পলাতক



পলাতক
রফিকুল নাজিম

কেমন আছো, আবীর?’ নাকি জিজ্ঞেস করবে ‘কিমুন আছোত,অকবি?’ আবীরের সামনে গেলে প্রথম কি দিয়ে শুরু করবে; এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়েছে সুদীপা। খুব শীতল গলায় নাকি কটকট করে জিজ্ঞেস করবে- আয়নার সামনে চললো কয়েকবার রিহার্সাল। আজ সুদীপার মনের অর্ধেকটা ফাগুনের রঙে রাঙানো আর বাকিটায় শোনা যায় শীতের ঝরাপাতার শব্দ। এখন সুদীপা যাচ্ছে আজিজ সুপার মার্কেট। এখানে বইঘরে দুজনের কেটেছে কতগুলো মিষ্টি বিকেল, পাখিদের নীড়ে ফেরা সন্ধ্যা। ঘরমুখো মানুষের ব্যাকুলতাকে উপেক্ষা করে ওরা বসতো বইঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে। রঙ চা আর সিগারেটের ধোঁয়ায় আবীর আঁকতো কবিতার শরীর আর নিমগ্ন পাঠকের মতো চুল ছেঁড়া বিশ্লেষণ করতো সুদীপা। আহা! সেই দিনগুলো কি দুর্ধর্ষ ছিলো। ছন্নছাড়া, বাউন্ডুলে সেই জীবনে ছিলো কত রঙ, কত প্রেম ছিলো, মান অভিমান ছিলো। আবার অহেতুক অট্টহাসিতে ফেটে পরার পাগলামিও ছিলো।

দীর্ঘ তেরো বছর নয় মাস তেইশ দিন পর গত পরশু ঢাকায় সুদীপা পা রাখলো। ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর সাথে গাঁটছড়া বাঁধার পর টরেন্টোতেই গড়েছিলো স্থায়ী আবাস। আর এই শীতল শহরের ভেজা বাতাসে হু হু করে উল্টে গেলো অনেকগুলো ক্যালেন্ডার, অনেকগুলো পাতা। এয়ারপোর্টে নেমেই সুদীপার চোখজোড়া খুঁজছে প্রিয় মানুষটাকে। শহুরে বাতাসে নাক রেখে খুঁজছে পরিচিত শরীরের সেই ঘ্রাণ।
বটতলা বসে বাদামের খোসা ছাঁড়তে ছাঁড়তে সুদীপাকে আবীর জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘আমি যদি কোন ক্লান্ত দুপুরে পুকুরের জলে ডুবে যাওয়া পাথরের টুকরোর মতো ডুবে যাই- তুই কি করবি?’ সুদীপা হাসতে হাসতে বলেছিলো, ‘আমিও টুপ করে জলে ডুব দিমু। তোর কলার চাইপ্পা ধইরা পুকুর থেইকা তুইল্লা আনমু আর কিলামু।’ পরক্ষনেই কি যেন মনে করে আবার সুদীপা বললো, ‘নাহ। তোকে জল থেকে তুলমু না। আমরা দুজন পুকুরের তলদেশে গড়ে তুলমু প্রেমের সাম্রাজ্য। জলকেলি করমু জলে জলে।’
আবীর আবার বললো, ‘আচ্ছা ধর, একদিন যদি আমি এই মায়ার শহরের জনসমুদ্রে হারিয়ে যাই- কি করবি তুই?’ সুদীপা এবার ক্ষেপে গেলো, ‘কি হচ্ছে এসব!’ ‘নাহ, বল, প্লিজ- কাতর গলায় বললো আবীর। সুদীপা আবীরের কাঁধে হাতটা রেখে বলে, ‘এই পাগলটার শরীরের ঘ্রাণটা শুঁকে শুঁকে অকবিটাকে খুঁজে বের করবো।’ কথাটা শুনে আবীরের বুকটা হঠাৎই প্রশস্ত হয়ে গেলো। শিনা টানটান করে হাঁটতে লাগলো সে টিএসসির দিকে। সুদীপা আলতো করে নিজের মাথাটা এলিয়ে দিলো আবীরের বিশ্বস্ত কাঁধে।


এলিফ্যান্ট রোডের জ্যামে আটকে আছে গাড়ি। কালো গ্লাসের কাচে টকটক করে নক করছে একটা আট নয় বছরের মেয়ে। কাঠিতে ঝুলছে অনেকগুলো বেলি ফুলের মালা। সুদীপা গ্লাসটা নামিয়ে- বনে মেয়েটাকে দেখছে। ঠিক লতার মতোই চেহারা। ক্যাম্পাসের দিনগুলোতে লতা প্রতিদিন আবীরকে একটা করে বেলিফুলের মালা দিতো। কখনো টাকা নিতো না। আর আমি একটা ফুল নিলেই টাকা চাইতো-বলতো,‘আফা, আপ্নে বড়লোক মানুষ। ভাইয়ার সব ট্যাহা তো আমগো খাতা কলম জামা কাপড় কিন্নাই শেষ হইয়া যায়। আমগোরে গাছতলা লেহাপরা করায় কত কষ্ট কইরা। ভাইয়া অনেক ভালা মানুষ। তাই ভাইয়ার কাছেত্তে ট্যাহা নেই না।’ কথাগুলো শুনে সুদীপার বুকটা তখন গর্বে ফুলে উঠতো। অবশ্যই তা বরাবরই গোপন ছিলো। তবে মাঝে মাঝে হিংসাও হতো।
প্রায় বিশ মিনিট হয় গাড়িটা জ্যামে আটকে আছে। সুদীপা ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে মোবাইলে কথা বলছে ।
-রাতুল ভাই, কেমন আছেন? আমি আপনার দোকানে আসতেছি। আপনাকে পাবো তো?
ওপাশ থেকে কি বললো বুঝা গেলো না। তবে মন্দ কিছু নয় এটা বুঝা গেলো। ছয় মাস হয় সুদীপা হঠাৎ ফেসবুকে রাতুলকে পায়। তারপর ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়। রাতুলও একসেপ্ট করে। এভাবেই আবার দুটোপথ এক হওয়ার আয়োজন চলে। আবীরের খোঁজ খবর নিয়মিত নিতে থাকে সুদীপা।

সুদীপা খুব অস্থির হয়ে আছে আবীরকে দেখার জন্য। উত্তেজনা তার চোখে মুখে স্পষ্টতই দৃশ্যমান। সময় যেন কাটছেই না। এবার গাড়িতে রাখা একটা পত্রিকার সাহিত্য পাতায় চোখ বুলাতেই পেয়ে গেলো কবি আবীর রুদ্রের কবিতা ‘বর্গাচাষী’। অকবিটা চমৎকার লিখেছে। ওর লেখার হাত বরাবরই ভালো। তবে ওর পাগলামি ও বাউ-ুলেপনা তাকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। কখনোই সিরিয়াস হলো না অকবিটা।


একবার সকাল ৭টায় সুদীপার হল গেইটে দাঁড়িয়ে আবীর অনবরত কল দিয়েই যাচ্ছে। চোখ কচলাতে কচলাতে সুদীপা হল গেইটে আসতেই আবীর খপ করে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সুদীপা কোনোরকম নিজেকে ছাড়িয়ে আশপাশটা দেখলো। নাহ কেউ দেখেনি।
-এই কি হইছে তোর? আজকা এত্তো খুশি কেন?
দেশের শীর্ষস্থানীয় একটা দৈনিক পত্রিকা এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘নে।পড়। আমার কবিতা ছাপাইছে রে, টুনটুনি। তরে কইছিলাম না, আমার কবিতা ছাপাইবোই। দেখছোত! ‘সুদীপা পত্রিকাটা বুকে চেপে ধরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে পাগলটার দিকে। কি সহজে একটা মানুষ এতোটা খুশি হয়! খুব অল্পতেই খুশি ছিলো আবীর। হঠাৎ সুদীপা খেয়াল করে আবীরের দু’পায়ে দু’রঙের স্যান্ডেল। সুদীপা মুচকি হেসে বলে, ‘হইছে, অকবি। এবার হলে যা। হুম, মানলাম- আপ্নে অনেক বড় কবি হইয়া গেছেন। এখন গিয়া হলে যা।’
স্মৃতিটা মনে করে সুদীপা  একা একা হু হু করে হাসতে হাসতে দেখে আজিজের সামনে গাড়িটা চলে এসেছে।
বইঘরের সামনে যেতেই রাতুল সুদীপাকে এগিয়ে নিয়ে গেলো ভিতরে। সুদীপা দোকানে ঢুকতে ঢুকতে খেয়াল করে উত্তর পূর্ব কর্ণারে দুটো টুল আজো পাতা আছে। যেখানে বসে আবীর আর সুদীপা প্রেমের নোঙর করতো। শব্দ টিপে টিপে কবিতার টেরাকোটা বানাতো আবীর। আর তাতে মুগ্ধ হতো সুদীপা।
-সুদীপা, কি খাবে? ব্ল্যাক কফি চলবে?
-না, রঙ চা খাবো। রাতুল ভাই,পাগলাটা কি জানতো আমি আসবো?
-হুম। জানতো। মনে প্রাণে বিশ্বাসও করতো।
-তাই?
-হুম।
বলতে বলতে চা আর সিঙ্গারা চলে আসলো।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই সুদীপা রাতুলকে জিজ্ঞেস করলো, কাসেম মামা এখনো আছে?
-হ্যাঁ। তবে কেমনে বুঝলে!
-এই যে চা। এই চা তো আর কেউ বানাতে পারবে না।
-হুম। ভালোই মনে রেখেছো সবকিছু।
-কি যে বলেন, রাতুল ভাই। আচ্ছা রাতুল ভাই, ক্ষ্যাপাটা এখন কই? কখন আসবে এখানে?
রাতুল কোন উত্তর না দিয়ে ট্রয়ার হাতড়ে বের করে তেরোটা খেরোখাতা। সুদীপাকে দিয়ে বলে, দেখো। সুদীপা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টায়। প্রতিটা খাতার উপর সাল লেখা আছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের খাতাও আছে। এগুলো তো বইঘরের আয়ব্যয়ের খাতা। খাতার শেষদিকে ৩০/৪০ টা করে কবিতাও আছে। মাঝে মাঝে পাগলার হাতের আঁকিবুঁকিও আছে। কোথাও কোথাও শূন্যস্থান পূরণ খেলা। ও একা একাই খেলতো।
-এগুলো দিয়ে আমি কি করবো, রাতুল ভাই? আর আবীরই বা কোথায়? প্লিজ বলেন কিছু। আমি ওকে একবার দেখবো শুধু। আর একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করবো, ‘সেদিন কেন সে পালিয়ে গিয়েছিলো?’
-রাতুল এবার একটা নীল খাম এগিয়ে দিয়ে বললো, আবীর তোমাকে খাতাগুলো আর খামটা দিতে বলেছে।
রাতুলের ডান চোখের কোণে চিকচিক করছে অশ্রু। আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। তবুও টুপ করে জলটা নিচে পড়লো।
সুদীপা কাঁপা কাঁপা হাতে ছিঁড়লো খামটা। আবীরের চিরকুটে লেখা-
প্রিয় টুনটুনি,
তুইও ভালো নেই- জানি আমি। আমি কিন্তু বেশ আছি। দেখ, সপ্তর্ষির পাশে ঐ যে বড় তারাটা দেখছিস, ওটাই আমি। তুই আর আমি অনেকদিন একত্রে তারাগুলো গুনেছি। কতকগুলো তারা আমাদের সাথে কথাও বলতো। মনে আছে? আমি জানতাম তুই ফিরবি। তবে আমি সেদিন থাকবো না-এটা আমি খুব মানতাম।
আজ তাই তো হলো। তুই এলি, আর আমি নেই। তোর সাথে করা আমার পাগলামির স্মৃতিগুলো আমাকে তিলে তিলে খুন করেছে। জানিস তোর মতো আর কেউ আমাকে বুঝতো না রে। আমার পাগলামিগুলো সহ্য করার মতো একজনকেই স্রষ্টা আমার কাছে পাঠিয়েছিলো। চাল চুলাহীন অকবি আমি। তাইতো তোকে ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের কাছে সম্প্রদান করে পালিয়ে গিয়েছিলাম সেইরাতে। আর বেঁচে গেছিস তুই। আমি আবারো পালাইলাম রে।
ওহ, শোন, মনে করে একবার খেয়াটা দেখে যাস। ছোট ছোট সোনা মুখগুলোকে আদর করে যাস। ভালোবাসাগুলো ভালো থাক রে।
ইতি
তোর অকবি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই গাছটায় এখনো ঝুলে আছে সাইনবোর্ড। বড় করে লেখা-‘খেয়া’। গাছতলায় ব্ল্যাকবোর্ড ঝুলিয়ে পড়াচ্ছেন একজন তরুন, পাশেই বসা লাস্যময়ী এক তরুণী। হয়তো আবীর সুদীপার মতো ওরাও খেয়ায় স্বপ্ন আঁকে। সুদীপা দ্রুত হাতে চকোলেট, কিছু নতুন জামাকাপড়, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে পালাতে চাইছে। সুদীপার খুব চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মাথা থেকে সানগ্লাসটা চোখে নামিয়ে রাখে। কাঁচা পয়সার মতো চকচকে চোখটা আড়াল হয়। আড়াল হয় সুদীপা আর আবীর। তবুও আবীর মাখানো সন্ধ্যার নিয়ন আলোয় ঠুকরে কাঁদে শহুরে রাস্তা। কালো পিচঢালা রাস্তাটা শোককে বুকে ধরে রাখবে আজীবন। শুধু এই শহরটা জানবে না আজ সুদীপার বুকে কতোটুকুন মেঘ জমেছে!

শ্যামলী আবাসিক এলাকা, 
মাধবপুর, হবিগঞ্জ।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট