পৃথিবীর সব গল্পেরই শ্রেষ্ঠ চরিত্র ‘আমি’

 



পৃথিবীর সব গল্পেরই শ্রেষ্ঠ চরিত্র  ‘আমি’

হাসান মাহাদি


প্রায় একবছর হতে চললো। গল্পটা লিখব লিখব করে আর লিখা হয়ে উঠেনি। ব্যস্ততা, অজুহাত, অলসতা ইত্যাদি কারণেই লিখা হয়ে উঠেনি। দু’য়েক পৃষ্ঠা লিখে ফেলে রেখেছিলাম। এমন অনেক লিখা, লিখব লিখব করে আর লিখা হয় না। ভুলে যাই। কিন্তু এ গল্পটা ভুলিনি। এটা আমাকে লিখতেই হবে। কারণ এটা জীবনের গল্প। আমার জীবনের গল্প। নতুন দিনের সূচনা লগ্নে একটি ভয়ানক রাত্রি শেষে দিক ভ্রষ্ট নাবিক যেমন সূর্যোদয় দেখে দিকের দিশা পায়, এই গল্পটাও আমার সকালের দিক নির্ণয়ের দিকদর্শন।


বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু হয়েছে। নতুন শহর, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ, নতুন অভিজ্ঞতা। তার উপর আঠারো উনিশ বছরের বেপরোয়া আর রঙ্গীন বয়স। কত অনুভূতি কত উপলব্ধি! তা আর ব্যাখ্যা করা যাবেনা। ফার্স্ট সেমিস্টার সবে শেষ হয়েছিল। জীবনের সবচেয়ে বাজে সময় যাচ্ছিল। ইনফেচুয়েশনাল এক্সিডেন্ট সাথে মধ্যবিত্তের সংগ্রাম। এই বয়সে মারাত্মক এক্সিডেন্টই বটে। সামলাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। বেশি সময় একা একা থাকতাম। সন্ধ্যার পর সদরঘাটে চলে যেতাম। মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যেতাম। নিজের সকল চিন্তা, চেতনা, বেদনাকে একঘরে করে দিয়ে মানুষের বৈচিত্রে নিজেকে খুঁজতাম।


একদিন  সম্ভবত আট নম্বর গেইটে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখলাম কয়েকটা ছেলে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটা ছেলে রেলিংয়ের উপর বসে একটা বই হাতে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে অভিনয়ের ভঙ্গিতে সবাইকে পড়ে শুনাচ্ছে। সবাই পথশিশু । কৌতুহলবশত এগিয়ে গেলাম। কী পড়ে শুনাচ্ছে তার শুনতে গেলাম। একটা জোকসের বই। পাতলা একটা বই। ছেলেটা বইয়ে বর্ণিত চরিত্র অনুযায়ী কণ্ঠস্বর বদল করছে। সবাই হাসছে এবং সে নিজেও হাসছে। শেষ হওয়া পর্যন্ত আমিও জোকস শুনলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। শেষ হওয়া মাত্রই ছেলেটাকে ডাক দিয়ে নাম জানতে চাইলাম। বললো, আব্দুল্লাহ। এখানেই থাকে। লঞ্চে পানি বিক্রি করে । কাছের একটা পথশিশু স্কুলে যায় । পড়ার আগ্রহ আছে। লালনকে পছন্দ  করে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পর কেউ একজন ডাকলো। ছেলেটি বললো ,ভাই এখন যাইতে অইবো।

বললাম, যা। আর শুন? কাল সন্ধ্যা সাতটায় আসতে পারবি? 

ছেলেটি বললো , না ভাই কামে থাকুম। 

-তাইলে আটটায়?

-হ ভাই। 

-ঠিক আছে যা।


পরদিন দশ মিনিট আগে আমি পৌছে গেলাম আট নম্বর গেইটে। ঠিক আটটা নাগাদ আব্দুল্লাহ আসলো। ওর পায়ে জুতো ছিলো না। ওর জুতো নেই ।

বললাম , চল। 

বললো, কোথায়?

-আমার সাথে চল ।

টার্মিনালের বাইরে ফুটপাথ থেকে জুতা কিনে দিলাম। প্রথমে লজ্জায় নিতে চাচ্ছিলো না। আমি অবাক হলাম। একবার ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে আমরা ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা মিলে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে পথশিশুদের নিয়ে সদরঘাটেই একটা প্রোগ্রাম০ করেছিলাম। খাওয়ার ও ব্যবস্থা ছিলো। গান আবৃত্তি ইত্যাদি শেষে যখন বিরিয়ানির প্যাকেট বের হলো এক ভয়ানক কা-! সেই দিক থেকে আব্দুল্লাহর সংকোচবোধে একটু অবাকই হচ্ছিলাম। দু’জন হাঁটতে হাঁটতে ঘাটে ফিরে আসলাম। একটা লঞ্চে উঠে গেলাম। ছাড়তে অনেক দেরি। তাই ভাবলাম, ছাদে বসে ওর সঙ্গে কিছুটা সময় গল্প করা যাক। মাত্র কিছুটা সময় ছেলেটার সাথে থেকে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম রঙ্গীন স্বপ্ন ভঙ্গ কিংবা আশাহত হওয়ার বেদনা। ভুলে গিয়েছিলাম কয়েকদিন বাড়িতে ফোন দিয়ে মায়ের সাথে একটু কথা হয়না। ভুলে গিয়েছিলাম সংকীর্ণ বেড শীটে বেডমেটের নিরব বিরক্তির উপহাস। ভুলে গিয়েছিলাম পেঁপেভাজি আর বেগুন-ডিমের অদ্ভুত তরকারি সমেত মেসের খাবারের  মেন্যু । টিউশনি নেই, কথা শেয়ার করার মতো ভালো বন্ধু নেই, অসম্ভব মানসিক চাপ সব মিলিয়ে আমি ভুলে গিয়েছিলাম জীবনে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র। জানি হয়তো অনেকেই আমাকে ইমোশনাল ফুল বলবেন। কিংবা বলবেন মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা নেই। কিন্তু যাই বলুন না কেনো বাস্তবতা এটাই ছিলো যে, সময়টা আমার খারাপ যাচ্ছিলো। আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম। 


-আব্দুল্লাহ বললো, ভাই, আমার মনটা আজ ভালো নেই। 

-কেন, খাবার খাসনি?

-খাইছি ভাই। তবে একবেলার খাওন খাইতে না পারার কষ্টের চাইতে সামনে থেইক্যা খাওন কেউ হালায়া দিলে বেশি কষ্ট লাগে ।

-তর সাথে কেউ কিছু করেছে?

-না ভাই। মজুন ভাইয়ের কথা কইতেছিলাম।আহ!

-কি হয়েছে তর মজনু ভাইয়ের?

-লঞ্চে ঝাল  মুড়ি বেচতো। লঞ্চের ক্যান্টিনের লোক থাইক্যা একটা পুলিশ ট্যাহা খাইয়া মজনু ভাইয়ের সব নদীতে হালায়া দিছে।

-পুলিশ টাকা নিছে তুই দেখছিস?

-হ ভাই। নিজ চোহে দেখছি। আল্লাহর কসম!

ছেলেটার চোখ তখন ছলছল করছে। আমার খুব মায়া লাগলো।

-ভাই আমি বড় হইয়া পুলিশ হমু। সৎভাবে চলমু। জানেন ভাই, এইখানে কত দুই নাম্বারি চলে? আমার থেইক্যা ছোডো ছোডো পোলাপাইনে বিড়ি খায়, নেশা করে। এমনকি নেশা বেচেও! 

-তুই নেশা করিস?

-আল্লাহর কসম ভাই ! বিড়িও খাই না। জানেন ভাই পুলিশ এইসব দেইখ্যাও  দ্যাহেনা। দ্যাহে শুধু মজনু ভাইয়ের মতো মানুষদের। আর ঘাডের লোকেরাও আমাদের কাছে থেইক্যা ট্যাহা তুলে। হেল্লাইগ্যাই পুলিশ হমু। কিন্তু কি করমু? সমস্যার অভাব নাই। বাপে ইস্কুলে যাইতে দেয়না। ওই যে আমনেরা কন পথশিশু নাকি? আমি কিন্তু হেই পথশিশু না।

আমি চুপচাপ শুনছিলাম ওর কথা গুলো । ভাবছিলাম আমি ব্যর্থ প্রেমের বিরহে শোক পালনে ব্যস্ত। আর অন্যদিকে এই ছেলেটা আশে পাশের জীবনকে দেখে দেখে উপলব্ধি করে নিজের জীবনের লক্ষ্য স্থির  করছে। সে বাস্তুহীন কিন্তু স্বপ্নহীন নয়। তার কাছে সুযোগ নেই কিন্তু স্বপ্ন আছে। আমার কাছে তো থাকার মতো একটা বিছানা আছে । হউক না গাদাগাদিময়। মাথার নীচে বালিশ নেই তো কি হয়েছে? গোঁজার মতো একটা পুরনো কম্বল আছে। দু’বেলা খাবার আছে হউক না বিদঘুঁটে পেঁপেভাজি অথবা বেগুন তরকারি । কিন্তু ওর কাছে তো কিছুই নেই। তবুও স্বপ্নবাজ। আহা জীবন! কত বৈচিত্র! 


আমাকে উদাস দেখে ছেলেটা বললো, ভাই একটা কথা কমু? 

-বল।

-আমার কাছে স্বপ্ন মানে কি জানেন?

-কী?

-আমার কাছে স্বপ্ন মানে একটা বাজি। ডর ভয়হীন একটা বাজি। ধরেন বিল্টু আমার লগে বাজি ধরলো যে, আব্দুল্লাহ তুই বুড়িগঙ্গা সাতরাইয়া এপাড় থেইক্যা ওই পাড়ে যাইতে পারলে তরে পুরস্কার দিমু। এখানে আমার স্বপ্ন লক্ষ্য কি জানেন?

-বিল্টুর পুরস্কার?

-না ভাই। ওই পাড় যাওন। আমার সাঁতরানোর  ক্ষমতা আছে এবং সাহস আছে এইডা প্রমাণ করা। বুড়িগঙ্গার পানি ভালা না? ময়লা ? গন্ধ? এগুলো সব সমস্যা। যদি এইসব মাথায় রাহি ওই পাড় যাওন ওইবো না। বিল্টুর কাছে বাজিডা হারমু। হারমু আমার ক্ষমতার কাছে, আমার স্বপ্নের কাছে।

স্বপ্নের কি অসাধারণ দার্শনিক ব্যাখ্যা! ওর কথা শেষ হতেই ওর পিঠ  চাপড়ে দিয়ে বললাম, সাবাশ!


ওইদিন বাসায় আসার পথে আব্দুল্লাহর প্রত্যেকটা কথাই কানে বাজতে ছিলো। এখনো বাজছে। ওইদিন নিজের উপর খুব রাগ লাগছিলো।  শপথ করেছিলাম, বিল্টুদের চ্যালেঞ্জের কাছে হার মানা যাবেনা। স্বপ্নের পথে সব সমস্যাই বিল্টুদের উপহাসের চোখে ছোড়া চ্যালেঞ্জ মাত্র।

ভাবছিলাম একটা স্বপ্নের কথা। একটা গল্পের কথা। প্রতিদিনই গল্পের সৃষ্টি হচ্ছে। কারো গল্পের চরিত্রে আমি আবার আমার গল্পের চরিত্রে অন্যেরা। সদরঘাট থেকে ফিরে সোজা চলে গেলাম ক্যাম্পাসে। ক্যান্টিনের বারান্দায় বসে সিঁধু মামার চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবলাম আমি কি গল্পটা লিখতে পারব? আব্দুল্লাহর স্বপ্নের সারথি হতে পারব?


একটা গল্প, একটা স্বপ্ন । একটা গল্প রাস্তায় উদাস গন্তব্যহীন পথিকের অলীক চিন্তার প্রশান্তির মঞ্জিল। গল্প শুধু  শব্দমালা কিংবা বাক্যমালার সমাহার নয়। প্রতিক্ষা, ছলমল আবেগ, চাপা জেদ, কান্না, হাসি, আনন্দ আর দুঃখসহ আরো অনেককিছু। গল্প, গল্পকারের মধ্য রাত্রিতে হঠাৎ জেগে উঠে ঘুম ঘুম চোখে সদ্য ভাঙ্গা কাঁচা স্বপ্নের বর্ণ-শব্দ-বাক্যদিয়ে গড়া এক অনন্য স্কেচ। আর সবশেষে নির্ঘুম রাত্রিকে ভুলে গিয়ে সুবেহ সাদিকে পাখির কিচিমিচি আর মোয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠের সাথে একটা প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস, ঠোটে এক চিলতে হাসি আর চোখের কোণে একবিন্দু অশ্রুসমেত প্রভাতকে বরণ করা। গল্প একটা দিনের সূচনা। গল্প, গল্পকারের পিতৃত্ব গুণে এক আধা স্বপ্নের পূর্ণতা। কোনো নতুনত্বরে দার উন্মোচিত হওয়া । 

জানিনা আমি সেই গল্প কখনো লিখতে পারবো কিনা। জানিনা মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে স্বপ্নের স্কেচে জীবনের চিত্র আঁকতে পারব কিনা। সব হতাশা বিলীন হয়ে গেছে স্বপ্নের চড়াবালিতে। আমার ইচ্ছে পথে পথে হাটি জীবনকে দেখি। রাতের মধ্য প্রহরে হঠাত ঘুম ভেঙ্গে যাবে । সমুদ্রের মাতাল ঢেউয়ের মতো, কাল বৈশাখির দুমড়ে মুছড়ে ফেলা তুফানের মতো আমার হৃদয়ের সমস্ত আবেগ আন্দোলন করে বেড়িয়ে আসবে। আমি গল্প লিখব। পথের গল্প, সদরঘাটের সেই স্বপ্নবাজ আব্দুল্লাহর গল্প। আমি সিঁধু মামাদের গল্প লিখব। নারিন্দার লালমোহন সাহ স্ট্রিট, শরৎগুপ্ত রোড কিংবা কলতা বাজারের পুরণো দালানের পরিত্যক্ত শেওলা আর খয়ে যাওয়া ইট-সুরকিদের গল্প লিখব। বাহাদুর শাহ পার্কের বেদিতে বসে জীর্ণ কামিজ পরিহীতা বালিকা, যে রঙ্গীন স্বপ্ন দেখা প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য মলিন হাতে বকুল ফুলের মালা গাঁথে আমি তাদের গল্প লিখব। গোলাপ শাহ মাজারের আশে পাশের কিংবা এই শহরের সকল চেনা-অচেনা পথের উদ্বাস্ত মানুষের নির্ঘুম জালে বোনা ব্যর্থ-অব্যর্থ, জানা-অজানা স্বপ্নের গল্প লিখব। মধ্যবিত্তের লজ্জ্বায় হাত না পাতা চাপা সংগ্রামের গল্প লিখব। উচ্চবিত্তের শান-শওকতের বাঁধানো দেয়ালের ওপারের বুক ফাঁটা খামোশ চিৎকারের গল্প লিখব। আমি জীবনের গল্প লিখব। 


যখন লেখার জন্য কোনো প্লট খুঁজে না পাই, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যাই। অতি নিখুঁত ভাবে নিজেকে দেখি । বেসিনের আয়নায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জল আর কুয়াশার ন্যায় ইষৎ ঝাপসা আবরণের ওপাশের আমিটাকে দেখি। পানির প্রতিটা ফোঁটায় ফোঁটায় গল্পের প্লট খুঁজে ফিরি। ঐ তো গল্প! অসংখ্য অগণিত গল্প। আয়নায় বিন্দু বিন্দু জলের মতো সারা আমিতেই তো কত শব্দ, কত বাক্য, কত গল্প। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। শুধু ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করে একটু তপস্যার পালা। মস্তিষ্কের শূণ্য অক্ষরেখা বরাবর শুধু আমি, জীবন ও আমার গল্প। সমস্ত বিক্ষিপ্ততা আর হিঝিবিঝি জটিলতার বাঁধন ছিঁড়ে একটা গল্পের জন্ম নেয়। জীবনের গল্প। আর বাথরুমের উন্মোক্ত দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে শ্যাম্পুর স্নিগ্ধতা অনুভব করতে থাকা তপস্যারত মুনী হয়ে উঠেন গল্পকার। পৃথিবীর সব গল্পেরই শ্রেষ্ঠ চরিত্র  ‘আমি’।



স্নাতক (সম্মান) ২য় বর্ষ,

লোক প্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট