পদাবলি




ভূত-ভবিষ্যৎ অতঃপর...
মাজেদুল হক

আত্মার অমিয় সুখ-
তপস্যার গৈরিকতায় এঁকে এঁকে খোলস বদলায়
বিনিদ্র চিন্তাধারা, স্বেচ্ছাচারিতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি লোভ-লালসায়
ভুলে যাই সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পঙ্কিলতা।

ভূত-ভবিষ্য জানবার অদম্য ইচ্ছা থাকলেও
বিগত দিনের হিসাব-নিকাশ, স্বীকারোক্তির লাল টালিখাতায়
             লিপিবদ্ধ হয় মৃত্যুর ক্রমিক নম্বর।

অভিশপ্ত জনপথ থেকে বাঁচার অদম্য ইচ্ছায় দেঁৗঁড়াতে থাকি
সামনেই দেখি বিশাল আকৃতির কাঁটাতারের বেড়া
                 অস্পষ্ট ভাঙা ভাঙা বড় অক্ষরে লেখা
                          সতর্কীকরণ নির্দেশ...
অতঃপর...
তেড়ে আসে অসংখ্য হিংস্র শকুনের ক্ষুধার্ত চোখ।




মমির অভিশাপ
শাহীন মাহমুদ

মাটির সারাংশে দেখি পিতামহের মুখ
উজান হাওয়া কাটে দায়াদ আকুতি
তুতানখামেন  তুমি তো সত্য-ঘুরছো লাটিম ।
ফারাও গোত্রের ভূগোল
একি গোলক ধাঁধা  
তোমাকে দেখি নাসিরাবাদ,কমলাপুর
এখনো ঘুমঘোরে তোমার অণুতরঙ্গ  ।

হলুদ ক্যালারী পাখি লুকিয়ে আছে শ্বেতপাথরে
পিরামিডের অভিশাপে মৃত মমি তুতানখামেন  
কি করে আবাস পাল্টাও বার বার!


মুখোশায়না ও প্লাস্টিকভাবনা
মাহবুব মিত্র

প্রতিনিয়ত চাষ করি নৈঃশব্দের জমিন; নরোম পায়ে হেঁটে যায় শিকারী বিড়াল, রাজহাঁসের ডিম পড়ে থাকে শ্যাওলাঘন পুকুরঘাটে, কামনার জলে মৃদু ইশারায় মুরগী খুঁজে মোরগের ছায়া, ক্লান্ত বাতাস বসে থাকে বিছানার কোণে মিহি নিরালায়, বেদনাক্রান্ত নিঃসঙ্গ পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে জ্বলন্ত উনুনে, দুরন্ত শিশুটির চোখে স্টেইনলেস রোদের খেলা; কচি-কাঁচা শৈশব ফিরে-ফিরে আসে কবিতার আঙিনায়।

মায়াহরিণ ঘুরছে সোনার জলে... দূর্বাফুলের মতো ফুটে আছে কিশোরী স্তনের বোঁটা আধপোড়া রাতের মগ্নতায়, মানুষের মাথায়-মাথায় ঘুরছে রাবারের বল, ধর্মের বুকে গজাচ্ছে দিনে-দিনে প্লাস্টিকের মরিচফুল, ভিমরুলের আস্তানায় কচি-কচি চোখের নির্মিলিত প্রার্থনা। সিলভার রঙের চাঁদের আলো ছুঁয়েছে গাছের পাতা; যেখানে ঈশ্বরহীন সালোকসংশ্লেষণ।

নাকফুল আর কৃষাণী আমার ঘরের শোভা- আঙিনায় ছড়িয়ে থাকা চুলের সৌরভ, ফুলে-ফুলে মধুবন্তী প্রহরের মুখরিত হাসি, নাকের ভিতর গরম দুধের গন্ধ, নির্ঘুম সিথানে গড়াগড়ি করছে বিষের পেয়ালা, প্রতিটি দরোজা-জানালায় উপছে পড়ছে কুমির-হায়েনা-বিশ্বাসঘাতকের দল, মুখোশের আড়ালে নগ্নতার আয়না, ধর্মের বেঢপ চোখে হিংসার লড়াই, মানুষ গড়ো হে মানবতার দেবদূত; ক্লাশে-ক্লাশে লম্পট শিক্ষকের তীক্ষè দৃষ্টিতে ঢেলে দাও আগুনের নদী।

হে আমার মাটির পুতুল- জমিনের আলে-আলে তোমরা বেড়ে ওঠো, ঘুমিয়ে থাকো শস্যের শয্যায়, শস্যদানা তোমাকে চুমু খাবে, শস্যক্ষেত তোমাকে আলিঙ্গন করবে মাটির কোমল স্নিগ্ধতায়, ফসলের প্রেমে তুমি মুগ্ধ হবে, পান করবে শিশিরস্নাত ধান-দুধ, অতঃপর শস্যসম্ভার তোমাকে বিজয়ী করবে, পুলকিত হবে চোখ-মুখ-শরীর; কবিতার মতো ঘামে-ঘামে জন্ম নিবে কৃষকফুল।




একবার ভালবেসে দেখো
ওয়াহিদ জালাল

একবার ভালবেসে দেখো, এখানেও রাত নামে রাতের মতো । একবার ভালবেসে দেখো,
আজ জীবনে ফসল জন্মে ভালবাসার নামে। একবার ভালবেসে দেখো, প্রাণের আহারে স্পর্শ কেমন মাংসে গেঁথে থাকে আর দুরত্বের কাঁটা কেমন খোঁচা মাড়ে বুকের গভীরে !

একবার ভালবেসে দেখো,
মনে পড়বেই বাসি নিঃশ্বাসের গন্ধ আর বুকের উপর শুয়ে থাকা সেই অন্ধকারের কথা আজকের প্রহরে । একবার ভালবেসে দেখো,
আগুনে পুড়লেও শেষে সেই আগুন জন্মিয়ে যায় আগুনের ভিতর ।

একবার ভালবেসে দেখো,
কারো ভালবাসার স্মৃতিতে পুড়তে কতো আনন্দ জাগে মনে;
মনের টানে মন নামে আগুনে
আর চিতার আগুনকে আপন কতো লাগে ।

একবার ভালবেসে দেখো,
কতো কাঁদলেও শেষে আরো কাঁদতে ইচ্ছে করে খুব একাকিত্বে । একবার ভালবেসে দেখো
কতো ব্যথায় তার বিলাসী করে নিজের মনকে !

প্রয়োজন
জান্নাতুল ফেরদোস লিসা

আমাকে তোমার খুব প্রয়োজন।
ঘুম ভাঙ্গা চোখে এক কাপ চা হাতে তুমি আমায় রোজ দেখতে চাও,
চোখ খুলেই দেখতে চাও-
আমি দাড়িয়ে আছি এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে।
আমার হাতে তখন, রোজ রঙ বেরঙের চুড়ি থাকে।
কাঁচের চুড়ির শব্দ আমার খুব পছন্দ, তোমারো নিশ্চয়ই?
স্নানঘর থেকে স্নানের সময় একটা ডাক আসে-
কই আমার তোয়ালে কই?
আমি এক দৌড়ে তোয়ালে হাতে উপস্থিত।
আমার কপালে তখন নীল বেগুনী টিপ আভা ছড়ায়।
খাবার টেবিলে রোজ নতুন রেসিপি।
তোমার পাতে দেবার বেলায়, আলতো করে তুমি আমার হাত ছুঁয়ে দাও।
সেই ছোঁয়াটা নাকি তোমার খুব প্রয়োজন।
জ্যোস্না রাতে
তুমি আমি হয়ে যাই এক পৃথিবী।
তখন এই পৃথিবীর রাজনীতি, সাইক্লোন, বৃক্ষ নিধন, খড়া
কোন কিছুই তোমায় ছুঁতে পারেনা।
কানের কাছে ঠোঁট লাগিয়ে ছোট্টো আওয়াজ তুলে বলো-
এই জীবনে তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন।

সত্যি, তোমার খুব প্রয়োজন আমায়।
সকাল বেলার চায়ে প্রয়োজন
স্নানঘরে তোয়ালে দেবার জন্য প্রয়োজন,
হাতের নরম ছোঁয়া আর
জ্যোস্না রাতে ভালোবাসার পৃথিবীতে ডুব দেয়ার জন্য প্রয়োজন আমায়।
কখনো বলোনি, বাহ্ কাঁচের চুড়ি!
কাঁচের চুড়ির শব্দ আমার খুব পছন্দ।
কারণ-
সে শব্দ যে কখনোই তোমার হৃদয় কুটিরে পৌঁছেনি।
বলোনি- এই টিপটা মানাচ্ছেনা
একটু অন্য রঙ্গের পড়ো না।
খাবার পাতে বলোনি রান্নাটা দারুণ হয়েছে।
সঙ্গমের জ্যোস্নায় ভাসার সময় বলোনি-
তোমায় ভালোবাসি।
তাই সারাটা জীবন আমি তোমার প্রয়োজন থেকে গেলাম,
ভালোবাসা হয়ে উঠতে পারলাম না।
আমার চুড়ির শব্দ তোমার কানে পৌঁছেনা
কপালের টিপ তোমার চোখ এড়িয়ে যায়,
আমায় হালকা ছুঁয়ে দাও
তোমার শরীরে শিহরণ জাগাবার জন্য।
আমায় এই প্রেমের জোয়ারে ভাসাও-
তোমার ক্ষুধার তাগিদে।
তাই আমি তোমার প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন।
ভালোবাসা নই।


আমি মানুষ দেখতে চাই
নূরে জান্নাত

সত্যিই কি ওটি মানুষ নাকি মানুষের ছায়া!
আজকাল স্বপ্ন গুলোও ঘুমের মধ্যে নরে চরে বসে! জ্যমিতির কাটায়
টিকটিকির ছবি আঁকি ত্রিভূজ, চতুর্ভূজ; সেও বৃত্তের বাইরে!
ইরেজারে মুছবোনা বলে কলম হাতে নিয়েছি পেন্সিলের জায়গায়!
স্পর্শ কলমে লাগবার আগেই আমার আঙ্গুলগুলো
হাসির প্রকম্পনে নেঁচে ওঠে!
অংক কষা বড্ড পক্ক মস্তিষ্কের খেলা! আমি তো ঘোলে নেয়ে তুলেছি শুষ্ক মস্তিষ্ক!
ঘি’এর অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া! আমার ঝুলিই ঘিলু ছাড়া খুলিই পাওয়া যায়;
শ্বসান থেকে কুড়িয়েছি কোন এক অন্ধকার আমাবৎশার রাতে দগদগে চিতার পাশে থেকে!!
যখন আমি হাঁটি..
কারা যেন পাশ দিয়ে
বির বির করে মন্ত্র পড়ে!! আমি মানুষ দেখি
আলোর মাঝে আমার সাঁজে।
ও পাড়ের নৌকায় কিছু মাঝি দেখি ওরা মানুষ মাঝি নয়- ছায়া!!
 অসম্পন্ন মধ্যরাতে আমার বুকের ঠিক মাঝখানে পুরে যাবার গন্ধ ছোটে!
অর্ধ মানুষ হওয়া চন্দ্রপূজারীকে করো জরে বলি..
‘আমি মানুষ দেখতে চাই
আমাকে বাদে।’
পূজারী পায়ে শুরশুরি নিয়ে হেঁটে চলে মানুষ রুপে মানুষের ছাঁয়ায়!!
আমি কষ্ট পেতে চাই খুব করে। হে বিধাতা-আমি মানুষ দেখতে চাই! কাঁদতে পারিনা আর!
আমার চোখে কোঠরে মরে যাওয়া স্বপ্ন পিচুটি রূপে গলে যায়
তবুও আমি মানুষ দেখতে চাই।




হেমন্ত কথন
জাহিদ হোসেন

সেবার আউলা বাতাসে দ্বাদশীর চাঁদ ইশারা বোঝেনি,
কুয়াশার অতীত ইতিহাস খুঁজে কোণের টেবিলে বসে
কেটেছে প্রাচুর্যের রাত। কাঁটাঘেরা একটি হেমন্ত
কষ্টের ভাগ নিতে বিনীত অনুরোধ জানায় অঘ্রাণ পাঁজরে।
দ্বাদশীর চাঁদ এক যমুনা প্রেম ঢেলে ঢেলে
ছায়ার ভোর হাতে নিয়ে যায় পাশের বাড়ির ছাদে,
বুকের তলায় পড়ে থাকে নিঝুম দুপুরের রোদ।


মানুষের ভিড়ে মানুষ নেই
মিশির হাবিব

নিকেলমাখা শহরে মানুষের অভাব নেই,
পিপড়ের মতো সারি সারি চলে মানুষ-
ট্যাক্সি, রিকশা আর বাসে চড়ে
মাছির মতো মধুর ওপর
চাদের মতো নীলের ওপর
মানুষের কাধে ঘুমিয়ে পড়ে মানুষ।
আমার একটা মানুষ নেই,
আমার একটা আপন মানুষ নেই,
আমার একটা ভালোবাসার আপন মানুষ নেই।
মানুষ থাকলে দুঃখ হতো না,
প্রেমের নেশায় মনের মধ্যে ছোবল দিতো না;
বাদল দিনে চুপটি করে চোখে চোখে কথা কইতাম,
চুমুর ছলে পেটের মধ্যে শিশুদের ছবি আকতাম;
মানুষ থাকলে ভালোবাসতো
বুকের ভেতর পাখির মতো পুষে রাখতো।
চোখ ফেটে জল এলে ঠোট দিয়ে শুষে নিতো।
আমার কোনো মানুষ নেই,
ভালোবাসার, ভালোলাগার মানুষ নেই।
মানুষ থাকলে সারাটা দিন একা লাগতো না,
তারার মতো চোখ দুটোর রাত জাগা হতো না
শিশুদের  পুতুল আছে
পাখিদের ফুল আছে
তারাদের নীল আছে
আমার কোনো মানুষ নেই
দুঃখগুলো ধার দেবার মানুষ নেই
কষ্টগুলো বোঝাবার মানুষ নেই
আমার কোনো মানুষ নেই
ভালোলাগার, ভালোবাসার মানুষ নেই।





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট