ষাঁড়ের লড়াই

 



ষাঁড়ের লড়াই 

রফিকুল নাজিম 


১.

বাহেরচরে আজ রঙ লেগেছে। সবকিছুতে একটা উৎসব উৎসব আবহ। মেঘনার পাড়ের এই গ্রামে আনন্দ দোলা দিয়ে যাচ্ছে। গ্রামে দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজনও আসছে। উৎসবটা যেন বাহেরচরের সকল মানুষকে একই সুতায় গেঁথে ফেলছে! আগামীকাল বাহেরচরের উত্তরপাড়া ও দক্ষিণপাড়ার মধ্যে ষাঁড়ের লড়াই হবে। একটা টমটম নিয়ে করম আলী সারাদিন গ্রামে ঘুরে ঘুরে মাইকিং করছে। ঠিক বিকেল ৩টায় স্কুল মাঠে এই লড়াই শুরু হবে।

করম আলীর মাইকিং শুনেই ছালেমা বশিরের হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। ষাঁড়ের লড়াইয়ের ঘোষণা শুনে তার মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল! অজানা একটা আশঙ্কা তার মনে কালো মেঘের মত দিগ্বিদিক ছুটছে। মেঘনার নয়া জলের মতই দুঃশ্চিন্তার ঢেউ তার বুকে আছড়ে পড়ছে।

- বশির, তুমি আমারে কতা দেও। তুমি এইসব লড়াই-ফড়াইয়ে যাইবা না।

- কও কী, ছালেমা! দীর্ঘ দশ বছর পর আবার আমাগো গেরামে আবার ষাঁড়ের লড়াই অইবো- আর আমি যামু না? আর এই লড়াইয়ের মূল আয়োজক তো তোমার চাচা!

- না গো, যাইবা না। আমার ডর লাগে। আর রজত চাচার মতিগতিও আমার কাছে ঠেকে না। হের মনে যদি কুনু কু-মতলব থাহে?

- আরে না। তোমার চাচায় জেলজুল খাইট্টা অনে ভালা অইয়া গেছে। আল্লা খোদার নাম লয়। হেয় আর আগের মত টেঁটাবাজ না।

- তবুও। তুমি আমারে কথা দেও। তুমি যাইবা না।

- আইচ্ছা। এইসব কতা রাখো ত। তুমি অহন বাড়িত যাও। কেউ দেখলে দুইজনের কপালেঐ দুঃখ আছে।

মুন্সি বাড়ির মেয়ে ছালেমা। সে রজত মুন্সির ভাতিজী। বাহেরচরের টেঁটা যুদ্ধের দুর্ধ্বষ যোদ্ধা এই রজত। দশ বছর আগে সামান্য কথা কাটাকাটি নিয়ে উত্তরপাড়া ও দক্ষিণপাড়ার মধ্যে টেঁটা যুদ্ধ হয়েছিল। বশিরের বাবাকে টেঁটা আর ছেনি দিয়ে নির্মমভাবে খুন করছিল এই রজত। সেই মামলায় রজতের সাত বছরের জেল হয়েছিল। মাসখানেক আগে ছাড়া পেয়েছে। এখন লম্বা জোব্বা পরে। তজবিহ হাতে আল্লাহ আল্লাহ জিকির করে। বশিরের বাড়ি উত্তরপাড়ায়। খাঁ বাড়ির পোলা। বাহেরচরের প্রভাবশালী এই দুইবাড়ির মধ্যে অনেক আগে থেকেই এই সাপে নেউলে সম্পর্ক। তারা টনটনা বাহুর শক্তি প্রদর্শন করেছে অনেকবার। হতাহতও হয়েছে বেশ কয়েকজন। হামলা মামলা। জেল-জুলুম। সবই এখন ইতিহাস। সেই টেঁটা যুদ্ধের পর বাহেরচরে আর কোনো টেঁটা যুদ্ধ হয়নি। বাহেরচর এখন শান্তির জনপদ। এই গ্রামে এখন রাতে বিজলি বাতি জ্বলে। আগের কাঁচা রাস্তাগুলো কালো কুচকুচে পিচে ঢেকে গেছে। এই চরাঞ্চলেও এখন সাঁইসাঁই করে চলে সিএনজি, টমটম। গ্রামে নতুন একটা হাই স্কুলও হয়েছে। ছেলেমেয়েরা এখন আর দা'য়ে শান দেয় না। টেঁটায় শান দেয় না। তারা এখন নিজের মগজকে শান দেয়। কালো কালো বর্ণের মাঝে খোঁজে আগামীদিনের স্বপ্ন। পূর্বপুরুষের কলঙ্কের দাগ মুছতে চায় তারা।

২. 

সকাল সকাল আজমত খাঁয়ের গোয়াল ঘর থেকে ফাটাকেষ্টকে চারজনে টেনে বের করেছে। গোসল শেষে সরিষার তেল মাখা ষাঁড়ের পিঠে সূর্য ঝিলিক মারে। গত দুই বছর ধরে আজমত খাঁ অনেক সেবা যতœ করে কালুকে লড়াইয়ের জন্য তৈরি করেছে। কালুর নামটা হঠাৎই গতকাল ফাটাকেষ্ট রাখা হয়েছে। খেলার মধ্যে হঠাৎ কালু নামটা শুনে যদি ষাঁড়ের মাথাটা বিগড়ে যায়! যদি মাইন্ড খায়! তখন তো খাঁ বাড়ির নাক কাটা যাবে।

ফাটাকেষ্টকে বাহারি ফুলের মালা পরিয়ে স্কুলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বশির। ফাটাকেষ্টর পেছন পেছন বাদকরা বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। তারও কিছুটা পেছনে উত্তরপাড়ার শত শত মানুষ হাঁটছে। দেখলে মনে হয় যেন কোনো নির্বাচনী মিছিল!

স্কুলের মাঠে লাল নীল কাপড়ের প্যান্ডেল। কড়ই গাছের ডালে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে মুখ করে বাঁধা দুইটা মাইকে মমতাজের গান বাজছে- ‘ফাইট্টা যায়।’ মাঠের ঠিক মাঝখানে চারদিকে বাঁশ দিয়ে ষাঁড় লড়াইয়ের জন্য মাঠ তৈরি করা হয়েছে। মাঠে হাজারখানেক মানুষের ঢল। গাছের মগডালে বসে আছে পাড়ার দুষ্টু শিশু কিশোরের দল। মহিলাদের জন্যও ব্যবস্থা করা হয়েছে পূর্বপাশে। বউঝিয়েরা নতুন কাপড় পরে সেজেগুজে এসেছে। মুন্সি বাড়ির ষাঁড়টি ইতোমধ্যে মাঠে গ্যাঁগো গ্যাঁগো করছে। শক্তির দিক থেকে সেও যে কম না- শিং দিয়ে মাটি খুঁড়ে তাই যেন সে জানিয়ে দিচ্ছে! 

করম আলী মঞ্চে ঘোষকের আসনে বসা। সে ঘোষণা দিতে শুরু করলো, ‘এখনই শুরু হতে যাচ্ছে বাহেরচর গ্রামের শতবষের্র ঐতিহ্যবাহী খেলা ‘ষাঁড়ের লড়াই’। দক্ষিণপাড়ার মুন্সি বাড়ির ডনের সাথে লড়বে উত্তরপাড়ার খাঁ বাড়ির ফাটাকেষ্ট। স্কুলের হাবিব মাস্টার এই খেলার রেফারি। তার হাতে বাঁশি। হাবিব মাস্টার বাঁশিতে ফুঁ দিতেই শুরু হয়ে গেল লড়াই। ষাঁড়ে ষাঁড়ে লড়াই। পাড়ায় পাড়ায় লড়াই। উত্তরপাড়ার ডন আক্রমনে গেলে উত্তরপাড়ার সবাই করতালি দিচ্ছে। তেমনি দক্ষিণপাড়ার ফাটাকেষ্ট আক্রমণে গেলে করতালি দিচ্ছে বশিরেরা। লড়াই চলছে সমান তালে। শক্তির বিচারে কেউ কারো থেকে কম না।

হঠাৎ মঞ্চের কোণায় কয়েকজনের জটলা পেকে গেছে। তর্কাতর্কি থেকে হাতাহাতি। দৌঁড়াদৌঁড়ি। যার যা কিছু আছে- তাই নিয়ে টেঁটা যুদ্ধে নেমে গেছে। বাহেরচর যেন ঠিক দশ বছর আগের দিনে চলে গেছে। বাতাসে মানুষের আর্তনাদ। গোঙানির শব্দ। রক্তের চোরানালা নেমে যাচ্ছে দক্ষিণের মেঘনার দিকে। রজত মুন্সির ছোড়া টেঁটা এসে বশিরের বাম হাতে বিদ্ধ হয়েছে। বশিরের চোখ সে দিকে না। সে এখন বুনো ষাঁড়ের মত গোঁগোঁ করছে। রক্তে তার তুফান উঠেছে। ডান হাতে তিনটা টেঁটা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে  বশির। হৈ হৈ করে এগিয়ে যাচ্ছে উত্তরপাড়ার সকল নারী পুরুষ। তাদের চোয়াল আজ আরো বেশি শক্ত ও দৃঢ়। তাদের চোখেমুখে দাবানল। ছড়িয়ে যাচ্ছে। ছাড়িয়ে যাচ্ছে রক্তে। বশিরদের আক্রমণ ঠিক সুবিধার মনে হয় না রজতের। তাই পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। বয়সের ভারে রজতের দমেও ভাটা এসেছে। রজত পড়ে আছে খোলা মাঠে। তার বুকের ওপর বসে আছে বশির। পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে সে আজ আকাশের দিকে নির্লিপ্ত চোখে কিছু একটা দেখছে। হয়তো তার পিতাকে কিছু একটা বলছে।

পিছমোড়া বেঁধে বশিরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। রাস্তার পাশ থেকে এসে বশিরের পথ আগলে দাঁড়ায় ছালেহা। তার হাতে টেঁটা। বশিরের রক্তেমাখা হাতের দিকে টেঁটা এগিয়ে দিয়ে বলে- ‘যাওনের আগে আমার বুকের মধ্যি এই টেঁডা মাইরা যাও।' কথাটা শোনার পর বশিরের চোয়াল আরো শক্ত হয়ে আসে। পুলিশের সাথে হাঁটতে হাঁটতে সে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। মেঘনার উন্মাতাল ঢেউয়ের শব্দকে ছাপিয়ে সে ছালেহার বিলাপ স্পষ্টতই শুনছে।


নরসিংদী। 



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট