ধারাবাহিক উপন্যাস : অনিঃশেষ অন্ধকার : পর্ব ০৬








অনিঃশেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ

[গত সংখ্যার পর]
১১.
সময় কিভাবে কাটবে তা নিয়ে একটা ভাবনা ছিল, তা দূর হয়ে গেল। রেজাল্টের টেনশন ভুলে বেশ আনন্দেই কেটে গেল দিনগুলি। দেখতে দেখতে রেজাল্ট প্রকাশ হওয়ার দিন এসে গেল। পত্রিকায় খবর বের হল, আগামী বৃহস্পতিবার সব শিক্ষা বোর্ডে একযোগে এস.এস.সি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হবে। কোনো কোনো টিভি চ্যানেলেও ব্রেকিং নিউজে তা দেখাল। তখন থেকেই বাবা বলতে লাগলেন-আমাদের সময়ে তিন মাসের আগে এস.এস.সি, এইচ.এস.সি’র রেজাল্ট বের হত না। তিন মাসের কথা বলতো। বেশির ভাগ সময় ৪/৫ মাস পরেও বের হত। আর এখন দেড় মাসে.........। ডিজিটাল যুগ। খাতা দেখে কম্পিউটার। এমন এক সময় আসবে যখন পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের সপ্তাহে রেজাল্ট প্রকাশ হবে। খাতা দেখবে রোবট। ছেলেমেয়েরা হাফ ছাড়ার সময়ও পাবে না। বড় একটা পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ করে ছেলেমেয়েরা একটু বেড়াবে, নাটক-সিনেমা দেখবে......। আমাদের সময়ে তো আমরা সব আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়িয়েও সময় শেষ করতে পারতাম না। তারপর যেতাম বন্ধুদের আত্মীয়ের বাড়িতে। যাযাবর কম দুঃখে বলেননি-বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। হায়রে......!
বাবার স্মৃতিচারণ কয়েক পৃষ্ঠায়ও শেষ হত না, যদি না মা তাকে থামিয়ে দিতেন। মা বললেন, হয়েছে, তুমি বড় স্মৃতিকাতর মানুষ। যুগ পাল্টাবে না? পুরনোকে ধরে বসে থাকলে চলবে ?
রেজাল্টের দিন সকাল নয়টায়ই বাবা চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন, মা সুমাইয়া, কোথায় তুই? তোর স্মার্টফোনটা দে’, একটা মেসেজ পাঠিয়ে দেখি রেজাল্ট আসে কি না।
সে তখনও শুয়ে ছিল। ঘুম ভেঙেছে অনেক আগেই। রাতেও ঘুমিয়েছে খুব কম। সব মিলিয়ে হয়তো দেড়/দুই ঘন্টা ঘুমিয়েছে। রেজাল্ট বের হবে-এ কথা ভেবেই তার হাত-পা কেমন শীতল হয়ে আসছে। শরীরে শক্তি নেই। মনের মধ্যে কেমন অস্থির ভাব।
সে শুয়ে থেকেই বলল, এত সকালে মেসেজ করে কোনো লাভ হবে বাবা? বোর্ড থেকে বলেছে, এগারোটার আগে তারা রেজাল্ট নেটে দেবে না।
মেসেজ পাঠিয়ে দেখতে তো দোষ নেই। নাকি দোষ আছে?
পাঠাতে চাইলে তোমার মোবাইল থেকে পাঠাও। আমারটা থেকেই পাঠাতে হবে এমন কোনো কথা আছে?
এস.এস.সি’র রেজাল্ট তো কোনো ছেলেখেলা না। দামী স্মার্ট ফোন থেকেই জানবো। তোর ফোনের বড় পর্দা। বড় অক্ষরে লেখা আসবে। কিভাবে যেন মেসেজ পাঠাতে হয় ? প্রথমে বোর্ডের তিন অক্ষর, তারপর রোল নাম্বার, তাই না? কোন নাম্বারে সেন্ড করতে হয় মেসেজ?
মেসেজ সেন্ড করা হলে রেজাল্ট এল না। বাবা অনেকটা নিরাশ হলেন। আরও দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। দুই ঘন্টা-লম্বা সময়। তিনি আবার ফিরে গেলেন তার স্মৃতি চারণায়-রোল নম্বর লিখে দিলেই সব রেজাল্ট হাতের মুঠোয়। আর আমাদের সময়.......। আমি আর তোর বড় ফুপি এক সাথে এস.এস.সি দিয়েছিলাম। যেদিন রেজাল্ট আউট হবে সেদিন আমরা দু’জন তো ঝিম মেরে বসে আছি। দুপুরে খাওয়ার পর তোর দাদা গেলেন স্কুলে রেজাল্ট আনতে। তখন বোর্ড থেকে স্কুলে স্কুলে রেজাল্ট বুক পাঠাতো। আমরা যে স্কুলে পড়তাম তোর দাদা সেই স্কুলের অভিভাবক প্রতিনিধি ছিলেন। স্কুলে তার একটা গুরুত্বও ছিল। বিকাল ৫টা পর্যন্ত বসে থাকার পরও স্কুলে রেজাল্ট বুক এল না। বোর্ড থেকে রেজাল্ট বুক আনতে গিয়েছিলেন ক্লার্ক শ্যামল বাবু আর সহকারী প্রধান শিক্ষক খালেক স্যার। তখন তো সেলফোনের যুগ না। এনালগ ল্যান্ডফোনের যুগ। সে ফোনে তো আর যখন-তখন কারও সাথে কথা বলা যায় না। আমরা বাসা থেকে জানতে পারছিলাম না বাবা রেজাল্ট পেলেন কি না। বাবাও স্কুল থেকে জানতে পারছিলেন না শ্যামল বাবু আর খালেক স্যার কি সমস্যায় পড়লেন। শেষে বাবা ছুটলেন বোর্ডে। রাত দশটায় বাবা রেজাল্ট নিয়ে ফিরলেন। আমি তিন বিষয়ে লেটারসহ ফার্স্ট ডিভিশন পেলাম। সব বিষয়ের গড় নম্বর ৭৫% ছিল বলে সেটাকে বলা হয় স্টার মার্কস। তখন স্টার মার্কস পেতো পুরো বোর্ডে বড়জোর ৪০/৫০ জন। আর এখন তোদের ডিজিটাল যুগে ৮০% নম্বর পায় লাখ ছাড়িয়ে। আর তোর ফুপি ফার্স্ট ডিভিশন পেল। তখন আর্টস গ্রুপ থেকে ফার্স্ট ডিভিশন মুখের কথা ছিল না।





সকাল সাড়ে দশটায় তার স্মার্ট ফোনে তার এস.এস.সি’র রেজাল্ট এল। মেসেজ সেন্ড করেছিলেন বাবা। রেজাল্ট যখন এল তখন ফোনটা বাবার হাতে। তিনি ফোনস্ক্রীনে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। মা তার উৎসুক দৃষ্টি ফেলে রেখেছেন বাবার মুখে। বাবার নীরবতায় মা ধৈর্য্য রাখতে না পেরে বললেন, কী হল?
মনে হয় কোনো সমস্যা হয়েছে।
কী সমস্যা ?
দেখি, রোল নাম্বরটা আবার দাও তো।
সে এক টুকরো কাগজে লেখা রোল নাম্বার বাবার দিকে বাড়িয়ে দিল।
বাবা বললেন, কোথায় থেকে লিখেছো এসব ? এডমিট কার্ড নিয়ে এসো।
এডমিট কার্ড আনতে হবে কেন? আমার তো মুখস্থ।
তোমার যে কি মুখস্থ ক্ষমতা তা আমার জানা আছে। বাপের নাম মনে আছে?
সে আর কোনো কথা না বলে এডমিট কার্ড এনে বাবার হাতে দিল। সে জানে, সিরিয়াস সময়ে বাবার সাথে বাড়তি কথা বললে ঝামেলা। বাবা সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাবেন। এখন সেন্টিমেন্টাল হলে বাপের নাম, মায়ের নাম, দাদার নাম, দাদীর নাম মনে আছে কি না তা বলতে বাধ্য করবেন।
বাবা চশমার গ্লাস পরিস্কার করলেন। তারপর ভাল করে এ্যাডমিট কার্ড দেখে নাম্বার টিপলেন। সেন্ড করতে না করতেই রিটার্ন মেসেজ এসে গেল। এবার বাবার মুখ কঠিন। তাকালেন তার দিকে।
বললেন, তুমি পরীক্ষা ভাল দাওনি? সারা বছর এত শিক্ষক, কোচিং, মডেল টেস্ট, কি করলে সে সব?
মা বললেন, কী হয়েছে?
যা হয়েছে তা মুখে বলার জো নেই।
কী হয়েছে শুনি না?
আর একটু হলেই ডাব্বা কাত হয়ে যেত। আর সেটা হলেই ভাল হতো। আমার স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা এক মুহূর্তে সব ধূলি হয়ে গেল। নিজের সাধ ছিল ব্যরিস্টার হওয়ার। পারিনি। হয়েছি মাঝারি গোছের উকিল। স্বপ্ন দেখেছিলাম, মেয়ে আমার জাঁদরেল ব্যারিস্টার হবে। সব শেষ। ইংরেজি শিক্ষক নাকি এত কেয়ার নিলো, সেই ইংরেজিতে তো দেখছি ড-ইরস্মিকারে ডি।
মা-ও রেজাল্ট দেখলেন। কয়েক মুহূর্ত মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। তারপর বললেন, এ রেজাল্ট দিয়ে কী হবে ? আগামীবার আবার পরীক্ষা দেবে।
বাবা বললেন, আগামী বার দিলে যদি ফেল করে? আমার তো মনে হয় তাই করবে।
তাহলে?
দেখ, যদি এইচ.এস.সি-তে একটু ভাল করতে পারে......।
আমার ধারণা কোচিং-এর সেই ইংরেজি মাস্টার তূর্য না ফূর্য তার সাথে প্রেম করেছে।
প্রেমের দোষ দিও না। প্রেম করলে কখনো রেজাল্ট খারাপ হয়? তুমি প্রেম করো নাই?
করেছি।
তাহলে? তুমি ফার্স্ট ডিভিশন পেলে কেমনে?
আমাদের প্রেম আর এখনকার প্রেম এক না। সাত বছরের প্রেমে কয় বার তোমার সাথে ঘুরতে গেছি? বড় জোর দুই বার। কতক্ষণ থেকেছি? বড় জোর দুই ঘন্টা। প্রেম করছি সেই অপরাধ বোধে পড়ার গতি পঞ্চাশ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছি। আমার মনে হয়, সে কোচিং-এ গিয়ে পড়াশোনা কিছু করে নাই। ঐ শয়তান মাস্টারের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে।
মায়ে প্রেম করছে সেখান থেকেই মেয়ের ভেতরে এটা আসছে।
আবার তুমি মায়ের প্রেমের দোষ দিচ্ছো। আমি অসময়ে প্রেম করি নাই। প্রেম করেছি কলেজ পার হবার পর। সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস।
এই সব পুরানা প্রবচন কবচায়ো না। এসব কবচায়ে এখন কি হবে?




তখন তো প্রেম আসতো ইশারা-ইঙ্গিতে, চাহনীতে, চিঠিতে। আর এখন প্রেম আসে স্মার্টফোনে।
সময় এগোবে না? তোমার চিঠি ধরে সারা জীবন বসে থাকবে? শুধু তোমার মেয়ের স্মার্টফোনেই প্রেম আসে না, সব মেয়ের ফোনেই আসে। প্রেম করে ভাল রেজাল্ট করতে দোষ আছে? যারা এ+ পেয়েছে, খোঁজ নিয়ে দেখো গিয়ে তাদেরও স্মার্টফোন ছিল, তাদের অনেকেও প্রেম করেছে। তোমার মেয়ে যদি অপারেশন করার চাকু দিয়ে মানুষ খুন করে তাহলে কার কি করার আছে?
আমি আমার মেয়েকে বিশ্বাস করে ভুল করেছি। কিন্তু তুমি বাবা হয়ে......।
বাবা হয়ে আমি কি আমার মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারি না? সেই বিশ্বাসের মূল্য এইভাবে দিল?
এরকম সময় ফোন বেজে উঠল। সে এক পলক তাকিয়েই দেখল নিলয়ের ফোন। সে একটু স্বস্তি বোধ করল। এই ফোনটা হয়তো পরিবেশ একটু অন্যরকম করবে। বাবা-মা যেভাবে বলতে শুরু করছেন তাতে তাদের সহসা থামার লক্ষণ নেই। কি বলতে কি বলা শুরু করবেন তা কে জানে। হয় তো দাদা-দাদী, নানা-নানীর প্রেম কাহিনীও বের করে ফেলবেন।
নিলয়ের ফোন রিসিভ করলেন বাবা। নিলয় হরবর করে বলতে শুরু করল, তোমার রেজাল্ট পাইছো? আর একটু হলেই তো ডাব্বা কাত হয়ে যেত। একেবারে কানের পাশ দিয়ে গেছে। ইংরেজি টিচারের সাথে প্রেম করলা, যার জন্য আমাকে বললা ত্যাজপাতা, সেই ইংরেজিতেই তো..........।
ফোন রিসিভ হতেই হরবর করে কথা বলতে শুরু করো। এ কেমন বদ অভ্যাস তোমার? আমি তোমার খালু বলছি।
খালু স্লামালিকুম। কেমন আছেন খালু? খালার শরীর ভাল তো? সুমাইয়ার রেজাল্ট পেলাম। রোল নাম্বার আমার কাছে ছিল। মেসেজ পাঠাতেই আমার মোবাইলে রেজাল্ট চলে এল। খুবই জটিল রেজাল্ট করেছে খালু।
জটিল রেজাল্ট মানে?
একেবারে কানের পাশ দিয়ে গিয়েছে। আর একটু হলে তিন সাবজেক্টে.......।
এটাকে জটিল রেজাল্ট বলা যায় কিভাবে? কোন শব্দ কোথায় ব্যবহার করতে হবে তাও জানো না ?
তাহলে কি বলবো খালু? কঠিন রেজাল্ট বলা যাবে? নাকি টাফাটাফি রেজাল্ট বলবো?
টাফাটাফি মানে কি?
ভাল রেজাল্টকে তো আমরা ফাটাফাটি রেজাল্ট বলি। এটা তো ভাল রেজাল্টের উল্টো হয়েছে, তাই উল্টিয়ে বলতে চাই।
জানো, এই বাংলা ভাষার জন্য ’৫২ সালে ছাত্র জনতা জীবন দিয়েছিল? তুমি জানো, এই ভাষা আন্দোলন না হলে এখানকার মানুষ রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিকভাবে আরও কতটা পিছিয়ে যেত? সাধের পাকিস্তানের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার হিং¯্রতা হাড়ে হাড়ে টের পেতে।
জানি খালু, সালাম, বরকত, রফিক জব্বার এই কয়জনের নামই বেশি শুনি। আপনি কি সবার নাম বলতে পারবেন খালু?
তাহলে তুমি এই ভাষার শব্দকে তোমার ইচ্ছা মতো ব্যবহার করতে পারো না।
সরি খালু, মারাত্মক সরি।
মারাত্মক সরি মানে কী? তুমি এখন কল কাটো। তোমার সাথে আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
ওকে খালু, আমি এখনই ফোন কেটে দিচ্ছি। কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া ঠিক না। আমি সুমাইয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও কিছু বলিনি কখনো।
সুমাইয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানে?
ঠিক আছে খালু রাখি। শরীরের যতœ নিবেন। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবেন। ফিফটি ওভার করেছেন, তাই অধিক কলস্টরেল এড়িয়ে চলবেন। মাঝে মাঝেই প্রেসার মাপবেন। মেয়ে বড় হলে বাবা-মায়ের প্রেসারের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। প্রেসারের সাথে কিডনীর সম্পর্ক নিবীড়। অতিরিক্ত প্রেসার ওঠা-নামা থেকে কিডনী ড্যামেজ হওয়ার সম্ভাবনা সেভেনটি পার্সেন্ট।
তুমি কি মেডিকেল সায়েন্স পড়ছো?
কি যে বলেন! আমি ম্যানেজমেন্ট পড়ছি-ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশের জনগণ সবাই কম-বেশি ডাক্তারি জানে। আপনি আপনার কোনো অসুখের কথা কোর্টে উকিল সাহেবদের সামনে বলে দেখেন, তারা ওকালতি ফেলে আপনাকে প্রেসক্রিবশন দিতে উঠে-পড়ে লাগবেন।
তুমি ফোন কাটো বলছি।
খালু, আপনিও তো কেটে দিতে পারেন।
আমি কাটবো না, তুমি ফোন করেছো, তুমিই কাটবে।
বুঝেছি, স্লামালিকুম।
এ্যাই কী বুঝেছো ? এ্যা কী.......... ? ফাজিলটা ফোন কেটে দিল। ও কী বুঝেছে তা জানার জন্য এখন আমাকে আবার ফোন করতে হবে।
সারাদিন বাবা-মা বাসায়ই ছিলেন। কিন্তু তাদের কেউ তার সাথে কোনো কথা বলেননি। সেও এড়িয়ে চলেছে বাবা-মাকে। সারাদিন সে তেমন কিছু খায়ওনি। বাবা-মা এ নিয়ে কিছু বলেননি। অন্য সময় হলে এটা তাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে যেত।
সন্ধ্যার পর বাবা তার ঘরে এলেন। তার সামনে চেয়ার টেনে বসলেন। কোনো রকম ভূমিকা না করে বলতে শুরু করলেন, আমরা তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। হ্যাঁ, করেছিলাম এই জন্য যে, ছোটবেলা থেকে অবিশ্বাসের কোনো কিছু তোমার মধ্যে পাইনি। তবে দোষ আমাদেরই। আমাদের বোঝা উচিত ছিল, চিরদিন কেউ বিশ্বাসী থাকতে পারে না। তুমি আমাদের বিশ্বাসকে পদদলিত করেছো। তুমি যদি আবার এস.এস.সি দাও, তোমার ইমপ্রুভ হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমার তাই মনে হয়। তার চাইতে আমার মতামত এই-এইচ.এস.সি তে আপ্রাণ চেষ্টা করো। সেখানে যদি ভাল করতে পারো তো পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া যাবে। কি বলো, আবার এস.এস.সি দেবে নাকি কলেজে ভর্তি হবে?
আমি কলেজে ভর্তি হব বাবা।
তুমি কিন্তু মাঝারি গোছের কোনো কলেজেও চান্স পাবে না। ভর্তি হতে হবে থার্ড গ্রেডের কলেজে। সেখানকার সহপাঠীদের মান এবং পড়াশোনার মানও কিন্তু তেমনই হবে। যা করার নিজেকেই করতে হবে।
আমি নিজেই চেষ্টা করবো বাবা।
তা আমরা কি তোমাকে আবার বিশ্বাস করবো, না কঠোর হব ? কঠোর হলে কি করবো জানো ?
কী বাবা ?




প্রথমেই তোমার স্মার্টফোনটা তোমার চোখের সামনে আছড়িয়ে ভেঙে ফেলবো। তারপর আমি অথবা তোমার মা তোমার সাথে কাঁঠালের আঠার মতো লেগে থাকবে। তোমার মা যত পারে অফিসে ছুটি কাটাবে। তার ক্যাজুয়াল লিভ, আর্ন লিভ, মেডিক্যাল লিভ, আরও অনেক ধরনের লিভ অনেক পাওনা আছে। আর আমিও প্র্যাকটিস কমিয়ে দেব। আমাদের চোখের আড়ালে তুমি শুধু দুই জায়গায় যেতে পারবে। দুই জায়গাটা কোথায় জানো?
কোথায় বাবা?
বাথরুম আর টয়লেট। এই দুটি কাজ ছাড়া আর কখনোই তুমি আমাদের চোখের আড়ালে যেতে পারবে না। তারপর আরও আছে।
আর কী বাবা ?
পান থেকে চুন খসলেই শুরু করবো গালিগালাজ। আর যদি চুনের সাথে খয়ের বা জর্দা খসে তো চুল ধরে ঠাস ঠাস। আমার মনে হয় তোমার মা এ কাজটা ভাল পারে। হঠাৎ করে এতটা কঠিনতা তোমার ভাল লাগবে না। তুমি কষ্ট পাবে। তুমি আমাদেরকে কষ্ট দিয়েছো। কিন্তু আমরা তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। বাবা-মা কি জিনিস তুমি এখন সেটা বুঝবে না। আমিও অতোটা বুঝতাম না। বুঝেছি নিজে বাবা হবার পর। তোমার কি কল্পনা শক্তি আছে?
আছে বাবা।
থাকার কথা। কল্পনা শক্তি ছাড়া মানুষ হয় না। কল্পনা করতে পারে না পশুপাখি। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীই কল্পনা করতে পরে না। তাই তারা নিজেদেরকে উন্নত করতে পারে না। আগে কল্পনা তারপর এগিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ। রাইট ব্রাদার্স প্রথমে কল্পনা করেছিল যে, তারা আকাশে উড়বে। তারপরই এ চেষ্টা-ও চেষ্টা থেকে উড়োজাহাজ আবিষ্কার করে ফেললো।  তাহলে কল্পনা করে দেখো-তুমি একটা মা। তোমার একটা মেয়ে আছে। তুমি তাকে জান দিয়ে ভালোবাসো। তার এতটুকু অভাব তুমি রাখোনি। কিন্তু সে প্রেমের নামে উল্টাপাল্টা করে এস.এস.সি তে কানকাটা পাশ করেছে। ভাবো তো ব্যাপারটা তোমার কেমন লাগবে। সেটা ভাবতে পারলে তুমি আমাদের বর্তমান অবস্থাটা বুঝতে পারবে।
আমি বুঝতে পারছি বাবা।
তাহলে বলছো, আবারও তোমাকে বিশ্বাসের ওপর ছেড়ে দেই ?
আমি আর তোমাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করবো না বাবা।
জীবনে সফলতার জন্য অনেকগুলো সিঁড়ি ভাঙতে হয়। তুমি একটা সিঁড়িতে হোঁচট খেয়েছো। তারপরও তুমি চাইলে আরও অনেক ধাপ সফলতার সাথে পার হতে পারবে। মহাত্মা গান্ধী প্রথম জীবনে লেখাপড়ায় খুবই খারাপ ছিলেন। পাস করতেন টেনেটুনে। আইন ব্যবসায় নেমেও যা-তা অবস্থা। সেই তিনি....। আমার স্বপ্ন, আমার একমাত্র সন্তান জাঁদরেল ব্যারিস্টার হবে।
আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করবো বাবা।
মাথা তোলো, তারপর আমার চোখে তাকিয়ে বলো।
সে মাথা তুললো। তারপর বাবার চোখে তাকিয়ে আবার বললো কথাটা। 
[চলবে...]












শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট