ধারাবাহিক উপন্যাস : অনিঃশ্বেষ অন্ধকার : পর্ব ০২




অনিঃশ্বেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ

[গত সংখ্যার পর]
৩.
এক রাতে কথা বলতে বলতে নিলয় বলল, সুমাইয়া, তোমাকে একটা কথা বলবো বলে ভাবছিলাম।
একটা কথা ! কত কথাই তো বলছেন এতদিন ধরে।
কিন্তু আসল কথাটা যে বলি বলি করেও বলা হয় নাই। গান আছে না-কত কথা যাওগো বলে কোনো কথা না বলে।
কেন, বলা হয়নি কেন ? বলেন আপনার আসল কথা।
তুমি আবার কিভাবে নিবা.....।
কিভাবে নিবো মানে ?
কিছু যদি মনে করো ?
আরে নাহ ! আপনি যা বলার বলুন। আমি কিচ্ছু মনে করবো না।
সুমাইয়া, অনেক আগে থেকেই-তুমি যখন সেই সিক্স/সেভেনে পড়ো তখন থেকেই তোমাকে আমার পছন্দ। কিন্তু কথাটা বলার সুযোগ পাই নাই। আর তুমিও তখন ছোট ছিলা। তো ফোনে কথা বলতে বলতে সহজ হয়ে যাওয়াতে.....। আমি তোমাকে ভালোবাসি সুমাইয়া। আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ ভেরি মাচ।
নিলয় ভাই !
সে ফোন কেটে দিল। তার বুকের ভেতর ভীষণ ধরপর করছে। তার শরীরটাও যেন কাঁপছে। জীবনে কারও কাছ থেকে এরকম একটা কথা কখনো শুনবে তা সে কল্পনাও করেনি।
সে পানি খেলো এক গ্লাস। পানি খেয়ে খাটের উপর শান্ত হয়ে বসলো। চোখে ভেসে উঠল নিলয়ের মুখ। ফর্সা, গোলগাল মুখ। মাঝারি গড়ন। জেল দিয়ে খাড়া করে রাখা চুল। জিন্স আর টি-শার্ট পরনে। হাতের কব্জিতে ব্রেসলেট কয়েকটা। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। ভীষণ স্মার্ট ছেলে! মফস্বল তো অনেক পরের কথা, ঢাকা শহরে এমন ছেলে খুব কম দেখা যায়। সে অস্ট্রেলিয়া যাবে। অস্ট্রেলিয়া মুখের কথা না। তার সমস্ত অস্তিত্বে অন্যরকম একটা পুলক খেলে গেল। তার মনে হল, নিলয়ের কাছ থেকে এই শব্দটা শোনার জন্য সে কতদিন অপেক্ষা করে আছে। নিজেকে কেমন স্বার্থক মনে হতে লাগলো। কেউ যদি কোনোদিন ‘ভালোবাসি’ কথাটা না বললো তাহলে জীবনের কী স্বার্থকতা ?
সে আরেক গ্লাস পানি খেল। তারপর নিলয়কে ফোন করল। ফোন ঢুকলে নিলয় ফোন কেটে দিল। সে তাই করে। ফোন কেটে দিয়ে সে নিজে ফোন করে। এ ব্যাপারটা তার জানা। কিন্তু আজ তার মনটা কেমন যেন করে উঠল। মনে হল-কেন সে আমার ফোন কেটে দিল? কেন?
নিলয়ের রিটার্ন ফোন এলে সে অনুযোগের সুরে বলল, আমার কল কেটে দিলেন কেন?
আমি তো সব সময় তাই-ই করি। তোমার ব্যালেন্স আমি খরচ করবো কেন?
আমার ব্যালেন্স তো আপনিই দেন।
আমি দেই অন্যের সাথে কথা বলার জন্য। শোন, তখন তুমি হঠাৎ লাইন কেটে দিলা কেন?
কখন?
আমার কথাটা শোনার পরেই তো তুমি লাইন কেটে দিলা।
ও, মা ডেকেছিল।
মিথ্যা বলাটা এতদিনে তার কাছে খুব সহজ হয়ে গেছে। উপস্থিতভাবে চমৎকার সব মিথ্যা এসেও পড়ে। প্র্যাকটিস মেকস এ্যা ম্যান পারফেক্ট।
নিলয় বলল, তাই বলো, আমি আবার ভাবলাম মাইন্ড-টাইন্ড করলা কিনা।
আরে না, মাইন্ড করবো কেন?
মেয়েদেরকে তো সব সময় বোঝা যায় না। আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো, তোমাকে ভালবেসে কি আমি ভুল করেছি?
ভুল করবেন কেন?
আমি কি তোমার ভালবাসা পাবার যোগ্য না?
যোগ্য হবেন না কেন?
তুমি কি আমাকে ভালবাসো?
নিলয় ভাই, অন্য কথা বলেন।
অন্য কথা বলবো কেন? শোন, আমি এক হাতে তালি বাজাতে চাই না। আমি তোমাকে ভালবাসি, তুমি যদি আমাকে ভাল না বাসো তো স্লামালিকুম। ঐ ফ্যাচর ফ্যাচর করার স্বভাব আমার নাই।
ফ্যাচর ফ্যাচর কি নিলয় ভাই?
মানে ঘ্যানর ঘ্যানর। তুমি আমাকে ভালবাসবে না, আর আমি তোমার ভালবাসা পাবার জন্য তোমার পিছে পিছে ঘুরে মরবো, ওরকম বান্দা এই নিলয় না। বলো, আমাকে কি ভালবাসা যায়? ইয়েস অর নো।
কেন যাবে না ?
তাহলে মুখ ফুটে বলো-আই লাভ ইউ।
মেয়েরা মুখে এভাবে বলে না।
তাহলে কিভাবে বলে ?
মনে মনে বলে।
তুমি মনে মনে বলেছো ?
বলেছি, বলেছি, বলেছি, হাজার বার বলেছি, হলো তো?
হয়েছে। ফেসবুক কবি আব্দুল কুদ্দুসের একটা কবিতা পড়েছিলাম-
তুমি
নীরব থাকলেই বুঝতে পারি-
আমাকে তুমি ভালোবাসো। কেননা-
নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ

তুমি
সরব হলেই আমার হৃদকম্প বেড়ে যায়
ক্ষীপ্রগতি মেইল ট্রেনের মতো। কেননা-
বাজাতে বাজাতে ঢোল শেষ অবধি
ফেটেই যায়। আর ফাটা ঢোল নিয়ে
তখন কি করে বাদক ?
ফেলে দেয়া ছাড়া আর তো
কোনো গত্যন্তর থাকে না

তাই
তোমার নীরবতাই আমার কাম্য
ভালবাসা সরব হতে পারে না
সাইলেন্স ইজ গোল্ড
কবিতাটা আমার ভাল লেগেছে। কিন্তু তাকে ফেসবুক কবি বলছেন  কেন?
অন্য কোনো জায়গায় ভাত নাই, তাই ফেসবুকে কবিতা লেখে।
তারপর থেকে তাদের কথা আর এক/দেড় ঘন্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রায়ই তারা সারা রাত কথা বলে। বই-পত্র টেবিলে এলোমেলো ছড়ানো থাকে। রাতের শেষ প্রহরে ঘুমাতে গিয়ে তার আর সকালে ঘুম ভাঙে না। স্কুলের সময় বয়ে যাচ্ছে বলে মা তাকে ডাকতে গিয়ে তাকান টেবিলে। টেবিলে বইয়ের এলোমেলো অবস্থা দেখে তিনি ধরে নেন, মেয়ে তার সারা রাত পড়েছে। তার হৃদয় থেকে মমতা ঝরে পড়ে শীতের শিশিরের  মতো। আহারে! থাক, আজ না হয় স্কুলে নাইবা গেল।
এভাবে প্রায়ই স্কুল কামাই হয়। একদিন মা বলেন, তুমি তো সারা বছরই নিয়ম মতো লেখাপড়া করেছো, তাই না?
জি মা।
তাহলে এখন সারা রাত জেগে পড়ার দরকার কি? এভাবে পড়লে শরীর খারাপ করবে যে।
আর সারা রাত পড়বো না মা।
বারোটা থেকে একটার মধ্যে শুয়ে পড়বে।
তাই করবো মা।
কিন্তু বারোটা থেকে একটার মধ্যে তার শোয়া হয় না কখনোই। কথা শুরু হলে এই পৃথিবীতে ঘুম, ক্ষুধা, তৃষ্ণা বা অন্য কিছু আছে বলে তার মনে থাকে না। নিলয় ভাইটা এত মজা করে কথা বলতে পারে!
কথা বলতে বলতে নিলয়কে তার দেখতে ইচ্ছা হতে লাগলো। সেই এক বছর আগে দেখেছিল। এক বছর মানে ৩৬৫ দিন, ৮৭৬০ ঘন্টা, ৫২৫৬০০ মিনিট, ৩১৫৩৬০০০ সেকেন্ডে। ভালবাসার মানুষকে এতটা সময় না দেখে থাকা যায় ?
একদিন সে বলল, আপনি তো অনেক দিন আমাদের বাসায় আসেন না?
সময় কোথায় বলো? শুধু কি লেখাপড়া করি? বাপের ব্যবসাও দেখতে হয়। এখন আবার অস্ট্রেলিয়া যাবার জন্য দৌড়-ঝাপ শুরু করেছি।
হয়েছে, ব্যস্ত মানুষরা কি আর বেড়ায় না? আপনার কি আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না?
ইচ্ছা করে না আবার? প্রতি মুহূর্তে তোমাকে দেখতে ইচ্ছা হয়। মনে হয়, সব সময় তুমি যদি আমার বুকের সাথে মিশে থাকতে!
বাজে কথা বলবেন না।
এইটা বাজে কথা? ভালবাসার মানুষকে বুকের কাছে পেতে চাওয়া বাজে কথা?
আপনি সময় করে একবার বেড়িয়ে যান দুই/চার দিন। সত্যি আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
তুমি যখন বলছো তখন আসবো।
কবে আসবেন?
দিন-তারিখ দিতে পারবো না, তবে আসবো-খুব তাড়াতাড়িই আসবো।
এই মাসের মধ্যে আসবেন?
এই মাসে না পারলেও আগামি মাসে আসবো। অস্ট্রেলিয়া যাবার ব্যাপারে একটা মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে হবে কিনা।
তাহলে আগামী মাসে আসবেন তো?
আসবো-অবশ্যই আসবো।
না এলে......।
না এলে কি?
আমি আর আপনার সাথে কথা বলবো না।
সেটা তুমি পারবা না।
পারবো।
বললাম তো, পারবা না।
পারবো।
পারবা না।
পারবো-পারবো-পারবো।
পারবা না-পারবা না-পারবা না।

৪.
বাবা-মা বের হয়ে গেছেন। সে স্কুলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক তখন নিলয় এসে হাজির।
এত সকালে? এত সকালে কেমন করে? এই প্রশ্ন দুইটা কয়েক সেকেন্ড পর পর এমনভাবে তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে, যেন প্রশ্ন দুইটা তার ভেতরে রেকর্ড করা ছিল। রেকর্ড কেউ চালিয়ে দিয়েছে।
নিলয় বলল, নাইটকোচে এসেছি।
তাই বলে এত সকালে ?
আরও সকালে আসতে পারতাম। পথে বাসের চাকা পাংচার হয়ে যাওয়াতে......। খুব ক্ষিধা পেয়েছে। সব বিস্ময় তোমার স্কুল ব্যাগে রেখে দিয়ে কিছু খেতে দাও।
সে স্কুল ব্যাগ ছুড়ে ফেলে দিল টেবিলের উপর। ফ্রিজ থেকে পাউরুটি আর ডিম নিয়ে গেল রান্না ঘরে। কুলসুমকে অস্থির করে ফেলল-পিঁয়াজ কাট, মরিচ কাট, তেল আন, লবন আন, কড়াই আন।
পিঁয়াজ-মরিচের সাথে ডিম গুলে নিয়ে তাতে পাউরুটি মাখিয়ে কড়াইতে ভাজবে। কাজটা কঠিন কিছু না। কিন্তু সে চিৎকার, তাড়াহুরো করে কাজটাকে কঠিন করে তুলল। পিঁয়াজ কাটতে গিয়ে কুলসুম আঙুল কেটে ফেলল। সে চুলায় অতিরিক্ত গ্যাস ছেড়ে তাতে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি ছুড়ে দিতেই দপ করে আগুন উপরে উঠে গেল। সে লাফ দিয়ে সরতে গিয়ে ফেলে দিল এক গামলা পানি। আরও কিছু অঘটনের পর সে পাউরুটি ভাজা শেষ করল।
খাবারটা যে খুব সুস্বাদু বা সবার প্রিয় তা নয়। তার নিজের কাছে খাবারটা প্রিয় বলে সে মনে করে খাবারটা সবার কাছেই প্রিয়। এ ছাড়া আছে আপেল, মালটা, কলা। নিলয় পাউরুটির পুরো একটা টুকরো একবারে মুখে চালান করে দেয়। ব্যাপারটা তার কাছে আরেকটা বিস্ময়। সে বলে, একবারে পুরোটা মুখে দিয়ে ফেললেন ?
তুমি কিভাবে খাও ?
আমি চামচ দিয়ে কেটে......।
এই আবার চামচ দিয়ে কাটতে যাব! আটার রুটি আছে না? একেকটা এর চারটার সমান। আমি সেই রুটি একেকটা রোল বানিয়ে একবারে মুখে দিয়ে দেই।
বলেন কি !
খেতে বসে পুতুপুতু করার সময় আমার নাই।
এই শব্দটা আপনি খুব বেশি ইউজ করেন।
আর ভাত খাই কিভাবে জানো ?
কিভাবে ?
প্রতি তিন মিনিটে এক প্লেট শেষ। প্রতিবার তিন প্লেট।
আপনার স্বাস্থ্য দেখে কিন্তু তা বোঝা যায় না।
সকাল-বিকাল দুই কিলোমিটার দৌড়াই। সপ্তাহে দুই দিন জিমে যাই। আমার পেশি দেখবা?
নিলয় টি-শার্টের হাতা গুটিয়ে পেশি দেখাল। হাত ভাঁজ করতেই পেশিটা ফুলে উঠল ডিমের মতো।
নিলয় বলল, ঘুষি মারো তো। তুমি ব্যথা পাবা, আমার কিচ্ছু হবে না। মারো ঘুষি।
খাওয়া শেষ হলে দু’জন কফি নিয়ে বসল। শুরু হল গল্প। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সে কুলসুমকে নির্দেশ দিতে লাগল-গরুর মাংস ভুনা করবি। ডালের ভেতর টমেটো দিবি। আলাদা দুইটা ডিম ভুনবি। শাকে শুকনা মরিচ দিবি। আরও অনেক রকম নির্দেশনা।
গল্প। গল্প। আর গল্প। সারা সকাল। সারা দুপুর। সারা বিকেল।
সন্ধ্যার কিছু আগে মা এলেন। এতদিন পর বোনের ছেলেকে দেখে তিনিও অনেক খুশি। তার অনুপস্থিতিতে মেয়ে নিলয়কে যতœ করে খাইয়েছে এ জন্য মেয়েকে অনেক ধন্যবাদ জানালেন। তারপর তিনি ব্যস্ত হয়ে গেলেন রাতের খাবার তৈরীর কাজে।
রাতে এলেন বাবা। সবাই মিলে খেতে বসে অনেক গল্প হল। হাসাহাসি হল। খুব আনন্দঘন পরিবেশ।
খাবার পরেও অনেক রাত পর্যন্ত ওরা দু’জন গল্প করল। তারপর নিলয় গেল গেস্ট রুমে। নিলয় যে রুমে থাকবে সে রুম, বিছানাপত্র সে নিজের হাতে গুছিয়ে রেখেছিল।
নিজের ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে খুব অবাক হল। নিজের এতটা আনন্দে ঝলমলে মুখ সে যেন এর আগে আর কখনো দেখেনি। মনের মধ্যে কি যে ভাল লাগা! যেন হাজারটা রঙিন প্রজাপতি মনের মধ্যে পাখা মেলে দিয়েছে। হাজার রকমের পাখি গাইছে নানা সুরের গান। এতটা ভাল লাগা সে যেন আর কোনোদিন অনুভব করেনি। পৃথিবীর সব ভাল লাগা তার কাছে এল কেমন করে? এরা এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল?
তার মনে হল-ইস! সারা রাত যদি নিলয় ভাইয়ের সাথে বসে গল্প করা যেত। বারান্দায় অথবা ছাদে।
কথাটা মনে হতে সে নিজেই যেন একটু লজ্জা পেল। শব্দ করেই বলে উঠল, ধ্যাৎ! তা কি করে সম্ভব ?
সে এদিক-ওদিক তাকাল। তার কথাটা কেউ আবার শুনে ফেলল কি না। তাহলে যে তাকে পাগল ভাববে। কোন কিসিমের পাগলেরা যেন একা একা কথা বলে?
বাবা বলেন, স্বপ্নবাজ পাগলেরা একা একা কথা বলে। মনের মধ্যে তাদের হাজারটা স্বপ্ন। একাকী মুহূর্তে সে হারিয়ে যায় স্বপ্নের ভূবনে। কখনো হয় কবি, কখনো শিল্পী, কখনো অভিনেতা, কখনো রাজনীতিক। সে কখন নিজের মত গান গায়, হাসে, অভিনয় করে, বক্তৃতা করে। যে পাগল রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে সে কিন্তু নিজেকে বড় এক ট্রাফিক পুলিশ মনে করে। মনে করে, তার কাঁধে বিশাল এক দায়িত্ব।
সেও কি স্বপ্নবাজ হয়ে যাচ্ছে? কি স্বপ্ন দেখছে সে? নিলয়কে নিয়ে কোনো স্বপ্ন?
রাত দুইটা। সে বিছানায় শুয়ে আছে। ঘুম আসেনি চোখে। সারা রাতেও বোধহয় আসবে না ঘুম পরীরা তার কাছে। সে একটু চিন্তিত হল। তাহলে যে সকালে ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। নিলয় ভাইয়ের নাস্তা তৈরীতে তদারক করা হবে না। নাস্তা খেতে বসে গল্প করা হবে না। সে কোলবালিশ টেনে নিল কাছে। চোখ বন্ধ করল। তাকে ঘুমোতে হবেই। আর তখনই তার স্মার্ট ফোনটা বেজে উঠল। দেখল নিলয় ফোন করেছে। কিন্তু কেন? ওঘর থেকে এত রাতে ফোন কেন? সে ফোন রিসিভ করল। নিলয় বলল, সুমাইয়া, এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও প্লিজ।
পানি দেইনি?
না।
জগ ভরে পানি আর গ্লাস না রেখে এলাম?
কই, দেখছি না তো।
সে বুঝল, ভুলটা তারই হয়েছে। সে এক গ্লাস পানি নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে পা বাড়াল।
গেস্ট রুমে ডিম লাইটের হালকা নীল আলো। সে দরজায় পা রেখেই দেখল সাইড টেবিলে জগ নামানো। সে ভাবল, হয়তো জগ আগে থেকেই ছিল, তাতে পানি নেই। খাটের পাশে দাঁড়িয়ে সে বলল, এই যে পানি।
নিলয়ের কোনো সাড়া-শব্দ নেই। এরই মাঝে ঘুমিয়ে পড়ল? বেশ ঘুম কাতুরে মানুষ তো। সে আবার বলল, আশ্চার্য ! এত ঘুম মানুষের?
তার মনে পড়ল বায়েজীদ বোস্তামীর গল্পটা। সারা রাত গ্লাস হাতে মায়ের বিছানায় দাঁড়িয়ে ছিল। সকালে চোখ খুলে মা আর বুঝতে পারে না, ছেলে কেন গ্লাস হাতে তার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সেও কি সারা রাত নিলয়ের মাথার কাছে পানি হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে? ধ্যাত! তা কি করে সম্ভব? সে বলল, এই যে আমি পানি রেখে গেলাম।
সে পানির গ্লাস রেখে যেই পেছন ফিরেছে অমনি আচমকা তার হাতে প্রবল এক টান। সে নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে হুমরি খেয়ে গিয়ে পড়ল নিলয়ের বুকের উপর। মুহূর্তে নিলয় তাকে কঠিনভাবে বুকে চেপে ধরল। সে দু/তিন বার অস্ফূট স্বরে বলেছিল-আহ! কি করছেন? ছাড়–ন তো? বেশ বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
তারপর চুপ।
প্রায় পনেরো মিনিট পর নিলয়ে বুকের ভাঁজ থেকে ছাড়া পেয়ে সে ফিরে এল নিজের ঘরে।
তার শরীরে ভীষন কাঁপন। তার চেয়েও বেশি কাঁপন বুকে। সে এক গ্লাস পানি খেল। শরীরের কাঁপন কিছুটা কমলেও বুকের কাঁপন কমে না। সে কাঁপন থেকে শিরশির করে সমস্ত অস্তিত্বে ছড়িয়ে যেতে লাগল অদ্ভূত এক ভাল লাগা। প্রথম ‘ভালোবাসি’ শব্দটা শুনতে যেমন লেগেছিল, প্রথম স্পর্শ তার চেয়েও অনেক বেশি মোহনীয়। সে মনে মনে বলল, এরকম স্পর্শ না থাকলে ভালোবাসার কোনো মূল্য আছে? নিলয় ভাইটাও এমন পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছিল.....!
সারা রাত তার ঘুম এল না। শুধুই এপাশ-ওপাশ। শধুই ছটফটানি। শুধুই ভাবনা-যেভাবে বুকের সাথে চেপে ধরেছিল যেন তার বুকের সাথে লেপ্টে ফেলবে। এমনভাবে ঠোঁট দুটি নিজের মুখের মধ্যে পুড়ে নিয়েছিল....! এসব ভাবতে ভাবতে তার শরীরে অজানা এক শিহরণ ঢেউয়ের মত অবিরাম আসতে থাকে।
সকালে দু’জনেরই ঘুম ভাঙে দেরিতে। মা ডাকতে চেয়েছিলেন। স্কুলে যাবে কি না জানতে চেয়েছিলেন। বাবা বললেন, থাক, ডেকো না। ঘুমাক।
মা-ও ডাকলেন না। সারা দিন সারা রাত শুধুই লেখাপড়া। দু’দিন না হয় স্কুলে নাই বা গেল। এতদিন পর খালাতো ভাইটা  এসেছে, তার সাথে না হয় একটু গল্প করুক-আনন্দ করুক।
মা নিজেই সকালের নাস্তা তৈরী করলেন। পরাটা। গরুর মাংস ভুনা। পায়েশ। দই-মিষ্টি, আর ফল তো ঘরে আছেই। নাস্তা সেরে বাবা-মা দু’জনেই বের হয়ে গেলেন।
সে ঘুম থেকে উঠে দেখে নিলয় তখনও ঘুমিয়ে। সে আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজেকে দেখে সে চমকে উঠল। সারা শরীরে নানা রঙের জরি লেগে আছে। মুখটা কেমন ঝিকমিক করছে। কোত্থেকে এল এসব?
পরে মনে পড়ল, নিলয়ের টি-শার্টের কথা। তার টি-শার্টের বুকে জরির কাজ। কি টি-শার্ট কিনেছে যে জরি উঠে যাচ্ছে? ভগ্যিস বাবা-মা কেউ দেখেননি। দেখলে প্রশ্ন করতেন-শরীরে এসব এল কোত্থেকে? তাতে খুব বেশি সমস্যা যে হত তা সে মনে করে না। মিথ্যা বলতে বলতে ইদানিং সে এ ব্যাপারে এক্সপার্ট হয়ে গেছে। উপস্থিতভাবে চমৎকার মিথ্যা বলতে পারে। সত্যকে হার মানায় সে মিথ্যা। পরক্ষণেই মনে পড়ল, এ ব্যাপারে পার পাওয়া যেত না। নিলয়ের টি-শার্ট দেখলেই তো সব খোলসা হয়ে যেত। কি বিশ্রী ব্যাপারই না হয়ে যেত! যাক বাঁচা গেছে। সে গোসল করে জামাটা পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল।
গোসল সেরে বের হয়েই সে দেখে নিলয় দরজা ভিড়িয়ে তার ঘরে বসে আছে। সে একটু চমকে উঠল যেন। বলল, আপনি এখানে বসে আছেন যে?
বাথরুমে যাব।
এ বাসায় আর বাথরুম নাই বুঝি?
আছে।
তাহলে?
আমার যেটায় যেতে ভাল লাগে সেটায় যাব।
রাতে আপনি এমনটি করলেন কেন?
কী করলাম ?
এরকমটি করা ঠিক হয়নি।
তাহলে কি হাত জোর করে ক্ষমা প্রার্থনা করব?
তা বলিনি।
অপরাধ করেছি, ক্ষমা চাইব না?
ক্ষমা করে দিয়েছি।
রাগ করোনি তো?
আরে না......!
শোন, এরই নাম ভালোবাসা। পৃথিবীর কেউ এসব অতিক্রম করতে পারেনি। সেদিন একটা বই পড়লাম-খুব বিখ্যাত এক লেখকের লেখা। নাম-ভালোবাসা ভালোবাসা। ভালোবাসা দুইবার কেন বলোতো? সেখানে দুই ধরনের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছেন। একটা মনে, আরেকটা শরীরে। খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছেন-একটা ছাড়া আরেকটা অর্থহীন।
হয়েছে, আর লেকচার না দিয়ে বাথরুমে যান।
তোমার খোপা থেকে গামছাটা দিয়ে যাও।
সে খোপা থেকে গামছাটা খুলতেই তার ভেজা চুল ছড়িয়ে পড়ল পিঠ অবধি। নিলয় বলল, সত্যি তোমার শরীরে ভরা যৌবনের ঢল নেমেছে। বুক দু’টো যা বানিয়েছো........। দু’টোর মাঝে এক আঙুলও ফাঁক নেই।
ছি! কিভাবে কথা বলেন? এত বাজে বকতে পারেন।
বাজে বকলাম ? তোমাদের তো জাহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসটা পাঠ্য আছে। পড়েছো সেটা? এক শীতের সকালে আম্বিয়া গোসল করে এলো। মন্তু চোরা চাহনী দিয়ে আম্বিয়াকে দেখল। সেখানে আম্বিয়ার আঁটসাঁট দেহের বর্ণনা দেয়া আছে। তার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে উথলে উঠছে যৌবন। তা দেখে মন্তু আম্বিয়াকে বিয়ে করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। হাসান আজিজুল হকের সাবিত্রী উপখ্যান পড়লাম। সেখানে সাবিত্রীর রূপের যে বর্ণনা দিয়েছেন। বুকের কথাটা আমি সেখান থেকেই নিয়েছি। সেখানে বলেছেন, সাবিত্রীর স্তন দুটি সুস্পষ্ট, সুডৌল, সুদৃঢ়-যেন শ্বেত পাথরের তৈরী। এমন নিবিড়ভাবে সে স্তন দুটি নিবদ্ধ যে, তাদের মাঝখানে এক আঙুলও ফাঁক নেই। আমার মাথায় এরকম কথা আসবে কেমন করে বলো? লেখকরা বললে দোষ নেই, সেটা শিল্প, দোষ আমি বললে। শেষ বার যখন তোমাকে দেখি তখন তুমি সেভেন না এইটে ছিলে।
নাইনে ছিলাম। আপনি না গত বছরের প্রথমে একবার এলেন।
ও এই এক বছরেই......।
আর আপনিও এ সময়ে প্রচুর বকতে শিখে গেছেন। যান, বথরুমে যান।
ওরা এক সঙ্গে নাস্তা খেল। তারপর মুখোমুখি বসে কিছুক্ষণ গল্প করল। গল্প করতে করতে প্রস্তাবটা তুলল নিলয়। বলল, চলো, বাইরে ঘুরে আসি।
কোথায় যাব ?
ঢাকা শহরে ঘুরতে যাবার জায়গার কি অভাব? পার্কে ঘুরবো, দুপুরে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাব, বিকালে পিজা-টিজা......।
তার মানে সারাদিন!
অসুবিধা কী? পড়ায় ক্ষতি হবে? সারা বছর কিছু পড়ো নাই? দুই দিন না পড়লে একবারে ডাব্বাকাত হয়ে যাবে?
না না, তা হবে কেন? ঠিক আছে, চলুন যাই।
সারা দিন তারা এক সাথে কাটালো। গল্প। হাসি-তামাশা। খাওয়া-দাওয়া। আর অনেক ধরনের খাবার বাসায় পার্সেল করে নিয়ে এল। রাতে বাবা-মা’র সাথে বসে সে সব খেতে খেতে আবার গল্প, হাসি-আনন্দ। বাবা-মাও অনেক খুশি। দু’জন কর্মজীবী। একমাত্র মেয়েটাকে সময় দিতে পারে না। কোথাও বেড়াতে নিতে পারে না। খালাত ভাইয়ের সাথে যদি দু’টো দিন বেড়ায় তাহলে মনের রিলাক্স হবে।
রাত অনেকটা পর্যন্ত গল্প করে নিলয় গেস্ট রুমে যাবার সময় নিজের সেলফোনটা তার টেবিলের উপর ফেলে রেখে গেল মনের ভুলে। সে সেটা খেয়াল করেও বলল না-আপনার ফোন নিয়ে যান। ভাবল-রেখে যাওয়াই ভাল। শেষে আবার রাত দুপুরে ফোন করে বলবে-সুমাইয়া, এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও তো।
শোয়ার আগে সে নিলয়ের স্মার্ট ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানায় গেল। বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে ফোনটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। ফোনের ব্যাপারে তার আগ্রহ অনেক বেড়ে গেছে। কোন ফোনের ফাংশন কেমন, কী কী কনফিগারেশন আছে তা জানতে তার ভাল লাগে। তা ছাড়া মেমোরিতে স্টক করা ছবি, গান এ সবের প্রতিও তার আগ্রহ অনেক। এটা-ওটা দেখতে দেখতে সে গেল ইমেজ ভিউয়িং-এ। নিলয়ের ছবি। কত রকম পোশাক পরে, কত বিচিত্র ভঙ্গিতে, কত বিচিত্র প্রকৃতির মাঝে সে ছবি তুলেছে! সত্যিই খুব স্টাইলিশ ছেলে! ঘোরাঘুরিও তো কম করেনি। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল সবই তো দেখে ফেলেছে। তাদের দু’জনের ঠোঁটে ঠোঁট লাগানো একটা ছবিও সেভ করে রেখেছে। কি আশ্চার্য ছেলেরে বাবা! কেউ দেখে ফেললে? সে ভাবল, ছবিটা ডিলিট করে দেবে। ডিলিট করতে গিয়েও আবার করল না। নিজের মতোই বলল-থাক। কে দেখবে?
তারপর ভিডিও। মাধুরী, ঐশ্বরিয়া, কাজল, রানী মুখার্জি, শাররুখ, আমির, সবাই আছে। বলিউড পেরিয়ে হলিউড। জাস্টিস বিবার, তার চেয়ে বয়সে বড় প্রেমিকা সেলেনা গোমেজ, ব্রায়ান এডামস এবং আরও অনেকে। আবার বাংলা গানও রেখেছে। শ্রীকান্ত, কবির সুমন, বন্যা, আনুশেয় এরাও আছে। আছে অনেক রবীন্দ্র সংগীত। তার মানে তার সব দিকেই রুচি আছে।
সে বেছে বেছে কিছু গান শুনল। গান শুনছে আর ফোল্ডার থেকে ফোল্ডারে যাচ্ছে। একটা ফোল্ডারের নাম স্পেশাল ভিডিও। স্পেশাল শব্দটা সবাইকে টানে। তাকেও টানলো চুম্বকের মতো। সে গান বন্ধ করে সেই ফোল্ডার ওপেন করল। প্রথম ভিডিওটা প্লে করেই তার হাত-পা অবশ হয়ে যাবার দশা। তার মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ আওয়াজ। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ। সেই প্রথম নারী-পুরুষের জৈবিক ক্রিয়া তার স্বচক্ষে দেখা। সে একটার পর একটা দেখতে লাগল। কানে হেডফোন লাগিয়ে শব্দ সহকারে দেখে আরও বেশি আকর্ষণ বোধ করল। তারপর যেটা তাকে খুব বেশি আকর্ষণ করল সেটা সে শেয়ারের মাধ্যমে নিজের স্মার্টফোন মেমোরিতে নিতে থাকল। কখন রাত শেষ হয়ে গেছে তা সে জানে না। দরজা বন্ধ না করেই দু’টো ফোন বালিশের পাশে রেখে সে ঘুমিয়ে গেল।
সকালে নিলয় ঘুম থেকে উঠে কুলসুমকে বলল, সুমাইয়া উঠে নাই?
না ভাইজান।
দশটা বেজে গেছে.....।
আমি তিন বার ডাকছি, উঠে নাই। কোনো নড়াচড়াই নাই। মরা মানুষের মতো পইড়া আছে। সারা রাইত ক্যান পড়তে অইবো আপনেই কন ভাইজান? কতজন তো দেখি ২/৪ ঘন্টা পইড়াই ফাস কিলাশ পাস দেয়।
তুই আবার ডাক।
ডাকলে কোনো লাভ নাই। বিশ্বাস না হইলে আপনে ডাইকা দেখেন।
নিলয়ের মনে পড়ল তার সেলফোনের কথা। সে পা বাড়াল তার ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকে একটু থমকে দাঁড়াল। সে বড্ড এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। বুকে ওড়না নেই। জামাটা অনেকটা উপরে উঠে আছে। পরক্ষণেই ভাবল, কোনো ব্যাপার না। সে ফোনটা পেল তার বালিশের পাশে। ফোনটা হাতে নিয়ে ডাকল, কি ব্যাপার নাস্তা করবা না?
কয়েক বার ডাকার পর তার একটু চেতনা ফিরে এল। গোঙানির মত করে বলল, আপনি নাস্তা করেন, আমি একটু পরে উঠব।
সারা রাত এভাবে লেখাপড়া করতে হয়? এটা কি ডিভিশনের যুগ যে ফার্স্ট ডিভিশন পেতে জান বের হয়ে যাবে? এক/দেড় ঘন্টা পড়েই তো কত জন গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে যাচ্ছে। এটা প্রশ্নফাঁসের যুগ। একটু চেষ্টা থাকলে লেখাপড়া না করেও.....।
আপনি যান তো। আমি চোখ মেলে তাকাতে পারছি না।
তার ঘুম ভাঙল বেলা বারোটার সময়। ঘুম থেকে উঠে গোসল করল। গোসল করার পর অনেকটা ফ্রেস হল। নিলয় একটু বিরক্ত। সকাল থেকে একা একা বসে আছে। দুপুরে খাবার খেতে বসে নিলয়ের খেদোক্তি-ভেবেছিলাম, আজ সকালেই বের হব, অথচ এখন খাবার খেতে হচ্ছে বাসায়। সারা রাত লেখাপড়া করতে হয় বলো তো?
কী করবো? কাল সারা দিন তো আপনার সাথে ঘুরে পড়তে পারলাম না।
তার মানে আমার জন্য তোমার লেখাপড়া ডিসটার্ব হচ্ছে? ঠিক আছে, আমি এখনই চলে যাচ্ছি।
আমি কি তেমন কথা বলেছি?
আপনার সাথে ঘুরে পড়তে পারলাম না-এ কথার মানে কি?
ধ্যাৎ! এমনি মজা করলাম।
তাহলে আজ বের হবে না ?
বের হব না কেন? একটু পরেই বের হব। আজ ফিরব একেবারে ডিনার করে।
আমি আরেকটা অফার করতে চাই।
কী?
একটু শপিং-এ যাব।
শপিং-এ কেন ?
তোমাকে কিছু কিনে দিতে চাই। উপহার ছাড়া ভালবাসা পূর্ণ হয় না।
উপহার লাগবে না।
কেন, সমস্যা আছে কোনো?
সমস্যার কিছু নাই।
তাহলে? সামনে তোমার পরীক্ষা। পরীক্ষা উপলক্ষেও তো আমি কিছু দিতে পারি।
পরীক্ষা দেরি আছে। এখনো টেস্ট হল না।
আগেই দিয়ে রাখি। আবার কবে আসতে পারি না পারি।
আচ্ছা দিবেন।
তারপর দু’জন কিছু সময় নীরবে খেতে লাগল। হঠাৎ নিলয় বলল, আচ্ছা, আমার ফোনটা তো তোমার টেবিলে রেখে এসেছিলাম। তোমার মাথার কাছে গেল কিভাবে?
আপনি আমার ঘরে ঢুকেছিলেন!
ঘরে না ঢুকলে ফোন আনলাম কিভাবে? তোমাকে ডাকলাম কিভাবে?
আমাকে ডেকেছিলেন?
তোমার দেখছি কিছুই মনে নাই। বেহুশ ছিলা নাকি? আমার ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করো নাই তো?
ছবি-টবি দেখলাম। যা স্টাইলিশ আপনি!
আর কী করলে ?
গান-টান শুনলাম।
ভিডিও দেখ নাই?
দেখেছি, আমির খানের গান দেখেছি।
স্পেশাল ফোল্ডারে গিয়েছিলা?
চুপ করেন তো।
আহ! গিয়ে থাকলে বলো। দোষের কী আছে?
আপনি এসব জমা করে রেখেছেন কেন?
সব কিছুই রাখতে হয়। এটা একবিংশ শতাব্দী। এখন এক হাতে থাকবে রবীন্দ্রনাথ, আরেক হাতে থকবে গবীন্দ্রনাথ। এক হাতে বাঁশের বাঁশরি, আরেক হাতে ইলেক্ট্রনিক গীটার।
গবীন্দ্রনাথ কে?
তুমি চিনবা না। তুমি তো কুয়ার ব্যাঙ। বাইরে মেলামেশা করলে বুঝতা।
আমার অতো বোঝার দরকার নেই।
তোমার বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করে দেখো, তারা সবাই এসব দেখেছে। আজকাল সিক্স/সেভেনের ছেলেমেয়ের ফোনেও এসব থাকে।
হয়েছে, চুপ করে খান।
খাওয়া তো শেষ।
ঐ বড় হাড়টা বসে বসে চিবান।
আচ্ছা।
নিলয় আরও দুই দিন ছিল। দুই দিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে-সেখানে ঘোরাঘুরি, বাইরে খাওয়া, শপিং এই সব হয়েছে। যাবার সময় নিলয় তিন হাজার টাকাও দিয়ে গেছে। সে নিতে চায়নি। নিলয় বলেছে, অসুবিধা কী? একটা ড্রেস কিনে নিও।
না, লাগবে না। ড্রেস তো কিনে দিলেনই।
তুমি মনে হয় আমাকে সত্যিকারে ভালোবাসো না।
কি যে বলেন! মিথ্যা করে ভালোবাসা যায়?
যায়। অনেকেই দুই/তিনটা নৌকা রেডি রাখে। যেটায় সুবিধা মনে করে সেটায় উঠে।
কি যে আবোল-তাবোল বলেন।
তাহলে আমার কাছ থেকে টাকা নিতে সমস্যা কি তোমার?
উপহার দিয়েছেন। নগদ টাকা কেন?
আমার দেয়াগুলো সেরকম ভালো নাও হতে পারে। আমি মেয়েদের ড্রেস তেমন বুঝি? তুমি নিজের পছন্দ মত কিনে নিও। টাকাটা নাও, আর মুখটা আগাও, একটা বিদায়ী......।
টাকা নিতে পারি, কিন্তু মুখ আগাবো না।
কেন?
আপনি সহজে ছাড়তে চান না?
আচ্ছা, তুমি যখন চাইবে তখনই ছেড়ে দেব। যত দোষ নন্দ ঘোষ, নিজেই আমাকে আটকে রাখে।
হয়েছে! এই কয়দিনে আমার সব লিপস্টিক আপনার পেটে গেছে।
ডাক্তার দিয়ে আবার পেট ওয়াশ করতে না হয়।
হি হি হি।
[চলবে...]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট