একুশ এবং একটি ফুলের আক্ষেপ !

 



একুশ এবং একটি ফুলের আক্ষেপ

ইয়াকুব শাহরিয়ার


চৌহাট্টায় বসে আছি এক কোনে। পুরোনো অভ্যাস। রিকশা গুনছি। প্রতিজোড়া প্যাডেলওয়ালা পায়ের স্যান্ডেলের বাঁকিয়ে যাওয়া দেখছি। দু’চোখে পড়ছি শীতেও ঘাম ঝড়ার গল্প। পাগলের মতো এসব দেখি; দেখার মতো পড়ি। হুডতোলা রিকশার ভিতর দিয়ে দেখি দুই পৃথিবীর তফাৎ। প্যাডেল পায়ে জীবন যুদ্ধের গল্প টেনে চলে সুখের পায়রা। কত নিষ্ঠুর দুনিয়া! এখানে হরদম চলে এমনই গল্প লিখার সফল সমাপ্তি। আনমনা আমি দেখছি রিকশা-সিএনজির চলে যাওয়া-আসা। হঠাৎ ধুন ভাঙলো আমার। লাল ডোরার সবুজ চাদর গায়ে জড়িয়ে বসেছিলাম। চাদরটি শ্লোগান থেকে কিনেছিলাম ৭শ ২০ টাকায়। চাদরে সৈয়দ শামসুল হকের আমার পরিচয় কবিতাটি লেখা। উলুখাগড়ার মতো চুল, দাঁড়ি আর চাদরে আমাকে পাগলই লাগছিলো। নিজেকে আজকাল পাগল কিসিমের লোক মনে হয়। পাগলের নিজস্ব একটা দুনিয়া দরকার। আমার সে দুনিয়া আছে। এই দুনিয়া নিয়েই এমন ভাবনাই ভাবছি আনমনে। পেচন থেকে কে যেনো খুব কষ্ট করে বানান করে করে কবিতার মাঝখান থেকে একটি লাইন পড়ছে- ‘এ-সে-ছি  বা-ঙা-লি রা-ষ্ট্র-ভাষার লাল রাজ-পথ থেকে’। এভাবেই আলগা আলগা করে পড়ছে। বিস্মিত হয়ে পেচন ফিরে থাকাই। একটা উদাম গতরি ছেলে দেখেই মনে হচ্ছে আমার মতোই একজন। পাগল কিসিমের কিন্তু পাগল না। কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো। কথা বলছি না; আমার ধুন বাঙলেও তার ধুন এখনো ভাঙেনি। লাইনটা অনেক কষ্টে পড়ে শেষ করে আমার দিকে তাকায়। আর পড়লো না। একটি কাঁচা গোলাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো- ফুল নিবেন? আমি সরাসরি না বলে দিলাম। কিছুক্ষণের জন্য চুপসে গেলো। আবার বললো নেন না মামা একটা। দশ টাকাই তো। চুপ করে রইলাম। তার ফুল বেচার নানা ধরণের আবদার। নেন মামা একটা। কালকে একুশে ফেব্রুয়ারি। শহিদ মিনারে দেবেন। না হলে ভাবীরে দেবেন। আমি তার দিকে দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলাম। সে আমাকে ফুল দিতে চাইলে নিলাম না। দশ টাকা ফেরত দিয়ে দিলো। বললো- মামা, আমি ভিক্ষা করি না। ব্যবসা করি। তার কথায় আরো অবাক হলাম। কতো  আত্মগৌরবী ছেলে!

নিশ্চুপ হয়ে কিছুক্ষণ ছেলেটাকে দেখলাম। টাকা দিলাম না। তার থেকে অনেক কিছু শিখে নিলাম। পুরোটা পৃথিবীই একটা পাঠশালা। যেখান থেকে ইচ্ছা সেখান থেকেই শিক্ষা নেওয়া যায়। আমি এই ছেলেটার থেকে শিক্ষা নিলাম। আত্মগৌরবের শিক্ষা! সন্ধ্যা হয়ে এলো। পিঠা খেতে মন চাইলো। ভাঁপা পিঠা। তাকেও খাওয়ার কথা বললাম। প্রথম দিকে না করলেও আমার জবরদস্ত জোড়াজুড়িতে আর না করতে পারলো না। পিঠা খেতে খেতে তাকে নাম জিজ্ঞেস করলাম। বললো- হাবু। চমৎকার মিশেল দেওয়া নাম। ভালো লাগলো। কিছু কিছু জিনিস দুনিয়ায় আছে, যেটা কোনো রকমের কারণ ছাড়াই ভালো লাগে। হাবুর নামটাও আমার কাছে তেমনই একটা বিষয়। পিঠা খেয়ে হাবুকে ছেড়ে দিলাম। সে মালঞ্চের দিকে হাঁটা শুরু করলো। আমি আর রিকশা গুনতে বসলাম না। বাড়ি ফিরতে হবে। তাই গাড়িতে উঠলাম। কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে ৪৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাড়িতে আসতে আসতে রাত তখন ৯টা।  

তখনও হাবুর ঘোর কাটেনি আমার। তাকে নিয়েই ভাবছি। বাতির ভাইয়ের চায়ের দোকানে বসে এককাপ গুড়ের চা গিলে বাড়ির দিকে হাটতে লাগলাম। তখন হাইস্কুলের শহিদ মিনারের দিকে নজর পরে। লাইট দুইটা জ্বলছিলো। কোনো মানুষ নেই। হয়তো রাতের প্রথম প্রহরে দলীয় শ্লোগান ফাটিয়ে স্থানীয় রাজনীবিদরা পুষ্পস্তবক অর্পন করতে আসবেন। আবার নাও আসতে পারেন। এটা তাদের ইচ্ছা। ইদানিং রাজনীতিবিদদের ইচ্ছাতে অনেক কিছুই হয়। যা হওয়ার নয়, তাও হয়। রাজনীতি যেনো এখন সোনার কিংবা রুপার কাটি। একটি দিনের ইতিবৃত্তান্ত দিয়ে চোখবুঁজে আসে আমার।

ভোর ৬টা। আলো ফুটলো বলে দিনের। এখনো দেখা নেই সূর্যের লাল আভারও। ২১শে ফেব্রুয়ারি। প্রভাতফেরির কোনো প্রস্তুতি নেই আগের মতো। ফুল হাতে কোনো কিশোরীর দল খালি পায়ে আসতে দেখছি না। শাদা শার্ট আর নেভি ব্লু-প্যান্ট পড়া নগ্নপায়ী ছাত্র দেখছি না। কুয়াশা ভর করেছে ২১এর বুকে। কিছু কাল অতিক্রম করে ধীরে ধীরে ছেলে মেয়ে আসতে দেখছি আবেগহীনভাবে। জুতাপায়ে। ফুলহীন হয়ে লিপস্টিকে টকটকে লাল দুটি মেয়ের ঠোঁট। বিস্মিত হলাম! যেনো উৎসব যাত্রা। আহ!

আমার লাল সবুজের পাঞ্জাবি ও চাদরখানা গায়ে জড়িয়ে খালিপায়ে ছোটছি। খালি হাতে। কিছুটা কুয়াশাঘোর কাটছে। মানুষের সমাগম বাড়ছে রেইন্ট্রি তলায়, জামতলায়। স্কুল মাঠে। স্যার ক্রমাগত প্রভাতফেরি শুরুর কথা বলে যাচ্ছেন। স্পোর্টস শিক্ষক বেহিসেবী বাঁশি বাজাচ্ছেন। কে কার কথা শুনছে? অধিকাংশ মেয়ে-ছেলে আলাদা ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমার মতো কয়েকজন বোকাসোকা সাবেকি, আধাপাগল লোক হাঁটতে শুরু করেছেন। সাথে বেবুঝ কিছু শিক্ষার্থী আর চাকুরীরত শিক্ষকগণ। মেয়েরা আর ছেলেরা আড্ডায় মগ্ন। এ যেনো আনন্দ দিবস! শহিদদিবসের কোনো আবেগ নেই। স্কুল কর্তৃপক্ষের আবেগহীন টাকায় কেনা বড় ফুলের তোরা ছাড়া কারো হাতে কোনো ফুল নেই। সবাই এলোপাতাড়ি হাঁটছে। প্রাতঃভ্রমণের মতো করে কতক্ষণ হেঁটে অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে দাঁড়াই শহিদ মিনারের সামনে। চোখজোড়া তখন টলটল করছিলো অতীত ভেবে। ভাষা শহিদদের কথা ভেবে। সকল আক্ষেপকে একত্রে করে দাঁড়াই সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারদের সামনে। তখন সবচেয়ে বড় হয়ে উঠে হাবুর জোড় করে দেওয়া একটি গোলাপ না আনার আক্ষেপ। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি মাঠের এক কোণে। লোকজন কমতে থাকে। কিছু অতি সুন্দরী মেয়েরা তাদের সেজে আসাকে ক্যামেরা বন্দি করছে। তখনো মাইকে বাজছে- ‘আমার ভাইয়া রক্তে নাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি।’

দক্ষিণ সুনামগঞ্জ




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট