ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : পর্ব ০৪



ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন

[গত সংখ্যার পর]
সকাল দশটায় মিজান মিয়া এসে হাজির। জানাল, তার বাবার চিকিৎসা চলছে। বাজারে যাবে বলতেই, ওকে টাকা দিলাম, দুপুর ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য। মিজান মিয়া তড়িঘড়ি চা বানিয়ে দিয়ে বাজারে চলে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবছি গতরাতের কথা। নীলা ও আমি ঘুরে বেড়িয়েছি গভীর শাল-গজারি বৃক্ষের সুবিশাল সাম্রাজ্যে। আমাদের যুগল জীবনে এমন একটি অ্যাডভেঞ্চারময় দিন আসবে, আগে কখনো ভাবতেও পারিনি। মা প্রায়ই কেঁদে কেঁদে আমাকে বলত আবার বিয়ে করার জন্য। খাপছাড়া এ জীবনটাকে গুছিয়ে সাজানোর জন্য। যদি আমি তাই করতাম, আজ নীলার সামনে যে কী হত? ও এসব শুনে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেত। সে তখন আমাকে বলত, সোম তুমি আমার জন্য কিছু দিন অপেক্ষা করতে পারলে না? কেন এমন করলে? আমাকে কেন এতটুকু সময় দিলে না?
তখন আমার কাছে প্রতি উত্তর বলতে কিছুই থাকত না। আচ্ছা, এসব শুনে তখনও যদি নীলা আমাকে কাছে টানতে চাইত, আমি কী করতাম? গতরাতের মতো ওকে ফিরিয়ে দিতাম? নাকি বলতাম, নীলা আমার কাছে এসো না, দূরে সরে যাও, আমাকে গ্রাস করো না, প্লিজ.. আমি বিবাহিত।
একটা প্রশ্নের উত্তর আমি এখনো আমার কাছে খুঁজে পাইনি। গেস্টহাউজে নীলা আমাকে খুব কাছে টেনেছিল। ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিল, কিন্তু আমি কেন ওর থেকে দূরে সরে ছিলাম? অথচ এই আমি নীলাকে কত অসীম ভালবাসি। নীলাহীন সোম ধূ-ধূ মরুভূমি। অথচ, ওকে কাছে টেনেও আমি সে মুহূর্তে প্রত্যাখ্যান করেছি, কেন এমন করেছি?
আমার ভেতর থেকে কেউ বলে ওঠল, অস্তিত্ব! অস্তিত্ব রক্ষার জন্য! শূন্যে, পরম শূন্যে বিলীন হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য।
কে? কে কথা বলছ?
নিজেকে প্রশ্নটা করে কোনো উত্তর পেলাম না। হঠাৎ বলে ওঠলাম, হ্যাঁ আমি, আমিই তো বলছি।

দুপুরের পর উৎসবকে কল দিলাম। জানাল, আজই সে খুলনা থেকে ঢাকায় ফিরছে। এখনো ঢাকায় ফিরে যাইনি শুনে ভীষণ রাগ করল। ওর স্ত্রী মোহনা ও দু’সন্তানকে নিয়ে আগামী সপ্তাহে নেপাল যাবে। আমি সাথে যাব কিনা জানতে চাইল। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। বললাম, শুধু আমি নই, আমার সাথে আরও একজন আছে। সেটা এখন বলছি না। তার আগে একবারের জন্য শালবনে আসতে হবে তোদের। তোদের জন্য একটি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।
উৎসব ঠাট্টা করে বলল, ঐ অঞ্চলের কোনো মেয়েকে শাদী করে ফেলেছিস নাকি?
তারচেয়েও বড় ঘটনা ঘটেছে। ঠিকানা তো তোর ম্যাসেঞ্জারে দেয়াই আছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে রোড ধরে ছুটতে থাক, তারপর আমি তো আছিই।

আজ নীলা আসেনি, একা একা কেটেছে সারাটা দিন। ও কি গতরাতের ঘটনায় এখনও অভিমান করে আছে? জানি না। তাপমাত্রার ভারসাম্যহীনতা যে ভালবাসাকেও দূরে ঠেলে দেয় তা আমি গতকাল নিজের কাছে জানলাম। আচ্ছা, উষ্ণতা কি সঙ্গমকে ত্বরান্বিত করবে? কাছে টানবে খুব সহজে? চুম্বকের মতো আকর্ষণ করবে? জানি না, কী সব ভাবছি, যুক্তি নাকি যুক্তিহীনতা।
নিম্ন তাপমাত্রার মতো উচ্চ তাপমাত্রার আচরণও একই রকম হবে। এটা খুব সহজ ও স্বাভাবিক যুক্তি।
দিশেহারা ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিতে বিকেলে মিজান মিয়ার সাথে বাইরে থেকে বেরিয়ে এলাম। মিজান মিয়া স্থানীয় মানুষদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। বনের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে গভীরে প্রবেশ করলাম। আমি আপন মনে খুঁজে চলেছি, রাতের সে গেস্টহাউজ। আমাকে দিগি¦দিক হাঁটতে দেখে, মিজান মিয়া বলে ওঠল, স্যার, ভেতরে যাবেন না, পথ হারায়া গেলে, খোঁজা মসিবত হইব।
তার দিকে তাকালাম, আশঙ্কা-দ্বিধার ছাপ মিজান মিয়ার চোখে-মুখে।
এখানে, বনবিভাগের গেস্ট হাউজ কোথায় বলতে পারো?
স্যার, এখানে কোনো গেস্ট হাউজ নাই। ফরেস্ট অফিসারের অফিস আরো অনেক দূরে মেইন রোডে। এইখান থেকে সাত মাইল পথ।
মিজান মিয়া যে এই এলাকা সম্পর্কেও অনভিজ্ঞ তা তার কথায় স্পষ্ট প্রমাণিত। গতরাতে ঘুরে গেলাম, দেখে গেলাম, আর এখন সে বলছে এখানে কোনো গেস্টহাউজই নেই।
মিজান মিয়াকে কিছুই বললাম না। বরং বাড়িতে ফিরে এলাম।
সন্ধ্যায় ডায়েরি পড়ায় মন দিলাম। একটানা রাত একটা পর্যন্ত পড়ে গেলাম। ১৯৩৫ সালের ডায়েরিটি পড়তে গিয়ে চোখের পাতায় ঘুম ঘুম ভাব এসে জড়ো হচ্ছে। দাদাজান এ ডায়েরিতে গণিত নিয়ে তাঁর নানা কৌতূহল ও প্রশ্ন একে একে তুলে ধরেছেন। গাণিতিক লেখার পাশে মাঝে মাঝে তিনি নোট আকারে মেঘাদ্রিকে নিয়ে লিখেছেন। আমার বুঝতে বাকি নেই, দাদাজানের কৈশোরের সে প্রেমিকা মেঘাদ্রি ব্যতীত অন্য কেউ নয়।
ঘুম আসতে না আসতে আমি স্বপ্নের জগতে ডুবে গেলাম। আজকের স্বপ্নে নীলা নেই, কলেজ ক্যাম্পাসের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে কে আছে আমার স্বপ্নে? জানি না, কাউকেই খোঁজে পাচ্ছি না।
আমি এখন কোথায়?
এই তো, আমি দাদাজানের ঘরে ঘুমিয়ে আছি। লক্ষ্য করলাম, আমার খাটের পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। আমার অনুমতি ব্যতীত কেউ ঘরে ঢুকেছে। ইচ্ছে করছে রেগে ওকে জিজ্ঞেস করি, কে তুই? কেন এখানে এসেছিস? কিন্তু আমার রাগ জাগছে না। চুপি চুপি ওঠে বসলাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম চেয়ারের দিকে। এই তো দেখতে পাচ্ছি, কে এটা? দেখে মনে হচ্ছে একুশ বাইশ বছরের কোনো তরুণ।
এই কে তুমি? আমি স্বশব্দে প্রশ্নটা করে ফেললাম।
তরুণটি আমার দিকে ফিরে তাকাল। কিছুই বলছে না। আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা কাকে দেখছি। ওর চেহারা তো দেখতে ঠিক আমার মতো। এটা তো সেই আমি, যে বয়সে আমি ভার্সিটিতে পড়েছি। গায়ের জামাটাও পরিচিত। এই শার্ট আমি ষোল বছর আগে পড়তাম। যখন আমি অনার্স থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট।
তুমি আমাকে চিনবে না। তরুণটি ওর স্বাভাবিক গলায় বলল।
ভয়, কৌতূহল ও প্রশ্ন আমার চারপাশে ঘুরঘুর করছে।
কী চাও এখানে?
মিঃ সোম আমি তোমাকে এখান থেকে চলে যাবার জন্য আদেশ করছি।
কেন?
ড. রিয়ন সাহেবের ডায়েরিগুলো আমার চাই।
কে তুমি? তোমার পরিচয় দাও। রূঢ়ভাবে বললাম।
আমার নাম গঞ৬৬৯, চতুর্মাত্রিক জগতে আমার বাসস্থান। যেখানে দৃশ্যমান কিছুই নেই, অথচ সবই আছে।
এ ডায়েরিগুলো তোমার কেন প্রয়োজন?
রিয়ন সাহেব, সারাজীবন তপস্যা করে ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা তৈরি করেছেন। এ ফর্মূলার মাধ্যমে সমাধান করা যাবে এমন কিছু গোপন সমীকরণ রয়েছে, যা বহুমাত্রিক জগতে প্রবেশের দ্বার উন্মোচন করবে। তাই ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলার খোঁজে আমি তোমাদের ত্রিমাত্রিক জগতে প্রবেশ করেছি, ও রিয়ন সাহেবের ডায়েরিগুলো পড়ে দেখছি।
চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালাম। নির্ভীক ভঙ্গিতে বললাম, না, তুমি এটা করতে পারো না। তুমি বিনা অনুমতিতে ঘরে প্রবেশ করেছ। এটা তোমার প্রথম অপরাধ। কারোর ব্যক্তিগত ডায়েরি পড়া নিঃসন্দেহে অন্যায়। তোমাকে এখান থেকে চলে যাবার জন্য আদেশ করছি। এখান থেকে বিদেয় হও, নইলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব।
তরুণটি হেসে ওঠল।
হা হা হা
আমি চরম বিরক্ত হচ্ছি।
কী ব্যাপার পাগলের মতো হাসছ কেন?
হাসছি, তোমার বোকামির মাত্রা দেখে। শোনো চতুর্মাত্রিক জগতের জীব তোমাদের চেয়ে বহুগুণ বেশি শক্তিশালী। তোমাদের পুলিশ কিংবা নিরাপত্তা বাহিনী আমাকে কিছুই করতে পারবে না। ইচ্ছে করলেই তোমাকে আমি হত্যা করতে পারি।
তরুণটির কথা শুনে এবার স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এ দুর্বৃত্তের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য আমাকে কিছু একটা করতে হবে। এক মুহূর্তে ভাবলাম এ ঘর থেকে আমার বের হওয়া উচিত। ধীর পায়ে দরোজার কাছে চলে এলাম। তরুণটি আমার বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আড় চোখে সে আমাকে দেখছে, ওর দেখার ভঙ্গি খুব সুন্দর! অথচ এ ভঙ্গিটা আমার কাছ থেকেই নকল করেছে। ঠিক এভাবেই আমি রহস্য ভরা চোখে নীলার দিকে তাকাতাম।
পালানোর চেষ্টা করে লাভ নেই মিঃ সোম। তুমি তো ঘুমিয়ে আছো বিছানায়। এই মুহূর্তে নিরুপায় তুমি।
বিছানার দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। একি, আমি তো বিছানায় শুয়ে আছি। তাহলে এখানে আমিটা কে? এসব কী ঘটছে? একই আমি তিনটি স্থানে কিভাবে সম্ভব?
আমার ছদ্মবেশী ঘাতক আমার সম্মূখে আমার চেহারায় দাঁড়িয়ে। এখন আমি আমাকে কিভাবে রক্ষা করব? চিৎকার করে ডেকে ওঠলাম, সোম, ঘুম থেকে ওঠো, সোম। তোমার সামনে বিপদ।
আমার ঘুম কিছুতেই ভাঙছে না। এখন উপায়?
তরুণটি দীর্ঘবাহু প্রসারিত করে আমার বিছানার দিকে এগোচ্ছে। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। তীব্র বেগে তরুণটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। ওকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঘুষি মারতে লাগলাম। অনবরত মাথায় আঘাত করছি। ও কাতরাচ্ছে। চিৎকার চেঁচামেচি করছে। ওকে দুর্বল করতে পেরে আমি যেন আরো শক্তি খোঁজে পেলাম। আহত তরুণটি মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় গোঙাচ্ছে। আমি বিছানায় ওঠে আমাকে জাগানোর চেষ্টা করছি। আমার গভীর ঘুম কিছুতেই ভাঙছে না। আমার মনে প্রশ্ন উঁকি দিলো আমি কি মারা গিয়েছি? এটা কি আমার মৃতদেহ? না, তা হতে পারে না।
হঠাৎ দেখলাম, তরুণটি মাথা তুলে জেগে ওঠেছে। ওর করুণ মুখ দেখে আমার ভেতরটা হু হু করছে। একি করেছি, বাইশ বছরের আমাকে আমি মেরে কী করেছি। খুব মায়া হচ্ছে ওর জন্য।
তরুণটি বিছানার দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আমার গলা চেপে ধরতে চাইছে। আমি আমার ঘুমন্ত দেহকে টেনে খাটের কিনারে নিয়ে গেলাম। সে আমাকে ছুঁতে না পেরে বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটা চেপে ধরল। মুঠোফোনটাও ধরতে চেয়েছিল, তার আগেই সরিয়ে নিয়েছি। ওর হাতের মুঠোয় প্রচ- চাপে ঘড়িটি মুহূর্তে ধুমড়ে-মুচড়ে গেল।
ভয় হচ্ছে, সে কি আমার দেহটাকেও এভাবে বিকৃত করে ফেলবে? ধুমড়ে মুচড়ে দেবে?
আমি আমার গায়ে তীব্র জোরে ধাক্কা দিতেই সজাগ হয়ে গেলাম।
নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কী হয়েছে?
তুমি বিপদগ্রস্ত, এখান থেকে পালাও।
আমি বিছানা থেকে নেমে তরুণটির দেহ ডিঙিয়ে দরোজা খুলতে গেলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, ও মুচকি হাসছে। জানি না কি মায়া সে হাসিতে লেপটে আছে। ইচ্ছে করছিল ওকে জড়িয়ে ধরি। আমার তারুণ্যকে, আমার হারিয়ে যাওয়া অতীতকে আদর করি। অথচ সে আমার ঘাতক।
দরোজা খুলে বেরিয়ে এলাম। চিৎকার করে ডাকছি, মিজান মিয়া আমাকে বাঁচাও.....। দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গেলাম। হঠাৎ মনে পড়ল, মিজান মিয়া নেই, ওকে তো ছুটি দিয়েছি।
এখন কটা বাজে?
শেষ রাত হয়তো।
নিরুপায় দৃষ্টিতে চারপাশে তাকালাম। কেউ নেই।
সোজা হয়ে বসতে চাইলাম, পারলাম না। পা অবশ লাগছে। হামাগুড়ি দিয়ে করিডোরের শেষ প্রান্তে এগিয়ে গেলাম। সুনসান নিরবতা! ঘাসের উপর মেঘে ঢাকা চাঁদের কিঞ্চিত আলো ছড়িয়ে পড়ছে। আবার নিভে যাচ্ছে। আমার ঘুম আসছে, দু’চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম।
অনেকক্ষণ পর হাতে বরফের মতো ঠা-া কিছুর ছোঁয়া পেলাম। চোখ খুলে দেখি, একটি বাচ্চা সাপ আমার আঙুল প্যাঁচিয়ে এদিক-সেদিক নড়াচড়া করছে। হালকা চাঁদের আলোয় ওর দেহের রেখা-বর্ণ দেখতে পাচ্ছি। রঙধনু রঙে ঝলমল করছে। এটা সেই শিশু সাপ, যাকে প্রথমদিন দেখেছিলাম। অচেনা আগুন্তুকের শব্দে পালিয়ে গিয়েছিল। আগেই বলেছি সর্পভীতি আমার মধ্যে নেই। তাই নির্বিঘেœ ওকে দেখতে লাগলাম। বাচ্চা সাপটি আমার ডান হাতের অর্ধমুঠোর ভেতর কু-লি পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ আগে আমার মনে জন্ম নেওয়া মরণ ভীতি ভুলে গেলাম, মনে প্রচন্ড মায়ার উদ্রেক হলো। মনে হচ্ছে, এ শিশু সাপটি আমার শিশু সন্তান শশী। এই মুহূর্তে সে আমার বাহুডোরে ¯েœহের পরশে শুয়ে আছে। আমিও ঘুমাচ্ছি, শশীও ঘুমাচ্ছে, সজাগ কেবল চাঁদ।


সদর হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। পুরো ত্রিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটালাম। আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থ্যবোধ করছি। গতকাল সকালে মিজান মিয়া আমাকে নিচতলায় বারান্দার মেঝেতে ঘুমন্ত বা অজ্ঞান অবস্থায় পায়। তখনই সে ট্যাক্সি ডেকে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তার জানিয়েছে, আমি সম্পূর্ণ আশঙ্কা মুক্ত। কেবল পায়ের গোড়ালীতে সামান্য চোট লেগেছে। ডাক্তার আমার ঘটনা শুনে বলল, পুরো ব্যাপারটা অনিদ্রা জনিত অসুখ। সুতরাং সুস্থ্য হবার জন্য প্রতিদিন আট ঘণ্টা ঘুমানো আবশ্যক।
মিজান মিয়াকে দেখে ওর বাবার কথা জিজ্ঞেস করলাম, জানাল ভাল আছে। কিছু সময় চুপ থেকে মিজান মিয়া বলল, স্যার আপনার হায়াত আছে বইলা, বাঁইচ্যা গেলেন।
এ কথা বলছ কেন?
সাপ, স্যার, বিষাক্ত সাপ! আপনার শরীরের উপর বইস্যা ছিল। কাছে যাইতেই আমার দিকে ফোঁস কইরা ফণা তুইল্যা আগায়া আইল। ধীরে ধীরে পিছনে গেলাম। রান্নাঘরে হাতের কাছে একটা বাঁশের লাঠি পাইলাম। এটা লইয়া দিলাম বারি, এক্কেবারে খতম।

সাপের বাচ্চাটা মিজান মিয়া মেরে ফেলেছে, শুনে খুব কষ্ট লাগল। আমি যেন আজ, আবার শশীকে হারালাম। নীলার কথা মনে পড়ল, ও হয়তো আমাকে খুঁজতে এসেছিল। না পেয়ে মন খারাপ করে নিশ্চয়ই ফিরে গিয়েছে।
এদিকে মিজান মিয়া একটানা বর্ণনা দিয়েই যাচ্ছে।
প্রথমে তো ভাবছিলাম স্যার, আপনারে সাপে কাটছে। হাতে-পায়ে কোত্থাও কোনো চিহ্ন নাই, পরে ভাবলাম আপনি সাপ দেইখ্যা অজ্ঞান হইছেন। তাই তাড়াহুড়া কইরা হাসপাতালে নিয়া আসছি।
মিজান মিয়াকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কাল সকালে নীলা এসেছিল?
সেটা আবার কে স্যার?
প্রতিদিন যে মহিলাটা আমার সাথে দেখা করতে আসে, ভুলে গেলে?
স্যার প্রতিদিন কে আসে?
মিজান মিয়ার বেখেয়ালিপনা আমার মধ্যে রাগের উদ্রেক ঘটালো। রূঢ়ভাবে বললাম, প্রশ্ন রেখে বলো কেউ এসেছিল কিনা।
মিজান মিয়া ভয়ে চুপসে গেল। কাঁপতে কাঁপতে বলল, না, স্যার কেউ আসেনি।

মিজান মিয়া বিড়ি সিগারেট খায় বটে, আর কী ধরনের নেশা করে তা ঠিক জানি না। তার মাথায় যে কিছুটা গ-গোল আছে, তা বিগত দিনগুলোতে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি। নীলা আমার সাথে দেখা করতে আসে, বিষয়টা মিজান মিয়া পছন্দ করে না। চা নাস্তা দিতে বললে দেরি করে, কখনো শুধু আমার জন্য চা-বিস্কুট নিয়ে আসে, নীলাকে অগ্রাহ্য করে। তাই মিজান মিয়ার প্রতি আমার প্রায়ই কিছুটা রাগ হয়। বেশিরভাগ সময় পুনরায় ধমকে বলার পর আবার সে এক প্রকার বাধ্য হয়ে নীলার জন্য চা-বিস্কুট নিয়ে আসে। নীলাকে দেখেও সে না দেখার ভান করে বা ওর দিকে তাকাতে চায় না। এটা নীলার প্রতি এক ধরনের অপমান। এর পেছনে আমি একটি কারণ ও যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। মিজান মিয়া চায় না, নীলা এই বাড়িতে আসুক। সে হয়তো ভাবছে আমাদের মধ্যে বিবাহ বহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এটা দেশের চোখে সমাজের চোখে যেমন অপরাধ, মিজান মিয়ার চোখেও তাই। মিজান মিয়া যদি আমার আর নীলার অতীতকে জানতে পারত, তাহলে হয়তো এমনটি করত না।
সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলাম। মিজান মিয়া আমাকে বাড়িতে নিয়ে এল। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে দোতলায় ওঠলাম। বারান্দায় সে চেয়ার এনে আমাকে বসার সুযোগ করে দিলো।

পূর্বাকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। পশ্চিমাকাশের লাল রঙের আবছা ঢেউ সেখানে আছড়ে পড়েছে। আবির রাঙা মেঘগুলো দাদাজানের সমীকরণের মতো, বামপাশে একদল রাশি, ডানপাশে আরেকদল। ওদের মধ্যে সমান চিহ্নের সম্পর্ক। কখনো কখনো অসমান সম্পর্কও তৈরি হয়।
বাসার কথা মনে হতেই আব্বুর সাথে ফোনে কথা বললাম। হঠাৎ আমার অসুস্থতার কথা শুনে আব্বু ভীষণ রাগ করল। বলল, দ্রুত শহরে ফিরে যেতে। কিন্তু আমি তো নাছোড়বান্দা। যেখানে নীলা আছে, সেখান থেকে আমি চলে যাই কি করে? তাই আব্বুকে সরাসরি না বলে দিলাম।
মিজান মিয়ার সাহায্যে ঘরে ঢুকলাম। বিছানায় যেতেই হাতঘড়িটা চোখে পড়ল। ঘড়িটা ধুমড়ে মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে আছে। সে রাতে আমার সাথে কী ঘটেছিল? মনে করার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, মনে পড়ছে। একজন আমি তিনটি স্থানে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হয়েছিলাম। আমি আমাকে খুন করতে চেয়েছিলাম, কৌশলে আমাকে বাঁচিয়েছি আমি নিজেই। এটা কী করে সম্ভব? এমনটা ঘটার পেছনে একটাই কারণ ছিল, তা হলো দাদাজানের ডায়েরি। অদ্ভুত!
আচ্ছা, এমনটিও তো হতে পারে। সবকিছুই স্বপ্ন ছিল, স্বপ্নেই আমি নিজেকে তিনটি পৃথক চরিত্রে সাজিয়েছি। কিন্তু, অবাক করা বিষয় হলো ঘড়িটা। সেটা তো দৃশ্যমান।
না, আমিই ঘড়িটাকে ঘুমের মধ্যে প্রচ- জোরে চেপে ধরেছিলাম? যার ফলে এমনটা ঘটেছে। তারপর হয়তো ঘুমের মধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছি। তারপর যা হলো, সবই স্পষ্ট মনে আছে।
রাতের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ গান শুনলাম। পত্রিকাতে পড়েছিলাম, দাদাজান তাঁর সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, তিনি গাণিতিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সময় কখনো কখনো বিরতি দিয়ে গান শুনতেন। বেশিরভাগ ফোক গান হাসন-লালন ও রবীন্দ্রসংগীত তাঁর খুব পছন্দ। অঙ্ক কষার সময় শাস্ত্রীয় সংগীত শুনতে তাঁর ভীষণ ভালোলাগত। দাদাজানের কথা ভাবতে গিয়ে ডায়েরির কথা মনে পড়ল। বিছানা ছেড়ে নিজেই আলমারির কাছে ওঠে গেলাম। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই ১৯৮৩ সালের ডায়েরিটা নেই। ১৯৮৪ সালের ডায়েরিটি আগের অবস্থানে আছে। আমি সে ডায়েরিটি তুলে নিলাম।
প্রথমদিকের কতগুলো পৃষ্ঠা একেবারে ফাঁকা। কিছুই লেখা নেই। অন্য পৃষ্ঠাগুলো খুলে দেখলাম। থিওরিগুলো লেখা থাকলেও, লেখার পাশে গাণিতিক সমীকরণগুলো নেই। দেখে মনে হয়, চিত্রগুলোকে কেউ অস্পষ্ট করে রেখেছে। আমার ধারণা পাল্টে যেতে লাগল, সে রাতে যা ঘটেছিল, সবই সত্য। ডায়েরি চুরির ঘটনার প্রমাণ আমার কাছে পূর্ণাঙ্গ সত্য। আমার ছদ্মবেশী সে তরুণ ডায়েরিগুলো পড়ে যাচ্ছে আর গাণিতিক সমীকরণগুলো মুছে ফেলছে। সে রাতে তরুণটি বলেছিল সে চতুর্মাত্রিক জগত থেকে এসেছে। সেটা আবার কেমন জগত? আর এ ডায়েরিগুলোই বা তার কী এমন ক্ষতি করেছে? কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।
মিজান মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম রাতে বাড়িতে চলে যাবে কিনা? সে বাড়ি যেতে অস্বীকৃতি জানাল। নিচের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তে বললাম। সে বলল, স্যার, আমি এখানেই থাকি। আপনার কখন কী লাগবে কে জানে? মেঝেতে চাটাই বিছায়া থাকমু।
মিজান মিয়ার কথা শুনে সন্তুষ্ট হলাম। বললাম, ঠিক আছে। তোমার যেখানে খুশি থাকতে পারো।
মিজান মিয়া আমাকে ওষুধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিলো। ডাক্তারের দেয়া ব্যথানাশক ও ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়লাম। তখন হয়তো রাত ১০টা বাজে।

[চলবে...]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট