ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৮


(গত সংখ্যার পর)
‘দায়ভার। মা সরস্বতীর দেখা পাবেন। মানুষ এমনটাই চায়। বিদ্যা। না হয় বিত্ত।’
উর্মিলা কথা বলে না। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। পিয়ন ডেকে প্যাকেট দুটো নিজের টেবিলে নিয়ে আসে।
দীপু ভাই কথা বলে না। উর্মিলা কথা বলে না।

ম্যানিলা যাবার আগের দিন বেবী আপা তার রুমে ডেকে নেয় উর্মিলাকে।
বেবী আপার চোখে মুখে ব্যস্ততার ছাপ!
‘তোমাকে তো কিছু বলা হয়নি। ম্যানিলা যাচ্ছি সাতদিনের জন্য। দীপু তোমাকে বলেনি?’
‘বলেছে।’
‘দীপু ভালো ছেলে। ওর প্রতি বিশ্বাস রেখো। লেখাপড়ায় মন রেখো। অফিসের কাজ শিখতে চেষ্টা করো। সামনে কত পথ পরে আছে!’
‘জি’
‘বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করে? উনাকে বেড়াতে আসতে লিখে দাও। সমস্যা হলে জাকির সাহেবকে জানিও। তুমি যত তাড়াতাড়ি শিখবে, আমি কিছুটা মুক্তি পাব।’
উর্মিলা কিছুই বুঝতে পারে না। কিসের মুক্তি। বেবী আপার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অসীম এক মমতা যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। উর্মিলার মনে হয়, এমন মাতৃমুগ্ধ মুখ ও আর কখনও দেখেনি।’

০৯.

অফিস শূন্য মনে হয়। সুনসান নীরবতা। এই নীরবতার মধ্যে রংপুর কিলিং-এর আউট লাইন তৈরি করে ফেলে উর্মিলা। বারবার পড়ে। নিজেই আশ্চর্য হয়। এমন আউট লাইন ও নিজে তৈরি করেছে! হয় তো নাজনীন আপা বলবে, ‘উর্মিলা, ওয়েল ডান। তারপরও আইডেন্টিটির ইনফরমেশন নেই। এগুলো মোস্ট নেসেসারি। রিম্ববার ডিয়ার।’
ভাবতে ভাবতে উর্মিলা ত্রুটি ধরতে পারে। তাইতো! আইডেন্টিটির গ্যাপ থাকা উচিত নয়।
রংপুর মিশন নাজনীন আপা কোর্ডেনেট করবে। যেখানে উর্মিলার গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা রয়েছে। তবে বুকের ভেতর এক রকম স্বস্তি অনুভব করে। দুরুদুরু ভাব নেই। ক্রমেই অমিত অদৃশ্য বিশ্বাস উর্মিলার মনোচৈতন্যে ছায়া ফেলতে থাকে। সুরবালা দিদির কথা মনে হয়। চাচা তো বোন। বিয়ে হয়েছিল দূর গাঁয়। হিজলনগর। খসমের সঙ্গে বনিবনা হয়নি। প্রতি রাত বাংলা মদ খেয়ে বাড়ি ফিরত জামাই বাবু। খিটখিট করতে করতে একদিন সুরবালা দিদি অ্যানড্রিন খেয়ে আত্মহত্যা করে। তারপর কেউ সুরবালা দিদির কথা মনে রাখেনি। জ্যাঠাও মনে রাখেনি। এমন বদ নসিব নিয়ে জন্ম নিয়েছিলেন।
উর্মিলার শুধু বুক পোড়ে। আর ওই বাবলা! মানসিক প্রতিবন্দী। সারা পাড়াময় বলে বেড়াত, ‘আমি উর্মি দিদিকে বিয়ে করব।’
ও পাড়ার রফিক ভাই। আহ! কী করুণ সুরে আড়বাঁশি বাজিয়ে মাঝনিশি তোলপাড় করে ফিরত। রফিক ভাই কী এখনো অমন করে সুর তোলে? কী বেদনা তার? অমন রোদনভরা কান্না এখনও বুকেতে আটকে আছে।
উর্মিলার শ্বাস খানেক আটকে এল। জোর করে নিঃশ্বাস নিতেই হাত পা ঘেমে ওঠে।
রুবীর ডাকে আচ্ছন্নতা কাটতে থাকে।
‘আমার মাথা আউল হইতাছে।’
‘কিসের আউল।’
‘এখন বুঝবে না বালিকা। দীপু ভাইয়ের বয়ানে কই।’
উর্মিলা দাঁত বের করে হেসে ওঠে।
‘হাসলি কেন?’
‘তোর এখন বিয়ে দেয়া উচিত।’
‘তাতো বলবেই। নাগর তো সরস। আর আমাকে বিয়ে করার জন্য মানুষের ঠেকা পরছে। আমি কী জুহি চাওলা?’
‘জুহি চাওলা নকল। তুই আসল।’
‘আসল নকল বুঝি না। রঙিলা শহরে কিছুই বোঝার উপায় নাই।’ রুবী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে।
দীপু ভাইয়ের দেয়া কলেজের বইগুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখলেও বেবী আপার দেয়া বইয়ের প্যাকেট খুলেও দেখেনি। আর মাত্র এক সপ্তাহ পর কলেজ শুরু হবে। তার আগেই দীপু ভাই চলে আসবে। ইত্যাকার ভাবনা উর্মিলার মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঘুরপাক খেতে থাকে।
লাঞ্চের পর জাকির সাহেব উর্মিলাকে ডাকে। এই প্রথম জাকির সাহেবের রুমে যাবে উর্মিলা। খুব বেশি অবাক হয়নি উর্মিলা। ভাবনায় এইটুকু ছিল। বর্তমানে অফিসের প্রধান ব্যক্তি। কাজে অকাজে ডাকতেই পারে।
শুধু রুবী একবার উর্মিলার দিকে তাকায়। উর্মিলার কোনো ভাবান্তর নেই। আগের মতো সহজ। ভাবলেশহীন। তড়িঘড়ি করে না। শুধু বুকের উড়নিটা একটু টেনে দেয়। করিডোর দিয়ে যেতে মিতালী শিকদার অযাচিতভাবে বলে উঠে, ‘হেই উর্মিলা।’
উর্মিলা বলে, ‘জি দিদি।’
‘সাবধান।’
উর্মিলা মাথা নাড়ে।
জাকির সাহেবের রুমে ঢুকতেই অনুভব করে সিগারেটের উটকো গন্ধ এসির শীতল হাওয়ায়। অস্বস্তিকর পরিবেশ করে রেখেছে। একটু বিব্রত হয়। দু’হাত তুলে নমস্কার জানায় উর্মিলা। জাকির সাহেব টেবিলের সামনে চেয়ার দেখিয়ে বলে, ‘বস উর্মিলা। আপা তোমার প্রতি আস্থাশীল। সুমি-নাজনীনের দেখলাম তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।’
উর্মিলা লজ্জিত কণ্ঠে বলে, ‘স্যার, গ্রাম থেকে এসেছি তো তাই সবাই একটু করুণা করে।’
‘ছি ছি এ কথা কেন বলছ? সবাইতো গ্রাম থেকে আসে!’
‘জি স্যার।’ উর্মিলা জাকির সাহেবকে চোখের দিকে তাকায়। বেশ বলিষ্ঠ পুরুষ। চোখের পাতা দ্রুত ওঠানামা করে।
‘আপা তোমার প্রতি দৃষ্টি রাখতে বলেছেন। এসব কাজ ভালো লাগে?’
‘লাগে স্যার।’
‘গুড।’
এ সময় পিয়ন দু’কাপ চা রেখে যায়। জাকির সাহেব হাতের ইশারায় উর্মিলাকে চা নিতে বলে।
‘স্যার, আমি বেশি চা খাই না। অভ্যেস কম।’
‘এনেছে যখন। খাও।’
জাকির সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে টাস করে শব্দ করে।
প্রায় মিনিট খানেক গড়ায়। জাকির সাহেবে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বলে, ‘অফিসে আমার সম্পর্কে কিছু শুনে থাকবে হয়তো।’
উর্মিলা বিস্ময় নিয়ে বলে, কেউ আমাকে কিছু বলেনি।’
‘বলবে বলবে। নতুন এসেছ তো!’
‘সমস্যা নেই, স্যার। বাবা বলেছেন, বস অলওয়েজ রাইট।’
‘প্রফেশন বড় কঠিন জায়গা। সবাইকে খুশি করা যায় না।’
‘জি স্যার।’ উর্মিলা মৃদু স্বরে বলে।
‘তুমি তো বেবী আপার মানুষ। তোমার প্রতি আমার দৃষ্টি থাকবেই।’
‘জি স্যার।’
‘অফিসে একটা নিজস্ব মানুষ লাগে না।’
‘জি স্যার।’
‘সমস্যা হলে অকপটে বলবে।’
‘বলব স্যার।’
‘দীপু ছোকড়া কি তোমার পেছনে ঘুরঘুর করে?’
‘না তো!’
উর্মিলা বুঝতে পারে দীপু ভাইকে জাকির সাহেব পছন্দ করে না।

‘সমস্যা নেই স্যার। আমার বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তার পূর্বপুরুষরা সাপের ওঝা ছিলেন। সাপের বিষ নামাতো। আমিও সেই বিদ্যেটা শিখেছি। সমস্যা করলে গোখরা দিয়ে কামড়ে দেব।’ শান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলে উর্মিলা।
জাকির সাহেব অনেকটা হতভম্ব হয়ে উর্মিলার দিকে তাকায়। পা থেকে চুল পর্যন্ত ভালো করে দেখে। ভয়ঙ্কর, অশুভ চোখ নিয়ে উর্মিলা তাকিয়ে আছে। জাকির সাহেব অস্বস্তি ফিল করে।
‘ঠিক আছে। তুমি যাও।’
কিছু না বলে উর্মিলা রুম থেকে বেরিয়ে আসে। (চলবে)


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট