দহন




দহন
আব্দুল্লাহ আল তানিম

আমার শাহানাজ আপু দেখতে যতটা সুন্দরী না কিন্তু তার চোখ দু’টো অসম্ভব সুন্দর। যতটুকু জানি চোখে কাজল দিলে নাকি মেয়েদের খুব সুন্দর লাগে কিন্তু আমার আপু তাও দিতো না তবুও তার চোখ কেনো এতো সুন্দর। হয়তো এই চোখ দেখেই আবির ভাইয়া আপুকে ভালবেসেছিলো।  ভালবাসতো বললে ভুল হবে আজও ভালবাসে।

আপু আর আবির ভাইয়ার পরিচয় হয় মেডিকেলে।
আপু তখন উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলো।  আপু সবসময় আব্বুর সাথে কলেজ যেত এবং আসতো । কারন আমার আপু ছিলো প্রচ- রকমের ভীতু একটা মেয়ে। সেদিন আপু একাই কলেজে যেতে বাধ্য হয় কারণ কলেজ বেতন এবং অন্যান্য যাবতীয় খরচ আজ শেষ তারিখ ছিলো। আর আব্বু বাসায় নেই বলে আপুকে একাই যেতে হলো।

যাওয়ার পথে আপু দেখলো একটা রিক্সা এক্সিডেন্ট হয় আপু গাড়ি থেকে নেমে এসে দেখে আব্বুর বয়সের একজন লোক আহত অবস্থায় পড়ে আছে। কেউ ধরছে ও না সবাই দাড়িয়ে দেখতে লাগলো কিন্তু আপু ওই লোকটার পকেট চেক করে একটা আইডি কার্ড বের করলো। উনি একজন ব্যাংক কমর্কতা ছিলেন।  আপু তখনি ওই লোকটিকে সিএনজিতে তুলে দিতে বললে কয়েকজন এসে তুলে দেয়। আপু তার পরিচিত একটা মেডিকেল নিয়ে যায়।

মেডিকেল নিয়ে গেলে ডাক্তার রোগীর সাথে তার সম্পর্ক জানতে চাইলে সে তার ডাক্তার বলে পরিচয় দেয়। ডাক্তার তাকে কিছু ফরম্যালিটি কাজ করতে দেয়। সে আইডি কার্ড থেকে নাম বয়স ঠিক করে লিখে দেয়। ভাগ্য ভালো তার কাছে টাকা একটু বেশি ছিলো।  ঐ যে কলেজ বাবদ খরচের টাকাগুলো। এমন সময় তার পরিচিত ডাক্তার খালা এসে বলে শাহানাজ তুমি এখানে তখন সে সব বললো ডাক্তার খালাকে। খালা বললেন উনার বাসায় কল করো। তখন তার পকেট থেকে মোবাইল যেটা পায় ওটা থেকে কল লিস্টে যার নাম্বার আগে ছিলো তাকেই কল দিলো।

শাহানাজ আপু কল দিয়ে সালাম দেয় আর ওপাশ থেকে একটা ছেলের কথা শুনা গেলো সে যানতে চাইলো কে আপনি ? আমার আব্বুর মোবাইল আপনার কাছে কেন ?? শাহানাজ আপু  তখন সব ঘটনা জানায়।

আপু মোবাইল ব্যবহার করতো না বিদায় বাসা থেকে কোন কল আসেনি তাই কিছু জানতে পারেনি।  অবশেষে ঐ লোকটির বাসার সবাই আসে তারা শাহানাজ আপুকে অনেক ধন্যবাদ জানায়। উনার জ্ঞান আসলো। তখন উনি কথা বলতে পারেননি বিধায় কোন কথা হয়নি আপুর সাথে। আপু চলে আসার পর শাহেদ সাহেব এর ডাক্তার এসে বলে আপনার  ভাইয়ের মেয়েটা কই ? ওহ বলা হলো না যিনি এক্সিডেন্ট করেছিলেন উনার নাম শাহেদ। তখন শাহেদ সাহেবের বড় ছেলে আবির বলে, উনি তো চলে গেছে কেনো ?? আর সে আমাদের রিলেটিভ না আমার বাবার জন্য মিথ্যা বলেছিলো তাই দয়া করে কিছু মনে করবেনা না।

ডাক্তার তখন বলে আজকাল নিজের সন্তান এতোটা করেনা যতটা এই মেয়ে করলো সে উনার জন্য তার কলেজ বেতন দিয়ে এডমিট করালো। তার টাকা গুলোও তো দেওয়া হলো না। জানিনা মেয়েটার কি হবে আজ। আবির এডমিট ফরম থেকে জানতে পারে তার নাম শাহানাজ। আবির তার বাবাকে ২ দিন পর বাসায় নিয়ে আসে। শাহেদ সাহেব এখন অনেক সুস্থ।  শাহানাজ আপু এরপর মেডিকেলে এসে আবার খোঁজ নেয় কিন্তু ডাক্তার বললো উনারা তো চলে  গেছেন।  তখন এটা শুনে আপুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

শাহানাজ তার পরিবারকে সব জানায় তার মা কিছু না বললেও বাবা খুব খুশি হয় মেয়ের কথা শুনে। শাহেদ সাহেব এখন পুরোপুরি সুস্থ। উনি এখন সবার সাথে শাহানাজকে নিয়েই কথা বলেন। পরিবার সবাই বলে, কই পাবে তাকে খুঁজে, আমরা তো তার মুখ ও দেখিনি মুখ হিজাব ছিলো তার চোখ ছাড়া কিছু দেখলাম না,  ঠিকানাও জানিনা। শাহেদ সাহেব তার বড় ছেলেকে ডেকে বলে বাবা তুমি কি শাহানাজ মুখ দেখছিলে? সে না সূচক জানালো । তবে সে বললো বাবা আমি খুঁজে বের করবোই তাকে কথা দিলাম।

তার মা রেহানা বেগম বলে, কি ভাবে ?? তখন আবিরের ছোট ভাই বলে, মা ভাইয়া পারবেই। কেননা ভাইয়ার রুমে আর্ট করা সেই আপুটির চোখ। আবির বলে, তুই চুপ করবি, রেহানা বেগম কিছু বলার আগেই আবির চলে যায়। রুমে এসে তার আঁকা চোখ আর তার সেদিন দেখা চোখ গুলো সত্যিই এক হলো কি ? আবির নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে কত মেয়েকে কলেজ লাইফ দেখলাম এখন ভার্সিটিতেও দেখি কিন্তু এই চোখ কখনো দেখেনি। সে বলে কারো চোখে এতো মায়া কিভাবে থাকে আর এতটা সুন্দর তাও কাজল ছাড়া। টানা টানা চোখ এক কথায় মায়াবী কন্যা আবির শাহানাজের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরের দিন থেকেই আবির সেই এক্সিডেন্টের জায়গায় গিয়ে তাকে খুঁজতো, তার ধারনা সে তো এই রোড দিয়ে কলেজ যায় একদিন না একদিন ঠিক পাবে। এই ভাবে  আবির ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহ ৬ দিন ওই রোডে যেতো।  কিন্তু সে কি জানতো না শাহানাজ কলেজে যাওয়া জন্য অন্য রাস্তাও আছে যে রাস্তায় সে সবসময় যায়। এভাবে কেটে গেলো ২ বছর। শাহানাজ এখন অনার্স প্রথম বর্ষে  আর আবির এম বিবি এ পড়ছে।  আবির আজও আসে পাশের সেই রাস্তা গুলোর মাঝে খুঁজে তার মায়াবী কন্যাকে আর শাহেদ সাহেব ও মাঝে মধ্যে এই রাস্তায় আসেন তার না ডাকা মা মনির খুঁজে।
শাহানাজ আগের থেকে একটু পালটালো সে এখন বান্ধবীদের সাথে কলেজ যায় আর সে এখন মুখ বাঁধে না কারণ তার সমস্যা হয় ডাক্তার বারণ করেছে।  মাঝে মাঝে ক্লাস শেষ করে ফুচকা খেতে যায়।  আজ শাহানাজের জন্মদিন তাই বন্ধুরা মিলে সবাই খেতে গেলো তার প্রিয় রেস্টুরেন্ট-এ।

খাওয়া দাওয়া শেষে বান্ধবীরা মিলে খোলামেলা জায়গায় বসে আছে।  তাদের পাশের টেবিলে কয়টা ছেলে ফুচকা খাচ্চে আর একটি ছেলে বার বার শাহানাজ আপুর দিকে তাকাচ্ছে আবার চোখ সরিয়ে ফেলছে। এটা শাহানাজ আপুর বান্ধবী আরিতা খেয়াল করলো। সে শাহানাজ আপুকে বললো পিছনের একটা ছেলে বারবার তোর দিকে তাকাচ্ছে। শাহানাজ আপু আর তার বান্ধবীরা চলে যায় আর তার পিছু নেয় ঐ ছেলেটা। শাহানাজ আপু একবার তাকালো ওর দিকে আর সে চিন্তা করতে লাগলো খুব চেনা চেনা লাগছে ছেলেটিকে। কিন্তু কে হতে পারে হয়তো তার ভুল হচ্ছে কোথাও।

সব বান্ধবীরা যার যার পথে রওনা দিলে শুধু আরিতা আর শাহানাজ আপু রয়েগেলো, তারা আইসক্রিম খেতে বসলো একটা দোকানে। তারা দেখলো সেই ছেলেটি এখানেও আসলো । আরিতা বললো, দেখ ওই ছেলেকে প্রশ্ন করি কেন তোকে ফলো করছে।  তারা কিছু বলার আগেই ছেলেটি এসে মানে আবির এসেই বলে শাহানাজ আপুকে আপনি  হিজাব দিয়ে মুখটা বাধুন তো।  আরিতা আর শাহানাজ কথা শুনে অবাক হলো । সে আবির কে বলে, আপনি কে ? আমার পিছু কেনো নিচ্ছেন আর আপনার কথা কেন শুনবো আমি ? আবির খুব মিনতি করার পর শাহানাজ আপু রাজি হলো। সে মুখ হিজাব করলো, আবির কিছুক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো তারপর বললো আপনি শাহানাজ ?

শাহানাজ বলে হ্যাঁ,  আমি-ই শাহানাজ আপনি কে ?? তখন আবির তার নাম বললো এবং পরিচয় দিলো।  শাহানাজ আবির কে চিনতে পেরে তার পরিবারের কথা জানতে চাইলো। তাদের মধ্যে অনেক কথা হলো।  কথা শেষ করে আবির শাহানাজ আপুর ফোন নম্বরটা চেয়ে নিলো, তারপর বিদায় নিলো।

যখন আপু রাতে ঘুমাতে যাবে তখন আবির কল দেয়।  তাদের মধ্যে পড়ালেখা, পছন্দ-অপছন্দ সব কিছু নিয়ে কথাবার্তা হয়। অবশেষে ভালবাসার মানুষ নিয়ে কথা হলে শাহানাজ জানায় তার এসব পছন্দ না আর আবির জানায় একজনকে সে খুব ভালবাসে আজ ৩ বছর ধরে কিন্তু এখনো বলা হয়নি ঐ মানুষটাকে।  অনেকক্ষণ কথা বলার পর আবির শুভ রাত্রি বলে ফোনটা রেখে দেয়।

পরের দিন শাহানাজ তার মাকে জানায় যে আজ সে তার নতুন ঐ নতুন আঙ্কেল এর বাসায় যাবে দেখা করতে।  তাই তাকে আবির কলেজ থেকে রিসিভ করে। শাহেদ সাহেব ওকে দেখে এতটা খুশি হলো তা বলে বুঝানো যাবে না। সবাই তাকে অনেক ধন্যবাদ দেয়। আবিরের ছোট ভাই রাকিব বলে, আপু আপনার জন্য দেবদাস ২ বছর বাস-টার্মিনাল ঘুরছে, অবশেষে খুঁজে পেলো তার মায়াবী কন্যাকে। আবির রাকিব কে বললো, তুই চুপ করবি। শাহানাজ আপু খুব বেশি লজ্জা পেলো। তারপর সবাই মিলে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো। আবির বলে কাল তোমার জন্মদিন ছিলো রাতে বলেছিলে। আজ আমরা সবাই একসাথে আছি তাই আজ শুভেচ্ছা জানালাম।

আবিরের মা খাবার আনলেন টেবিলে, শাহানাজ আপু লক্ষ করলো টেবিলে রাখা খাবারগুলো তার পছন্দের খাবার। সে বুঝে ফেললো কাল রাতে কথার মাঝে পছন্দের খাবারগুলো আবির সব কেন জেনে নিয়েছিলো। খাবার শেষে আবিরের ছোট ভাই শাহানাজকে বলে, আপু আবির ভাইয়ার রুমে যাবো আসুন। তারা গেলো। রাকিব আবিরের আঁকা সে চোখের ছবি দেখালো। আর তার ভাই আবির দুই বছর ধরে কেন খুঁজছিলো সব বলে দিলো শাহানাজ আপুকে। আবির তার ডায়েরীর পাতায় শুধু শাহানাজকে নিয়েই লিখছিলো। রাকিব আবিরের ডায়েরীটা আপুর হাতে দিলো। আপু পড়ে নিলো ডায়েরীটা। তারপর আবির চলে আসে রুমে। এসে দেখে রাকিব আর শাহানাজ দুজনে চুপ হয়ে বসে আছে। আবির বুঝতে পারেনি এতক্ষণ কি হয়েছিলো এ রুমে।

শাহানাজ বুঝতে পারে ওই পরিবারটা তাকে খুব ভালবাসে। আপু আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে তার  মনের ভাষা বুঝতে পারে। আবির সবসময় শাহানাজ আপুর খোঁজ নেয় কিন্তু শাহানাজ কখনো একটি বারও নিজ থেকে খোঁজ দেয় না। দুপরিবারে অনেকটা সুখের মিল ছিলো।  কিন্তু আবির ও তার পরিবার একটি কথা জানে না তা হলো শাহানাজ এ পৃথিবীতে মাত্র কিছুদিনের অতিথি । তার থ্যালাসেমিয়া নামক একটি কঠিন অসুখ। আর তার মাথায় টিউমার আছে যা ভালো হওয়ার উপায় নেই বললেই চলে।

শাহানাজ তার পরিবারকে বাসা পাল্টাতে বলে আর সে কলেজও বদলে ফেলে এমন কি আবিরের পরিবার যেনো তাকে খুঁজে না পায় কারন আবির নামক ছেলেটি তার ভাবনার মাঝে মিশে যাচ্ছে... তাই সে চায় না তার সাথে আরেকটি জীবনকে জড়াতে। বাসা ছেড়ে চলে যায় তারা নতুন এলাকায় নতুন জায়গায়  মোবাইল সিম হতে সব কিছু বদলে ফেলে। অন্য দিকে আবির আর তার পরিবার খুঁজতে থাকে আগের মতই আবারো।  নীড় খোঁজের মাঝে চলে যায় পাঁচটি বছর।

এখন শাহানাজ পড়ালেখা করেনা। সে এখন আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। হঠাৎ তার ইচ্ছে হলো পুরানো সেই রেস্টুরেন্ট যেতে আর পথ শিশুদের সাথে সময় কাটাতে। তাই তার মা তার বান্ধবী আরিতাকে কল করে। সে এসে নিয়ে যায় সাথে ছোট বোন শিফাও যায় সে একা একা বসে রইলো সেই নিরিবিলি জায়গাটিতে। হঠাৎ একজন তার পাশে বসে বলে উঠলো লুকাতে তো খুব ভালো পারো তা পেরেছো কি ? নাকি ভালবাসার মানুষ হিসেবে আমি খুব খারাপ নাকি আমার পরিবার খারাপ যে এত কষ্ট দিয়ে গেলে। জানো মা বেঁচে নেই তবে তার ছেলের বউয়ের জন্য সব পছন্দের জিনিস রেখে গেছে , চুপ কেনো ? কথা আসে না নাকি বোবা হয়ে গেলে ?

শাহানাজ আবির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো আর ভাবলো যে ছেলেটি এতটা স্মার্ট ছিলো কি স্টাইল ছিলো চুলের। আর আজ তাকে দেখতে দেবদাস ছবির হিরো কে হার মানালো। কতশত ভাবনা ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে পানি চলে এলো। চোখের জল মুছে সে আবির কে বলে, কেমন আছেন? আর আন্টির কি হয়েছিলো তখন আবির জানায়, উনি স্ট্রোক করেন আর সেইদিন ই যেদিন থেকে তোমরা বাসা ছেড়ে চলে গেছো... তখন বেঁচে গেলে পরের দিন মা একটা কাগজে লিখে রাখে বউ মাকে পেলে আমার এই গয়নাটা দিবি আবির ? শোন, শাহানাজকে ছাড়া তুই কাউকে বিয়ে করবিনা। আর রাকিব তোর ভাবিকে না আনার আগেই তুই বিয়ে করলে তোর খবর আছে। দেখিস একদিন তাকে খুঁজে পাবি। আর তোদের বাবার খেয়াল রাখিস। এই ছিলো মায়ের কথা আর তার কিছু সময় পর মা না ফেরার দেশে চলে যান।  তাই রাকিব তার মায়াবী ভাবি আর বাবা তার মা-মনি কে খোঁজে আর আমি ?? আমার কি অপরাধ ছিলো তা জানার জন্য মানুষটাকে খুঁজি।

আচ্ছা, কেমন আছো বলো তারপর আমার উত্তর জানতে চাইবো। শাহানাজ মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছে বলে, আমি ভালো আছি তবে আমি কোন উত্তর দিতে পারবো না। এটা বলে উঠে যেতে চাইলে আবির তার হাত ধরে এই প্রথম। প্রথমবারের মতো হাতে হাত রাখা শাহানাজ আপুর খুব ইচ্ছা করছে আবিরের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে কিন্তু না সে পারবে না। কেননা তার ভাগ্যটা এতটা ভালো না।

আবির বলে উঠে আজ আমার কথা শুনতে হবেই আর সব প্রশ্নের জবাব চাই। বলো কি দোষ ছিলো আমার আর আমার মা-বাবার ছোট্ট চাওয়াতে যে তুমি না বলে চলে গেলে, হারিয়ে গেলে। কি অপরাধ ছিলো আমার পবিত্র ভালবাসাতে বলো ?? এমন সময় শাহানাজ আপুর বোন আর বান্ধবী এসে বলে ওর হাত ছেড়ে দিন ওকে এখন যেতে হবে । আপনি আবির সাহেব তাই না ?? আবির ভাইয়া আপুর হাত ছেড়ে দেন.. আপু হয়তো ব্যথা পাচ্ছে খুব। আবির বলে, ও ব্যাথা পাচ্ছে ঠিক কিন্তু ওর চেয়ে বেশি ব্যাথা আমি পাচ্ছি তার চুপ করে থাকাতে।

কিছুক্ষণ পর শাহানাজ নিচে পরে যায়। আবির তাকিয়ে রইলো আর সে পাগলের মতো কান্না করতে করতে বললো, শাহানাজ আমার আচরনে কষ্ট পেলে ক্ষমা করে দাও। চোখ খুলো কি হয়েছে তোমার ?? শিফা আর আরিতা দুজনে বলে, এজন্যই বলছিলাম আমরা আপুর হাতটা ছেড়ে দিতে। আপুর হাতে ওর মেডিসিন আর ইনজেকশনের সময় পার হয়ে যাচ্ছিলো। আবির ওদের কথা কিছু বুঝতে পারছে না। কি বলে এরা। শাহানাজ আপুকে তারা গাড়িতে তুলে মেডিকেল নিয়ে যায়।  ডাক্তার বলে, ওর আজ আবার এই অবস্থা ?? শিফা তুমি কি ইনজেকশন আর মেডিসিন খাওয়ানি ?? আবির ডাক্তারকে বলে, কি হয়েছে শাহানাজের ?? আমাকে বলুনতো। কিন্তু শিফা ডাক্তারকে বারন করাতে ডাক্তার কিছু বলেন নি। তারপর আবির আবার শিফাকে বলে, ওর কি হয়েছে বলো ?? শিফা কিছু না বলে তাদের বাসায় নিয়ে যায় আবিরকে আর হাতে একটা ডায়েরী দেয়।

আবির ডায়েরীটা পড়তে থাকে। ডায়েরীর মাঝ পৃষ্ঠায় কিছু লেখা পায় তা হলো এমনঃ
‘০৩/০৭/.... আজ বার বার এক জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। চোখ গুলোর মাঝে অদ্ভুত একটা নেশা ছিলো। খুব ইচ্ছে করছিলো তার চোখের মাঝে নিজেকে হারাতে। কিন্তু আমার মতো মেয়ের স্বপ্ন দেখতে নেই, ইত্যাদি। তারপর অন্য একটা পৃষ্টায় লেখা ছিলো আজ আবিরদের পরিবারের সাথে দেখা হয়ে বুঝলাম এমন পরিবার পাওয়ার জন্য সবাই স্বপ্ন দেখে। আমি জানি আমি পেতে যাচ্ছি  কিন্তু আমার পক্ষে তো সম্ভব না। আরও একটা পৃষ্টায় লেখা ছিলো আজ আমার ভালবাসার মানুষটিকে না বলা কথাগুলো রেখেই বিদায় নিচ্ছি। আমি তাকে বলতে পারছিনা কেনো চলে যাচ্ছি। আমি চাই সে খুব ভালো থাকুক আর সবসময় সুখে থাকুক। তাই তো তাকে নিজের বাঁধনে বাঁধতে চাই না আমি।

শাহানাজ আপু এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কিছুদিন পর খুব অসুস্থ হয়ে পরে। মেডিকেলে নিয়ে গেলে ডাক্তার জানায় তার থ্যালাসেমিয়া আর মাথায় টিউমার হয়েছে, যা তার সুখের দিন গুলোর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তখন থেকে সে হাসিখুশির মাঝে নিজেকে রাখে। সে সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতো। কেউ জানতো না যে সে আর মাত্র কিছুদিনের অতিথি।  এর মাঝে এই তো আবির আসলো তার জীবনে আলোর প্রদীপ হয়ে। কিন্তু আপু জানতো তার আলো নয় অন্ধকার তাই আমার মনের খাঁচা থেকে তাকে মুক্ত করে দিলো। আপু জানে সময়ের সাথে সে হারিয়ে যাবে। আবির চাইলেও পাবে না খুঁজে, ভুলে ও যাবে হয়তো। হয়তো ভালোবাসি কথাটি কখনো আবির কে বলা হবে না।

আবির ডায়রিটা আর পড়তে পারছেনা তার চোখ দুটো ছল ছল করছে কিছু লোনা পানি জমে। সে মেডিকেল গিয়ে শাহানাজের রুমে গেলো। তার দিকে তাকিয়ে রইলো। শাহানাজ চোখ মেলে তাকালো, ওর চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে পানি তার গাল বেয়ে পড়তে থাকে।  আবির বললো, আমার মায়াবী কন্যা আজ থেকে আর তার চোখের পানি ফেলবে না। ভালোবাসি কথাটি বলা হয়নি তবুও আমি তোমাকে ভালোবাসি আর বাসবো।  আমার বিয়ে পরশু আর তোমাকে আসতেই হবে। শাহানাজ বলে সত্যি তুমি বিয়ে করবে ?? আবির বলে হ্যাঁ পরশু করবো কাল তুমি মেডিকেল থেকে ঘরে যাচ্ছো তাই কাল নয় তবে পরশু বিয়ে করবোই।

আজ আবিরের বিয়ে সে শাহানাজের জন্য শাড়ী নিয়ে আসে তাদের বাড়িতে। শাহানাজ এখন কিছুটা সুস্থ। শাহানাজ আজ বউ সাজবে,  শিফা শাহানাজ কে শাড়ি পড়ায়।  আজ আবির শাহানাজের চোখে কাজল দেয়, কপালে টিপ আর চুলে খোপা আর সে খোপায় পড়িয়ে দেয় লাল গোলাপ। আবির নিজে সাজিয়ে শাহানাজ কে আয়নার সামনে নিয়ে বলে আমার বউকে কেমন লাগছে বলো তো ?? শাহানাজ চোখ খুলে দেখে সত্যি আজ তাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। বিয়ের সাজে অবশ্য সব মেয়েকেই সুন্দর লাগে।

আবির আর শাহানাজের বিয়ে হয় খুব ধুমধাম করেই। আবির আর শাহানাজ এর আজ বাসর রাত।  শাহানাজ বসে আছে হাজারো ফুলের মাঝে এই রাতটি তার জীবনে আসবে সে ভাবেনি কখনো। আবির রুমে আসলো এসে শাহানাজ কে বলে, উঠো আর অজু করে আসো দু-রাকাত নফল নামাজ পরে নিলো দুজনে।  আবির কে সালাম করে নিলো শাহানাজ। আবির বলে, কি চাও বলো তো আজ তুমি যা চাইবে আমি তা দিবো। শাহানাজ বলে আমি চাই আমার যেটুকু সময় আছে তার মাঝে আমি তোমার সব সময়ের সাথী হতে। আর চাই আমার মৃত্যুর পর তুমি আবার খুব ধুম ধাম করে বিয়ে করে নিবে আর তোমার সেই বউকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবেসে তোমার বুকের মাঝে রাখবে।

আবির তাকে কিছু না বলে চুপ থাকে। শাহানাজ জেদি মেয়ে, শাহানাজ তাই তাকে হ্যাঁ বলাতে বাধ্য করে। আবির শাহানাজের সব সময় কেয়ার নেয় নিয়মিত ঔষধ খাইয়ে দেয়। রাকিব আর শাহেদ সাহেব শাহানাজ কে পেয়ে খুব খুশি তারা ও তার যতœ নেয়। কোথায় সে নিবে সবার খেয়াল আর উল্টো ওরা নিচ্ছে। শাহানাজ নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করে, সে তার ডায়রিতে আজ ও লিখলো পৃথিবীর সব সুখ সে পেয়ে গেলো মা শব্দটি শোনা ছাড়া। এতদিনে হয়তো সে মা হয়ে যেতো কিন্তু সে চায়না সে চলে যাওয়ার সময় কিছু রেখে যাক আবিরের কাছে। কারণ, সে আবিরকে বলেছে নতুন বিয়ে করে সুখে থাকবে। সে তার নতুন সংসার সাজাবে। আবির একদিন দেখে শাহানাজ বাচ্চা না হওয়ার জন্য মেডিসিন খাচ্ছে। তখন জানতে চায় কেন সে এমন করলো ??  আবিরের বুঝতে বাকি রইলো না যে কেন শাহানাজ এমন করলো। সে হয়তো তার বাচ্চা কে অন্য কারোর উপর ভরসা করে দিতে চায়না। আবির তখনি শাহানাজ কে ওয়াদা করায়, সে যেন আর না খায় এই মেডিসিনগুলো।

দু-মাস পর শাহানাজ প্যাগনেন্ট হয়।  আবির খুব খুশি হয় সেটা জেনে। সে শাহানাজ কে আরও বেশি যতœ করতে লাগলো। তার মাঝে মাঝে ব্যথা ওঠে কিন্তু সে এতো খুশির মাঝে ভুলে গেলো যে তার আয়ু কমে আসছে।  খুব কষ্ট হয়েছিলো তবু এর চেয়ে কষ্ট হলো তাদেরকে ছেড়ে যেতে হবে।  কয়েক মাস পর তার একটি মেয়ে হয়, তার নাম রাখা হয় হিমু জাহান আলো। সে আলোর মতো আলোকিত ছিলো।

খুব সুখের মধ্যে দিয়ে শাহানাজের শেষ বিদায়ের দিন গুলো আসলো।  মেডিকেলে শুয়ে আছে পাশে আবির ও তার মেয়ে হিমু। শাহানাজ পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিলো এক এক করে, সবাই যেন পাথর হয়ে রইলো। আবির তার কপালে আলতো ভাবে চুমো দিয়ে বলে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তুমি ?? তোমার কি আমার জন্য কষ্ট হয়না ?? আমাকে একা রেখে আমার হাত ছেড়ে দিবে ??  তুমি তোমার মেয়ে হিমু কে ছেড়ে চলে যাবে ?? যাওয়ার কথা বললে বাবা মেয়ে আড়ি দিবো দুজনে কথা বলবো না তোমার সাথে। আবিরের কথা শুনে শাহানাজ আর চুপ রইলো না তার কান্না আর রাখতে পারলো না। সে আবির কে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার হিমুকে নতুন মা এনে দিবে তো কথা দাও ?? আর আমাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরো। তোমার বুকের মাঝে আমাকে আগলে রাখো। এই আমাকে একটি বার বউ বলে ডাকো, যেমনি সবসময় ডাকতে।

আবির তার প্রাণের প্রিয়সখী কে বউ বলে ডাকলো। তার কিছু সময় পর শাহানাজ শেষ নিঃশ্বাস নিয়ে পৃথিবী  ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেলো। আবির বার বার মৃত দেহটাকে জড়িয়ে ধরছে আর বলছে, বউ এই বউ বৃষ্টিতে ভিজবে না তুমি ?? আসো বাইরে হিমেল হাওয়া বইছে আজ ওরাও তোমাকে তাদের মাঝে মিশাতে চায়। তারপর আবির তার মেয়েকে বুকে নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করে তার কোন শব্দ নেই, শিফা আর রাকিব আবির কে ধরে উঠাতে গেলে আর উঠেনি। রাকিব আর শিফা তাকে ধরে তারা বুঝতে পারে আবির আর নেই। শিফা আর রাকিব আর নিজেদের কে কেউ সামলাতে পারলো না। এক সাথে দু দুটো মৃত্যু, ভালবাসার টানে দুজনে চলে গেলে।

আবিরের রুমে আজ সবাই বসে আছে শিফার কোলে হিমু। তখন আরিতা এসে ২ টা ডায়রি দিয়ে যায় ওকে আবির দিয়েছিলো হিমু হওয়ার দুদিন পর ...
ডায়রিতে লেখা ছিলোঃ-
প্রিয়তমেষু তোমার সব চাওয়া পূরণ করতে পারবো কিন্তু এই একটি চাওয়া বাদে তুমি বাসর রাতে বলেছিলে তুমি না থাকলে আরেকটি জীবন কে জড়াতে কিন্তু আমি পারবো না। হিমি হওয়ার পর বলতে ওর জন্য একটা নতুন মা আনতাম আমি হয়তো মা আনতে পারবো না তবে আমি তাকে আমার সবটুকু দিয়ে ভালবাসবো। আর জানো আমি ওর জন্য মা নয় চাচী আম্মু আনবো। তোমাকে তা সারপ্রাইজ দিবো তোমার জন্মদিনে।  তাকে তারা পৃথিবীর সব সুখ দিলো সবার ভালবাসায় বড় হলো আবির আর শাহানাজের ভালবাসার ফসল।

কি মা-মনি তোমার বাবা মায়ের গল্প শুনলে তো তুমি। বলেছিলাম তোমার ১৮তম জন্মদিনে শুনাবো।  শিফা খেয়াল করলো তার আদুরেরর হিমুর চোখে জল চল চল করছে। হিমু রাকিব আর শিপাকে জরিয়ে দরে বললো ভালবাসি তোমাদেরকে  অনেক বেশি ভালোবাসি। ’

ভালোবাসার মানুষ, সেই প্রথম দিনের চুম্বন, সেই প্রথম দিনের উষ্ণ আলিঙ্গন সব কিছুই হেরে গেল মৃত্যুর কাছে।

মানুষের জন্ম হয়, মৃত্যু হয়।  ভালোবাসার জন্ম হয়, মৃত্যুও হয়। সব স্বঁপ্ন পূরণ হয় না। সব স্বঁপ্ন পূরণ হতে নেই। 

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট