পদাবলি - ০৩



খোরাকী কেনা
মোস্তফা হায়দার

ঘুমের বিছানায় মরতে মরতে জেগে উঠি
বালিশের নীচে জমা রাখি বিশ্বাস
দিনের আলোর কাছে তা থাকে বন্ধক!

বেহায়াদের হাসির কাছে সূর্যের আলো জিম্মি!
বাতাসের মিহিসূরে কেঁপে ওঠে চেতনাবাদ
আস্থারপিঠে চড়ে সোহাগ খোঁজে মিথ্যাবাদী

কাঁচের দেয়ালে ভর করা সোহাগবাদিরা
পণ্য পাঠায় পাদুকার নীচে থাকা পদবীর কাছে
ভেঙ্গে দেয় না বিশ্বাসে কেনা কাবিন নামা!

পালকীর সোহাগ বুঝে আস্তর ভেদ দেখে
পান পাত্রের মতো উষ্ণতা বেড়ায়
খসে যাওয়া বিবেকের খোলসে দেখতে বসে

রাতের বাবহারে দিনের আয়না ভেঙ্গে চুরমার
খোরাকী কেনা হলেও কৃষক মরুক মাঠে!

এখানে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়
সুমন আমীন

এখানে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়
বড় ভয় আজ বেঁচে থাকা
শ্বাপদ পথের শেষে শুধু মৃত্যু
অপঘাতে ক্ষয়ে যায় হাজার স্বপ্নের সৌধভূমি।

এখানে ফুটেনা ফুল নতুন সকাল নিয়ে
প্রজাপতি বনবাসে সীতার দীর্ঘশ্বাসে।

এখানে পাখির কন্ঠে নেই গান
কপোত কপোতী আজ
পৌরাণিক নিস্তেজ পাথর য্যানো
শিশুরাও বুঝে গেছে
নিষেধের বেড়াজালে হাসি কলধ্বনি

এখানে আত্মগৌরবের চরে
হাজার শকুন করে উড়াউড়ি

ইতিহাস তুমি ক্ষমা কর
ভুল পথে চলে গেছে রক্ত স্রোতধারা
বিশ্বাস দাফন করে শান্তি হলো সর্বহারা।


মানুষের মাঝে আর মনুষ্যত্ব নাই
দিপংকর দাশ

ও লালন সাঁই,
মানুষ ভজে গেছো শুধু তুমি
মানুষেরই মাঝে আছে স্বর্গ ভূমি
কোথায়? আজ তো মনুষ্যত্ব নাই।

ও লালন সাঁই,
কেমন মানুষ খুঁজেছো ধরায়?
যে মানুষ তার হাতটি বাড়ায়
পরের ক্ষতির লাই।

তুমি খুঁজেছো তুমি ভজেছো সেই মানুষের মন
যে মানুষ তার দু’নয়নে করে মানুষের সাধন
যে মানুষ ছিলো সত্য পুজারি বুঝিতো সবার কষ্ট
যে মানুষ কভু পথ হারিয়ে মনুষ্যত্ব করেনি ভ্রষ্ট।

ও লালন সাঁই,
হিন্দু-ইসলাম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মানোনি কোনো ধর্ম
সবার আগে মানুষ সত্য বুঝিয়েছো মানব কর্ম
সে তো আজ আর নাই।

ও লালন সাঁই,
যে নগরে বিলিয়েছো তুমি মানবতার ঐ দীক্ষা
সে নগরে নেইগো মানুষ নেইগো সে মহান শিক্ষা
হতাশায় ডুবে যাই।

ভাইয়ের হাতে ঝরে দেখো আজ আপন ভাইয়ের রক্ত
দূর্বল মরে কাঁদিতে কাঁদিতে সকলি শক্তের ভক্ত
তুমি কি চেয়েছো এভাবেই মানুষ লাঞ্চিত হোক রোজ?
মানুষের রক্তে মানুষের মাংসে মানুষেরই হোক ভোঁজ!

ও লালন সাঁই,
ঘুমিয়ে গেছে মানুষের প্রেম জেগে উঠেছে হিংসা
বিষাক্ত হয়ে গেছে ধরণী চারদিকে জিঘাংসা
মানবতা কোথাও নাই!


 ধানশালিক ইউটিউব চ্যানেল । সাবস্ক্রাইব করে পাশে থাকুন : https://www.youtube.com/watch?v=7_bEP0d9Rm4


নিষিদ্ধ গান
শাহান সাহাবুদ্দিন

বাঁশঝাড় কিংবা শালবন অথবা পুরনো সাঁকোতে গিয়ে থেমে গেছে
আমাদের প্রকৃত জীবন, জীবনের সরল পথ;
তারপর জীবন খেলো নিষিদ্ধ ফল, আর দাঁড়াতে পারেনি।
ক্রমশ আলো নিভে যাবার কালে বারবার আমরা ফিরে যেতে চেয়েছি নক্ষত্রের নিচে; চিরোচেনা নক্ষত্রের মুখ সব মৃত মনে হলে আশ্রয় নিয়েছি নিঃসঙ্গতার কাছে-;
নিঃসঙ্গতার একটিই অদ্ভুত দরজা, কেবল প্রবেশের, আমরা জানতাম। তবু আমরা এই দরজাকেই ভালোবেসেছি পরিতাপহীন হৃদয়ের মাংসে হাত রেখে।
কিছুটা কাল আমরা ভালো থাকি পরস্পর জিহ্বার উত্তাপে
তারপর যা ঘটে, তা ভালো রকম বিজ্ঞাপনের ভাষা হতে পারে একলা থাকা মানুষের জন্যে;
কিছুটা কাল ভালো থাকার চেয়ে নির্বিবাদ আড়াল ভালো, আমরা এই তত্ত্ব অনেক আগেই জেনেছি। অথচ কী আশ্চর্য, সাময়িক বিরতীর পর আমরা ফের পৌঁছে যাই পুরনো অসুখে-রক্ত গোঙ্গানি বিদীর্ণ আকাশ অন্ধকারের গান ও জেদের আঙুল-এইসব ভালোবেসে।
আমরা চিরোকালের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো; যেমন কোনো কোনো নক্ষত্র একবার কক্ষচ্যুত হলে মূলে ফেরার সুযোগ থাকেনা আর, এরকমটি-আমরা ভাবি; 
কিন্তু হায়, ভেতরে কুহক পাখি ডাকার কালে আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ম্লাণ হাসি-
অনাদি বেদনা আমাদের পরম বান্ধব, সান্ত¡না খোঁজার জন্যই হোক, কিংবা দুজনের কাছে দুজনের ভুলের পরাগ বাঁচিয়ে রাখার প্রশ্নেই হোক, বাঁশঝাড় কিংবা শালবন অথবা পুরনো সাঁকোতে আমরা ফিরে যাবো ভাবি-
এবার, হ্যাঁ- এইবার, নিষিদ্ধ গান ভালোবেসে অনন্ত মৃত্যুর প্রতীক্ষা করি আমরা; কেনোনা শীতল মৃত্যুর আলিঙ্গনই কেবল পারে আমাদের ক্ষুধা মেটাতে-
কী বোধের, কী সংরাগের!



বিদায় নরকের পৃথিবী
মাহবুবা করিম

খেয়াঘাট- পুলসিরাত! পারাপারে মৃত লাশ
স্বর্গে যায়! স্বর্গে যায়! স্বর্গে যায়! ওরা স্বর্গে যায়।

নেকড়ের তাড়া খেয়ে ঘন জংগল থেমেছে এ শহরে।
ধর্ষিত শিশুর লাশ থেকে শুরু করে, ঘাতক বাস যে দেহটাকে চাকায় হেঁচড়ে নিয়ে এসেছিল। বেপোরোয়া ট্রাক যে বাড়ন্ত নক্ষত্রের মুখ থেতলে দিয়েছিল। বেদম পেটাতে পেটাতে একজন স্কুল শিক্ষক যে শিশুর মুখ থেকে জীবনের মত কেড়ে নিয়েছিল ভাষা। সেই সব লাশ এখানে এসে থামে। এখানে এসে একটি লাশ আরেকটি লাশের দিকে মৃত ইলিশের মত ঢেবঢেবিয়ে চেয়ে থাকে। পৃথিবী থেকে এই ফুলগুলো এখানে থেকেই স্বর্গের টিকিট কাটে। এখান থেকেই তাদের স্বর্গযাত্রা।

নরক তো পৃথিবী।
এই পৃথিবীকে তাচ্ছিল্য করে ওরা স্বর্গে যায়।

আগুন ফুল
রফিকুল নাজিম

সূর্য,
তোকে উল্টো পিঠে করে দাঁড়িয়ে আছি
তোর তেজালো শক্তি; দাম্ভিকতায় ভুল!
বিশ্বাস না হলে দেখ, আমার পিঠেই পুড়ছিস তুই
আগুন পিঠে হাঁটছি আমি হাতে নিয়ে ফুল!

জল উৎসবের উৎস
আহমেদ ইউসুফ

নয়নের জল যদি হয় চোখের কাজল
অপ্রস্তুত এলোমেলো এই হৃদয়ের লিপি
পাঠের প্রেরণা দিতে ফাঁটে কার্পাসের ফল
তুলো উড়া বিকেলে খুলে দিও মুখের ছিপি।
কথার পাখিরা ডানা মেলে উড়বে যখন
ব্যথার ভারে নত হবে না রঙচটা দিল
শরীরের সব বাঁধ কেঁটে দিও তখন
আর তুমিও হয়ে যাও দুরন্ত গাঙচিল।

পাখা মেলে উড়ে যেও নদীর উদোম পিঠ
জলের রেখাংশে ভেসে উঠবে বিচ্ছিন্ন মুখ
প্রশান্তির ঢেউয়ে শান্ত হবে এপিঠ ওপিঠ
পটে আঁকা জলচিত্রে দেখো ভাসা ভাসা সুখ।

জলে মেতে উঠে জীবনের উত্থান পতন
সেই জল থেকে ছিনে নিও বিজয় কেতন।




মন মানেনা বাঁধা
শারমিন সুলতানা রীনা

হীরা চুনী পান্নাতো নও
তার চেয়েও দামী
তোমার শোকে তাইতো এখন
বৃষ্টি হয়ে নামি।

পাশে থাকার কথা বলে
হারিয়ে গেলে কই?
হাজার কথার মণিমালায়
নীরব স্মৃতি বই।

ভুলতে চাইলেও যায়না ভোলা
তবু আসো ঘুরে
এতো কাছে থাকেও যেন
যোজন যোজন দূরে।

আটকে রাখা যায়না কেনো
অবুঝ এ মন পাখি
শুনতে কি পাও তোমায় আমি
কত্তো  নামে ডাকি।

চলে যাবার ইচ্ছে যদি ছিলো
তোমার মনে
আমায় কেন বানিয়ে পাখি
ঘুরাও বনে বনে??


আমার মনের বর্তমান অবস্থা
ইমামুল কবির

আমি নাফ হতে হিমালয় পর্যন্ত, সহস্র পথে-
ফুল নিয়ে তোমার পিছু পিছু হেঁটেছি।
তুমি অবজ্ঞাভরেও একবারও পিছু ফেরনি!
আমি রাতারগুল হতে সুন্দরবন পর্যন্ত-
তোমার পিছু পিছু কোকিলের মত প্রেমের গান গেয়েছি।
তুমি একবারও সে গান শোনোনি!
আমি জ্যোৎস্না রাতে তোমাকে নিয়ে-
লিখেছি বহু রঙিন কবিতা।
তুমি একটি কবিতাও পড়ে দেখোনি!
আমি রামধনুর সাত রঙ দিয়ে-
তোমার মুখের মায়াবী ছবি এঁকেছি।
তুমি একটি নজরও ফেলোনি!
আমি লক্ষবার কালো মেঘের মত-
চিৎকার করে বলেছি, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’
নীলাঞ্জনা, আমি তোমাকে ভালোবাসি’।
তুমি একটিবারও জবাব দাওনি!
আমি হাজার রাত্রে  স্বপ্নে তোমাকে দেখেছি।
তুমি একটি রাতেও আমাকে দেখনি!
বহু পথ হেঁটে হেঁটে আমার পা দুটো এখন অসাড় ক্লান্ত-
আমি আর তোমার পিছে পিছে হাঁটতে পারিনা,
আমার কণ্ঠ ভেঙে হয়ে গেছে কর্কশ-
আমি এখন আর কোকিলের মত গাইতে পারিনা
ছন্দ-জ্ঞানেরা অভিমানে চলে গেছে অজানায়-
আমি এখন আর তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখতে পারিনা।
আমি রামধনুর রঙ এখন আর দেখতে পারিনা,
তাই  আর আঁকতে পারিনা তোমার ছবি!
আমার কণ্ঠ হয়ে গেছে শক্তিহীন নির্জীব,
তাই  চিৎকার করে আর বলতে পারিনা- ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি!’
নীলাঞ্জনা, আমি তোমাকে ভালোবাসি!’
আমার টিকটিকির মত ভিতু হৃদয়টা এখন-
নীরবে নিভৃতে একাকী বসবাস করতে শিখে গেছে।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট