পদাবলি






তখনও আমি তোকে প্রশ্ন করিনি
মুহাম্মদ রাফিউল আলম

নীরব আর্তনাদে
ধস নেমেছিল যেদিন আমার শহরে-
শেষ নদীটাও দেউলিয়া হয়েছিল
দেনার দায়ে- তোকে নিয়ে লেখা
কবিতার অক্ষরগুলো ভেসে যাচ্ছিলো রক্তস্রোতে-
তখনও আমি তোকে প্রশ্ন করিনি।

সত্যের মূল্যে মিথ্যে বিক্রি করে
যেদিন রচেছিলি চক্রব্যূহ; কুরুক্ষেত্রের
ময়দানে লড়েছিলাম আমি একা-
একের পর এক তিরে বিদ্ধ হচ্ছিল আমার শরীর;
যন্ত্রনায় ভেঙে পড়েছিল আমার শেষ শক্তিটুকুও
তখনও আমি তোকে প্রশ্ন করিনি।

প্রশ্ন তো তাকেই করা যায়-
মূল্যবোধ ঠুকরে খায়নি যার শকুনি।
প্রশ্ন তো তাকেই করা যায়-
যে সত্যের মূল্যে কখনো মিথ্যে বেঁচেনি।

তাই তোকে কোনোদিন কোনো প্রশ্ন করিনি...




প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে মৃত্যু ডাকে বান
আহেদুল ইসলাম আদেল

শোন হে মহাপ্রাণ
এখানে প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে মৃত্যু ডেকেছে বান
লোলুপ পৃথিবী স্বপ্ন দেখিয়ে কেড়ে নেয় অন্ন বস্ত্র জান
সশস্ত্র পরাণের হাতে দেয় অবিশ্বাসের বিষাক্ত অস্ত্র
কৃপণ মানব অন্তরে পুষে বিধ্বংসী কালো চিত্র।
যে বীজ তলা যুগযুগ ধরে প্রস্তুত করেছ খেটে
ব্যথিত চিত্তে সেখানেই দেখি সর্বনাশের ভিটে
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তস্নানে পূত জননী
সেখানেই প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে মৃত্যু ডাকে বান নিরবধি।
ভরদুপুরে নেমে এসেছিল নির্জনতার কালো
হে মহাপ্রাণ, এ মরুর বুকে সদ্যশিশুর অঙ্কুর তোলো
মরা নদের তীরে কূমন্ত্রণার যতো বিভীষিকাময় দৃশ্য
হে মহাপ্রাণ, একবার দৃষ্টি পাত এই বিবর্ণ গ্রাম নগরের ভীড়ে;
এখানে কতো মৃতমানবের কঙ্কাল, এখন পোকার দখলে
তাজা তাজা প্রাণ সহস্র নষ্ট জারজ সন্তান
কুকুর শিয়ালে নিচ্ছে টেনে নির্জন অরণ্যের ভীড়ে
শকুনের চাহনি পরেছে স্বৈরতন্ত্রের মুখে।
হাজার দীপ্ত চেতনা মৃত্য্যু খাটলিতে শুয়ে
লৌহ শাবল লাঙল নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছে গ্রামে গঞ্জে
অন্ন তালাশে হারিয়েছি দিশা, বিপ্লবী চিত্তে লাল সবুজের পতাকা
পুঁজিপতির হিংস্র আঁধার স্বাধীন ভূমি গেছে ছেঁয়ে
আজও ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে নেমে আসে
অভাবের অত্যাধুনিক চিত্র
পচাশি শতাংশই আজও অন্ধকারেই ডুবন্ত;
দগ্ধ হৃদয় তবুও বাঁচতে চায়, জননীর কোলে শুয়ে
একজন চাষার অশ্রু অনলে পুরো পরিবারই জ্বলে
পুত্রের দীর্ঘশ্বাসে চেতনা মৃত্যুকে ডাকে বান
শোষক আর শাসকের বিষে আর হারাবে না কারো মান
রাষ্ট্র মাথা থেকে উচ্ছেদ হবে ক্ষমতা শৃঙ্খলিত করার প্রাণ
জনচক্ষুর আড়ালে পাতিও না আর স্বৈরতন্ত্রের খপ্পর।
আজও কি আমরা পরাধীন বাঙালি?
হে মহাপ্রাণ, আর একবার দৃষ্টি পাত
এই লোকালয় কংক্রিটের প্রাসাদে
মুখেতে মানব পূত ইনছান, অন্তর গেছে পুড়ে
এখানে মৃত্যু ডেকেছে বান, চেতনা চাষার মহাশশান।
এই গ্রাম গঞ্জের মেটোপথ ডোবা নদ
মিথ্যা পেতেছে ঘাঁটি, নির্জন অন্ধকারে অন্তর গেছে ভরি
এখানে পঁচে গেছে কতো, হিং¯্র আঁধার প্রাণ
জন্ম নিয়েছে বিশ্বাসী মহাপ্রাণ
সামনে পিছনে তবু মৃত্যু ঠেকানো দুষ্কর
সম্মুখে শুধু রক্ত লাল পাহাড়
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন পুনঃ লালিত সাধ
মৃত্যুর ফাঁদ পাতে পুঁজিপতি বারংবার
সোনা ফলা প্রাণ এ মৌসুমে তোকে করব না আর রোপণ
এই উর্বর কাঁদায় পুঁজিবাদকে পুঁতে
ডাকব সুখের বান, সাম্যবাদ সমাজ হবে হবেই কায়েম
প্রজ্জলিত পুত্রের চেতনা নিয়ে
এখানে চাষার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে মৃত্যু ডাকে বান।

কাঠ গোলাপ
সৈয়দ ইবনুজ্জামান

কাঠগোলাপ মিশে যায় কফিনের মিছিলে
রয়ে যায় খোয়াবনামার ফসিল
প্রেমপত্র গুলো কর্পোরেটের আবেগী বিজ্ঞাপন
থেকে যায়-
শেষ না হওয়া কবিতার পংক্তি
যামিনীর ওষ্ঠে এঁকে দেয়া চুম্বনের প্রতিশ্রুতি
আরো কিছু!
লাশেরা ফেরে না
স্বপ্ন ফেরে কোন কালের জাতিস্বর হয়ে।



পথের ব্যথা
শ্রীমন্ত দে

পথের বাঁকে আটকে পড়ে মন
নিশুতি কথা ছটফটিয়ে মরে
এখানেই না কি হয়েছিল হোলি খেলা
সাক্ষীরা সব অন্ধ-বধির-শব।
দীর্ঘশ্বাস এখনও কম্পমান
অট্টহাসি আকাশ বাতাস ভাঙে
শোণিতের দাগ অশ্রুতে ধুয়ে গেছে
নির্জন পথে ভাঙা আরশির ব্যথা।


অপেক্ষার আগুন
কাজী রুপাই

পড়ে আছি শূণ্যের বারান্দায়; পকেটে আমার অসংখ্য
সংরক্ষিত মেঘের মাংস। ধারাবাহিক সন্ধ্যার নিয়মন্ত্র
ভেংগে ভেংগে  ছুটে চলছি রেইনট্রির অপার্থিব ছায়ার সাম্রাজ্যে

কালের পকেটে আটকে আছে কিছু রাসায়নিক পদার্থের আগুন
লেগে আছে মস্তিস্কের অনাবাদী কোষে কোষে;
বৈকালিক প্রজাপতির শৈল্পিক ডানার ক্যানভাসে একলক্ষ নক্ষত্রের স্ফুরণ

রোপন করা বীজের অঙ্গরোদগমনের অপেক্ষা এখন
মুখোশ পরিহিত অন্ধকারে উসকে দেওয়ার অপেক্ষা এখন ।




আমি তোমাকে ভালবাসি
আল মামুন

ঐ পাহাড়ের শীর্ষ ভাগে দাঁড়িয়ে
ইচ্ছে তো করে বলি গলা ফাটিয়ে
আমি তোমাকে ভালবাসি...
ঐ আকাশের শূণ্যেতে ভেসে ভেসে
ইচ্ছে তো করে বলি লাজুক হেসে
আমি তোমাকে ভালবাসি...
ঐ চোরাবালির ঢিবিস্থানে ওঠে
ইচ্ছে তো করে বলি কম্পিত ঠোঁটে
আমি তোমাকে ভালবাসি...
ঐ নদী মোহনায় ডুবার আগে
ইচ্ছে তো করে বলি প্রচ- রাগে
আমি তোমাকে ভালবাসি...
ঐ চন্দ্রমাটির বুকে ঘর করে
ইচ্ছে তো করে বলি বিনয়ী স্বরে
আমি তোমাকে ভালবাসি...


শূণ্যতাবোধ
নাবিল তুরাব

বিশাল শূণ্যতাবোধ, দুধারে নদী, মাঝখানে দাঁড়িয়ে তুমি। আল্পস থেকে আলাস্কা, আমুর থেকে হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহে ভেসে চলেছো। কোথায় তোমার তরী আর লাইফজ্যাকেট? শূণ্যতার অনলে পোড়ো তুমি। হিসেব কষতে কষতে একদিন আরো বেশি জেনে যাও শূণ্যতাই জীবন, শূন্যতাই সার।




ক্রোয়শী
অরণ্য

ত্রোয়শীর আজ ৩৩,
পেছেনের মায়া! স্বপ্নের ছায়া!
প্রশ্নের বর্ষন! নিরুত্তরের কায়া!

পেছনের গণ্ডিতে পা,
সে হারায়!
হারিয়ে বেড়ায় মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমতলার সেই বাগানের গেটে,
হারিয়ে বেড়ায় ঘুড়ি উড়িয়ে সেই আনন্দের ভেলার মাঝে,
আর শীতের সকালে পিঠা বানানোর সেই উৎসবের সাজে।
মা বলতো-
করিস না কোনো কাজ, দেখবি একদিন কিভাবে চলতে হয় কাজ করে খেটে খেটে।
আর স্কুল এর সেই মাষ্টার স্যার?
কোথায় সে আজ? আজো কি সে শুধু সেই সাদা শার্ট আর কালো প্যান্টাতেই হাটে?
আজো কি সে তার মতো অভাবী কাউকে ডেকে দু’টো অন্ন দেয়?
আর মায়াভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে-
কেমন আছিস রে? বাবার শরীর ভালো? মা ভালো আছে?

আজো কি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে
সবার সময় সেই গান গেয়ে কাটে?
আর নির্বাক আর রোদনের মতো দস্যুগুলো রাস্তায় চোর পুলিশ খেলার হল্লায় মাতে?
আর সন্ধ্যায়! সন্ধ্যায় কি আজো নিভৃত ভাই বাঁশি নিয়ে বসে?
সে সুর,
সেই বাঁশির ক্রুন্দন আজো কি ক্রোয়শীর মতো কাউকে বিষন্নতার মায়ায় ফেলে?
সে সুর কি আজো কথা বলে?
যে কথার প্রতিটি অর্থ ছিলো-
প্রেম যে বড় বিষময়! পথ ফসকোলেই যে মায়াভরা স্বপ্ন ধসে!
রাতে কি আজো সবাই একসাথে খেতে বসে?
যেমনটা তারা করতো?
যেখানে বাবা বলতো সারাদিনে অফিসের কাজের গভীরতা,
সেখানে তার চোখে থাকতো মাস শেষে মাইনেটা সময়মতো না পাওয়ায় দুঃখের নিবিড়তা।
যেখানে সে করতো: বৃষ্টির দিনে সারা পথ আর হেটেঁ আসবে না সেই প্রলাপ।
যেখানে মা বলতো ক্রোয়শী আর তার ভাই এর দস্যুপনার কীর্তিকলাপ।
সকালে পড়া ফাঁকি দিয়ে আমবাগানে দৌড়োনো,
আর ভাইয়ের লজেন্স নিয়ে খেয়ে ফেলে ক্রোয়শীর হাসির সেই কার্যকলাপ।
আর ছোট ভাইয়ের সেই আবদার- মা, সামনের ঈদে একটা খেলনা কিনে দিও।
আবদারের সময় সে কি মায়াভরা তার চাহনি!
আর ক্রোয়শী?  সে যে এই মধুর সময়ের লগ্নি না শেষ হওয়ার পথ খুঁজতো!
কি আশাভরা হৃদ যে ছিলো তার! তা যদি একবার কেউ বুঝতো!
সেখানে শুধু ছিলো মধুরতার ধ্বনি।
তার দৃষ্টিতে ছিলো সুখের পাতা,আর লিখতো অবিরাম তার স্বপ্নের খাতা।
আজো কি তার মতো সেখানে কেউ তার চঞ্চলতার রংয়ে মাতে?

ক্রোয়শীর মনে আজ স্মৃতির ভারী মেঘ,
মা-বাবা আজ নেই। না ফেরার দেশে তাদের বাস।
ত্রোয়শীর জন্য যে এ বড় সর্বনাশ, সর্বনাশ।
ভাইটাও বিদেশ, সময়রের টানে, অসময়ের আগুনে সে পড়ে আছে।
শিকড়ের মাটি যে ক্রোয়শীর প্রায় শেষ, প্রায় শেষ।
আজ সে মাটির ঘরে থাকে না, কিন্তু সে গন্ধ  তার স্মৃতির পাতায় আজো লেগে আছে।
নিজস্ব শিকড় কি আর ভোলা যায়?
এই স্মৃতি গুলোই যে তার কাছে পড়ে আছে।

কাল ও সূর্য উঠবে,
কাল ও কেউ নতুন করে স্বপ্ন দেখবে,
কাল ও কেউ প্রেয়সীর অপেক্ষায় থাকবে,
কাল ও কেউ আনন্দের বন্যায় সাঁতরাবে।
কাল ও কেউ হতাশায় ডুববে।
কাল ও নতুন করে পৃথিবী সাজবে,
কাটছে দিন তার এভাবেই কাটুক না! স্মৃতি গুলো জমে থাক হাহাকারের মাঝে।



দুর্গন্ধ
রেজাউল রেজা

খুন হওয়া হৃদয়ের নিঃশব্দ আর্তচিৎকার, ষোড়শী তরুণীর বুকে সর্বস্ব হারানোর হাহাকার।
সুখের সংসারে ভাঙনের সুর, সমাজ সচেতন বাবার একমাত্র সন্তান মাদকের নেশায় চুর!

রাত-দুপুরে ডিজে পার্টি, ওয়াটার কিংডমে যুবক-যুবতীর নাচানাচি, ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা।
বাঙালীর সংস্কৃতি ভুলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চর্চা, অতি আধুনিক হতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব।

দিনশেষে ভুল ভেঙে যাওয়া অতঃপর হাজী-হাজীয়ানী, সাধু-ঋষি সাজার ব্যাকুল প্রচেষ্টা।

চর্মচোক্ষে সুখী মনে হলেও, হৃদমাঝারে একরাশ শূণ্যতা। হৃদয়ের অলিগলিতে দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি, বড্ড দুর্গন্ধ!!


অলিখিত চোখের জল
শম্পা মনিমা

ধীর পায়ে আসে গোপনে বয়ে চলে
মৃত্যুর ভেতরে, সহ্য করতে পারেনা তা
ঘুমহীন রাতে না পাওয়ার তাড়িত আবেগে
রোজ অপেক্ষারত মধুময় বিরহের সঙ্গী।

রোজ সে হারিয়ে যায় ফিরে ফিরে আসে
সুযোগের অপেক্ষায়, যা জ্বালাতনের নামান্তর মাত্র
ঢেউ ওঠে শরীরবৃত্তীয় গানের অধরে,
যখন সে আরো পেতে আগ্রহী আদরের মুহুর্তে।

কেন সে আসে? সেকি বিস্তার পুরানো কোনো অসুখে?
নাকি, একটা অপেক্ষা হয়ে থাকা মননের
ভেতরে, নীরবে, না বলাতে চাওয়া আস্তিনের ভাঁজে
মুছে ফেলা কঠিন সত্যিগুলো, গুমরে মরে
অতঃপর তোমার না ফেরার অপেক্ষায়।।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট