, ‘চা খাওয়া ভদ্রতার লেবাস।’
‘আমি কি এতকিছু জানি!’
‘জানবে। শুধু প্রোগ্রাম অফিসার জাকির সাহেবের কাছ থেকে দূরে থাকবে।’
‘কেন?’
‘ও আমার বুকে হাত দিয়েছিল।’
উর্মিলা অবাক হয়। আরক্ত লজ্জায় ওর মুখ ছলকে ওঠে। রুবীর সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বিষণœতা ওর ওপর ভর করে। বাবার কথা মনে পড়ে। শুভপুরের আদ্যিকালের লোহার ব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়া কিশোরীর ডুব-সাঁতারের ছবি ভেসে ওঠে। না না ওখানে উর্মিলা নেই। উর্মিলা এখন জাকির সাহেবের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজকে প্রস্তুত করছে।
তারও বেশ পরে নারকেলের চিকন পাতায় উঠে আসে চৈত্রের পিঙ্গল চাঁদ। জানালা দিয়ে উর্মিলা চাঁদের দিকে তাকায়। এক চিলতে আকাশের গায় চাঁদ ঝুলে আছে। আধভাঙা। বাঁকানো চাঁদ। নগরে চাঁদ জোছনা বিলায় না।
(চলবে)

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট