বিজয় দিবসের বিশেষ গল্প : সুরবালা




সুরবালা
রফিকুল নাজিম

চা বাগানের ৬নং লাইনে একটা লাশ পড়ে আছে। ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধার লাশ। চা শ্রমিকেরা হৈ হৈ রৈ রৈ করে সেদিকেই ছুটছে। পুরো বাগানে শোকের মাতম পড়েছে যেনো। সুরবালা আর  নেই। ঘাসের উপর পড়ে আছে তার শূন্য খাঁচা। সুরবালার মুখের কাছে ভনভন করছে কয়েকটা মাছি। মুহূর্তেই বেশ লোকের জমায়েত হয়ে গেলো। হরিদাসী একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,‘বুড়িটা মরেই বাঁচলো গো!’  নৃপেন কয়েক ঢোক চোলাইমদ পেটে চালান দিতে দিতে গান ধরলো, ‘ওলো সই, তোর যা ছিলো নিলাম কেড়ে/ওলো সই, আয় ঘর বানামু বাগান ছেড়ে।’ সকালের আয়ু বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে আসছে পুলিশ, সাংবাদিক ও প্রশাসনের হর্তাকর্তারা। আজ শুধু সুরবালার দিন। একজন পুলিশ লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বার্ধক্যজনিত মৃত্যু। তবুও পোস্টমর্টেম করা জরুরি। তাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে। সুরবালা এই প্রথম চা বাগানটা পেছনে রেখে চলে যাচ্ছে। চা গাছগুলো কেমন নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে! আহা রে জীবন!
০২.
২৬ শে মার্চ, ১৯৭১ সাল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সেদিন অনেকে মায়ের আঁচল ছেড়ে ধরেছিলো থ্রি নট থ্রি রাইফেল। প্রেমিক তার হাতের ফুল ফেলে ধরেছিলো এলএমজি। সেদিন কৃষক লাঙ্গল ছেড়ে ধরেছিলো স্টেইনগান। সেদিন ছাত্ররাও কলম ছেড়ে হাতে নিয়ে ছিলো বন্দুক। শিক্ষকের হাতেও ছিলো চকের পরিবর্তে গ্রেনেড। সেদিন চা শ্রমিক সুসেনও দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি ফেলে হাতে তুলে নিয়েছিলো অটোমেটেড রাইফেল। হ্যাঁ সুসেন বাড়ুঐ। ১৬ বছরের টগবগে কিশোর। প্রাণ চাঞ্চল্যে সুসেন যেনো বন্য হরিণের মতোন। যুদ্ধে যাবার রাতে সুরবালার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সুসেন বলেছিলো, ‘তুই পালারে সুরবালা। শুন, ভোরে জলেশ্বরীরাও চলে যাবে ওপার বাংলায়। তুইও চলে যাস সাথে।’ সেইরাতে সুরবালা কোনো মায়ার বন্ধনে কিংবা চোখের জলে আটকাতে পারেনি সুসেনকে। চোখের জলেই বিদায় দিয়েছিলো তাকে। সেইরাতে সুসেন ৬নং লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিলো। সুরবালা সেই দৃশ্য একা দেখেছিলো।

০৩.
নভেম্বর, ১৯৭১। বাগানে ভটভট করে এগিয়ে এলো কয়েকটা জলপাই রঙের জিপগাড়ি। খাকি পোশাক পরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। বড়বাবুর ডাক বাংলোয় স্থাপন করলো ওদের ক্যাম্প। লেফট রাইট করতে করতে ওরা হাঁটে। ওদের খেদমতে জহির মোল্লা নিজেকে উৎসর্গ করেছে স্বর্গ পাওয়ার আশায়। বাগান প্রায় জনশূন্য। লাইনগুলোও ফাঁকা। চায়ের কচি পাতাগুলো বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে অযতেœ। সুরবালা ছোটবাবুর বাংলোয় টুকটাক কাজ করে। ঘর ছাড়ু দেয়। ধোয়ামোছা করে। ছোটবাবুর ঘরেই ঠাঁই হয়েছে মা বাপহীন সুরবালার। ছোটবাবুর কাছেই বর্ণের সাথে পরিচয় হয় তার। সুরবালা গোপনে আড়ালে চিরকুটটা পড়ে আর একলা একা হাসে। এক সন্ধ্যায় ছোটবাবুর চায়ের নিমন্ত্রণ রাখতে মেজরসহ চার পাঁচজন সৈন্য এলো। চা পর্ব শেষ করে চলে যাওয়ার সময় কি জানি মনে করে মেজর সাব উনুনঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন সুরবালাকে। তেরো বছরের সুরবালা। মেজর চিৎকার করে বললো, এহি খুব সুরুত লাড়কি হে। সুরবালাকে টেনে হিঁচড়ে নিতে চাইলে ছোটবাবু পায়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললো, হুজুর, এহি ছোটকা আদমি হে। ছোড় দো, হুজুর। মেজরের ইশারায় ছোটবাবুর বুকে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করলো অপর দুই সৈনিক। জোর করে জিপগাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে সুরবালাকে। সদ্য জবাই করা মুরগির মতোই ভয়ে থরথর করে কাঁপছে আর কাঁদছে সুরবালা। তারপর সুরবালার এই ছোট্ট শরীরের উপর সারারাত চললো নির্যাতন। ক্ষতবিক্ষত যোনি থেকে ঝরছে রক্ত। সেই রক্তে ভিজে গেলো মাটি। বাগানের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হলো সুরবালার আর্তচিৎকার।
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ক্যাম্পের এখানে সেখানে কুকুরের মতো পাক হানাদারদের সারি সারি লাশ পড়ে আছে। অর্ধমৃত সুরবালা টলতে টলতে বের হয়ে আসে ক্যাম্প থেকে। তখনো থেমে গুলি হচ্ছিলো। সুরবালা ৬নং লাইন ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। সামনেই দেখে একটা লাশ পড়ে আছে। লাশটা উল্টিয়ে সুরবালা সুসেন বলে প্রচন্ড এক চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর থেকেই সে পাগল। অর্ধনগ্ন হয়ে সারা বাগান একা একা হাঁটতো। সবচেয়ে বেশি ৬নং লাইনে বসে বসে কাঁদতো আর বুক চাপড়াতো। আমৃত্যু সে আর কারো সাথে কোনো কথা বলেনি।

০৪.
উপজেলা চত্বরে একটা কফিনে শুয়ে আছে সুরবালা। জাতির সবচেয়ে দামী জিনিসে আজ মোড়া সে।জাতীয় পতাকায় ঢাকা তার ৪৮ বছরের অর্ধনগ্ন শরীর। একজন বীরাঙ্গনাকে পুলিশ সদস্যরাও রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর জন্য প্রস্তুত। এদিকে প্রস্তুত ক্যামেরা হাতে টিভিওয়ালারা ও খবরের কাগজওয়ালারা। দামী দামী ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে চিৎকার করে উঠে সুরবালার আত্মা!


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট