চুড়ি
আতিক এ রহিম
সতী আমার হাতে একটি চুড়ি দিয়ে বলল, আপাতত আপনাকে দেয়ার মত কিছুই নেই। জানেন তো এখানে এসেছি ২/৩ দিনের জন্য। বই বহন করার মত ব্যাগ ছিলনা। তা ছাড়া কি নেব না নেব সেরকম পরিকল্পনা করার সময় ছিলনা। কবির ভাই রাতে ফোন দিয়ে কনফার্ম করল যে আমাদের পরশু ঢাকা যেতে হবে। তাছাড়া এখানে এসে আপনার সাথে দেখা হবে তা কখনো ভাবতে পারিনি।
সতী আবার বলল, আপনার সাথে ফেইসবুকে পরিচয় তা তো বেশিদিন হলো না। আমরা যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম তখন আপনার একটা ম্যাসেজ দেখে আপনার কথা মনে পড়ল। তাই আপনাকে লিখলাম যদি পারেন আপনার বইটি আমার কাছে পৌঁছানো ব্যবস্থা করবেন।
সতী একজন শ্যুটার। সে প্রতিযোগিতা করতে ঢাকায় এসেছে। সতী বিকালে আমাকে ম্যাসেজ লেখেন ‘আমি ঢাকায় এসেছি... হাতির ঝিলে আছি’। আগামী তিনদিন থাকব। আমিতার মোবাইল নাম্বার নিলাম কথা বলে কনফার্ম করলাম আগামিকাল দেখা করব। ভাবতে পারছিলামনা সত্যি কিতার সাথে দেখা হবে? মাত্র কয় দিনের পরিচয় কারো সাথে ভাল পরিচয় নেই। তারপরও আমার ইচ্ছাটাকে দমন করতে পারছিলাম না। আমি অনেক দ্বিধা-দ্বন্ধে ছিলাম মেয়েটির অন্যকোন অভিসন্ধি আছে কিনা। আজকাল তো বিপদেও কোন হাত পা নেই বলা যায়না। সমাজে নানা ধরনের অপরাধ ঢুকে পড়েছে এ মোবাইল আর ফেসবুকের কারণে। প্রতিদিনের ঘটনা শুনলে বা দেখলে চিন্তা হয়। কিন্তু সতীর কথায় সে ধরনের কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তার কথা কাটকাট বাস্তববাদী । যারা বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত তাদের কথাই আসল হাতিয়ার। তারা কথার মাধ্যমে অন্যকে আকৃষ্ট করে রা ফাদেঁ ফেলতে চেষ্টা করে। কিন্তু সতীর কথার মধ্যে সে রকম কোন ইঙ্গিত ছিলনা।
আমার যে সময় সতীর কাছে পৌছানোর কথা আমি সময় মত পৌঁছতে দেরি হয়ে গেল জ্যামের কারণে। গুলশান বাসষ্ট্যানে নেমে রিক্সা নিতে চাইলাম রিক্সাওয়ালা এ রোডে রিক্সা যেতে দেয় না। কি আর করব অজানা উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলাম। একটু সামনে এগিয়ে জিজ্ঞাস করলাম শ্যুটার স্পোর্টস ফেডারেশন বিল্ডিংটা কোনদিকে? আমি হাঁটা ধরলাম। ৫/৬ মিনিট হাঁটার পর পেয়ে যাই ফেডারেশন বিল্ডিংটি। এ বিল্ডিংটি দেখে আমার মনটা একটু আস্বস্ত হলো এই ভেবে যে তাহলে সতীর মধ্যে কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই। ফেডারেশনের গেটে দাড়িয়ে দেখি ভেতওে অনেক লোকজন চলাফেরা করছে গেটের একপাশে দুজন সিকুউরিটি বসে আছে। আমি গেটে দাঁড়িয়ে সতীকে ফোন দেই রিং হচ্ছে কেউ রিসিভ করছেনা। পর পর দুইবার কল দেই কেউ ধরেছে না। আমি একটু হতাশ হয়ে যাই কারণ কাকে জিজ্ঞাস করব সতীকে কেউ চিনে কী না! আবার জিজ্ঞাস করব রাজশাহী থেকে মেয়েরা এসেছে আমি তাদের সাথে দেখা করতে চাই। আমার এ ধরনের কারো কাছে গ্রহণ যোগ্য তা হবেনা তাই দাঁড়িয়ে থাকি গেট থেকে একটু দুরে। আবার ট্রাই করে দেখি কল দিলাম। এ মূহুর্তে নিজেকে কেন যেন অদ্ভুদ লাগছে। একজন অপরিচিত মেয়ের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। এবার রিসিভ করল সতী বলল, দাড়ান আমি আসছি। একটু পরে দেখি একটি মেয়ে কালো জিন্সের প্যান্ট এবং কালো রঙের শার্ট পড়া পায়ে কেডস গলায় একটি নেমকার্ড ঝুলানো এগিয়ে আমার দিকে। আমাকে দেখে দুর থেকে হায় বলে একটা হাসি দিয়ে বলল, সরি রুমে ছিলাম না তাই সময় মত কল রিসিভ করতে পারিনি। আমিও একটু হাসি দিয়ে এগিয়ে গেলাম তার সাথে। সতী সিকুউরিটিকে বলল, বন্ধু কোন ইনফরমেশন লেখতে হবে?
সিকুউরিটি বলল, নোম্যাডাম।
আমি সতী!
ও হেসে বলল, আমি আসলে সতী নয় । এটা আমার ছদ্ম নাম। আমার সামনে দাঁড়িয়ে ওর নেম কার্ডটি উচুঁ করে ধরে বলল আর গোপন রাখতে চাইনা। এই যে আমার আসল নাম। পার্সপোর্টের সাইজের ছবির নিচে ওর নাম সুন্দর করে লেখা আমি পড়লাম দুজনেই হেসে ঊঠলাম।
ওয়েটিংরুমে বসলাম দুজন পাশাপাশি। আমি বললাম আমি আপনাকে সতী বলে ডাকব। সতীর যে কয়জন বন্ধুরা এসেছে সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয় সে। ওর কোচ, ম্যানাজার সবার সাথে আমার পরিচয় হলো।
সবাই বলল, তোমরা কথা বল তবে বাইরে বের হওয়া নিষেধ। পাশাপাশি দুজন বসে কথা বলছি মাঝে মধ্যে দুজনই হেসে ওঠছি এ ভেবে যে হচ্ছিল না যে আমরা দুজন ফেসবুকে সামান্য পরিচয় তারপর দুজনের সাক্ষাত নিজেদেও কাছে মনে হয়েছিল অবাস্তব বা কোন নাটক সিনেমার গল্প ।
সতী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী । এবার ফাইনাল দিবে। কথা বলতে বলতে ওর সম্পর্কে সব জানতে পারি।
সতী খুবই প্রাণচঞ্চল ধরনের মেয়ে। তবে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখে তার প্রতিভার কথা। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার নেত্বত্ব দেয় তার বিভাগে। ওর আকেটা গুণ হলো সুন্দর করে কবিতা আবৃত্তি করতে পারে। সতী মুখে একটি কবিতা শুনলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমরা ভেতরের গেলাম। ভেতওে বিশাল মাঠ যেখানে শ্যুটার প্রতিযোগিতা হয়। এই প্রথম দেখলাম এ মাঠ। ভেতওে অনেক প্রতিযোগিরা প্র্যাকটিস করছে ছেলে মেয়েরা। তাদের বয়স ১৮/১৯ বছর হবে।
সতী আমাকে দেখাতে লাগল কিভাবে একজন শ্যুটার প্রতিযোগিতায় বসে, শুয়ে এবং দাঁড়িয়ে শ্যুটার লক্ষ্য বস্তুতে শুট করতে পারে। আমি শ্যুটার প্রতিযোগিতা সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নিলাম। আমার ভীষণ ভালো লাগল তার বিভিন্ন দিক বুঝানোর জন্য।
আমরা আবার চলে আসি ওয়েটিংরুমে । আমরা দুজন দুজনার বিভিন্ন দিক কথা বলতে লাগলাম। তবে আমি শুনছি আবার মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছি সতীকে।
সতী আমাকে আগেই বলে রেখেছিলেন আমাকে ২০/২৫ মিনিট সময় দিতে পারবেন। তারপরও প্রায় ঘন্টাখানেক চলে যাচ্ছে। আমরা কথা বলে যাচ্ছি। আমাদেও পাশে অনেকে আসছে যাচ্ছে আবার কেউ শেয়ার করছে আমাদের সাথে। আমরা বসে আইসক্রিম খেলাম যদিও আমার দাতের সমস্যা ছিল , সতী তাতে পাত্তা দিলনা। নিজে ওঠে গিয়ে দুহাতে দুটি চকবার নিয়ে এলো।
সতী বার বার আমাকে বলতে লাগল আমার কাছে এমন কোন কিছু নেই আপনাকে দেওয়া যায়। আমি বললাম আপনি এখানে এসেছেন প্রতিযোগিতায় তেমন কিছু থাকার কথা না।
আইসক্রিম খেতে খেতে আমরা কথা বলছিলাম। এক সময় আইসক্রিম খাওয়া শেষ হয় সতী আমাকে বলে, আপনাকে আর সময় দেওয়া যাবেনা। আমিও দেখি অনেক সময় ২০/২৫ মিনিটের জায়গায় অনেক সময় পার করে ফেলেছি। আমার ফিরতে হবে।
আমি উঠছি চলে আসব সতী তার বা’হাত থেকে একটি চুড়ি খুলে বলল, রেখে দেন। আমি গিফট দিলাম। আমি হাত পেতে নিলাম। একজন তার হাতের চুড়ি আরেক জনকে উপহার দেয় এঁটা সত্যি পরম পাওয়া। আমি সযতেœ আমার প্যান্টের পকেটে রাখি। দুজন কয়েক সেকেন্ডের জন্য দাঁিড়য়ে থাকি মুখোমুখি। হাঁটতে হাঁটতে সতী চলে আসে গেট পর্যন্ত। আমাকে যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। চোখের আড়াল হওয়ার আগ মূহুর্তে আমাকে বা’হাতের নেড়ে বিদায় জানান। আমি নিঃশব্দে হাটঁতে থাকি সামনে। আমার পাশ দিয়ে শোঁ শোঁ করে চলে যাচ্ছে শত শত গাড়ি আমার সেদিকে খেয়াল নেই, শুধু কিছুক্ষণ আগের আর এখনকার সময়ের পার্থক্য অনুভবকরি।