বকুল কথা








বকুল কথা
রফিকুল নাজিম 

০১
বকুল বিছানায় শুয়ে আছে। পাঁচদিন ধরে সে কোথাও যায় না। পাড়ার সবার মুখে বকুলের গল্প। বকুলের জন্য পাড়ার কারো কারো মায়া হচ্ছে। গোপনে কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাসও ফেলছে। কেউবা মনের সুখে নিজের বগল সেইরাম বাজাচ্ছে। পুরো পাড়া জুড়ে একটা পতনের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে এঘরের দেয়াল থেকে ওঘরের দেয়ালে আঘাত করছে। বকুল কাঁদছে। চোখের জলে ভিজে গেছে বালিশ। গত পাঁচ দিনে সে মুখে কোনো খাবার তুলেনি। শূন্যঘরে জিন্দালাশের মতো পড়ে আছে। আহা রে জীবন!

০২
বুলেট মিজানের লাশ পাওয়া যায় বেড়িবাঁধের ঢালে। পিকুল মিয়ার চটপটি দোকানের ঠিক পেছনে পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে কাটা পড়ে মিজান। টিভি চ্যানেলগুলোর স্ক্রলে মুহূর্তেই শিরোনাম হয় বুলেট মিজানের মৃত্যুর খবর। পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় করে লাল কালিতে লেখা-বন্দুক যুদ্ধে দুধরষ সন্ত্রাসী বুলেট মিজান নিহত। খবরটা পাড়া মহল্লা থেকে গ্রামের মাঠে ঘাটেও চাওড় হয়ে গেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে ধারাবাহিকভাবে মিডিয়ায় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন বুলেট মিজানের উত্থান ও অপরাধের বিশদ বিবরণ আসছিলো। লোমহর্ষক ঘটনাগুলো সাধারণ মানুষের মনে প্রচন্ড ঘৃণার তুফান তুলতে পেরেছে-এ কথা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। বুলেট মিজানের নামটা শুনলেই অজান্তেই ঘৃণার থুথু দলা পাকিয়ে আমজনতার ঠোঁটের খুব কাছে চলে আসে। তাই তো সারাদেশে মিজানের মৃত্যুর খবরে আনন্দ উল্লাস হচ্ছে। মৃত্যু কখনো কখনো বুঝি আনন্দের উপলক্ষও হয়! শুধু বকুল খুশি হয়নি। হ্যাঁ, পৃথিবীতে শুধু সে একা মিজানের জন্য কাঁদছে।



০৩
গত পৌষের এক কনকনে শীতের রাতে বকুলের দরজায় হঠাৎ জোরে জোরে নক করছিলো কেউ। কিন্তু দরজা খুলছে না বকুল। একজন খদ্দেরকে মাত্র খুশি করেছে। নতুন আয়োজনের জন্য সে আপন মনে বিছানা গোছাচ্ছে। মনে হয় বাসরঘর সাজাচ্ছে। প্রতিরাতে কমছে কম চার/পাঁচ বার ফুলশয্যা সাজায় সে। রাতের কোনো নাগরকে সে ঠকায় না। ফুলের রসে সবার মন ভেজাতে ওস্তাদ বকুল। কেউ রাগে দরজায় আরো জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। বকুল বুকের কাপড়টা ঠিকঠাক করতে করতে বললো, ‘হালার্পুত, তড় সয় না! আমার দরজার সামনে আইলেই উন্মাদ হইয়া যাছ! ‘দরজা খুলতেই মিজান বকুলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিছানায় পড়ে যায়। বকুল হতভম্ব হয়ে দেখে মিজান তার ডান হাত দিয়ে বাম হাতের বাহুতে শক্ত করে ধরে রেখেছে। তবুও রক্তপড়া থামছে না। মিজান অজ্ঞানের মতো কাতরাচ্ছে শুধু। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো বকুল। সেইবার বকুলের তিনদিনের নির্ঘুম সেবায় মিজান মাথা তুলে দাঁড়িয়ে দেখেছিলো এক দেবীরূপ।এই নিগূঢ় অন্ধকারে সুরভিত এক ফুল যেনো-বকুল!





মিজান। তার কোথায় জন্ম;সে জানে না। মা বাবার পরিচয় জানে না।পথে পথে ফুটপাতে বড় হওয়া। ছোট ছোট চুরি ছিনতাই করতে করতে তার পেকেছে। এখন একটা গ্যাং গ্রুপের লিডার সে। আর বকুলের পরিচয়? সে এক বিরহ বিলাপের মোড়কে নিশুতি রাতের বিষাদ গাঁথা। শ্যাম-বর্ণের বকুল সুলতানপুরের অনেকেরই নির্ঘুম রাতের কাব্য হয়ে উঠেছিলো। আট ক্লাশ পর্যন্ত লেখাপড়া করা বকুলের বাবা হঠাৎ তার বিয়ে ঠিক করে ৩৯ বছর বয়সী এক বিপতœীক পাত্রের সাথে। তাই বিয়ের দুইদিন আগে পাশের গ্রামের নিতাই মোদকের ছেলে প্রদীপের হাত ধরে শহরে পালিয়ে আসে। সপ্তাহখানেক প্রেমের ময়ূরকণ্ঠী নায়ে চড়ে কাটে স্বপ্নের মুহূর্তগুলো। তারপর একদিন রাতে প্রদীপ তার চারজন বন্ধু নিয়ে আসে বাসায়। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে প্রদীপ বকুলের কানে ফিসফিস করে বলে,‘যা এবার, চারজনকে একটু সুখ দিয়ে আয়। এদিকে আমি একটু গলা ভিজিয়ে নেই। ‘শত চেষ্টা করেও বকুল নিজেকে আর রক্ষা করতে পারেনি। সারারাত চারজন লোক দলে মুচড়ে শরীরটাকে উচ্ছিষ্ট করে রেখে গিয়েছিলো সেদিন। এভাবে একমাস চলার পর একদিন পাড়ার মাসীর কাছে ত্রিশ হাজারে রফাদফা হয় বকুলের। সেই থেকেই বকুল এ পাড়ার ফুল। বকুল ক্রমেই হয়ে উঠেছে সর্দারনী মিনতি বালার টাকার মেশিন।

মিজান প্রায় নয় মাস ধরে বকুলের কাছেই থাকে। প্রতিবার বাইরে থেকে আসার সময় বুক পকেটে করে সে বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসে। নিজ হাতে বকুলের খোঁপায় পরিয়ে দেয়। প্রতিবারই মিজান ঘরে ঢুকে বকুলের বাড়ন্ত পেটে চুমো খেয়ে বলে, ‘আলো কি পেটে নাচে? তোর সাথে কথা বলে! ‘হাঁটু গেড়ে বসে বকুলের পেটে কান রাখে সে। কিছু একটা শুনতে চায়।এসব কিছু বকুলের কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। বকুলের পেট হওয়ার পর মিজান পেটের শিশুর নাম রাখে- আলো। পাঁচ মাস সতেরোদিন দেখতে দেখতে চলে গেলো। কয়েকমাস পরই আলো পৃথিবীতে আসবে। বকুল আর মিজানের চোখে অদ্ভুত এক সুখের ঝিলিক খেলা করে।এ শহরের অন্ধকার গলি ভেদ করে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য প্ল্যান করেছে দু‘জন। এক বছর ধরে চলছে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার আয়োজন।আলোর জন্য বাঁচতে চায় ওরা। আলোর জন্য আলোর খোঁজে প্রতিনিয়ত।

আজ মিজান দরজায় এতো জোরে নক করছে কেন! দ্রুত দরজা খুলে দেয় বকুল। ঘরে ঢুকেই একটা কালো পলিথিনের ব্যাগ বকুলের হাতে তুলে দেয় মিজান। ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে সে বলে, ‘আমার হাতে সময় নাই। পলিথিনের ব্যাগে কাগজ দিয়া পেঁচানো আছে পাঁচ লাখ ট্যাহা আর কিছু গহনা আছে। এগুলা রাখ্। আলো’কে মানুষ করতে কামে লাগবো। ‘বকুল অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কি হইছে তোমার? তুমি এত্তো হাঁপাইতাছো কেন্! কি হইছে আমারে খুইল্লা কও। ‘আমার পিছে টিকটিকি লাগছে। পুলিশ খুঁজতাছে আমারে। জানোছ বকুল-লিডার নিজেরে আড়াল করার লাই¹া পুলিশ আর খবরওয়ালাগো কাছে আমারে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন বানাইছে। এখন আমারে বলি দেওয়ার আয়োজন করছে! আমি হয়তো আর আলোর খোঁজ পাইলাম না রে.....। ‘বলতে বলতে পকেট থেকে বেলি ফুলের মালাটা বের করে বকুলের খোঁপায় পরিয়ে দেয় মিজান। বকুলের পেটে সে চুমো খায় কয়েকবার। দাঁড়িয়ে বকুলকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু দিতেই বাতাসে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা যায়। পুলিশের বাঁশি কাছেই আসছে। দ্রুত পালাচ্ছে মিজান। সরি, বুলেট মিজান। আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন মিজান নিকষ অন্ধকারে দৌঁড়ে পালাচ্ছে। অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে মিজান চিৎকার করে বলছে, ‘বকুল, তুই পালা। আলো’কে আলো দিছ রে।’




০৪
বকুলের দরজা ধাক্কা দিয়ে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করতে করতে ঘরে ঢুকে সর্দারনী মিনতি। বকুলের মাথার কাছে বসে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে শীতল গলায় মিনতি বলে, ‘হুন বকুল, কাইন্দা আর কি অইবো? মিজাইন্ন্যা ত মইরা ভূত অইয়া গেছেগা।এহোন তো পেট চালান লাগবো। তাই কই কি- তুই পেটটা ফালাইয়া দে। আমি সব ব্যবোস্থা করতাছি। তোর কুনু চিন্তা করতে অইবো না। ‘বকুল কোনো কথা বলছে না। মিনতি বকুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘তুই থাক। আমি ধাত্রী সখিনারে লইয়া আইতাছি। ‘খবরদার মাসি, তুমি যাইবা না। আরেক পাও বাইরে গেলে ভালা অইবো না কইলাম। ‘বটি হাতে নিয়ে বাঘিনীর মতো হুংকার দিয়ে মিনতির সামনে এসে দাঁড়ায় বকুল। ভয় নাকি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেছে মিনতি ! হঠাৎই অগ্নুৎপাতের মতো বিস্ফোরণ ঘটায় মিনতি, ‘এই মাগি, তোর এতো ভার বাড়ছে! তুই আমারে বটির ভয় দেহাছ! ‘আচমকা বকুলের চুলের মুডিতে খপ করে ধরে মিনতি। ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠে বকুল। বকুলও খপ করে মিনতির পায়ে ধরে বলে, ‘মাসি গো, তুমি আমারে যাইতে দেও। আমি আলো’র জন্য আলো কিনতে যামু। আমারে যাইতে দেও। তোমার পায়ে পড়ি, মাসি। আমারে আর আটকাইয়ো না গো। ‘মিনতির পা ছেড়ে বকুল কালো পলিথিনের ব্যাগটা হাতে তুলে নেয়। পত্রিকার কাগজ ছিঁড়ে বের করে টাকার বান্ডিলগুলো। মিনতি হা করে দেখে দশ দশটা পাচঁশ টাকার বান্ডিল। বকুল একটা বান্ডিল মিনতির মুখে ছুঁড়ে মারে। অন্য বান্ডিলগুলো ঘরের এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে। ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো মিনতি টাকার বান্ডিলগুলো কুড়াচ্ছে আর হাসছে। এরই ফাঁকে বকুল দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায়। বকুল অভিশপ্ত পাড়া ছেড়ে পালাচ্ছে। শাঁই শাঁই করে দৌঁড়ে পালাচ্ছে বকুল। গঞ্জের সড়ক ধরে দৌঁড়াচ্ছে বকুল। বন্দুকের নল দেখে যে রকম প্রাণপনে পাখা মেলে উড়াল দেয় পাখি। তেমনি বকুল ডান হাতে পেট ধরে দৌঁড়াচ্ছে সে। বকুলের কানে বারংবার একটা বাক্যই বাজছে, ‘তুই পালা, বকুল। আলো’র জন্য আলো খোঁজে। ‘আলোর খোঁজে সে আজ ক্লান্তিহীন। ছুটে যাচ্ছে আলোর খোঁজে আলোর পথে। বকুল দৌঁড়াচ্ছে। অন্ধকারকে পেছনে ফেলে বকুল দৌঁড়াচ্ছে আর দূর থেকে ভেসে আসছে ফজরের আযান।
মাধবপুর, হবিগঞ্জ।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট