অসময়ের অতিথি...

 



অসময়ের অতিথি

যাহিদ সুবহান


বাগদীপাড়ার আজকের সকালটা থমথমে। কিছু ঘটেছে হয়তো। তবে কী ঘটেছে তা কেউ জানে না। কিছু বোঝাও যাচ্ছে না। গতরাতে না কি খুব চিৎকার-চেচামেচি শোনা গেছে কমলের বাড়ির উঠোন থেকে। কমলের বউ গীতার চিৎকার শোনা গেছে। ওদের উঠোনের দিক থেকেই এসেছে এ চিৎকারের শব্দ। মাত্র চল্লিশ ঘর নি¤œশ্রেণির হিন্দু বসতী এই বাগদীপাড়ায়। চারপাশে মুসলমান পল্লী। নিশুতি রাতে কোন হিন্দুনারীর এমন চিৎকার গন্ডগোলের বছরের পরে এখনো কেউ শোনে নি। গন্ডগোলের বছর মানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর এমন ঘটনা ঘটে নি বাগদীপাড়ায়। যাদের বয়স পঞ্চাশের কোঠা ছাড়িয়েছে তারা হয়তো কিছুটা মনে করতে পারবে। যারা এ কালে জন্ম নিয়েছে তাদের সে কথা মনে থাকার কথা নয়। যাদের বয়স ষাট পেরিয়েছে তারা সে ঘটনা পুরোপুরি বলতে পারবে। অন্যরা হয়তো বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া সে ঘটনা ঘটেছিলো দিনের বেলা; ভর দুপুরে। তাই সেদিন ঠিক কী ঘটেছিলো সবাই বলতে পারে। আর গতরাতের ঘটনা ঘটেছে গভীর রাতে তাই কেউ কিছুই জানে না।

মুক্তিযুদ্ধের বছর অক্টোবর মাসের শেষের দিকে হবে। এই বাগদীপাড়ায় ঘটেছিলো এক নারকীয় ঘটনা। একদল হায়েনা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো বাগদীপাড়ার নিরীহ মানুষগুলোর উপর। ওরা পাকিস্তানী সেনা ছিল না; ছিল এদেশেরই স্বাধীনতাবিরোধী কিছু কুলাঙ্গার রাজাকার। চল্লিশ ঘরের প্রায় সব ঘরেই আগুন দিয়েছিল। লুটপাট করেছিল সব। সুন্দরী হিন্দু বালাদের কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল নদী চন্দ্রাবতীর তীরে কাঠালবাগানে। ওরা ক্ষতবিক্ষত করেছিল এইসব হিন্দুবালাদের সরল সতীত্ব। খুব নির্মম ছিলো সেদিনের বাগদীপাড়ার দুপুর। সেদিন নদী চন্দ্রাবতীর তীরে পড়েছিল কয়েকটি নারীদেহ। জীবন্ত অথচ নিথর! খুব হল্লা করে রাজাকাররা এই কাজে অংশ নিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যেন ওদের উৎসব চলছে। ফেরার সময় এই নরম কাদামাটির সরল আর অসহায় নারীদের ব্লাউজ ছিড়ে মাথায় বেধে উল্লাস করে ফিরছিলো। এ উল্লাস জয়ের। এ যেন ওদের যুদ্ধজয়ের চিহ্ন। এ যুদ্ধ ধর্মের! আর এই নারীরা গণিমতের মাল। এ বিষয়ে সেদিন বা পরে কেউ প্রশ্ন তুলেছিল কিনা জানা যায় নি। সে সময় অন্যায় বলে কিছু ছিল না। বরং সবই যেন ন্যায় এবং জায়েজ! প্রাণভয়ে সেদিন বাগদীপাড়ার হিন্দুরা যার যার মতো পালিয়েছিল মুসলমান পাড়ায়। বয়স বা অন্য সমস্যায় যারা পালাতে পারে নি তারা যার যার ঘরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল। প্রতিরোধ করা তো দূরের কথা কেউ টু শব্দও করতে পারে নি। সবাই ছিল অসহায় এবং নিরুপায়। ওরা শুধু ঈশ্বরকে ডাকছিল আর তার কাছে বিচার দিয়েছিল। ঈশ্বর সেদিন ওদের আকুতিতে সাড়া দিয়েছিলো কিনা জানা যায় নি। তবে একদল রাজাকার ফেরার পথে সেদিনই অমিতবিক্রমী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ধরাশায়ী হয়েছিল।

নদী চন্দ্রাবতীকে বাগদীপাড়ার নি¤œশ্রেণির এই বাগদীকূল গঙ্গার মতো পবিত্র মনে করে। ওরা মনে করে গঙ্গার মতো চন্দ্রাবতীর জলে ¯œান করলেও পূণ্য হয়। তারা নদী চন্দ্রাবতীকে তাদের জননীর মতো ভক্তি করে। বাগদীরা মরলে শ্মশানপোড়া ছাই তো এই চন্দ্রাবতীই গ্রাস করে। বিজয়ার দিনে মা দূর্গাকে এই নদীতেই বিসর্জন দেয় ওরা। বাগদীরা সারা বছর এই নদীতেই মাছ-শামুক-কাছিম-শাপলা-শালুক-কুইছে ধরে হাটে বেঁচে; নিজেরা খায়। বর্ষা এলেই খাঁ পাড়ার সব পাট এই নদীতেই জাগ দেওয়া হয়; ধোয়া হয়। এ কাজ বাগদীরাই করে। পাটধোয়ার কাজ করে দুটো পয়সা ঢোকে ওদের ঘরে। সারা বছরের চুলার পাটখড়িও জোটে এখান থেকেই। বাগদী গিন্নিদের তাই এ কাজে খুব জোর। নদীর উপর এখন বিশাল ব্রিজ হয়েছে। অথচ এই নদীর ঘাটপাড়ানির কাজ করতো এই বাগদীপল্লীর বাগদীরাই। এই নদীর সাথে ওদের শত বছরের সম্পর্ক। অথচ সেদিন সেই ভয়াল দিনে নদী চন্দ্রাবতীও নীরব ছিল। এই অসহায় মানুষগুলোর ডাকে সাড়া দেয় নি সে। 

বাগদীপাড়া ঘেষেই খাঁ পাড়া। এ গাঁয়ের সবচেয়ে বড় পাড়া। খুব কাছে হওয়ায় খাঁ পাড়ার লোকজনের সাথেই বাগদীদের সব কাজকর্ম, চলাফেরা। খাঁদের সব জমিজমাই এদিকে। চাষাবাদ-ঘরগেরস্থালী থেকে শুরু করে ব্যবসা আর সামাজিক অনেক কাজেই খাঁ পাড়ার লোকজন বাগদীদের উপর নির্ভরশীল। খাঁ দের ডানহাত-বাঁ হাত বাগদীরা। কী অর্থনীতি, কী সমাজ সকল সকল ক্ষেত্রেই আষ্টেপৃষ্ঠে আছে দু’পাড়া। অথচ তারা দুই ধর্মের; দুই শ্রেণির মানুষ!

এসব কারণেই বাগদীরা খাঁদের প্রতি খুব অনুরক্ত। ওদের দৃষ্টিতে খাঁ রা দেবতুল্য। খাঁ পাড়ার মুসলমানরাও বাগদীদের বিপদের সাথী মনে করে। তবে সব খাঁ কে তারা এক পাল্লায় মাপতেও চায় না। যেমন আছু খাঁ। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। লোকটার পোশাক চমৎকার। সাদা রঙের লন্ড্রি করা জামা, পরনে দামী কাপড়ের প্যান্ট, মুখে চাপদাড়ি। রাজনীতি করার সুবাদে অনেক সুন্দর করে কথা বলে থাকে। অপরিচিত কেউ হঠাৎ তাকে দেখলে এ গাঁয়ের সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষ ভাবতে পারে। তবে তা ঠিক নয়। আছু খাঁর সুনামের চেয়ে বদনামই বেশী। এলাকার মানুষের সাথে বাটপারী, গরীব মানুষের গমচুরি, ভাতার টাকা চুরি, কম্বল চুরির বদনামও আছে। আবার নারী কেলেংকারীর বদনামও আছে কিঞ্চিৎ। বাগদীপাড়ার সুন্দরী মেয়েগুলো আছু খাঁর আরাধনা। 

কমল এই বাগদীপাড়ার ভূমিপুত্র। এ পাড়ায়ই কোন এক ঘন বর্ষার দিনে সে জন্ম নিয়েছিল কহের বাগদীর ঘরে। কহের বাগদীও ছিল জাত বাগদী। সারাদিন তীর-ধনুক নিয়ে বুনো মানুষটা বনে বনে ঘুরতো। শামুক কুড়াতো, কাছিম মারতো, মাছ ধরতো। কমলও একই স্বভাব পেয়েছে। বাপকা বেটা আর কী। কমলের সুন্দরী বউ গীতা। যেমন সুন্দর চেহারা তেমনি শরীরের গঠন। দেখে বোঝার উপায় নেই যে নি¤œবর্গের বাগদীর বউ সে। সংসার কর্মেও গীতার কোন জুড়ি নেই। সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠে ¯œান সেরে তুলসীতলায় ধুপধুনো দেওয়া, রান্না করা, ঘুটে কুড়ানো, ঘরদোর গোছানো কত কাজ। আবার বাড়ির উঠোনে লাউ-কুমড়োর মাঁচা, উঠোনে শাক-লতার চাষ করে। নিজের সংসারের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বেঁেচ কিছু টাকা পায়। হাস-মুরগীও পোষে। টানাপোড়নের সংসারে একটু আয়েশ হয়। বর্ষার সময় অন্যদের মতো পাট ধোয়ার কাজ করে। খাঁদের খন্দের সময় ধান শুকানোর কাজ করে। উঠোন লেপা, ঘর-দুয়ার পরিষ্কার করা, বউ-ঝিঁদের ফরমায়েশ খাটে। এতো কাজ করে অথচ সামান্য ক্লান্তি নেই চোখেমুখে। ওদের দুজনের ছোট্ট সংসার ভালোই চলে। ওদের সংসার দেখে অনেকেই ঈর্ষা করে। কথার ছলে অনেকেই ওদের সংসারকে উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করায়। বলে ওঠে, ‘যাও গিয়ে দেখে এসো গীতার যেন লক্ষীর সংসার!’

চারিদিকে থৈ থৈ বর্ষার পানি। পাটপঁচা গন্ধে নদী চন্দ্রাবতীর দুই পাড়ের বাতাশ যেন রি রি করছে। বাগদীপাড়া থেকে খাঁ পাড়া সমস্ত পাড়ার কী মুসলমান, কী হিন্দু সব শ্রেণিপেশার মানুষ ব্যস্ত কাচা পাট কাটা, জাগ দেওয়া, পাটধোয়ার কাজে; পাট শুকানো কাজে। এই পাট শুকানোর পর মেপে গুটি বেধে ধলপ্রহরে পৌছাতে হবে মুলগ্রাম, চাটমোহর কিংবা গোড়রী হাটে। এই পাট বেঁচে খা পাড়ায় নগদ টাকা ঢুকবে, টাকা ঢুকবে বাগড়দীপাড়ায়ও। ব্যস্ততা সকলের। ব্যস্ততা কমল আর গীতারও। কমল সারাদিন খাঁদের পাটকেক্ষতে পাট কাটে। পাট জাগ দেয়। পাট শুকানো হলে মাপে, ধরা বাধে। সন্ধ্যায় গোসল সেরে কোনদিন উপেনের চায়ের দোকানে আড্ডা দেয় কোনদিন আবার এক হাতে টর্চ আর এক হাতে কোঁচ নিয়ে মাছ ধরতে যায়। মাঝরাত পর্যন্ত মাছ ধরে ঘরে ফেরে খালুই ভর্তি মাছ নিয়ে। গীতা খুশি হয়। সকালে কাজে যাওয়ার আগেই মাছ কুটে-বেছে রেখে যায়। নদী চন্দ্রাবতীর তীর উপচে পানি ঢুকেছে ধানক্ষেতে-পাটক্ষেতে। এই নতুন পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে কই-টাকি-ট্যাংরা মাছ। এসব তাজা মাছ কমলের বাবার কাছ থেকে পাওয়া নেশাকে জাগ্রত করে। সে ঘরে থাকতে পারে না, ছুটে যায় নদী চন্দ্রাবতীর যৌবন ছিটিয়ে রাখা তীরে। আজন্ম কৈবর্ত বলে কথা; আজন্ম জেলে সন্তানবলে কথা!

একদিন রাতে পাড়ার কয়েকজনের সাথে মাছ ধরতে বের হয় কমল। এক হাতে কোঁচ আর এক হাতে বৈদ্যুতিক টর্চ লাইট। রহিম খাঁর কাছ থেকে মাছ ধরার জন্য টর্চলাইটটা ধার চেয়ে এনেছে সে। লাইটটি বিদেশ থেকে আনা। রহিম খাঁর বড় ছেলে সৌদি আরব থাকে সেই পাঠিয়েছে। টর্চের আলো যেদিকে পড়ে মনে হয় দিনের মতো পরিষ্কার। মাছ ধরতে ধরতে রাত গভীর হয়। নিশুতি রাত; পুরো বাগদীপাড়া ঘুমিয়ে। গভীর রাতে বাড়ির পথে হাঁটা দেয় কমলরা। বাগদীপাড়ায় ঢুকতেই একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ায় কমল। এই কণ্ঠ তার চেনা; এই কণ্ঠ গীতার। কমলের উৎকণ্ঠা বাড়ে। কমল মাছভর্তি খালুই, হাতে টর্চ আর কোঁচ নিয়ে দৌঁড়াতে থাকে বাড়ির দিকে। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে দরজায় টর্চের আলো ধরতেই কমল আবিষ্কার করে এক ভয়াবহ দৃশ্য। রহিম খাঁর ঝোপ পরিষ্কার করার রামদা হাতে নিয়ে দরজা সামনে একজন পুরুষ মানুষকে তেড়ে আসছে গীতা। চোখগুলো রাগে আগুন হয়ে আছে। যেন কালীমূর্তি ধারণ করেছে। এখনই হয়তো কোপ দেবে লোকটির ঘাড়ে। গীতা চিৎকার করে বলছে, ‘শুয়োরের বাচ্চা, তোর এতো বড় সাহস, তুই আমার ঘরে ঢুকিস!’ 

একটা লোক গীতার ঘরে ঢুকেছিল। বাংলার গাঁয়ের সরল কোটি নারীর মতো বাগদীপাড়ার এক সরল হিন্দুবালার সতীত্বের কাছে হার মেনেছে তার লোলুপ দৃষ্টি। কমল সব বুঝতে পারলো। প্রিয়তমা স্ত্রীর এই অপমান মেনে নেওয়া যায় না। কমল বাম হাতে টর্চ লাইট আর ডানহাতে কোঁচটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে গেল। মুখে টর্চলাইটের আলো পড়ায় ভয়ে জড়োসরো হয়ে পালাতে থাকা লোকটা হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য মুখ ঘুরালো কমলের দিকে। কমল থমকে দাঁড়ালো। লোকটি কমলের খুব পরিচিত। শুধু কী কমলের; এ পাড়ার সবাই লোকটিকে চেনে। সেই মুখ, সেই জামা-প্যান্ট, সেই চাপদাড়ি। কমল নিজেকে বিশ্বাস করতে পারলো না। শুধু অস্ফুট ভাষায় বলে উঠলো, ‘খাঁ সাহেব আপনি!’   


আটঘরিয়া, পাবনা।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট