ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : পর্ব ০৮













ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন

[গত সংখ্যার পর]
বেলা শেষে বিকেল।
শরতের বৃষ্টি। সারাদিন ধরে ঝরছে। বয়ে বেড়াচ্ছে গা কাটা দেওয়া শীতল বাতাস। ফুলহাতা শার্টটা গায়ে জড়িয়ে করিডোরে পায়চারি করছি। খুব কাছে কোথাও ব্যাঙ ডাকছে। বিরক্তি ভরা ছন্দহীন ডাকাডাকি। এক ঝটকা বাতাস গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিকণাকে আমার মুখের উপর ছুঁড়ে দিলো। হেঁটে বেড়াচ্ছি। নানা দিক থেকে ভাবনার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে, আমার স্নায়ুতন্ত্রে। নিঃশেষে ভাবনাগুলো এলোমেলো।
নীলা গণিতের প্রেমে বিভোর। আমার কাছে ওর আসা-যাওয়ার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেছে পুরনো ডায়েরি পড়া। ওর দৃষ্টি কেমন অচেনা লাগে। ওকে ফিরে পাবার আনন্দ মোহনায় হঠাৎ মলিনতা গ্রাস করতে বসেছে। আমার উচ্ছলতার জোয়ারে পড়েছে ভাটা! গতরাতেই সে আমার ভালবাসাকে করেছে অবহেলা। অবজ্ঞা! ফিরিয়ে দিয়েছে নিঃসংকোচে।
তবে একটি মহাযজ্ঞ সফল হয়েছে। দাদাজানের ছদ্মবেশী ভাষা বোঝার একটি উপায় উন্মোচিত হয়েছে। নীলার উপলব্ধি ও মেধাকে সত্যিই প্রশংসা করতে হয়। কারণ, ওর পরিশ্রমেই এত অল্প সময়ে বিষয়টা অনুকূলে মোড় নিলো। মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক বা পিকটোগ্রাফিক কিংবা কিউনিফর্ম সে যাই হোক না কেন, এ ভাষাচিত্রের সাথে যে বাংলা ভাষার একটি সাদৃশ্য সম্পর্ক রয়েছে সেটা সঙ্গত কারণেই খুব স্পষ্ট। এই বিষয়টাই নীলা উদ্ধার করল। ঐ চিত্রগুলো এক একটা বর্ণ। কোনো শব্দকেও চিত্র মনে হয়। দাদাজান দুর্বোধ্যভাবে লেখার উদ্দেশ্যেই বাংলাবর্ণকে হায়ারোগ্লিফিকের রূপ দিয়েছেন। ডায়েরিতে প্রতিটি বাংলা বর্ণের পাশে রয়েছে সাংকেতিক চিহ্ন। সে চিহ্নগুলো ছদ্মবেশী ভাষার বর্ণ। ক-এর পাশের চিত্রে ত্রিভূজের একটি বাহুতে পশুর মাথা আঁকা। খ-এর পাশে বাঁকা খেজুর গাছ, গ-এর পাশে একটি মিনার ও উড়ন্ত সাপ, ঘ-এর পাশে কুঁড়েঘর, চ-এর পাশে চামচ, তালব্য শ-এর পাশে একজোড়া চোখ প্রভৃতি। বেশ কয়েকটা পৃষ্ঠা জুড়ে এই সব বর্ণমালা ও অদ্ভুত কার চিহ্নের মেলা। তারপর কিছু পৃষ্ঠা জুড়ে অনুশীলন চিত্র। সে চিত্রের পাশে কিছু সহজ বাক্য লেখা আছে। বলা যায় প্র্যাকটিসের জন্য প্রতিটি বর্ণ দিয়ে কয়েকটা বাক্য গঠন করা হয়েছে। শিশুপাঠ্য বইয়ের মতো সে লেখাগুলো। ডায়েরির শেষাংশে ভাষাচিত্রে লেখা আছে একটি অনুচ্ছেদ।
“অবাক হবার কিছুই নেই। এ নোটবুকটা একটি অচেনা ভাষার বিন্দু বিসর্গ। এর উদ্দেশ্য দুর্বোধ্যতা সৃষ্টি। এটি দুর্গকে শত্রুর কবল থেকে রক্ষার পরিখা মাত্র। আমার মৃত্যু হয়তো আসন্ন। জানি না, শেষ পর্যন্ত আমার পরিশ্রমের কি পরিণতি ঘটবে। শত্রু সর্বদাই আমাকে ঘিরে রেখেছে। চতুর্মাত্রিক জগতের এ যুবকই কি আমার ঘাতক হবে?
১৯৬৯ সালের ডায়েরিটি যার হাতেই পড়বে। সে নিঃসন্দেহে বিপদের সম্মূখীন। ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলার মোহে বহুমাত্রিক জগতের শত্রুরা তাকে অবশ্যই আক্রমণ করবে। সে যদি এই মানবসমাজের কেউ হয়ে থাকে, তবে আমি তার কল্যাণ কামনা করছি। ভিন্ন মাত্রা বা মহাজাগতিক কেউ হলে তার প্রতি অভিশাপ বর্ষিত হোক। হে অচেনা অস্তিত্ব, তুমি মানব সমাজের কেউ হলে এই সম্পদকে রক্ষা করো। আমি আশাবাদী, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য এক মহা বিপ্লবের সূচনা করবে এই অভেদ ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা”।
এ লেখা থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় ১৯৬৯ সালের ডায়েরিটিতে অচেনা বা অদ্ভুত ভাষায় লেখা আছে ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা। যা শত্রুর লক্ষ্যবস্তু। দাদাজান তাঁর জীবনের আশঙ্কা প্রকাশ করেও দু’এক লাইন লিখেছেন। দাদাজানের মৃত্যু আজও রহস্যের জালে ঘেরা। অযুতের ভাষ্যমতে দাদাজান এখনো বেঁচে আছেন। তিনি জগত ভ্রমণে ব্যস্ত, তাঁর মৃত্যু ধ্রুবক হয়ে আছে। অন্যদিকে এ লেখা আমার বিপদের বার্তা বহন করছে। আমি যেকোনো মুহূর্তে অযুতের রোষানলের শিকার হতে পারি। আমার মৃত্যু হতে পারে অনায়াসে।
আর এ ফর্মূলা আমি কেন রক্ষা করতে যাব? যেখানে মৃত্যুর হাতছানি সেখান থেকে তো দূরে থাকা উচিত। কেউ আমাকে কাপুরুষ বললেও কোনো ক্ষতি নেই। আমি নীলাকে ভালবাসি, ওর ভালবাসাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে চাই, বাঁচতে চাই। নীলা আমাকে দূরে ঠেলে দিলেও, আমি ওকে দূর থেকে ভালবাসব। দেহ ও কামের ফাঁদে বন্দি হতে চাই না। আমি ওকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসি।

সন্ধ্যা নামতে অনেক দেরি। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে বিরতি নেই। ঘরে চলে এলাম। চেয়ারে বসে আছি। অযুতের কাছে একটি ডায়েরি দেখেছিলাম। অনেক ছল-চাতুরি করেও তা দখল করতে পারিনি। ঐ ডায়েরিটি কোনো ক্রমে দেখার সুযোগ হলে বেশ হতো। হঠাৎ টিনের বেড়ায় ঝনাৎ শব্দ হলো। তৎক্ষণাৎ, মিজান মিয়া ডেকে ওঠল কে ওখানে? কি চাই?
মিজান কারোর সাথে কথা বলছে। অস্পষ্ট শব্দগুলো কানে আসছে। করিডোরে এগিয়ে গেলাম।
মিজান, কে এসেছে?
স্যার, গাঁয়ের এক পোলা এখানে ফাজলেমি করতেছিল।
কী করেছে, তা বলবে তো?
বলে আপনার সাথে দেখা করবে। আপনি নাকি তারে চিনেন, পুরাই পাগলের গপ্প করতাছে।
আঙ্কেল, আমি ফাজলেমি করিনি, এই লোকটা মিথ্যা বলছে। ওপাশ থেকে একটা চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
মিজান মিয়াকে অগ্রাহ্য করে টিনের বেড়াটা টেনে ভেতরে ঢুকল মাহিদ।
আরে। মাহিদ তুমি?
হ্যাঁ, আঙ্কেল। আপনাকে খুঁজতে এত দূর এলাম। ঐ হাতিটারে বন্দি কইরা নিয়া গেছে।
তাই নাকি? কবে? কিভাবে?
গতকাল দুপুরে। হাতিটারে ইঞ্জেকশন দিয়া ঘুম পাড়ায়া, বড় ট্রাকে তুইল্যা নিয়া গেল।
মাহিদ বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে আছে। আরেকটা ছেলে টিনের বেড়া পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল। তার মাথার উপর একটা বড় কচুপাতার ছাতা। মিজান মিয়া ওদেরকে আর বাধা দিল না।
মাহিদ, তুমি যে বৃষ্টিতে ভিজতেছ। জ্বর আসবে না?
আমরা হরহামেশা বৃষ্টিতে ফুটবল খেলি, জ্বর আসে না।
সাথে ওটা কে? তোমার বন্ধু?
না, চাচাত ভাই। ওর নাম মিন্টু।
তোমরা দু’জন ভেতরে এসো চা নাস্তা খেয়ে যাবে।
মিজান মিয়া ওদেরকে নিয়ে ভেতরে এসো।
মাহিদ ও মিন্টুকে মিজান মিয়া নিচের ঘরে বসতে দিলো। আমিও নিচে নেমে গেলাম। চা নাস্তা খেতে খেতে ওদের সাথে দীর্ঘক্ষণ গল্প করলাম।
মাহিদ বলে ওঠল, আচ্ছা আঙ্কেল, এ ভুতুড়ে বাড়িতে থাকেন কেন? এখানে তো আগে কেউ থাকেনি।
আমি হাসলাম।
আমার ভয় নেই তো, তাই থাকি।
মিন্টু অবাক হয়ে বলল, আপনার ভয় নেই?
না, আমার ভয় নেই।
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, এখানে বড় বড় সাপ থাকে। বছর দুয়েক আগে এখান থেকে সাপুড়ে তিনটা পদ্মগোখরা ধরে নিয়ে গেল।
তাই নাকি? ভারি ইন্টারেস্টিং তো। এখন যে বসে আছো, ভয় করছে?
না, ভয় করছে না। মানুষ থাকলে ভয় লাগে না।
মাহিদ বলল, রাত হয়ে গেলে ঠিকই ভয় লাগবে। নানা বিষয় নিয়ে মাহিদ ও মিন্টুর সাথে গল্প হলো। সন্ধ্যার পরপরই ওরা বিদায় নিলো।
রাত এগারোটার দিকে আলমারি খুললাম। দেখলাম ১৯৭০ সালের ডায়েরি নেই। ফাঁকা জায়গাটার দু’পাশে ১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালের ডায়েরি রয়েছে। সবই অযুতের চালাকি ও ফাঁকি। ১৯৬৯ সালের ডায়েরিটি তুলে নিলাম। মাথার একটা ধাঁধা কাজ করছে। “১৯৬৯ সাল” ডায়েরি সংখ্যা দুটি। একটি ছিল খাটের বক্সে, অন্যটি আলমারিতে। আলমারির এ ডায়েরিটির বিশেষত্ব আমার কাছে অজানা।
ডায়েরিটির মলাট উল্টে দেখতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই নীলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।
সোম....সোম।
ডায়েরিটি বিছানায় রেখে বাইরে বেরিয়ে এলাম। নিচে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না।
নীলা...।
এদিকে সোম।
করিডোরের ও প্রান্ত থেকে নীলা আমার কাছে এগিয়ে এল।
কি হলো? তোমাকে এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন?
নীলার ঘর্মাক্ত চিবুকে হাত বুলালাম।
ওর ঠোঁটে এক বিন্দু হাসি।
ঘরে চলো সোম।
আমরা দু’জনই ভেতরে এলাম। ১৯৬৯ সালের ডায়েরি দেখেই নীলা বলল, সোম এ ডায়েরিতেই সেই ফর্মূলা। এখানে ওটা রেখো না। শত্রুরকবলে পড়বে। আর এ সূত্র একবার শত্রুর হাতে গেলে পুরো পৃথিবীর জন্য বিপর্যয় বয়ে আনবে।
নীলার ইতস্তত কথা বলা ও উদগ্রীব হওয়া দেখে কিছুই বললাম না। চুপচাপ ছিলাম অনেকক্ষণ।
নীলা ডায়েরিটি হাতে নিয়ে অন্য ডায়েরিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছে।
নীলা, আমার এখন কী করা উচিত?
সোম, এ ডায়েরিটি আপাতত আমার কাছে থাকুক। তাহলে আশঙ্কা মুক্ত থাকতে পারবে।
কিন্তু, নীলা এ ডায়েরি যার কাছে থাকবে সেই বিপদে পড়বে। নোটবুকে তাই লেখা আছে।
আমাকে নিয়ে ভেবো না, সোম।
না, নীলা। তোমাকে আমি হারাতে পারব না।
আমি হারাব না, সোম। আমি আছি, থাকব। তুমি শুধু আশির্বাদ করো।
ঠিক আছে। তবু মনের ভেতরের খস খস তো থামে না।
সোম। তুমি একদম দুশ্চিন্তা করবে না। আমাদের পৃথিবীকে নিরাপদ রাখার জন্য এ ফর্মূলা অবশ্যই লুকিয়ে রাখতে হবে।
নীলার আবেগ আপ্লুত স্বরে আমি বার বার চমকে ওঠছি। এ যেন ভিন্ন কোনো নীলাকে দেখছি। ওর চোখের কোণে একবিন্দু স্রোত! ছুঁয়ে দিলেই ঝর্ণা হয়ে ঝরে পড়বে।
নীলা চলে যাবার পর একটা প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছিল। যে কেউ বাইরে থেকে বাড়ির ভেতরে এলে, টিনের গেইট খোলার একটি কর্কশ শব্দ শোনা যায়। যে শব্দে চারপাশ সজাগ হয়ে ওঠে। বিকেলে মাহিদ-মিন্টুর আসার শব্দ অনায়াসে শুনা গেল। কিন্তু নীলা সে এক ভিন্ন মানবী! ওর আসা-যাওয়ায় সে কর্কশ শব্দের ছিটেফোঁটাও নেই। এই নিঃশব্দ কি ওর নিপুণতা? ও এতটাই সতর্কতার সাথে গেইট খুলে, যে শব্দ হবার জো নেই?

অযুত আসার পর ওর সাথে কেবল কুশল বিনিময় হলো। প্রথমদিকে আর তেমন কথা হয়নি। আমি আনমনা হয়ে টেবিলে বসে আছি।
একবার সে প্রশ্ন করল, মিঃ সোম, তুমি আমার প্রতি রাগান্বিত?
আমি চুপ ছিলাম। আমার দৃষ্টি ওর নিজস্ব ডায়েরিটার দিকে। আমার বিশ্বাস সে প্রয়োজনীয় সূত্র-সমীকরণগুলো ঐ ডায়েরিতে নোট আকারে তুলে রাখে। তাই সে ওটা প্রতিদিনই সাথে নিয়ে আসে।
অযুত আবার বলে ওঠল, জানি তুমি রাগান্বিত। কারণ তোমার প্ল্যান মতো আমি ডায়েরি সার্চ বন্ধ করিনি। তোমার মোটা ইতিহাস পুস্তক পড়ার প্রতি আমার মোটেও আগ্রহ নেই। তাই পরের ডায়েরিগুলোর দিকে অগ্রসর হয়েছি। বিষয়টা তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ।
হুম বুঝতে পেরেছি।
তুমি এখন যেতে পারো।
অযুত কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। ঘুমানোর চেষ্টা করেও চোখ বুজতে পারলাম না। চোখের সামনে কেবল ভেসে বেড়াচ্ছে হায়ারোগ্লিফিক চিত্র। গোপন বক্সের ঐ ডায়েরিটি আমার পড়া উচিত। ডায়েরিটি নিচতলার ঘরে রাখা। তড়িঘড়ি নিচে নেমে গেলাম। খাটের ওপাশে ঝুঁকে মেঝে থেকে ডায়েরিটি তুলে আনলাম। ধূলি-ময়লা মুছে পড়া শুরু করলাম। পড়তে গিয়ে বার বার ঐ নোটবুকটার সাহায্য নিতে হচ্ছে। বর্ণচিত্রের জটিল ভাষা ধীরে ধীরে আমার কাছে সহজ হয়ে ওঠল। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা থিওরিতে বর্ণিত হয়েছে নির্ণায়ক অভেদ। “ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা”। লেখা পড়ে সূত্রটি বোঝার শক্তি সামর্থ আমার নেই, কেবল চোখ বুলিয়ে গেলাম।
বহুঘাত বিশিষ্ট কতগুলো জটিল রাশির কথা লেখা আছে। তারপর সমান চিহ্নের অবস্থান। সমান চিহ্নের ওপাশে বহু গাণিতিক চিহ্ন ভিন্ন কিছু রাশিমালার সমাবেশ। কিন্তু কোথাও ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলাটির গাণিতিক রূপ পাওয়া যায়নি।

ডায়েরির শেষাংশে কাঠপেন্সিলে লেখা তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা বিহীন কিছু অদ্ভুত ধারা পাওয়া গেল। ধারাগুলো নিম্নরূপ,

৩+৪.২৪২৬+৫.১৯৬১+৬+৬.৭০৮২ৃৃৃৃৃ৯০.২৯৯৫
২+২.৮২৮৪+৩.৪৬৪১+৪+৪.৪৭২১ৃৃৃৃৃ৬০.১৯৯৬
১+১.৪১৪২+১.৭৩২০+২+২.২৩৬০ৃৃৃৃৃ৩০.০৯৯
১+২+৩+৪+৫+ৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃ৯০৬
১+৪+৯+১৬+২৫ৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃ৮২০৮৩৬
১+৮+২৭+৬৪+১২৫+ৃৃৃৃৃ৭৪৩৬৭৭৪১৬
১+১৬+৮১+২৫৬+৬২৫+ৃৃৃৃৃ৬.৭৩৭৭১৭ব১১

নীলা যে ডায়েরিটি নিয়ে গেল সেটাতে কী লেখা আছে? একই সালের দুটো ডায়েরি হবার কারণ কী? সে ডায়েরি কি এর পরবর্তী অংশ? কালকেই নীলার সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে হবে।


গত কয়েকদিন ধরে আব্বুর সাথে যোগাযোগ নেই। আমাকে বার বার কল দিলেও, রিসিভ করা হয়নি। ফোনটা যে কখন কোথায় রাখি, ঠিক নেই। সময়গুলো এলোমেলো ¯্রােতে দিগি¦দিক বয়ে যাচ্ছে। আর কেয়ারলেস আমি সে ¯্রােতে নির্বিকার ভেসে যাচ্ছি। সকালে মিজান মিয়া জানাল তার বাবা খুব অসুস্থ। ছুটি নিয়ে সে চলে গেল।
আলমারি খুলতে গিয়ে অযুতের অস্তিত্ব টের পেলাম। সে ওখানে আগে থেকেই ছিল। ইতস্তত ভাব নিয়ে আমার সামনে দৃশ্যমান হলো। আজ সে আমার তরুণ বয়সের অবয়ব ধারণ করেছে।
অযুত, তুমি এখানে?
হ্যাঁ, মিঃ সোম। ইদানিং তুমি আমাকে দেখে হুটহাট অবাক হয়ে যাও কেন?
চতুরতার একটা সীমা থাকা উচিত। তোমার মধ্যে সেটা নেই।
মিঃ সোম, তুমি হয়তো এ সীমারেখার ব্যাপারে খুব অজ্ঞ। তাছাড়া চতুর্মাত্রিক জগতের প্রাণী সম্পর্কে তোমার ধারণা শূন্য। তাই এভাবে বোকার মতো কথা বলছ।
থামো অযুত। তুমি খুব বেশি বক বক করছ।
বক বক করছি? শোনো, আমার সাংকেতিক নাম গঞ৬৬৯। তবে তোমার দেয়া অযুত নামটিও মন্দ নয়। তবে বিশ্রী বিষয় হলো, পৃথিবীর মানুষদের নামগুলোর কোনো সৌন্দর্য বিন্যাস নেই। একটা উপলব্ধি থেকে বলছি, ত্রিমাত্রিক জগতে শৃঙ্খলাবোধের ব্যাপক ঘাটতি। এলোমেলো সবকিছু। একই নামে একাধিক ব্যক্তি থাকে। একই ব্যক্তির একাধিক নাম। তাছাড়া বহু জাতি-ভাষা-রাষ্ট্র সবকিছু মিলিয়ে হিজিবিজি দশা। আর আমাদের চতুর্মাত্রিক জগতে একটি ভাষা, একটি জাতি গোষ্ঠী। যেখানে সমস্যা বিভেদ বলে কিছু নেই।
এভাবে বলার কারণ কী? তুমি কি পৃথিবীর বহু ভাষার ফাঁদে পড়ে ক্লান্ত?
আমাদের ক্লান্তি বলে কিছু নেই মিঃ সোম। তবে পৃথিবীর ভাষাগুলো আয়ত্ত্ব করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। বাংলা ভাষাটা যদি দ্রুত শেখা সম্ভব হত, তাহলে হয়তো তোমার সাথে সাক্ষাত হবার সুযোগ থাকত না। কারণ, অনেক আগেই এ ডায়েরিগুলো পড়া শেষ হতো। সূত্রটিও হাতের নাগালে চলে আসত।
ব্যস। ব্যস। তোমার কথা অনেক হয়েছে। এবার তুমি এখান থেকে বেরোয়।
উত্তেজিত হওয়াটা সমীচীন নয়, মিঃ সোম।
রাগান্বিত হয়ে আমি বারান্দায় চলে এলাম। চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম।
...মিজান, মিজান।
ততক্ষণে অযুতও বারান্দায় এল। ওর মুখে বিদঘুটে হাসি। সে হাসিটা আমার কাছ থেকে নকল করা। নিজের মুখটাকে এমন কুৎসিত দেখতে মোটেও ভাল লাগছে না।
মিঃ সোম, তুমি ভুলে গেছ, মিজান এখানে নেই। তোমাদের এই হচ্ছে মহাদোষ সহজেই ভুলে যাও।
হ্যাঁ, মিজান মিয়া তো ছুটি নিয়ে চলে গেছে।
আমি কি তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?
অযুতের দিকে তাকালাম। এখন ওর স্বাভাবিক মুখটা সুন্দর লাগছে।
এক কাপ চা হলে ভাল হতো।
ওকে, মিঃ সোম। তোমার জন্য এখুনি চা নাস্তার ব্যবস্থা করছি।
অযুত তর তর করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেল। ওর পা ফেলার শেষ শব্দটিও আমার কানে এল। তারপর নিরবতা। হঠাৎ রাগ-ক্রোধের সীমানা ছাপিয়ে কোনো এক অজানা প্রান্ত থেকে আমার মধ্যে একটি ভাবনার উদয় ঘটল। মুহূর্তে মাথার ভেতর সে ভাবনা ফন্দি টগবগ আকার করল। অযুতের ডায়েরিটা কব্জা করতে হবে। এটাই উপযুক্ত সময়। ঘরে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে লাল বর্ডারের ডায়েরিটা হাতে নিলাম। কিভাবে কী করা যায়? ওকে একটা চরম ধোঁকা দেওয়া চাই। আলমারি থেকে আরেকটি ডায়েরি বের করলাম। দুটো ডায়েরির উপরের কভার আলাদা করে ফেললাম। তারপর মূল ডায়েরির সাথে কভার বদলে দেবার চেষ্টা শুরু করলাম। হাতে সময় অল্প। ওদিকে কড়া নজর রেখে কাজটা চালিয়ে যাচ্ছি। আলমারির ডায়েরিগুলো আকারের একটু বড়। তাই, অযুতের ডায়েরির কভারের সাথে মেলানোর জন্য সে ডায়েরির কিছু অংশ কাঁচি দিয়ে কাটতে হলো। ডায়েরির কভার দুটো পাল্টে বাইন্ডিং করা পেইজগুলোকে গাম দিয়ে আটকে দিলাম। পুরো কাজটা সম্পন্ন করতে মাত্র আট মিনিট সময় নিয়েছি। তবু ভয়ানক আশঙ্কা কাজ করছিল। অযুতের ডায়েরিটা আলমারিতে রেখে দিলাম। অপর ডায়েরিটি রয়ে গেল টেবিলের উপর। তিন মিনিট পড়েই অযুত ফিরে এল। হাতে চায়ের কাপ। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। ওর মুখে সন্দেহ মিশ্রিত হাসি।
চায়ে চুমুক দিলাম।
বাহ, চমৎকার হয়েছে।
অযুত হাসল।
থ্যাংকস মিঃ সোম।
ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা কাটা কাগজগুলোর দিকে অযুত বার বার তাকাচ্ছিল। একটা সন্দেহ কি ওর মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছে? টেবিলের উপরেই ছিল কাঁচিটা। চা পান শেষ করে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা পুরনো খাতা বের করে কাটা শুরু করলাম।
বুঝলে, অযুত। এ কাগজ কাটা স্বভাবটা আমার ছোটবেলার। এখন পর্যন্ত ছাড়তে পারিনি।
অযুত হেসে বলল, স্বভাব? অদ্ভুত! বেশ কাগজ কেটে যদি মজা পাও, সেটা তো ভালো। এই কাগজগুলো রিয়ন সাহেব আমাকে দিয়ে কিনিয়েছিলেন।
ও, আচ্ছা। তুমি বেশ কাজের অযুত।
হ্যাঁ, তা তো হবোই। যাক অনেক কথা হলো মিঃ সোম। তর্ক পর্বের শেষে চা পর্ব, তারপর কাগজ কাটা পর্ব, এখন মূল পর্বে আসি। ১৯৭০ সালের ডায়েরিটি পড়া শেষ। কিন্তু আলমারির ভেতর ১৯৬৯ সালের ডায়েরি নেই। ডায়েরিটি যেখানেই রাখো না কেন, আমার হাতে তুলে দাও।
একটু, খোঁজে দেখো না। হয়তো আশপাশেই আছে।
মিথ্যে বলো না, মিস্টার সোম। তোমার গুঁটিচাল আমাকে অতিক্রম করতে পারবে না। বলো ডায়েরিটি কোথায়? নইলে সে রাতের ঘড়ির মতো হবে তোমার অবস্থা।
হুমকি দিচ্ছো?
হুমকিতে কাজ না হলে, বাধ্য হব অশালীন আচরণ করতে।
অযুতের ক্রোধাগ্নির বিচ্ছুরণ পুরো ঘরটাতে ছড়িয়ে পড়ল। ওর আচরণ প্রতিকূলতার দিকে মোড় নিচ্ছে। সে রাতের কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে ওঠে। এই মুহূর্তেও বেশ ভয় লাগছে।
অযুত হঠাৎ চায়ের কাপটা মেঝেতে সজোরে ছুঁড়ে মারল। সশব্দে কাপটা ভেঙে কয়েক টুকরো।
অযুত, এসব কি হচ্ছে? ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
মিঃ সোম, ইচ্ছে করলে তোমাকেও কাপটার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি।
প্লিজ, অযুত থামো।
পেছন ফিরেই অযুত আমার শার্টের কলার চেপে ধরল। গলায় খুব চাপ লাগছে।
আমি ডায়েরিটি চাই। কোথায় রেখেছ বল?
বলছি, কলার ছেড়ে দাও। এখনই বলছি।
অযুত কলার ছেড়ে হাসতে শুরু করল।
হা হা হা। বলো মিঃ সোম। আমি তো তোমার সাথে কোনো বাজে আচরণ করতে চাই না।
ডায়েরিটি নীলার কাছে আছে। সে এসে নিয়ে গেছে। নীলা এখন কোথায় আছে আমি ঠিক জানি না।
নীলা? কে নীলা?
আমার সাবেক স্ত্রী নীলা।
অযুত চিৎকার করে বলতে লাগল, নীলা...নীলা...কোথাকার নীলা....।
কিছুক্ষণের জন্য অযুত চুপ হয়ে গেল। ওর নিস্তব্ধতা, আমাকে আরো ভয় পাইয়ে দিলো। মিনিট পনের পরে সে বলে ওঠল, ঐ অসভ্য নিম্নমাত্রিক মেয়েটাকে আমি উচিত সাজা দেব। দুষ্টচক্রী!
অযুত টেবিলের উপর থেকে ডায়েরিটি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
অযুত চলে যাবার পর কতক্ষণ ঝিম ধরে বসে ছিলাম জানি না। অবশেষে ওঠে আমি এক বিন্দু হেসে আলমারিটা খুললাম। অযুতের ডায়েরিটা হাতে নিলাম। অর্ধেকেরও কম পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। যা লিখেছে সবই সংক্ষিপ্ত আকারে। লেখাগুলো বেশিরভাগ বাংলা। তবে অচেনা কয়েকটা ভাষার মিশ্রণও রয়েছে। সারাদিনের জমে থাকা ক্ষুধা-তেষ্টা দূরে ঠেলে ডায়েরিটা এক নিশ্বাসে পড়া শুরু করলাম।
এ ডায়েরিটি অযুতের ভ্রমণ গল্প ও সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী। শুরুতে উল্লেখ করেছে রিয়ন সাহেবের ডায়েরি লেখা দেখে ওর কাছে ভাল লাগে। সে ভাললাগাকে অনুসরণ করে সেও ডায়েরি লেখায় মনোযোগী হয়। ওর প্রধান উদ্দেশ্য রিয়ন সাহেবের লেখাগুলো পড়া, বহুমাত্রিক জগত ভ্রমণের অভিনব সূত্রটি আত্মসাৎ করা। সে সুবাদে তাকে দীর্ঘ সময় নিয়ে বাংলা ভাষাটা আয়ত্ত্ব করতে হয়েছে। ভাষা চর্চা ও টুকটাক লেখার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সে ডায়েরি লেখা শুরু করে।
অযুত ওর লেখায় ত্রিমাত্রিক জগতে আসার কারণ ও উদ্দেশ্য বিস্তারিত বর্ণনা করেছে। চতুর্মাত্রিক জগতের মহাপ্রশাসকের নির্দেশে একটি চৌকস টীম ত্রিমাত্রিক জগতের উপর সর্বদাই নজর রাখে। ওরা দীর্ঘকাল গাণিতিক পথ পরিক্রমায় নিজস্ব চেষ্টা ও পরিশ্রমে ত্রিমাত্রিক পৃথিবীতে প্রবেশের পথ উন্মোচন করে। সে পথচলাকে অব্যাহত রাখতে ওরা ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ওদের লক্ষ্য ত্রিমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক ও একমাত্রিক জগত দখল করে শাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু ওদের পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতবিদরা সে পথ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়। ওদের দৃষ্টি প্রসারিত হয় ত্রিমাত্রিক জগতের গাণিতবিদদের দিকে। তাই রিয়ন সাহেবসহ পৃথিবীর বিখ্যাত সব গণিতবিদদের তথ্য ওরা সংগ্রহে রেখেছে। তাঁদের ওপর নজরদারিও চালিয়ে যাচ্ছে। অযুত ওর দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যেই রিয়ন সাহেবের কাছে আসে। তাছাড়া গোপন তথ্যে ওরা জানতে পেরেছে রিয়ন সাহেব, বহুমাত্রিক জগত নিয়ে খুবই কৌতূহলী। বহুমাত্রিক জগত ভ্রমণের পদক্ষেপ স্বরূপ তিনি কিছু সমীকরণ সাজিয়েছেন। তবে ঐ সমীকরণ নিয়ে তিনি খুব বেশি দিন গবেষণা করেননি। চতুর্মাত্রিক মহাপ্রশাসক কেন্দ্র চাচ্ছে রিয়ন সাহেব তাঁর গবেষণা চালিয়ে যাক। সে ক্ষেত্রে তাঁকে উৎসাহ দেবার জন্য অযুতকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীর বিখ্যাত গণিতজ্ঞদের একটি দীর্ঘ তালিকা অযুতের লেখায় উল্লেখ আছে। অযুত প্রাচীন গণিতবিদ থ্যালাস, পিথাগোরাস, ইউডোক্সস, আর্কিমিডিস, টলেমি, ডাইওফেন্টাসের বিশেষ বিশেষ অবদানগুলো নোট করে রেখেছে। এছাড়া বিস্তারিত বর্ণনাসহ রয়েছে আল খোয়ারিজমি, ওমর খৈয়াম ও লিওনার্দো ফিবুনাক্ষির গণিততত্ত্ব।
কিছু কিছু স্থানে অযুত এক অচেনা ভাষার প্রয়োগ করেছে, যা বুঝা আমার কাছে একেবারে দুঃসাধ্য। দীর্ঘ গাণিতিক রাশিমালাও রয়েছে।
তারপর অযুত লিখেছে, রিয়ন সাহেবের পিছু নেবার কিছুদিন পরেই সে একটি মেয়ের সাথে পরিচিত হয়। সেই মেয়েটির নাম ক্রিটিনা। প্রথমদিকে বন্ধুত্ব ও পরবর্তীতে তা প্রেমে পরিণত হয়। অযুত অনেকটা ভুলে যায় ওর প্রধান দায়িত্ব। তখন সে ক্রিটিনার প্রেমে অন্ধ। গল্পছলে ওর প্রকৃত পরিচয় ও এখানে আসার উদ্দেশ্য সবকিছুই ক্রিটিনার কাছে প্রকাশ করে। সে এটাও জানায় কেউ ইচ্ছে করলেই ওকে আঘাত করে বা অন্য কোনো উপায়ে ত্রিমাত্রিক জগত থেকে তাড়াতে পারবে না। কারণ চতুর্মাত্রিক জগতের প্রাণীকে ত্রিমাত্রিক জগত থেকে প্রস্থান করার জন্য রয়েছে একটি বিশেষ পন্থা। যা ত্রিমাত্রিক জগতের কারোরই জানা নেই। চতুর ক্রিটিনা একদিন ধাঁধার ফাঁদে ফেলে সে গোপন পন্থাটিও জেনে নেয়। যা একটি বিশেষ সূত্রের প্রয়োগ। অযুত ওর লেখায় নিজেকে সে মুহূর্তে অবুঝ দাবি করেছে। কর্তব্য ভুলে অবুঝ হবার অপরাধে ওকে চরম মূল্যও দিতে হয়েছে। টীমের পক্ষ থেকে পেয়েছে কড়া শাস্তি। তারপর থেকে ক্রিটিনা নামের সে মেয়েটির সাথে ওর সাক্ষাত নেই।
পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলো আয়ত্ত্ব করতে গিয়ে অযুত যে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তার বিরক্তিকর বর্ণনা সে লিখেছে। অযুত বার বার দুঃখপ্রকাশ করে লিখেছে ওর অস্তিত্ব রিয়ন সাহেব কিছুতেই বিশ্বাস করতে চান না। তাকে তিনি কল্পনা সৃষ্ট চরিত্র মনে করেন। অবিশ্বাসের সে দিনগুলো ঘিরে রয়েছে বহু ঘটনার কথা। রিয়ন সাহেবের সাথে সখ্য হবার পর, ওর সাথে গণিতের খুঁটিনাটি নানা বিষয় নিয়ে কথা হতো। অযুত চতুর্মাত্রিক জগত থেকে ত্রিমাত্রিক জগতে প্রবেশের সূত্রটি রিয়ন সাহেবের কাছে প্রকাশ করে একটি বিশেষ শর্তে। শর্তটি বহুমাত্রিক জগতের সূত্রটি অযুতকে অবশ্যই জানাতে হবে। অযুতের মতে, রিয়ন সাহেব শর্তটিতে রাজি হয়ে অযুতের সূত্রটি গ্রহণ করেন। সে সূত্রটিকে ফলো করে এগোতে থাকেন রিয়ন সাহেব। যদিও তিনি অনেক আগে থেকে এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেছিলেন।
অযুত ভৃত্যের মতো সর্বক্ষণ রিয়ন সাহেবের যতœ নিয়েছে। বার বার উৎসাহ দিয়েছে।
দীর্ঘ পরিশ্রম শেষে রিয়ন সাহেব বহুমাত্রিক জগতের সমীকরণ গুলোর সমাধানে পৌঁছে যান। যে সূত্রের সাহায্যে তিনি সমীকরণগুলোর সমাধান করেছিলেন সে সূত্রটির নাম ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা।
এক সময় রিয়ন সাহেব অযুতকে অবজ্ঞা করতে থাকেন। কড়া ভাষায় তাকে তাড়িয়ে দেন। রিয়ন সাহেবের অভিসন্ধি প্রথমদিকে অযুত বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারলে হয়তো, ওদের জগত ভ্রমণ প্রাথমিক সূত্রটা প্রকাশ করত না। রিয়ন সাহেবের আচরণে অযুত এক সময় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে, কারণ ওর প্রধান উদ্দেশ্য “ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা”টি খুঁজে বের করা। একদিন উত্তেজনা বশত রিয়ন সাহেবের সাথে অযুত দুর্ব্যবহার করে। তখন রিয়ন সাহেব অযুতকে মাথার পেছন দিক থেকে চেপে ধরে। সে লোমহর্ষক ঘটনার কথা অযুত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছে। কারণ, অযুতের মাথার পেছন দিকে চেপে ধরলে ওর দৈহিক চাপ স্থির হয়ে যেতে থাকে। যা ওকে স্থির বিকল করে দিতে পারে। এটা মৃত্যু না হলেও, মৃত্যুর মতোই যন্ত্রণাদায়ক। সেদিন অযুত খুব কষ্টে রিয়ন সাহেবের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল।
অযুত আমাকে বলেছিল, দাদাজান বেঁচে আছেন। তিনি জগত ভ্রমণে ব্যস্ত। রিয়ন সাহেবকে যে হত্যা করা হয়েছে, তার প্রমাণ অযুতের লেখা। মিথ্যাবাদী অযুত দাদাজানের মৃত্যুর ঘটনাটিও লিখে রেখেছে। সে লিখেছে,“রিয়ন সাহেবকে আমি হত্যা করতে চাইনি। তাঁর অযাচিত আচরণ, আমাকে অতিমাত্রায় উত্তেজিত করেছে। বার বার বিনয়ের সাথে বলা সত্ত্বেও তিনি ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা প্রকাশে রাজি হলেন না। তাই আমি, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে তাঁকে মৃত্যুর দুয়ারে পাঠিয়ে দিলাম।”
এ অংশটুকু পড়ার সময় আমার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। দাদাজানকে কোনোদিন কাছে না পেলেও, তাঁর ভালবাসার ছোঁয়া যেন পাই।
ডায়েরির শেষের দিকে অযুত আমার কথাও লিখেছে। গাণিতিক রাশিমালার আশপাশে প্রায়ই ফুটে ওঠেছে সোম মজুমদারের নাম।
সে লিখেছে,“স্বল্প সময়ে বিরূপ আচরণের মাধ্যমে মিঃ সোমকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। ও যেহেতু রিয়ন সাহেবের ডায়েরিগুলো আমাকে পড়ার সুযোগ দিয়েছে, সেহেতু আমি তার সাথে ভাল আচরণ করছি। তবে প্র্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে, অবশ্যই ওকে রিয়ন সাহেবের পরিণতি ভোগ করতে হবে।”
গা শিউরে ওঠল। অযুত যে কোনো মুহূর্তে আমাকে হত্যা করতে পারে। এখানে থাকা আমার জন্য মোটেও নিরাপদ নয়। কালই নীলাকে সাথে নিয়ে শহরে ফিরে যাব। ক্রাইটেরিয়ন সূত্রটিও আমাদের সাথে থাকবে। এ অমূল্য সম্পদ কিছুতেই শত্রুর হাতে সমর্পণ করতে পারি না।

আমরা শহরে ফিরে যাচ্ছি, খবরটা উৎসবকে জানানো উচিত। তাছাড়া উৎসব ওর গাড়িটা নিয়ে এলে সহজে যাওয়া যাবে। অযুত পাবলিক বাস বা ট্রেনে সহজেই আক্রমণ করতে পারবে। মূল বিষয়টা উৎসবকে জানালে, নিশ্চয় গাড়ি নিয়ে আসবে। ওকে এত রাতে কল দিয়ে বিরক্ত করব না। বরং একটি মেসেজ দিয়ে রাখি।
“উৎসব, আমি আর নীলা খুব বিপদে আছি। কালই তোর গাড়ি নিয়ে এখানে আয়। আমাদের উদ্ধার কর, প্লিজ। -সোম।”
রাত যতই হোক নীলাকে কল করা উচিত। নীলার নম্বরে ডায়াল করলাম।
হ্যালো, সোম।
নীলা, আমরা কালই ঢাকায় ফিরে যাব। অযুত যেকোনো মুুহূর্তে আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলাটি যেভাবেই হোক রক্ষা করা চাই।
সোম, তুমি এত আশঙ্কা করছ কেন? কিচ্ছু হবে না। নো টেনশন।
তুমি যে ডায়েরিটি নিয়েছিলে ওটাতে কী আছে?
এ ডায়েরিটি বেশির ভাগই মেঘাদ্রিকে নিয়ে লেখা। তবে কয়েকটা জটিল রাশিমালা রয়েছে।
আজ অযুত এ ডায়েরি খুঁজে পায়নি বলে খুব উত্তেজিত হয়েছিল। আমাকে হুমকি দিয়ে তোমার কথা জেনে নিয়েছে।
বলো কি?
হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। তুমি খুব সাবধানে থেকো। কালই আমরা ঢাকা ব্যাক করব।
কথা শেষ হবার আগেই নীলা ফোনটা রেখে দিলো।
[চলবে...]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট