আবুল কালাম বেলালের ‘বাংলাদেশ’ কবিতা ও একটি দাবী

 



আবুল কালাম বেলালের ‘বাংলাদেশ’ কবিতা ও একটি দাবী

 অনার্য আমিন


ছড়াসাহিত্যকে শিশুসাহিত্যের অংশ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। যিনি ছড়া লেখেন তাকে ছড়াকার বলা হয়ে থাকে। তবে বাংলা সাহিত্যে যারা ছড়া লিখে বিখ্যাত হয়েছেন তাদের সবাইকে কবি বা শিশুসাহিত্যিক বলে সম্বোধন করা হয়। শিশুদের সাহিত্য সম্পর্কে জানার প্রথম সিঁড়ি হলো ছড়া। ছড়াকে কবিতার মধ্যেই গন্য করা হয়। কারণ ছড়াও কবিতা, শুধুমাত্র শিশুদের উপযোগী করে লেখা হয় বলে একে কবিতার ক্যাটাগরি থেকে বাদ দেওয়া উচিত না। তবে ছোটদের কবিতাও বলা যেতে পারে। ছোটদের ছন্দোবদ্ধ কবিতাকে শিশুসাহিত্যিকরা উনিশ শতকের শেষের দিকে  আরো মডিফাই করে নতুন কাঠামোয় দাড় করিয়েছেন। বারো থেকে আঠারো-উনিশ বছরের বয়সীদের উপযোগী করে লেখা কবিতাকে নামকরণ করা হয়েছে কিশোর কবিতা। বর্তমানে শিশুসাহিত্যে এ মাধ্যমটি বেশ পরিচিত ও সুদৃঢ়। কেননা বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিকরা কিশোর কবিতা নিয়ে দুহাতে লিখে যাচ্ছেন এবং এটাকে আন্দোলনে পরিনত করেছেন। এ কবিতার প্রধান উপজীব্য হচ্ছে স্বদেশপ্রেম, নৈসর্গিক রূপচিত্রন, জীবনমুখী আদর্শ প্রকাশ ও কিশোর মনের কল্লোলিত কল্পনা কালির আচড়ে ফুটিয়ে তোলা। বাংলাদেশে যে সকল শিশুসাহিত্যিকগন কিশোর কবিতার আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন- আবুল কালাম বেলাল। আপদমস্তক সাহিত্যিক এ কিশোর কবির ধ্যানে ও চিন্তায় শুধু শিশু ও শিশুসাহিত্য। শিশু কিশোরদের জন্য তিনি নিবেদিত ছড়া, কিশোরকবিতা ও গল্প লেখায়। তবে কিশোরকবিতায় তার লেখনি ফুল ফুটিয়েছে কাব্যকাননে। 


আবুল কালাম বেলাল একজন শব্দ সচেতন কবি। অত্যন্ত সচেতনভাবে তিনি তার প্রতিটি ছড়া, কিশোরকবিতায় শব্দ চয়ন করেছেন যাতে শিশু-কিশোরমন অহেতুক ভারাক্রান্ত না হয়। এতে করে তার লেখাগুলো দ্রুত পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। ফড়িং নিয়ে খেলার বয়সে যুদ্ধে হানা দেয় তার স্বাধীনতায়। নিষ্পাপ নয়নে অবলোকন করে রক্তনদী পেরিয়ে কিভাবে আসে বিজয়োল্লাস। তাইতো তার লেখায় বারবার ঘুরে ফিরে আসে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, দেশের গৌরবময় কীর্তিগাথা। তিনি যতগুলো ছড়া-কবিতা লিখেছেন ‘বাংলাদেশ’ কবিতাটা সবথেকে আলাদা। দেশপ্রেমে ডুব দিয়ে, সময়কে নিজের নিয়ন্ত্রনে এনে,  ভাবনার আকাশে বলাকা হয়ে উড়ে উড়ে, শ্বান্তচিত্তে লিখেছেন এ কবিতাটি। আমার পাঠ করা এ সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা এটি। হয়তো তারও সেরা কবিতা এটি। কবিতায় প্রতিটি লাইনে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হয়েছে সবর্কালের শ্রেষ্ঠ জননী হিশেবে। কবি শুরুতেই চমৎকার প্রশ্নপর্বের মাধ্যমে কবিতাটি শুরু করেছেন। কবি শিশু-কিশোরদের ছন্দে ছন্দে প্রশ্ন করেছেন এভাবে-


‘কোথায় নিখাদ পটে আঁকা রূপ, ঘাসের সবুজে ঝরে-

আকাশের নীল, শিশিরের হীরে, চন্দ্রিমা অগোচরে?

কোন সরোবরে জলের মুকুরে শাপলা-কমল ফোটে?

অলস দুপুরে নূপুরের সুরে নদীরা কোথায় ছোট?...’


এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়তো কিশোরমন ব্যাকুল হয়ে বিশ্বের বড় বড় দেশের নাম তুলে আনতে পারে। কবি ওদের ব্যাকুলতার অনুসন্ধানে সঠিক দেশ পাবে না জেনে লিখেছেন-


‘ভাবছো তোমরা মরু, বালিয়াড়ি আরব দেশের কথা

যেখানে বন্দি সাইমুন-ঝড়ে শ্বাসের স্বাধীনতা।

কিংবা কানাড়া, দূর আমেরিকা, ব্রিটেন দেশের কথা

যেখানে তুহিন প্রাণপাত করে আনে হিম নীরবতা।’


এভাবে যতই দেশের কথা ভাবনায় আসুক না কেন সৌন্দর্যের পালাবদলের শ্রেষ্ঠ দেশ কোথাও খুঁজে পাছে না কেউ। সে দেশ কেবল ময়ুর পেখম সুশীতল দেশ, বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে রূপদান করতে যাদের অবদান ইতিহাস খচিত সেইসব শ্রেষ্ঠ মনীষীদের আবুল কালাম বেলাল চমৎকার নিপুনতার ধাচে অংকিত করেছেন এই কবিতায়। তিনি লিখেছেন-


‘এখানে সূর্য সেন, প্রীতিলতা বিপ্লবী সুর তুলে

আগল ভাঙতে জান করে দান জয়ের মর্মমূলে।

চোখে রঙদার উচ্ছ্বাস মেখে গেয়ে জীবনের গান-

নীলকর ঠেলে বীর তিতুমীর মাঠে বুনে সোনা ধান।’


‘বাংলাদেশ’ কবিতার প্রতিটি লাইন এত চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, পুরো কবিতাটাই তুলে ধরতে লোভ লাগছে। সৌন্দর্য রক্ষার স্বার্থে লোভকে নিয়ন্ত্রনে করেছি। ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা জীবনকে তুচ্ছ করে সংগ্রাম করেছেন কবি তাদেরকে তুলে ধরেছেন সন্মানের সাথে-


‘ভাষা ভাষা করে সালাম-রফিক-বরকত ভালোবেসে

বুকের সুপ্ত গোলাপ ফোটায় অমলিন হেসে হেসে।

এখানে আসাদ-মতিয়ুর দেয় মিছিলের লাল ডাক

আলো অভিযানে পেরোয় তপ্ত রক্ত নদীর বাঁক।

এখানে মুজিব নির্মল খোলা আকাশের কথা বলে-

জাগুয়ার চিল তাড়ায় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাচ্ছলে।’


সবুজ কিশোরদের প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা কবিতায় কবি শেষে এসে সেই স্বপ্নের দেশের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন-


‘হৃদয় মাতানো জড়োয়া পাতানো পরিমল পরিবেশ

সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জননী- আমার বাংলাদেশ।’


কবিতাটি পাঠ শেষে ভালোলাগার স্থান থেকে কিছু চাওয়া মনে জেগে উঠেছে সেটা দবীও বটে। মনের একান্ত চাওয়া বা দাবী যাই বলি না কেন তার আগে বিখ্যাত কিছু ছড়া-কবিতার নাম বলা যাক। যেগুলো ছোট বড় সকালের কাছে প্রিয় ও মুখস্ত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘নন্দলাল’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’, রোকনুজ্জামান খানের ‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’, সুকুমার বড়–য়ার ‘এমন যদি হতো’, হুমায়ুন কবিরের ‘মেঘনার ঢল’, কালীপ্রষন্ন ঘোষের ‘পারিবো না’, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীনের ‘কানা বগীর ছা’ রজনীকান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’, সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’, কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ অতুল প্রসাদ সেনের ‘বাংলা ভাষা’, আল মাহমুদের ‘নোলক’, ‘একুশের কবিতা’, বন্দে আলী মিয়ার ‘আমাদের গ্রাম’ ইত্যাদি। আপদত স্মরনে আসা এই কবিতাগুলো কীভাবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে গেল? কখনো ভাবা হয়েছে?


এর একটি মাত্র কারণ কবিতাগুলো পাঠ্যবইয়ের। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে সপ্তম অষ্টম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠের কবিতা এগুলো। ইচ্ছায় অনিচ্ছায় পঠিত হয়েছে বারবার। তাইতো কবিতাগুলো মুখে মুখে, জনপ্রিয়। বর্তমান সময়ের অসংখ্য সুন্দর সুন্দর কবিতা আছে যেগুলো প্রচারের ধীরতায় পাঠকমহলে সমাধৃত হয়নি এমনকি কিছু কবিতা যথাযথ মূল্যায়িত হয়নি। আবুল কালাম বেলালের ‘বাংলাদেশ’ তেমনি একটি পাঠ্য অন্তর্ভুক্তির দাবিদার কবিতা। প্রয়োজন কতৃপক্ষের দৃষ্টিপাত ও সঠিক মূল্যায়ন। আমার চাওয়া বা দাবীর যায়গাটুকু হলো- বাংলাদেশ শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডসহ সকল সায়ত্বশাসিত ও কিন্ডারগার্টেন এ্যসোসিয়েসনের সকলের দৃষ্ট আকর্ষন যাতে এই চমৎকার সুন্দর দেশপ্রেমের কবিতাটি সকল কচিকাঁচা শিক্ষার্থী পাঠের মাধ্যমে দেশকে সুন্দর ভাবে জানতে ও শিখতে পারে।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট