নকল মানুষ



নকল মানুষ
যাহিদ সুবহান

কয়েকটা দিন খুব খারাপ যাচ্ছে আজগর আলীর। কাজকর্ম সব সিকেয় ওঠার জো। চাটমোহর স্টেশনে ভিক্ষা করে দিনাপাত করে সে। কিন্তু কয়েকটা দিন আজগর আলী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেও দাঁড়াতে পারছে না। স্টেশন মাস্টার থেকে শুরু করে আনসার-কুলি-হকার এমনকি ওর জাতভাই ভিক্ষুকরাও ওকে দেখলেই তেড়ে আসছে। ওর স্টেশনে আসা নিষেধ! আজগর আলী বিষয়টি নিয়ে খুব চিন্তিত। এভাবে চললে তো বেঁচে থাকা দায়। সবার ভাব এমন যে সে একাই সবার পেটে লাথি মেরেছে। আজগর তো কিছুই করে নি! আরে বাবা এই স্টেশনে আজগর আলী কি কোন কুকর্মের সাতেপাঁচে থাকে? প্রতিদিন দুইবেলা এই স্টেশনে লোকান ট্রেন আসে। এই ট্রেনেই সে ভিক্ষা করে। আট-দশটা ইন্টার সিটি ট্রেন থামে চাটমোহরে, কেউ কোনদিন এসব ট্রেনে আজগর আলীকে উঠতে দেখেছে? কেউ বলতে পারবে? তোমরা তো বাপু লাফ দিয়ে ওঠো। যতো ভীড়ই থাকুক চিৎকার চেঁচামেচি করে ট্রেনের যাত্রীগুলোকে অস্থির করে তোল। আজগর তো এসব করে না। তারপরও এই আজগরই খারাপ; তোমাদের চোখের বালি! কখনো দেখেছো আজগর আলী কোন যাত্রীর কাছে গরম গলায় ভিক্ষা চেয়েছে? নরম গলায় পায়ে ধরে ধরে ভিক্ষা চাই। কান্নাকাটি করে ভিক্ষা করি বেটা। চোখের পানি ঝরানো যে কত কষ্ট তা শুধু আমিই জানি!

আজগর আলী নিজেকে দুর্বল মানুষ মনে করে। প্রতিবন্ধী মানুষ সে। অথচ এই দুর্বল মানুষটার উপরই সবাই শক্তি খাটায়; কু-নজর দেয়। এই যে হিজড়াদের দল প্রায় প্রতিটি ট্রেনে জোড় করে সন্ত্রাসীদের মতো তাদের কেউ কিছু বলে না। বরং সবাই ওদের ভয় করে। কী যাত্রী কী লোকজন সবাই জানে হিজড়ারা চাওয়ামাত্র টাকা না দিলে কিংবা ওদের ক্ষ্যাপালে কপালে দুর্গতি আছে। ওরা সম্মানহানী করে, এমন কি গায়ে হাত তুলতেও দুইবার ভাবে না। এসব বিষয় সবই জানে রেলের কর্তারা। কিন্তু কোনা সুরাহা নেই। চাওয়ামাত্র তাই হিজড়াদের দাবী মেনে নেয় সবাই অথচ যত অভিযোগ আজগর আলীর বিরুদ্ধে। আজগর আলী হাত পেতে অঝরে কান্নাকাটি করেও কারো পকেট থেকে দুই টাকা বের করতে পারে না। কেউ কেউ টাকা তো দেয়ই না বরং অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দেয় আর বলে ‘যা ব্যাটা দুর হ!’

দুপুর বারোটায় বাড়ি থেকে বের হয় আজগর। সমস্যার সমাধান করা জরুরী। ভিক্ষা ছাড়া কিছুই জানে না সে। ভিক্ষার মতো টাকা কামানোর সহজ উপায় পৃথিবীর কোথাও নেই। স্টেশনের বড় বাবু মানে স্টেশন মাস্টার ছাড়া কোন উপায় নেই সমস্যা সমাধানের। তিনি বলে দিলেই আর কোন সমস্যা নেই। স্টেশন মাস্টারকে এখন গেলেই ফাঁকা পাওয়া যাবে। তার পায়ে ধরে হলেও সমাধান আজ করতেই হবে। পথে দেখা হয় শুকুরের সাথে। সে স্টেশনের দিক থেকেই আসছে।
Ñ আইজক্যি অবেলায় বাইর হইলে ক্যা আজগর ভাই? এহোন তো আর কোন লোকাল ট্রেন নাই। ভোরের ট্রেন তো চইলি গেছে, আর বিকালের ট্রেন তো অনেক দেরী। তুমি তো ইন্টারসিটিত ওটো না।
Ñ আর কইস নি ভাই, ইস্টিশনের সব শালা তো আমার পিচনে লাগেছে! ট্রেনে উটা তো দূরে থাক আমাক পিলাটফরমেই দাঁড়াতি দেয় না। যাচ্ছি একটু বড় বাবুর সাথে দেহা করতি।
Ñ ক্যা, সব তোমার পিচনে লাইগলি ক্যা?
Ñ কী জিনি রে ভাই, আমি আবার কার পাহা ধানে মই দিলেম!
কথা শেস করেই স্টেশনের দিকে হাঁটা দেয় আজগর আলী। ডান পায়ের উপর ভর করে বাঁ পা টা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটে সে। শুকুর আরী তার হাটার পথে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকে আর মিটমিট করে হাসে। শুকুর আলীর এই হাসির যথেষ্ঠ কারণ আছে। শুধু শুকুর আলী নয় এখানকার সবাই ইদানিং আজগর আলীকে দেখলে এভাবেই হাসে। এই হাসির যথেষ্ঠ কারণও আছে।

আজগর আলী হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে পৌছে যায়। এখন কোন ট্রেন নেই তাই নিজের খাস কামড়ায় এক কাপ রং চায়ের কাপে মনের তৃপ্তিতে চুমুক দিচ্ছেন স্টেশন মাষ্টার। আজগর আলী সোজা গিয়ে স্টেশন মাস্টারের পায়ে পরে যায়। ওকে দেখে স্টেশন মাস্টার চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। উনার চোখে ক্রোধের অনল জ্বলছে বোঝাই যাচ্ছে। থতমত খেয়ে স্টেশন মাস্টার আজগরের দিকে তাকিয়ে বলেÑ
Ñ কী রে আজগর নেংড়া, এখানে কী? তোকে না বলেছি প্ল্যাটফর্মে পা না রাখতে।
Ñ স্যার, আপনের দয়ায় বাঁইচি আছি। প্ল্যাটফর্মে না আসলি খাবো কী? বাঁচপো ক্যামা কই রি!
স্টেশন মাস্টার পা টা ছাড়িয়ে ওকে বাইরে বসতে বলে। আজগর আলী সুবোধ বালকের মতো বাইরে যাত্রী ছাউনিতে গিয়ে বসে থাকে।

আজগর আলী এই চাটমোহরেই থাকে। পয়তাল্লিশ বছর বয়সী আজগর আলীর বাড়ি এখান থেকে কয়েকগ্রাম পরে। খুব ছোটবেলায় বাবা-মা মারা যাওয়ায় অসহায় হয়ে পড়ে সে। গরীব মানুষের ছেলে তাই গ্রামের মানুষ ওকে নানাভাবে সাহায্য করতে থাকে। গ্রামের একটি আবাসিক এতিমখানা ও মাদ্রাসায় সবাই ওকে ভর্তি করে দেয়। এানেই সে বড় হতে থাকে। অসহায় হলেও ছোটবেলা থেকেই আজগর আলী অত্যন্ত দুষ্টু স্বভাবের মানুষ। মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া, এর ওর গাছে আম আর বড়ই গাছে ঢিল ছোড়া, ছোট ছেলেপুলেদের ধরে মারধর করা ইত্যাদি ছিল আজগর আলীর নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পড়ালেখায় অমনোযোগী হওয়ায় বার বার একই ক্লাসে সে পড়তে থাকে। আজগর আলীর উধাও হয়ে যাওয়ার দিনগুলোতে তাকে আবিষ্কার করা যেত সিনেমা হলে। চাটমোহরের সিনেমা হলগুলোতে সে খুব পরিচিত মুখ। সিনেমা হলে কোন নতুন ছবি এবং তাতে সামান্য গরমদৃশ্য থাকলে তা মিস হতো না তার। একই টিকিটে ডাবল প্রোগ্রামে বিদেশি সিনেমার গরম গরম দৃশ্যের প্রথম সারির দর্শক আজগর আলী। আর এসব সিনেমার টিকিটের টাকা জোগাড় হতো বিশেষ উপায়ে। হাটবাজারে মাদ্রাসার জন্য টাকা তুলতে যেতে হতো। এসব উত্তোলনকৃত টাকা থেকে কিছু টাকা সরিয়ে রাখতো আজগর আলী। তার এসব কুকীর্তি ধরা পরে যায় মাদ্রাসার হুজুরের কাছে। তাই মাদ্রাসা ছাড়তে হয় তাকে। মাদ্রাসা ছাড়তে হলেও মাদ্রাসার লেবাস ছাড়ে না আজগর আলী। থুতনির নিচে সামান্য দাড়ি, মাথায় সুতার একটা ছোট টুপি আর গায়ে ময়লা একটা পাঞ্জাবি পড়েই থাকে সবসময়। তবে মসজিদে নামাজের জামাতে শেষ কবে তাকে দেখা গিয়েছিল তা কেউ ঠিক বলতে পারে না।

 গ্রামের মানুষের সহযোগীতা আর এই সেই করে চলতে থাকে আজগর আলী। তবে তার স্বভাব পাল্টায় না। একবার আলেয়া নামে এক বিধবার দিকে কু-নজর দেয়। আলেয়া আজগর আলীর চেয়ে বয়সে বড় হলেও আজগর আলী তাকে কুপ্রস্তাব দেয়। অনেকবার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হয় একদিন সন্ধ্যার পর আলেয়ার ঘরে ঢুকে পড়ে সে। আলেয়ার চেঁচামেচিতে এলাকার মানুষ আজগরকে ধরে ফেলে। হাত-পা বেধে বেদম মারপিট করে। চড়-থাপ্পড়-কিল-ঘুষি আর চেলাকাঠের বাড়ির চোটে আজগর আলীকে আধমরা হয়ে গ্রাম ছাড়তে হয়। কয়েকদিন ডান পাটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে হয়। কয়েকদিন এভাবে চলতে থাকায় খুড়িয়ে হাঁটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। একসময় খুড়িয়ে হাঁটা হয়ে যায় তার উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম। সেই থেকে চাটমোহর স্টেশনে ঠাঁই হয় আজগর আলীর। খুড়িয়ে হাঁটার অভিনয়টা খুব রপ্ত করে আজগর আলী।

এসব ঘটনার সবটাই জানে চাটমোহরের লোকজন। স্টেশন মাস্টার-আনসার-কুলি-হকার-ভিক্ষুক সবাই। তবে তার উপর সকলে ক্ষ্যাপা অন্য কারণে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নুরজাহান নামে একটা আধপাগলি মহিলাকে ইদানিং সে না কি খুব বিরক্ত করছে। নুরজাহান প্লাটফর্মের পাশে পলিথিনে তৈরী খুপড়ি ঘরে থাকে। হাতে নাতে ধরাও পড়েছে কয়েকবার। আজগর আলীকে চাটমোহরে থাকতে দেওয়া হবে না। কোন ট্রেনেও উঠতে দেওয়া যাবে না। সবাই এ ব্যাপারে একাট্টা।

স্টেশন মাস্টারের মৌন সম্মতি পেয়ে আজগর আলী প্ল্যাটফর্মে আসে। আজ সে যেন তার হারিয়ে যাওয়া রাজত্ব ফিরে পেয়েছে। অনেকদিন পরে আজগর আলীর যেন সুদিন ফিরে এসেছে। আজ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আজগর আলী মনের আনন্দে। কুলি-হকার-ভিক্ষুকদের কাছে আকার ইঙ্গিতে সে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। একটা সমঝোতাও হয়ে গেছে। স্টেশন মাস্টার সবাইকে বলে দিয়েছেন অন্তত এবাবের জন্য ওকে মাফ করে দিতে। একটু পরেই স্টেশনের আউটারে ঢুকবে লোকাল ট্রেন। পা টা আগের মতই ঠিকমত খোড়াতে পারছে কি না সেটা খতিয়ে দেখছে বারবার। আগের মত আবার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে প্ল্যাটফর্মে আসা যাত্রীদের দিকে। নরম সুরে ভিক্ষা চাইছে। কেউ কেউ দুই টাকা, পাঁচ টাকা দিচ্ছে। কেউ কেউ টাকা তো দিচ্ছেই না বরং অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছে আর বলছে  ‘যা ব্যাটা দুর হ!’


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট