বন্ধুত্ব

 


বন্ধুত্ব

তারিকুল আমিন


সন্ধ্যা তারাগুলো আলো মেলে প্রবেশ করছে নিরুর ঝরোকার পর্দা ফুঁটো করে। সন্ধ্যা হলেই ঝিঁঝিপোকার আনাগোনা। মোরগের ডাক। তারপর হাসের প্যাক্ প্যাক্ শব্দ করে ঘরে ফেরা। দূরে বাতাসে ভেসে আসা শেয়াল প-িতের হুক্কাহুয়া শব্দ। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যায়। সন্ধ্যার সাঁজবাতি জ্বালায় প্রতিটা বাড়িতে। চারপাশে খাঁ খাঁ অন্ধকার। তার ভিতরে দূরে দেখা যায় একটি জানালার কাছে কুপি বাতি জ্বলছে আপন ত্যাজে। পাশে একটি স্বাধীনতাহীন টিয়াপাখি বন্ধখাচায় বন্ধী। কোন একটি বাড়ি থেকে ভেসে আসে “মা আমারে আরাকটা পোড়া রুটি দিবা?” বাহিরে জোনাকি পোকার পিটপিট আলো জ্বলেই চলছে। এমন সময় বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে উঠবে “না না মম আর লাগবে না!” ধীরে ধীরে শব্দগুলো হারিয়ে যায়। সব ঘরের কুপি নিভে যায়। জ্বলে থাকে ঐ জানালার সেই আপন গতিতে জ্বলতে থাকা হারিকেন। হঠাৎ একটি শব্দÑ না..! না..! আমায় ছাইড়া দেন সাব! আমার এতো বড় ক্ষতি কইরেন না! হঠাৎ মিলিয়ে যায় খাচা আর নিভে যায় হারিকেন। চিৎকারের শব্দে কলাবাদুরের ছুটোছুটি দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর সেই জানালার থেকে কী জানি লাফিয়ে পড়ে। কে হতে পারে? সেই মেয়েটা? নাকি ভদ্রতার আড়ালে থাকা অভদ্র মানুষটা?

আজান শোনা যায়। রোজিনা বেগমের ঘুম ভেঙ্গে যায়। রোজিনা বেগম নামাযের জন্য ওজু করতে যায়। ওজু করে নামায আদায় করে। নামায শেষ করে ঘর ঝাড়– দেয়।

-বাবা করিম। উঠ বাজান। কামে যাবি না। দেরি হইলে তোরে মারবো। যা বাজান। 

দেখে ঘরে করিম নেই। অনেক আগেই চলে গেছে কাজে। কারণ কাজ না করলে হাজিরা পাবে না। আর ঘরে চুলাও জ্বলবে না। রোজিনা মনে মনে বলল, পোলাঢার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। এই বয়সে পড়াশোনা করার কথা। সেখানে ও কাজ করে। কাজে একটু দেরি হইলেই মারে মহাজন। হায় খোদা! কান্নায় ভেঙ্গে পরে।

-ও আল্লাহ মেলা সময় হইল দেহি। আমার সাহেব তো অফিসে যাবু। যাই তাড়াতাড়ি কাজে যাই। 

-পারু ও পারু। কই গেলা। দরজা খোলো। 

এদিকে কাজ করে রোজিনা। চা বানায়। রুটি বানায়। সবজি আর ডিম ভাজি করে। 

-বুয়া! এই নাও এই রুটি তুমি খাও। মনে হয় সকালে কিছু খাওনি। দুটো রুটির একটি রোজিনা খায়। আরাকটা ছেলের জন্য নিয়ে যাবে তাই শাড়ির আঁচলে গিট দিয়ে রেখে দিয়েছে। এভাবে রোজিনা ছেলের জন্য খাবার নিয়ে যায় বাসায়।

সন্ধ্যা। বারান্দায় দেখা যায় একটি মেয়ে দাড়িয়ে আছে। দাড়িয়ে দাড়িয়ে অপলোক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চাঁদের দিকে। মাঝে মাঝে চাঁদের সাথেও কথা বলে। কিছুক্ষন পর পর বারান্দায় হাটতে দেখা যায়। একা একা কার সাথে জানি কথা বলে। তবে কার সাথে কথা বলে তা দেখা যায় না। বারান্দার ব্যালকনিতে থাকা সেই টিয়া পাখি বললÑ নিরু! আজ তোমায় এতো খুশি দেখাচ্ছে। নিরু বললÑ কই খুশি। আরে এমনি সই। টিয়া বললÑ না সই তুমি যতই লুকাতে চাও তুমি আমার কাছে লুকাতে পারবে না। আমি তোমার মুখ দেখে সব বুঝতে পারি। এমন সময় চুলের মুঠি ধরে দে টান। নিরুকে মারছে। আর টিয়া চেচাচ্ছে। ছাড়ো! ছাড়ো! দুষ্ট মেয়ে ছাড়ো! টিয়া পাখিকে রাগে খাচা খুলে যেই ধরতে যায়। অমনি কামড় দিয়া টিয়া চলে যায়। তারপর টিয়া উড়ে পাশের বাড়ির বারান্দায় বসে। এদিকে নিরুকে গরম খুরচুন দিয়ে পিঠ পুড়িয়ে দেয়। সেদিন নিরুর চিৎকারে টিয়া শুধু বললÑ হায় আল্লাহ! সখি! ও সখি! তোমায় ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। দরজাল মহিলা পাখিটাকে তাড়ানোর জন্য সব সময় গরম পানি মারে। কিন্তু টিয়া যায় না। টিয়া নিরুর কষ্ট দেখে আল্লাহকে সব সময় বিচার দেয়। টিয়া কষ্ট সহ্য করতে পারে না নিরুর। একেই বলে বন্ধুত্ব।

জন হচ্ছে বড়লোক ঘরের একমাত্র সন্তান। জনের কোন অভাব নেই। জন দেখতেও যেমন তেমনি ভালো একটি ছেলে। 

-ড্যাড গাড়িটা নিয়ে কোথায় ঠিক করাবে? আমাকে নিবে ড্যাড? 

-ওকে চল। 

সেখানেই পরিচয় হয় করিমের সাথে। একই বয়স। কিন্তু নিয়তির কী অভিনয়। কেউ পেটের ক্ষুধার জন্য ছোট বয়সে ধরতে হয় পরিবারের দায়িত্ব। আর কেউ এর কিছুই জানে না। ওদের দুজনের প্রথম দেখাতেই ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। দুজন অনেক কথা বলে। এমন সময় ডাক আসে। 

-করিম...! ঐ শালার বেটা করিম। ঐহানে গল্প করলে কী তোর পেটে ভাত হইবো। শালা জানোয়ারের ছাওয়াল। 

-ড্যাড! লোকটা করিমকে এসব বকা দিচ্ছে কেন? ছি কী খারাপ মানুষ। তার কি ওর মত সন্তান নেই। 

-থাক বাবা এসব নিয়ে চিন্তা করো না। 

পরে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। কিন্তু জনের মাথায় বন্ধুর সেই কথাগুলো ঢুকে রয়েছে। এরপর খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে ওদের বস্তিতে। 

- করিম! করিম! তুমি বাসায়?

-হ্যা! কে?

-আমি জন? শুনলাম তুমি অসুস্থ নাকি?

-কাল তোমায় মেরেছে ঐ দুষ্ট লোকটা মনে হয়। তখন দেখে শরীরে অনেক আঘাত।

-কে বাবা তুমি। আর আমার পোলারে তুমি চিন কীভাবে?

-আন্টি আমি জন। আন্টি ওকে আমি নিতে এসেছি। 

জনের গাড়ি দিয়ে ঘুরে করিম। জন করিমকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে। পুরা জায়গাটা ঘুরায়।

-করিম তুমি স্কুলে পড়বে? 

-হ্যা! 

-আচ্ছা, তুমি আজ থেকে ঐ দুষ্ট লোকটার কাছে যাবে না ঠিক আছে। 

-না গেলে ভাত খামু কী কইরা। 

-সেটা তোমার চিন্তা না। এই কলমটা নাও। প্রতি রাতে তুমি এটার কাছে চাবে। দেখবে সকালে তোমার বাসার কাছে রোজ টাকা চলে আসবে। 

-কী বল? সত্যিই! 

-হ্যা, সত্যি! 

পরে করিমকে বরাবর মোহনপুর সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করায়। রোজ সকালে দেখে ওদের বাসার সামনে টাকা আর কিছু ফল ও সবজি রাখা থাকে। কে দেয়? কীভাবে আসে? এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না করিম। কারণ ও জানে ওর কাছে জাদুর কলম আছে সেটাই দেয়। এভাবে পড়াশোনা চলতে থাকে করিমের। অন্য দিকে জন ও করিমের বন্ধুত্ব আরো গভীর হচ্ছে। দুজন দু স্কুলে পড়ে। আর করিমের মা নতুন বাড়িতে কাজ করে। এখন ওরা ভালো সুখেই আছে।

বন্ধু টিয়া একদিন বলল- আল্লাহ তুমি আমাকে নিরু বানিয়ে দেও আর নিরুকে টিয়া করে দাও। ঐ শয়তান বুড়ো আর বুড়িকে এবং ওদের দুষ্ট সন্তানকে শাস্তি দিবো? 

আল্লাহ সাথে সাথে কবুল করে নেয়। পরে এক এক করে পাখি নিরু দুষ্ট বুড়ো আর বুড়িকে এবং ওদের সন্তানকে জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। আর মহিলাটাকে ঝুলিয়ে রাখে। তারপর হাওয়া হয়ে যায় পাখি নিরু আর মানব নিরু। তবে শোনা যায় ওদের দুজনকে প্রায় দেখা যায় জানালার পাশে গল্প করতে। খিল খিলিয়ে হাসতে।

এভাবে অনেক বছর কেটে যায়। করিম এখন কয়েকটি ছেলেকে পড়ায়। অন্যদিকে জন বিদেশে চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে। একদিন বুঝে যায়। আসলে কলমটি জাদুর নয়। বন্ধু জন রোজ লুকিয়ে ওসব রেখে যেতো। এখন করিমের মাকে আর বাসা বাড়িতে কাজ করতে হয় না। করিম প্রাইভেট পড়ায়। সেখান থেকে ভালো টাকা আয় করে।

-হ্যালো! কে বলছেন?

-আমি জনের বাবা..!

-আসসালামু আলাইকুম আংকেল!

-জন আর নেই বাবা! বলেই চিৎকার করে কান্না করে জনের বাবা। 

পাশের ঘর থেকে শোনা যায়। আমেরিকায় একটি বড় শপিংমলে ডাকাতির হামলায় বাংলাদেশী ছাত্র জন নামের একটি ছেলে মারা যায়। বাকরুদ্ধভাবে বসে পড়ে করিম। আর কোন শব্দ বের হয় না..!



প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অভিনয় ও আবৃত্তি শিল্পী।

বাড়ি#২১, ফ্লাট#এ-৩, রোড#২, ব্লক-এ, ঢাকা উদ্যান

মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৩১০২৭৫৬৩৩



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট