পোড়ামাটির ঘ্রাণ...

 



পোড়ামাটির ঘ্রাণ

শফিক নহোর 


ক.

কামারহাটের বাতাসে একটা গোপন খবর ইদানীং খুব ঘুরে বেড়াচ্ছে তা নিয়েই মানুষ কানাঘুষা করছে। জোয়ারের পানি বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাতাসের বেগও বাড়ছে। পদ্মার-ঢেউয়ের আঘাতে বাহির বাড়ির ঠাকুরঘর ভেঙ্গে যাবার উপক্রম। ভগবানের নাম জপতে জপতে এ যাত্রায় ঠাকুর রক্ষা করেছে, না হলে গাঙের জলে পতিমার মতো নিজেও বিসর্জন হয়ে যেতে হতো এতোদিনে। মন্দির রক্ষা করবার জন্য উপজেলায় কাগজ পত্র জমা দিলাম। তা কোন কাগজের নিচে চাপা পরে আছে কে জানে। আজ ক’দিন নিজের শরীর ভাল যাচ্ছে না। বিভিন্ন ব্যবসা বানিজ্যের খোঁজখবর নিতে পারছি না, ঠিকঠাক মতো। টাকা ছাড়া কি কোন কাজ হয়। ‘সব মানুষই গু খায় দোষ হয় ঘাইড়া মাছের।’ টাকা পয়সা দিয়েও তো  নদী ভাঙন রোধ করতে পারছে না গ্রামের মানুষ। এই নদী ভাঙনে আমাদের স্বপ্ন ভেঙে যায় বুকের ভেতর থেকে। 


বিশু পোদ্দার দানবীর, গ্রামের মানুষের হৃদয়ে তার নাম খোদাই করে লিখে রাখছে। পরের ভালো আজকাল মানুষ সহজে সহ্য করতে পারে না। কতোবার ফিকির-ফন্দি করে রাতে পোদ্দার বাড়িতে ডাকাতি করেছে, ফটিক সরকার। মানুষের জীবন সবচেয়ে আলাদা জীবন পশু-পক্ষীর মতো না, দিন এনে দিন খাওয়া। মানুষের জীবনে সংসার আছে, ছেলেপেলে আছে। বাড়তি চিন্তা আছে, ভবিষ্যতের জন্যে কিছু জমাতে হবে। না হলে শেষ বয়সে ছেলেপেলের উপর চেয়ে থাকতে হবে।

পুরুষ মানুষের কাজকর্ম করতে লজ্জা কিসের? সৎ ভাবে বেঁচে থাকলেই হল। ঠাকুর রক্ষা করুক।

নিমাই, লক্ষ্য করেছিস, রীতার বিষয়টা নিয়ে গ্রামে কু-কথা ছড়িয়ে পড়ছে। ‘কথা বলাবলি করছিল মানুষজন পথদিয়ে যাবার সময়। রাম রাম, এসব কথা মুখে আনাও পাপ।’ হিন্দুদের পুটকি মেরে সরকার বাড়ির মানুষ এখন সাধু সাজছে, যুদ্ধের সময় পোদ্দার বাড়ির সয়-সম্পত্তি নিয়ে শহরে গাড়ি, বাড়ি করে চাষার লেবাস খুলে অফিসার হয়েছে, বছরে একবার বাড়ি আসবে। বড়ো চার পাঁচটা ষাঁড় কোরবানি দিলে বাড়ির পথে কুত্তার মতো মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর গ্রামের গরীব মানুষ মনে করবে এরা দেবতা, অন্য মানুষের মতো না। তাদের মুখে এখন কত কথা শোনা যাবে। মানুষ সাধু সেজেছে প্রকৃত সাধু না।

নিমাই, মন্দ বলিস নাই। তুই তা হলে যা, পরে আলাপ করবো।

বক্কার মিয়ার সঙ্গে দেখা হলে বাড়ির পর আসতে বলিস।

পাটের গদিতে আজ কদিন যেতে পারছি না।

কাকা শোনলাম,

বক্কার মিয়া বিয়ে করছে?

হ, আমাকে তো তাই বলেছিল, ওদের গ্রামের মাতুব্বরকে বলেছিলাম।

রীতা মোসলমান ঘরের মেয়ে, তার একটা দোষ বের হলে আমাদের সমাজের জাত যাবে। হিন্দু হোক মোসলমান হোক সে তো আমার প্রতিবেশি। বক্কার রীতাকে বিয়ে করলে করুক। বক্কার ছেলে হিসাবে সহজসরল, ধর্মভীরু। বিয়ের জন্ন্যিই তাহলে আজ দুদিন বাজারে আসছেনা। বাজার সদাই করতেও তো একজন মানুষ দরকার। গরীব মানুষ এতো বিয়ে করবার শখ জাগে কেন?

পুরুষ মানুষের আসলে বদঅভ্যাস একবার জড়িয়ে পড়লে নেশার মতো অতো সহজ আসা কঠিন। বিয়ে কী বদঅভ্যাসরের কারণে করে বিশু বাবু; ‘তা না হলে কি?’

বক্কার মিয়া, সকালে নতুন বউয়ের সঙ্গে ভাত খাওয়া নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। আপনার এখানে আসার পথে শুনে আসলাম।

নিমাই, তা কি জন্ন্যি বাড়ির পর আসছিস কিছু তো বললি না। আমার হাজার পাঁচেক টাকা হাওলাত দিলে বড় উপকার হবে। সামনে সোমবারে নাজিরগঞ্জের হাটে ধান বিক্রি করে টাকা দিবো দিব্য করে কচ্ছি,

ভাল কথা মনে করেছিস, 

সামনে দূর্গাপূজো খই, মুড়ির জন্য এক মণ ধান আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিস। তুই বাজারে গিয়ে আমার কথা বলিস, কুঠিতে ক্যাশিয়ার থাকে তাকে কাগজ লিখে দিচ্ছি  তোর টাকা দিয়ে দিবে। বিশু পোদ্দার কোন মানুষকে কখনো খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে, এমন কথা মানুষের কাছে শোনা যায় না। যখন যে কাজের জন্য মানুষ গিয়েছে, কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। সে বছর উদয়পুরের মিয়া বাড়ির লোকজন বাঁশ নিয়ে গেল চার ভ্যান মাদ্রাসা না-কি জালসার জন্য পরের দিন দেখলাম। গোয়ারিয়ার হাটে কার্তিক পাল সেই বাঁশ কিনে নিয়ে গেল। দলীয় লেবাস লাগিয়ে গ্রামে দেখছি কেউ কেউ রাজপ্রসাদ গড়ছে।

আজকাল বক্কার মিয়ারে দেখলে কষ্ট হয়।

পোদ্দারের পাটের কুটিরে সকাল থেকে সন্ধ্যা অদধি কাজ করে যে টাকা পায় তা- দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। বক্কারের বাপ একসময় নৌকা চালাতো, বয়স্ক মানুষ শরীরে কুলায় না। ছেলের সংসারে বসে খাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই এখন। বক্কারের মা গখেন সাহার বাড়ি ঝির কাজ করে, কীর্তন পূজা, অথবা বিশেষ কোন বড় আয়োজন হলে বারতি খাবার বেচে থাকলে বাড়ি নিয়ে যায়। বক্কারের বাপের জন্ন্যি, তার ভালোবাসা চোখে পরবার মতো। গবীর মানুষের সখ-আহ্লাদ বলতে আর কি পেটে চারটা পানি ভাত পড়লেই হয়। সারাদিন খাটনির কাম করা লাগে।

দেখতে দেখতে কী ভাবে বছর পার হয়ে যাচ্ছে; বক্করের বিয়ের বয়স সারে তিন বছর, বাচ্চা-কাচ্চা তিনজন। নিয়ম নাই, পরিকল্পনা নাই, সংসারে অভাব তো থাকবেই।

সকাল বেলা চলে শুধু এক গেলাস পানি খেয়ে, দুপুরে ঢেঁকিতে ধান ভানলে কুলার উপর কয়ডা চাল ঝেড়ে মুখের ভেতর দিয়ে চিবিয়ে দুপুর পার করা। সাঁঝের সময় সমস্ত কামকাজ শেষ করে খেগেন সাহার বউ শাড়ির আঁচলে খুদ, অথবা চিটা ধানের বাড়া দিলে বাড়িতে এসে চুলাই চুড়িয়ে তা লবণ মরিচ দিয়ে অথবা কোন কোন দিন পেঁয়াচ-মরিচ  ছেনে রাতের খাবার খেয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে শুয়ে পড়ে।


খ.

পোদ্দার বাড়ির শান বাধানো ঘাটে গোসল করবার পর ভেজা কাপড় শরীরে পেচিয়ে বাড়িতে যাওয়া একটু কষ্ট হয়, এই শীতের দিনে রীতার।

‘কি গো বক্কার মিয়া, তোমারে বললাম পোদ্দারের কুটির থেকে আমার সঙ্গে ঢাকায় চলো গেলে না। শোনলাম,

‘বউ বাচ্চার খাবার দিতে পারছো না সংসারে অভাব বাড়ছে। ছেলে-মেয়ে অসুস্থ। তার উপর তোমার বাপ তোমার ঘারে চাপছে।

‘নিমাই, কাকা আমি মুর্খ মানুষ। ঢাকা গিয়ে কি করবো, ঢাকা না-কি অনেক মানুষ থাহে সবাই ধনী। 

‘ধূর বেটা ঢাকার শহরে তোর চেয়ে ফন্নি মানুষের অভাব নাই। তোর ত চরিত্র ভাল আছে, শহরে বিভিন্ন এলাকার বদচরিত্র মানুষ এসে বস্তী বানায় ফেলছে। খারাপ ভালো সবি আছে শহরে। 

তোর বউ সকালে পোড়া মাটি খায়, ভাত খেতে না পেরে এ কথা একজনের কাছ থেকে গ্রামের সবাই জানে। তোর বউরে দেখতে আসে। মানুষ মুখের সামনে কিছু বলে না। পিছনে মজা নেয়। মানুষ জাতটাই এমন বেহায়ার মত। কেউ উপকার করতে পারলেও করবে না। এখন মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় কওে মানুষকে বনের বাঘের চেয়ে।


‘নিমাই কাকা, রীতা সকালে পোড়া মাটি দিয়ে দাঁত ঘষতে-ঘষতে অল্প অল্প করে খাওয়া শিখে গেছে। আমি যেমন বিড়ি খাই, বিড়ি না টানতে পারলে মাথা ভার ভার লাগে। আমার বউ পোড়া মাটি না খেলে ওর না-কি ভাল লাগে না। একটা কিছু খেয়ে বেঁচে আছে তাতেও মানুষের কত কথা।’ 

‘নিমাই কাকা তুমি যাও, তোমার লগে পরে কথা কবোনে।


বউয়ের শরীরটা ভাল না। ভাবছি, কবিরাজ বাড়ি নিয়ে যাবো। পরনের কাপড় খানা প্রায় ছিড়ে গেছে, পথের লোকজন বউয়ের শরীরের দিকে চাইয়া থাহে। লাজ শরম কিচ্ছু নাই। সংসারের কোন আয় উন্নিতি নাই, সারা জীবন পরের বাড়ি কাম করেই চলি গেল। বউরে কোনদিন এক জোড়া কাঁচের চুড়ি কিনে দিতে পারলাম না। নিজের মনের ভেতরে আফসোসের ঢেউ গড়াগড়ি খায় বক্কার মিয়ার মনে।   

ঘরের ভেতর ঢুকতেই বউ বমি করতে করতে উঠোনে বের হয়ে গেল। কুয়া থেকে পানি তুলে বউয়ের মুখে, মাথায় দিতেই মাটিতে শুয়ে পড়ল। সারাদিন কিছু খায়নি বড় মেয়ে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলছে, 

‘বাজান আমিও মায়ের সঙ্গে মাটি খাওয়া শিখে গেছি।

আমার চোখ ভিজে ওঠে। পদ্মাপাড়ের সমস্ত পানি আমার চোখের ভেতেরে পোড়া মাটি হয়ে ঢেউ খেলে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ আমার কাছে তখন নরক যন্ত্রণার মতো মনে হয়। ভোর বেলা থেকেই গাছের ডালে কাক পক্ষী ডাকছে, আমার তখন থেকেই মনে হয়েছিল, ‘আজ একটা খারাপ কিছু হবে।’ 


‘বউরে আমার দিকে একটু দ্যেখ। রীতার চোখ গুলো কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মুখ মলিন হয়ে পরে আছে মাটিতে। কথা বলছে না, মনে হয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। নাক দিয়ে মৃদু বাতাস বের হচ্ছে দাঁত লেগে আছে। ঘর থেকে পানের বোটা নিয়ে এসে যেই রীতার কানের ভেতর দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে নড়াচড়া দিয়ে উঠে পড়ল। আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। বাড়ি ঘরের দিকে কেমন তাকিয়ে রইল। ভাব চক্কর দেখে মনে হচ্ছে রীতা এ বাড়িতে নতুন এসেছে। বউ বাচ্ছার দিকে তাকালে মায়া করে, মায়া করে লাভ কি ভাল কোন কিছু কিনি দিবার তো পারছি না। 

‘নিমাই কাকা, আমার বউয়ের অসুস্থতার কথা শুনে বাড়ির উপর আসছিল। রীতা রাক্ষসের মতো নিমাই কাকার মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ!


‘বক্কার তোর বউয়ের জন্য ডাব নিয়ে আসলাম, আর হাকিম কবিরাজের কাজ থেকে একটু তেল পড়া নিয়ে আসলাম। মাথায় দিয়ে দে ঠিক হয়ে যাবে। কথা গুলো কেমন যেন রীতার শরীরে গিয়ে তীরের মতো বিঁধল।

‘রীতা জোড়ে চিৎকার করে বলল,

‘এই ডাকাত আমাগো বাড়িতে ক্যান। পোদ্দার বাড়ির তা খায়ছে নিমকহারামি,

তাকে দেখেই আমি চিনছি, সেই তো ফটিক সরকারের সঙ্গে ডাকাতি করে। 

বক্কার ওঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নিমাই অদৃশ্য হয়ে গেল।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট