বহুরূপী মানুষের নিপুণ চিত্রায়ণ

 



বহুরূপী মানুষের নিপুণ চিত্রায়ণ 

মীম মিজান


মানুষ বহুবর্ণিল। এই বর্ণ তারাই দেখতে পান যাদের দেখার চোখ আছে। উপলব্ধির বোধ আছে। এমনই দেখার চোখ ও বোধসম্পন্ন ব্যক্তি হচ্ছেন শফিক সেলিম। কেননা তার সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ন্যাশনাল কারিকুলাম এন্ড টেক্সটবুক অব  বোর্ড বাজার আইল্যান্ড’র পুরোটা জুড়ে এই মানুষের বহুরূপীতার চিত্রায়ণ হয়েছে নিপুণভাবে।


কাব্যগ্রন্থটির নাম কবিতাটি সচরাচর দেখা কবিতার থেকে ভিন্ন। পুরো কবিতাই সংলাপ। আসলে রাজনীতিক যারা তারা কীভাবে শোষণ করছে তারই এক নিপুণ চিত্র। এক লোক চুরি করে মানে পকেট মারে। মানুষ যখন রাস্তা পারাপারের জন্য আইল্যান্ডে দাঁড়ায় তখন তাদের দৃষ্টি থাকে শা শা বেগে ধাবিত লক্কর ঝক্কর গাড়ি ঘোড়া পেরিয়ে ওপারে যাওয়া। দৃষ্টি সেদিকেই নিবদ্ধ। এই ফাঁকে, চোর হাকে। চেইন খুলে, পকেট হাতড়ে সব নিয়ে নেয়। আমরাও রাজনীতির কাছে বন্দী। ইলেকশনে দাঁড়িয়ে জনপ্রতিনিধি আমাদের সবকিছুও ওভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে। আমরা টের পাই না। যখন সম্বিত ফিরে, চোর ধরাছোঁয়ার বাইরে। চোরের কথার মাধ্যমে রাজনীতির সেই চোরা পথ বলছেন কবি:

: আইল্যান্ডে খাড়াইলেই?

: হ, খাড়াইলেই সব কিচু আমার।

: ক্যামনে?

: ইলেকশনে খাড়াইলেই যেমনে নেতারা দ্যাশের গুয়া মারে তেমনে’


এ কবিতায় তিনি বেশকিছু বিষয়ের খোলাসা করেছেন। যেমন শিক্ষিত হলে কী করে ব্যাংক ডাকাতি করা যায়। মেয়ে শিক্ষিতা হলে কার সাথে বিয়ে দিবেন এমন। চোরকে তাই কবির জিগ্যেস আর চোরের উত্তর:

: লেহাপড়া হিকলে কি করতি?

: ব্যাংক লোন নিতাম।

: তারপর?

: ক্যাসিনু খেলতাম, টাকিলা খাইতাম, গাড়ি নিয়া ঘুরতাম, মাগি...

: তর পুলারে কি করবি?

: লেখাপড়া হিকামু, বড়ো চোর বানামু

: তর ম্যায়ারে কি করবি?

: লেহাপড়া হিকামু, বড়ো চোরের কাছে বিয়া দিমু’


উন্নয়ন উন্নয়ন বলে যে জোয়ার। তারই নিচে মানুষ না খেতে পেয়ে, বিনে চিকিৎসায় মারা যায়। আর কিছু বললে চোখে কিছু দেখে না জনগণ। আর যতো সমালোচনা। এই সমালোচনার দারুণ মঞ্চায়নের কবিতা ‘তুমি মিয়া আজাইরা’। কবি বলছেন:

‘আন্দা নাহি তুমি?

‘এত্তো বিজলি বাত্তি, এত্তো ফালাই ওভার, বিলডিং, এত্তো উন্নয়ন কিচ্চু দেহো না?

গণভবন গিল্লা খাইবার চাও?’


আসলে গরীব মানুষেরা কি গণভবন গিলে খেতে চায়? পারবে কি? না। তারা চায় নাগরিক অধিকার। মৌলিক অধিকার, মানবিক জীবন যাপন। যা আমলা, রাজনীতিক আর পাতিরা খেয়ে বিদেশের ব্যাংক ভরেছে, সুরম্য বাড়ি গড়েছে। আবার যারা উচ্ছিষ্ট ভোগী তারাও কম যায় না। কাকের মতো চোখ বুঝে মহারাজের জয়গান করে। এমনই জয়গানের পঙ্ক্তি রচনা করে এসব নিকৃষ্ট মানুষের চরিত্র চিত্রায়ণ করেছেন এভাবে:

‘আমি সরকারি চাকরি করি

সরকার আমাগো খাওয়ায়

দ্যাশ বালো আচে’


শুধু কি আমলা বা সরকারি চাকুরে? অকবি, কুসাহিত্যিক, অপসংস্কৃতি সাধক এরাও কম যায় না। শিল্প যেমন তার স্বসময়কে ধারণ করবে তেমনই তা হবে গণমানুষের। কিন্তু এদের কোনও সৃজন মানুষকে ধারণ করে না। নারী শরীর, প্রেম, প্রকৃতির স্তুতি গাইতে গাইতে বেহুশ। কবি একই কবিতায় এসব মুখোশ আঁকছেন:


‘এহুন বরষা মাস-খালি প্রেমের কবিতা লেহুম

আর পুরোনো প্রেমিকার বিলাউজের মাপ কতো

তাই ভাবুম’

(দ্যাশ বালো চলচে...)


আইনের চোখ নাকি অন্ধ। কাউকে দেখতে পায় না। যার অপরাধ তারই শাস্তি হয়। দেশের সংবিধানও আইন। দেশের নাগরিকদের অধিকার রক্ষার আইন। কিন্তু সেই সংবিধান এখন দেখতে পায়। তার চোখে ক্ষমতাসীন, পুঁজিপতিরা নিষ্কলুষ। যত অপরাধ গরীব হয়ে জন্মানোতে, বিরোধী মত হওয়ায়। তাই সেই সংবিধানের প্রতি নিদারুণ খেদোক্তি কবির:

‘খাড়াইয়া মুততাচি

দেহি, ছেঁড়া বইয়ের পাতা

পাতার উপরে ল্যাহা ২৭ নম্বর আর্টিকেল 

উপরের ল্যাহা বাংলাদেশের সংবিধান’

(আমাগো সংবিধান) 


সংবিধানে অধিকার সংরক্ষিত থাকলেও তার বাস্তবায়ন না থাকায় দেশের সব মানুষই সমালোচনা করে। বিশেষ সমালোচনার স্থান চায়ের দোকান। এক কাপ চা, আর গ্যালন গ্যালন সমালোচনা। এমনই সমালোচনায় বস্তি থেকে সংসদ ভবন এমনকি জাতিসংঘ ও মার্কিন মুলুকও উঠে আসে। কবির কাব্য পঙ্ক্তি বরাবরই নির্মম সমালোচনায়। এমনই নির্মম সমালোচনায় নাকানিচুবানি খাচ্ছেন রাঘববোয়ালরা। দায়িত্বশীল ব্যক্তির উক্তি ছিলো ‘সরল বিশ্বাসে ঘুষ খাওয়া যাবে।’ কবি তাই বলছেন:

‘দুর্নীতি কিচু না

সরল বিশ্বাসে করেন, ক্ষমা পাইবেন

তবে ভুলেও কিন্তু ইচ্চাকিত দুর্নীতি করবেন না

সুযোগ লুইট্যা ন্যান। দ্যাশ যাইক গুয়া মারা’

(চাওয়ালা)


বইটি দুটো ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে ছয়টি কবিতা। আর দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ ‘সোনার মাকড়ি’ অংশে আছে আঠারোটি কবিতা। দ্বিতীয় অংশের কবিতাগুলোতে কবি নিজের ব্যক্তি জীবনের কথা বলেছেন। কিন্তু ব্যক্তিকে বিশ্বের একজন করে তুলে প্রকাশভঙ্গী এমন করে দিয়েছেন যা হয়েছে সব মানুষের। সবার জীবনের প্রতিচ্ছবি। এককথায় গ্রন্থটিকে বলা যায় মানুষের আয়না। সে প্রান্তিক হোক আর ভুড়িওয়ালা মালদার হোক সবাই স্থান করে নিয়েছেন এখানে। যে গরুর চামড়া ত্রিশটাকা বিক্রি হয় সেই চামড়ার জুতো গুলিস্থানের সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেটে বিক্রি হয় হাজার টাকার উপরে। প্রান্তিক শ্রমিক তাই ভেবে দিশেহারা। এরূপ চেটেপুটে খাচ্ছেন সবাই। সে প্রসঙ্গ ও বুনন হামেশাই দেখা যায়। 


‘সোনার মাকড়ি’ কবিতাটিও গরীব-প্রান্তিক মানুষের। মায়ের সম্পদ বলতে একজোড়া সোনার মাকড়ি। তাই বারংবার সুদে বন্ধক রাখতে হয় স্থানীয় স্বর্ণকারের কাছে। কেননা পরীক্ষার ফি দেয়ার সামর্থ্য নেই মায়ের। পরে নিতান্ত কষ্টে মাকড়ি জোড়া ফেরত নেয়ার টাকা জোগাড় করেন মা। এ যেনো সারা বাংলাদেশের মেটে মজুরের চিত্র।


বোধসম্পন্ন কবি ‘হাসপাতাল’ নামক কবিতায় মানুষের জীবনের দু’টি কান্নার কথা বলেছেন। একটি কান্না বাবা মারা যাওয়ার। আরেকটি নতুন শিশুর ওয়াও। বোধের খোঁজ করতে বলেছেন ‘মানুষের সময় হয় না’ কবিতায়। নিজেকে জানা সব থেকে বড় কাজ। কবি বলছেন:


‘শকুন বদলায়ে যায়। মানুষের সময় হয় না

নিজেকে দেখার।’


কৃষকদের নিয়ে দু’টো কবিতা লিখেছেন তিনি এখানে। কৃষকদের মহত্ত্ব তুলে ধরেছেন মমত্ববোধের কবি:


‘কৃষকের প্রাণ নিয়ে ধানেরা বয়স্ক হয়

তাই, কৃষকের চেয়ে বড়ো কোন ভগবান দেখি না’

(কৃষক)


বঞ্চিত করছি প্রান্তিক মানুষকে। আর পাহাড়, বন-বনানী, প্রকৃতিকে নিজেদের বিলাসিতার জন্য ছেটে-কুটে শেষ করছি। কিন্তু তাতে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়োল মারছি। কেননা এই প্রকৃতিতেই আমাদের বাস। তাদের ধ্বংসে নিজেদেরই সর্বনাশ। কবি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন:


‘আপনি দেখলেন

আপনি মূলত খেয়েছেন আপনার নিজের হাত, পা এবং হৃৎপি-’

(আপনি একজন মানুষ) 


মানুষ। এই মানুষই আবার শ্রেষ্ঠ দুশমন মানুষের। জাত-পাতের জন্য কত্ত যে মানবের কবর রচিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কবি ‘নাম’ শীর্ষক কবিতায় এ বিষয়টি পরিস্ফুটন করেছেন। দায়। পিতার দায়। মাতার দায়। সন্তানের দায়। কিন্তু এই দায় শুধু পিতা-মাতারাই করে যাচ্ছি। আবার সন্তান হিশেবে পিতা-মাতার দায় এড়িয়ে যাচ্ছি। তাদের ইহধাম ত্যাগে পাবো স্বস্তি। সমস্যা নেই আমাদের ইহধাম ত্যাগের আকুল প্রত্যাশি হবে আমাদের সন্তান। এমনই বিষয়বস্তু ‘বিক্রি’ ও ‘বাবা’ কবিতার। সবচেয়ে বড় চপেটাঘাত দিয়েছেন কবি আমাদের দুই গালে। পঙক্তি দু’টো :

‘পাঁচ ভাইবোন মিলে পরামর্শ করি

বাবা মাকে বিক্রি করলে কেমন হয়’

(বিক্রি)


আমরা কি মানুষ হবো না। না দু’পেয়ে জন্তু হিশেবে থেকে যেয়ে হাম্বা হাম্বা ডাক দিয়ে খেয়ে দেয়ে ঘুরবো? তবে এ মানুষের স্থান লোকালয়ে না হয়ে হোক আমাজনে। আর যদি সত্যিকারের মানুষ হতে পারি তাহলে লোকালয় হবে শেখ ফজলল করীমের কাব্যের স্বর্গ।


ভাষার ব্যবহারে কবির অকৃত্রিমতা লক্ষণীয়। ঠিক যেনো শহীদুল জহিরের গল্পের প্রান্তিক থেকে সংসদ ভবনের বাসিন্দারা কথা বলছে। প্রচ্ছদটি উপলব্ধির জন্য পুরো কাব্যগ্রন্থের শব্দে শব্দে পরিভ্রমণ দরকার। কবি মমিন মানব ফ্ল্যাপে যে কথাগুলো লিখেছেন তা কাব্যগ্রন্থের সারাৎসার। মজার বিষয় কোনও যতিচিহ্ন ব্যবহার করেন নি মমিন। আর একটি বিষয় হচ্ছে যে, যত প্রাতিস্বিক কবি আছেন তাদের কবিতায় ছন্দ আছে। আছে অলংকার। শফিক সেলিমের সব কবিতাই গদ্য। গদ্যের মধ্যে একটি স্বাদ আস্বাদিত হলেও ছন্দের অন্যান্য বিষয়গুলো আমার দৃষ্টিতে পড়ে নি। আমার পরামর্শ থাকবে, কবিতার ভাব, ভাষা, আবহ ও বুননে তার যে দক্ষতা সেখানে যদি ছন্দ ও অলংকার যোগ হয় তাহলে আরও মনোহর হবে কাব্য কানন।


প্রকাশক: বাংলা জার্নাল 

প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি-২০২০

প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত

মূল্য: ১৩৫ টাকা



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট