গাঙ পাড়ের প্রেম

 

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


গাঙ পাড়ের প্রেম

মিসির হাছনাইন 


চাঁদপুরের তিন কি সাত নদীর মিলিত ¯্রােত মেঘনা নাম নিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। বেড়ীবাঁধের পুবে বিশাল বড় খরস্রোতা মেঘনা নদী আর পশ্চিমে গ্রাম উত্তর চাঁচড়া, যেখানে কয়েক সংখ্যক নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বাস। আর এই বেড়ীবাঁধে ঘর তুলেছে হাজার হাজার ভূমিহীন পরিবার। এরা পুরোপুরি নদীর উপর নির্ভরশীল। নদীর মাছেই তাদের জীবন-জীবিকা। 

পুবের মেঘনা মারমার করে ভাঙ্গছে, হয়তো পশ্চিমের তেঁতুলিয়া নদীর সাথে মিশতে চায়। ছোটকালে দাদীর মুখে শুনেছি মেঘনা আর তেঁতুলিয়া ভাইবোন। তাই মিলনের জন্যে দুপাশ থেকে সমান তালে ভাঙ্গছে।

গ্রামের মধ্যবিত্তরা উপজেলা শহরে কিংবা একটু পশ্চিমে গিয়ে ঘর তুলছে, আবার নতুন বেড়ীবাঁধ হয়, ভূমিহীন জেলে পরিবার আবার নতুন ঘর তোলে। 


এই অঞ্চলেরই বেড়ীবাঁধে ঘর কাঞ্চন মাঝির। সেই দাদার আমল থেকে বেড়ীতে নিবাস তাদের। তাঁর চার ছেলে, দুই মেয়ে। ইলিয়াস সবার বড়, ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছি, মনে আছে স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি। তারপর ইলিয়াস আর পড়াশোনা করছে কিনা, জানি না, আমরা চলে গেছি উপজেলা শহরে।


তারপর যখন জেলা শহরে অর্নাসে পড়ি, তখন একবার গ্রামের বাড়ি আসা হয়, গাছ বিক্রির জন্যে, নদী তখন আমাদের বাড়ি ভাঙ্গে। সেবার ইলিয়াসের সাথে এই দেশ-গ্রামের নৌকা-নদীর নানান হাবিজাবি কথাবার্তায় খুব একটা ভালো খাতির হয়ে ওঠেছিল আমাদের। বলেছিলাম- সময় করে আবার আসবো। ইলিয়াস বলছিল- মিয়াভাই, বিয়া করলে ফোন দিমু, আপনারে আসতেই হইবো।


তার বহু বছর পর আজ ইলিয়াসের সাথে দেখা। সন্ধ্যার একটু পর বেড়ীবাঁধের উপর বসে নদী দেখছি- ঐ তো ওখানে ছিল আমাদের বসতভিটা, আজ তা নদীর পেটে, ইশ! নদী যদি আর না ভাঙতো, যদি নদীর ভাঙ্গন জাপানিদের মতন রোধ করা যেত,  গ্রামের জেলেদের একি হাল অবস্থা, এসব হাবিজাবি চিন্তায় যখন সিগারেট টানছি হঠাৎ ইলিয়াস ডাক দেয়..


- কি অবস্থা শফিক ভাই, কেমন আছেন? দেশ গ্রামের কথা ত ভুলেই গেছেন। কবে আইলেন, কই থাকেন এখন। ঢাকাত নাকি অন্য জায়গায়.. আপনার আব্বা আম্মা কেমন আছেন..?? আর এখন....

আমি কথা না বললে হয়তো আরো শ খানেক প্রশ্ন শুনা লাগত। বললাম-

- ইলু ভাই, ভালো আছি, আব্বা-আম্মাও ভালো আছে। কাছে আইসা বসো। কথা বলি, সব বলবো। আগে বলো, তুমি ভালো আছো ত? শুনলাম- বিয়াশাদি করছো।

- হ, ভাই আছি, গরিবের আর ভালো। আপ্নে যে হে গেলেন আর বলছিলেন আবার আসবেন.. বিয়া করছি, আপনারে খবরও দিতে পারি নাই। খুব ইচ্ছা আছিল আমার বিয়েতে আপনারে দাওয়াত দিমু। পারি নাই!!

- আরে ব্যাপার না ইলু ভাই। ত ভাবী কেমন আছে? পরিবার নিয়া নাকি নতুন ঘর বাঁধছো।

- হ, ভাই। ঐ যে ঐডা আমার ঘর। আছে বেক্তে ভালা আছে। পোলা হইছে, নাম রাখছি লালচাঁন। আল্লাহর রহমতে ভালো রাখছে আল্লাহ। 


তারপর নানান কথাবার্তায় আমাদের আড্ডা শুরু হয়, আমরা এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নদীর পাড়ে ইলু ভাইর নৌকায় গিয়ে বসলাম। পৃথিবীর সব মানুষের জীবন নিয়ে হয়তো লেখা যাবে এক একটা দীর্ঘ উপন্যাস, কত অদ্ভূত মানুষের জীবন, কত না জীবন চরিত্র পৃথিবীতে ঘুরছে। আমি এই মানুষটার ক্ষুদ্র জীবনের ঘটে যাওয়া অল্প কিছু দারুণ সত্য কাহিনী, সে বলেছে আমি লিখেছি। হয়তো একটা ছোটখাটো গল্পের মতন হয়ে যাবে। ইলু ভাই আপনি বলেন.. আমি লেখা শুরু করলাম-


ভাই, ওরে আমি প্রথম দেখি- আমগো ঘরের পাশে মামাগো ঘর, ওখানে উঠান বলতে বেড়ীবাঁধের ঢ্যালে নারিকেল গাছ তলায়। দেখার সাথে সাথে আমি অজ্ঞান হয়ে গেছি, ভাই, তামাম পৃথিবীটা মনে হয় উল্টে গেছে, বুকের ভিত্তে কেমন জানি করতে ছিল। শুধু মনে হইছে মেয়ে মানুষও এতো সুন্দর হয়!! কিছুক্ষণ পর, জেগে দেখি সেও আমার অজ্ঞান হওয়া দেখতে আইছে, আমি চোখ খুলেই তারে দেখলাম। উঠলাম, ভয়ে আমার বুক ধুকপুক করতেছিল, আমি ঘরে গেলাম। একটা শার্ট গায়ে দিয়ে বের হয়ে দেখি, মামাতো বোন আর সে মামাগো পানিফল গাছের নিচে দাঁড়ায় আছে। আমার ভয় লাগতেছিল, যদি মেয়েটারে আমি আর না দেখি- আমি দৌড়ে গেলাম, আমার আসা দেখে সে দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। 

আমি মামাতো বোনকে ডাকতে লাগলাম- লিপি, লিপি ও লিপি.. বাহিরে আয়.. লিপি আসলো, বললাম- ওরে ডাক দে, নিয়া আয়, বল যে ভাইয়া, কি কথা বলবে। লিপি চলে গেল, আমি দাঁড়ায় আছি, ভয় লাগতেছে যদি না আসে.. কিছুক্ষণ পর লিপি আসলো, বললাম, কিরে ও কই.?? লিপি বলে, ও আসতে চায় না, আমি বললাম, বল যে, জরুরি কথা বলবে, আসতেই হবে, জাস্ট দুই মিনিটের জন্যে, আর বলবি যে না আসলে আমি মারা যামু। 

লিপি চলে গেলো, ভাই, কিছুক্ষণ পর সে আসলো.. আমার যে কেমন লাগতেছিল আপ্নারে কেমনে বুঝায়!!

আমি বুঝতেছি আপনার অবস্থা! তারপর.. কি হল-

আমি খপ করে তাঁর হাত ধরলাম। তারপর বললাম, আমার চোখের দিকে তাকান, আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে, হাত ধরেই বলতেছি, ‘আপ্নারে ছাড়া আমি বাঁচুম না’, আমি তার হাত আমার মাথায় দিয়া বলতেছি, বলেন- ‘আমারে ছাইড়া কোথাও যাইবেন না। আপ্নারে আমি সারাজীবনের জন্যে পাইতে চাই’। ভাই, সে এক ঝাটকা দিয়া হাত ছাইড়া ইশ! বলে দৌড় দিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকলো। চোখের পলকে হাওয়া। সেদিন তাঁর এই ভাবে চলে যাওয়াতে আমার প্রচুর রাগ হইছে। আমি কি সব ভাবতে ভাবতে আমগো ঘরের দিক গেলাম।


কিছুসময় পর আমি কি জানি ভেবে লিপির খোঁজে বের হইলাম। ডাকতে লাগলাম লিপিরে। ভাই, মনে এতো রাগ লাগতেছিল যে লিপিরে খুঁজে পাই না, দাঁতে দাঁত রাইখা- লিপির বাচ্চা লিপি কই গেলি!! শেষে দেখি, বেড়ীর উপরে উত্তর দিক থেকে আসতেছে। আমি ডাক দিলাম, লিপি আসলো-

- কে রে এই মেয়েটা?? তোর সাথে এতো ভাব। তাড়াতাড়ি বল তাড়াতাড়ি বল..

- কেন তোরে কমু কেন?? তুই জেনে কি করবি??

- শুন লিপি, তুই ভাইয়ার কাছে এক জোড়া দুল চাইছিলি না, তোরে কালকেই আইন্না দিমু, বল না, কে এই মেয়ে..

- সত্যি দিবি ত..!! এর আগেও বলছিস দিবি কিন্তু দেস নাই।

- আরে দিমু, দিমু, দিমু। বলছি ত দিমু, তুই বল, কে ও, কোনহানে বাড়ি অগো..??

- আল্লাহ কেমন করতেছে, কইতেছি ত.. ওর নাম ঝুমুর। আমার লগে মাদ্রাসায় পড়ে। বাড়ি মাদ্রাসার পিছনে বেড়ীর উপরে, ঐ যে চুকু মাঝি আছে না হেইতের মাইয়্যা। এবার ক, আমার জন্যে দুল আনবি..?

- তুই এবার কোন ক্লাসে জানি পড়স?? আরে কইছি ত আইন্না দিমু। 

- ক্লাস নাইনে উঠছি এবার।

- এখন হুন, ওরে কাইলকাও আমগো বাড়ির এদিকে নিয়া আইবি, বলবি যে কি জানি বলবে ভাইয়া। আমি আজকেই ছবিগঞ্জ হাঁটের তন তোর লাই দুল নিয়া আমু।

- ঠিকাছে, আমি যাই, মা সে কোনসুম থেকে ডাকতেছে। 

লিপি দৌড় দিয়া ঘরে ঢুকলো.. আমি জোরে ডাক দিয়া বললাম, মনে কইরা নিয়া আসিস, ঝুমুররে..

মনে হয় একটা অস্পষ্ট আওয়াজ আসছে- আইচ্ছা।।


ভাই, আমি গিয়া গোসল করলাম। বুঝ হওয়ার পর থেকে আমি দুই এক শুক্রবার ছাড়া জীবনেও নামাজ পড়ি নাই। সেদিন আমি মসজিদে গেলাম, নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে কইলাম, আল্লাহ আমি যেন ওরে (ঝুমুররে) পাই। মাবুদ আমি তোমার কাছে আর কিচ্ছু চাই না, শুধু ওরে আমার করে দিও। মসজিদ থেকে বের হয়ে ঘরে গেলাম, ভাত খাইতে পারতেছি না, শুয়ে থাকতে পারতেছি না, শরীরডার মধ্যে খালি কেমন জানি করতেছিল, কেমনে বুঝাই ভাই, খালি মনে হইতেছে আমার কি জানি নাই..!!


আমি সিগারেট টান দিয়া তারে দিলাম। বললো, ভাই এখন খামু না, আপ্নে খান। কি বুঝে আবার কইল- দেন, দেন। দিলাম, একটান দিয়ে সিগারেট আমারে দিয়া কইল, হুনেন তারপর কি হইছে.. সেদিন রাতে আমি আর গাঙে যাই নাই, মা কয়- কিরে তোর কি হইছে, গাঙে যে গেলি না। বললাম, কিছু না, একটু খারাপ লাগতেছে, ঠিক হইয়া যাইবো। মা গায়ে হাত দিয়া দেখলো। তারপর চলে গেলো। আমি সারাটা রাত একটু ঘুমাইতে পারি নাই, শুধু ভাবছি কাল কি ও সত্যি আইবো, যদি না আসে.. ভাই এসব ভাবতে ভাবতে আর ঘুম আসে নাই। খালি চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় ওরে দেখি...। সকালে খেয়েধেয়ে মামাগো বাড়ি যাই, ডাকি, লিপি, লিপি ও লিপি। মামানি ঘর থেকে কয়, লিপি মাদ্রাসায় গেছি। আমি বলি, আচ্ছা মামানি, কখন আইবো?? 

আর কোন সাড়াশব্দ নাই, আমি এর কিছুক্ষণ পর গাঙে গেলাম। ভাই, কি মাছ ধরুম, আমার মন পইড়া রইছে কখন ঘাটে যামু.. লিপি বুঝি মাদ্রাসা থেকে চলে আসলো, এসে যদি না পাইলো!! আমি ঘাটে ভাগী মোল্লারে মাছ বিক্রি করতে দিয়া সোজা বাড়িতে আসলাম। প্রথমে লিপিদের ঘর তারপরই আমাদের ঘর। এসেই লিপি, লিপি ও লিপি। মামানি ডাক দিল, কিরে ইলিয়াস, মাছ পাইছস কয়ডা?? পাইছি চার হালি। লিপি কই মামানি?? লিপি ত মাত্র প্রাইভেটে গেছে।


আমি আমগো ঘরে গেলাম। হাত মুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে আব্বার পুরান সাইকেল দিয়া লিপির জন্যে ছবিগঞ্জ থেকে দুল নিয়া আসলাম। দুল নিয়া বেড়ীর উপরে দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে আছি, কখন আইবো লিপি, কখন প্রাইভেট শেষ হইবো, ভাই, সময়ই কাটতেছে না, কেমন যে লাগতেছিল, মনে হয় পৃথিবীতে ঘড়ির কাটা আটকায় গেছে.. শেষে অনেক পরে আসরের একটু আগে দেখি লিপি একা একা আইতেছে..আমি দৌড় দিয়া লিপিরে জিগ্যেস করলাম, কিরে, ঝুমুর কই? তোরে না কইছি ওরে নিয়া আসতে...

- ভাইয়া, ঝুমুর আইতে চাইছে। অগো বাড়িতে ঢাকা থেকে ওর বড় দুলাভাই আইছে.. তাই স্যারের তন ছুটি লই আগে আগে চলি গেছে। 

- এই ল তোর দুল। তোরে ঝুমুর কিছু কইছে..??

- অনেক সুন্দর। হ, কইছে তুই নাকি হেরে ছাড়া বাঁচবি না। তুই কি সত্যি ওরে ভালোবাসিস ভাইয়া..??

- ওরে লিপিরে তোরে বুঝাইতে পারুম না, আমি ঝুমুররে ছাড়া বাঁচুম না। তুই এখন যা.. ঘরে যা, সন্ধ্যা হয়ে গেছে.. কাইল মাদ্রাসা যাবি না??

- হ যামু ত। এই বলে লিপি ঘরে ঢুকবে, আমি আবার ডাক দিলাম, লিপি শোন, তোর খাতার কাগজে ভাইয়ার ফোন নাম্বার লিখে ঝুমুর রে দিয়া দিস। আর এই ল ওর জন্যেও একজোড়া দুল আনছি..


ভাই, আমি তখন একটা বাটন সেট চালাই। নদীত গিয়া আমার যা ইনকাম হইত তার পুরাটাই আমি খরচ করতাম, মাঝে মইধ্যে আব্বারে কিছু দিতাম আর মার জন্যে পানটান কিনে আনতাম। তখন বিড়ি সিগারেট কিচ্ছু খাই না। ভাই, রাইত ত শেষ হয় না, কখন লিপি যাইবো, ফোন নাম্বার দিবো, এসব চিন্তায় ঘুম আইয়ে না। তারপর কোনসুম যে আব্বা ডাক দিল, গাঙে যাইতে, গাঙে গেলাম.. গাঙ থেকে আইলাম দুপুরে.. এখন লিপি ত মাদ্রাসায়, আইবো আসরের সময়। ঘরে গিয়া ঘুমায় পরলাম। 


ঘুম থেকে উঠছি সন্ধ্যার সময়। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে আমি ফোন দেখি, যে কোন ফোন আইছে কিনা। কই, কোন ফোন ত আসে নাই। আমি মনে মনে ভাবলাম তাহলে লিপি নাম্বার দেয় নাই, নাকি দিতে ভুলে গেছে বোধহয়। আমি তাড়াতাড়ি ওঠে মুখ না ধুয়েই মামাগো ঘরে গেলাম, দেখি- লিপি পড়তেছে.. আমি লিপির পাশে বসলাম, বললাম, কিরে নাম্বার দিসত নি? লিপি বলে- দিসি ত। ফোন দেয় নাই?? আমি কইলাম, কই না ত কোন ফোন টোন আসে নাই।


ভাই, ফোনটা বাজলেই এই বুঝি ঝুমুর ফোন দিছে। যখন দেখতাম না, এটা ঝুমুর না, মেজাজটা যা গরম হইত। আর কথাই বলতে ইচ্ছা হইত না। কি যে করি ঝুমুর কেন ফোন দিতেছে না, ভাবছি, ও ত পারে, ঘরের একটা ফোন থেকে একটু ফোন দিতে। আবার ভাবি, হয়তো ভয়ে ফোন দিতেছে না। এই বলে নিজেরে সান্ত¡না দিতেছি.. আর সারা দিন রাইত শুধু চোখের উপর ঝুমুররে দেখি, ভাই ওরে না পাইলে বোধহয় আমি মরা মানুষ এই রকম অবস্থা আমার।


এইরকম করে বিশাল এক অস্থিরতার মধ্যে আমার দিন কাটতেছে, দুইদিন কি তিনদিন লিপির কাছে ওর কথা শুনতেছি, কি কি বললো, ও নাকি শুধু, আমি কেমন আছি এই কথা জিজ্ঞেস করতো। আর আমি লিপিরে সবসময় বলতাম, ওরে আমগো এদিকে আসতে বলিস, আর বলিস আমি কেমন আছি নিজের চোখে দেইখা যাইতে। আমি দুইদিন ঝুমুর গো বাড়ির ঐদিকে গেছিলাম, কিন্তু ঝুমুরের দেখা পাই নাই। তারপর দুইদিনের জন্যে আমরা পুবের গাঙে গেছি মাছ ধরতে, ভাই, দিন গুলো যে কেমনে কাটাইছি আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে। পরে যেদিন আইছি দুপুরে, সাইকেল দিয়া মাদ্রাসায় গেছি, যাইয়া দেখি ছুটি হয়ে গেছে, পরে আসার পথে লিপির কাছ থেকে শুনি, ও নাকি দুইদিন যাবৎ মাদ্রাসায় আসে না। ভাই, হঠাৎ কি যে একটা খারাপ লাগা আমার ভিতরে শুরু হইলো, আমি ভাবলাম কোন অসুখ টসুক হইলো নাকি। আমি লিপিরে বললাম, লিপি তুই যা, ওর বাসায় যা.. হ, এখনই যা, আর এই ধর তিনশ টাকা, কিছু বিস্কুট টিস্কুট কিনে নিয়া যাইস।


সন্ধ্যার সময় ঘর থেকে বের হইছি। দেখি ঝুমুর আর লিপি আমগো বাড়ির দিকে আসতেছে.. আমি দৌড়ে গেলাম, বললাম, লিপি তুই ঘরে যা.. 

- আসসামুলাইকুম। কেমন আছেন..??

- আমি যে কেমন আছি, কেমনে বুঝাই তোমারে, রাইতে দিনে ঘুম আইয়ে না, নদীতে, ঘরে কোন জায়গায় মন টিকে না। শুধু তোমার কথা মনে আইয়ে.. তুই কেমন আছো, ঝুমুর??

- আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। ওমা! কি কন এগুলা।

- হাছা কইতাছি ঝুমুর, তোমারে ছাড়া আমি বাঁচুম না। আমার জান প্রাণ সব তুমি। মনডা চায় সারাক্ষণ তোমারে নিয়া থাকি।

- হাছা নি.? কয়দিন পর ত ভুলি যাবেন!!

- আস্তাগফিরুল্লাহ। কি কও এগুলা, আল্লাহ না শুনুক। লিপি তোমারে ফোন নাম্বার দিছে..??

- হ, দিছে, কিন্তু ভাবীর ফোন থেকে ফোন দিতে পারি নাই ডরে..

- এই লও, এই ফোন আজ থেকে তোমার। আমি নতুন একটা সিম কিনে লিপির কাছে দিমু। আর আমি বাজারে গিয়া নতুন ফোন কিনে নিমু।

- আইচ্ছা, ঠিকাছে, এখন যাই, ম্যালা রাইত হইছে।

- তুমি কি আজকে লিপিগো বাড়িত থাকবা..?

- হ, থাকমু।

- ঠিকাছে যাও। রাতে দেখা করবো...


এই কথা বলার আগেই ঝুমুর নাই, কি সাত পাঁচ ভেবে আর রাতে দেখা করতে যাই নাই। কখন যে ঝুমুর আমগো এদিক থেকে চলে গেছে নিজেও জানি না।


ভাই, সেদিনের মতন খুশি আমি আমার জীবনেও হই নাই। ঘুম থেকে ওঠেই বাজারে গেছি, ষোলশ টাকা দিয়া একটা নতুন ফোন আর একটা গ্রামীণ সিম কিনে আনছি। সারাদিনে মনে হয় হাজার বার ফোন দিছি, সন্ধ্যার একটু পর ফোন রিসিভ করছে, সেই প্রথম পাঁচ মিনিটের মতন কথা হইছে। ভাই, তারপর থেকে এই ফোনের পিছনে যে আমি কত টাকা খরচ করছি তার কোন হিসাব নাই। দোকানদার দুলাল ঐ যে কাটাখালীর ফ্লেক্সিলোড, ওরে বলে রাখছি- যখনই লোড লাগবে সাথে সাথে লোড দিতে, যত টাকাই হয় আমি দিনকে দিন পরিশোধ করে দিবো।

তারপর থেকে আমার ফোনে কথা কওয়া শুরু, একটু পর পর ফোন দেখতাম ইশ! কখন ঝুমুর মিস কল দিবে, কখন তার সময় হবে। ভাই, এই রকম চুরি করে কথা বলতে বলতে একদিন, ঝুমুর ওর ভাবীর কাছে ধরা পড়ে। আমি ওরে বললাম, তুমি তোমার ভাবীরে সব খুলে বলো। ও ভাবীরে সব বলছে, মিছা কথা কমু না ভাই, ওর ভাবী যথেষ্ট হেল্প করছে। তারপর থেকে আমাদের কথা বলা আরো বেড়ে গেছে.. খালি মনডা চাইত কখন ঝুমুররে কাছে পামু, একটু আদর করমু।


কত কথা যে ফোনে বলতাম, ভাই, আল্লাহ জানে এতো কথা কই থেকে নাযিল হইত। আমি ওরে নিয়া ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতাম, বলতাম, বেড়ীর উপরে আমাগো ঘরের পাশে আমাদের একটা নতুন ঘর হইবো, আর একটা নৌকা করবো, দেইখো- দুজনে কত সুখে থাকবো। ও শুধু বলতো, আল্লাহ, তাই যেন হয়।


ভাই আমি যেমন কইরা কইতাছি, আপ্নের তেমন কইরা লেখতে হইবো না, আপ্নে আপনার মন মতন সাজাই সাজাই সুন্দর করে লেখবেন।

একবার বলতে চাইছিলাম- ভাই, আমি ত লিখতেই জানি না, তারপর গুছিয়ে আবার সুন্দর করে কেমনে লিখবো!! তাও কোথাও কোথাও আঞ্চলিক আর বইয়ের ভাষায় গুরুচন্ডালী হয়ে যাচ্ছে।  

তারপরও লিখছি, ইলু ভাই, আপনি বলেন... 


২.


পরের কথা আর কইতে ভালো লাগতেছে না ভাই। আরেকটা সিগারেট ধরান। আমি সিগারেট ধরাই, এক টান দিয়া, ইলু ভাইরে দিলাম। 

মনে মনে ভাবছি, ইলু ভাই যদি আর না বলে, আমি পাঠক রে কি বুঝ দিমু..!! এই পর্যন্ত শেষ.. পাঠক তো তা মেনে নিবে না। গল্পের শেষ চাইবে..

হঠাৎ ইলু ভাই বলে উঠলো...

ভাই, তারপরে আর কি কমু!! আমি ওর জন্যে যা ইচ্ছা তাই করতে পারতাম, এই জীবনে বহু কিছু আমি ওরে দিছি, শুধু এই পোড়া কলিজাডা খুলে দিতে পারি নাই, যদি দেওয়া যাইত, তা ও দিয়া দিতাম। ইলু ভাই দেখাইলো, বুকে আর হাতে এসিড দিয়া পুইড়া ‘ঊ+ঔ’ লিখছে। বললাম, ভাই কেমনে সম্ভব!! ভাই হাসে আর কয়, একটুও কষ্ট হয় নাই। বলে, আমি জানতাম, ও আমারে মন থেকে ভালোবাসছে.. আমিও ওরে প্রাণের চাইতে বেশি ভালোবেসে ফেলছিলাম। তার কারণেই সব পারছি ভাই, আরো যে কত কি করছি, এতোকিছু আপনারে না কই, আপনার লিখতে কষ্ট হইবো।

আমি বললাম, আরে না, ইলু ভাই, আপনি বলেন.. সব লেখা হয়ে যাচ্ছে..তারপর কি হইলো, বলেন না, শুনি...


তারপর আর কি কমু ভাই। আমি দেখলাম ইলু ভাই তারপরের কাহিনী আর বলতে চাইতেছে না, জোর করবো? না। করলাম না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সিগারেটে টান দিয়া নদীর পানিতে ফেললো ফুস করে একটা শব্দ হলো। তারপর বললো ভাই, শুনেন..

- হ্যা, আমি শুনতেছি... আপনি বলেন..

এরপর ঝুমুর অনেক বার লিপিগো বাড়িত আইছে, আমি ওরে নিয়া মাঝ রাইতে নৌকার ভিতর শুইয়া ছিলাম অনেক রাইত শুধু আমি আর ঝুমুর, ভাই নদীর নৌকা আর নোনতা এই গাঙের পানি সাক্ষী .. এই ত, এই যে এখানে এই নৌকায় সারারাত আমরা নদীতে ভাসতাম, যদিও এসব কিছুর পিছনে লিপি যথেষ্ট হেল্প করেছে, ওর কারণেই সম্ভব হইছে। 

ভাই, সত্য কইতাছি ঝুমুরের সাথে আমার সব হইছে.. বুঝছেন ত..?

- হ্যা, আমি বুঝছি, আপনি বলেন...


তারপর একদিন হুনি আমার বিয়া ঠিক হইছে। কবে, কই, কার সাথে কিচ্ছু জানি না। আমি মনে হয় আকাশ থেকে পড়লাম, আমার বিয়া আমারই খোঁজই নাই.. অথচ মেয়ে দেখাও নাকি হয়ে গেছে.. ঐদিনই আমি ঝুমুররে সব বলছি, ঠিক করলাম, আমরা পালিয়ে কোথাও চলে যাবো। ঝুমুর বলছিল, তুমি আমারে যেখানে নিয়া যাবা আমি সেখানে যাইতে রাজি এবং সবসময় এক পায়ে রেডি আছি। 

আমি ওর কথা শুনে, হাসলাম।


ভাই, ভুলডা আমারই হইছে, আমি ঐদিন ঘরে শুয়ে শুয়ে কথা বলছিলাম, মনে হয় আব্বা হুনছে..

রাতে কথাটথা শেষ করে কখন যে ঘুমাইছি, ঘুম থেকে ওঠে দেখি আমার হাত পা সব চকির সাথে বাঁধা। পাশে ফোনও নাই..(পরে হুনছি ফোন নাকি আব্বা ভাইঙ্গা গুরা গুরা করে পানিতে ফালাইছে।) আব্বা বেড়ীর উপর থেকে চিল্লাইয়া কয়, ওর বান্ধন কেউ খুলবি না। যে খুলবি ওর কল্লা কাডি হালামু। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম কাল রাতে ত ঝুমুররে বলছি আজকে বিকেলে লঞ্চ ঘাট থাকতে আমরা ঢাকায় চলে যামু। এখন কেমনে কি!! কিচ্ছু না বুঝেই আমি চোখ বুজে মারে ডাকলাম, সব ঘটনা খুলে বললাম। 

-মা কয়, এই সম্পর্ক তোর বাপ জীবনেও মেনে নিবে না, হয় তোরে কাইট্টা নদীত ভাসাই দিবে। 

- আমি কইলাম, তাহলে তাই করো, কাইট্টা কও নদীতে ভাসাই দিতে, মা খালি কাঁদতেছিল.. 

বললাম, ঝুমুর রে না পাইলে এই জীবন রাইখ্যা কি লাভ। ভাই, এই কথা শেষ হইতে না হইতেই আব্বা বেড়ীর ঢ্যালে বেগুন ক্ষেত নিড়ানি দিতেছিল, ঐ কোদাল দিয়েই আমার মাথায় এক বাড়ি। তারপর মনে হয় আমি মরা গেছি, আমার কোন হুশ নাই..


(পরে জানছি, আমি যখন মায়ের পেটে তখন একবার গাঙে চুকু মাঝি নাকি আমগো জাল কাইট্টা নিয়া গেছে। এই নিয়া অনেক ঝামেলা হইছে, এলাকায় বিচার সালিশ শেষে থানা হাজত পরে নাকি মামলা মোকদ্দমাও হইছে। চুকু মাঝি নাকি কুড়াল নিয়া আব্বারে মারতেও আইছিল। ঘুস দিয়া আব্বারে জেলে পাঠাইছে... আমার জন্মের পরও ঘরে প্রচুর অভাব ছিল, এক বেলা খাইতে পারছি কি পারি নাই, মানষের বাড়িত গিয়া ভাতের ফেন খুঁজে খুঁজে মা আমগো সংসার চালাইছে..)


যেদিন আমার হুশ হইছে, মনে পড়ছে (ঝুমুররে যে বলছি) বিকেলে লঞ্চঘাটে যাইতে আমরা ঢাকা যামু। এর পর দেখি আমগো ঘরে লিপি, ভাই, আমার মামাতো বোন লিপি এখন আমার বিয়া করা বউ। আমি নাকি এই মুখ দিয়া কবুল বলে বিয়া করছি, খাতায় সই করছি। ভাই, বিশ্বাস করেন আমার মাথায় তখন কোন সেন্স ছিল না। আমি অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা ছিলাম। তারপর, আমি কিচ্ছু বিশ্বাস করতে পারি নাই। আমাদের নাকি বাসারও হইছে। শুধু মায়ের মুখের দিক চাইয়া আমি আর কিচ্ছু করি নাই। ত ভাই, মাঝে মাঝে মনে চায়, এই জীবন রাইখ্যা কি লাভ। এই যে দেখতেছেন বাঁইচা আছি, বিশ্বাস করেন ভাই, আসলেই আমি বাঁইচা নাই, যেদিন হুশ হইছে (ঝুমুরের কথা মনে পড়ছে) ঐ দিন থেকেই আমি মরা। জীবনেও ভাবি নাই, আমার জীবনডা এই রকম হইব। ভাই, বেশি স্বপ্ন দেখছি ত.. 


- ইলু ভাই, আসলে কি দিয়া আর কি বলে আমি আপনারে সান্ত¡না দিবো, আমি আসলেই বুঝতেছি না।

- আরে না, ভাই, ঠিক আছি। তো দেশের অবস্থাটা একটু ভালো হইলে আর গাঙে একটু মাছ পড়লে দুইচোখ যেদিকে যায়, সব ছাড়ি সেদিকেই চলি যামু.. মামতো বোন লিপিরে দেখলেই আমার কেমন জানি লাগে, ভাই। আর ভাল লাগে না, পোলাডার দিকে চাইয়া এখনও রইছি..

- আমি বললাম, ঝুমুরের সাথে কথা হয়নি আর??

- ভাই, আপনি নিজেই কন, কোন মুখে আমি ওর সাথে কথা কই! না, আর কথা হয়নি। ত, হুনছি খুবই ভালো জায়গায় ওর বিয়া হইছে। এখন চর জহিরউদ্দিন থাকে। স্বামীর বেশ ভালোই জায়গাজমি আছে, গরু মহিষ আছে, নৌকা আছে, ও আছে, হয়তো সুখেই আছে।

- আমি কি বলবো, বলার মতন কোন কথা খুঁজে পেলাম না। শুধু মনে মনে ভাবলাম- আসলেই সত্য,  এই রকমই হয় মানুষের জীবন। মানুষ নিত্য ভালো থাকার অভিনয় করে আর এই ভালো থাকতে থাকতে এইভাবেই হয়তো কেটে যায় মানুষ জীবন

- ভাই, বাদ দেন এসব। এই লন সিগারেট লন। চলেন, আপনারে নিয়া আজকে গাঙে যামু..।

- আমি বললাম চলেন, যাই....।


নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট