দুই শালিক

 


দুই শালিক 

সাব্বির হোসেন 


আমার নাম শের আলী। জগতনন্দী নদীর ঘটেই আমার একমাত্র দোকান। প্রতিদিন কতশত মানুষ আসে যায় নদীর এপার থেকে ওপারে।

আমার দোকান জগতনন্দী নদীর পাড়েই। দোকান লাগোয়া ছোট দুটো বাঁশের টং আছে। লোকজন পারাপারের সময় চা নাস্তা করে। এক কেজি ননী গোপালের রাজভোগ মিষ্টি নিয়ে আমার একমাত্র নাতি ছগির, আজ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বাড়ি ফিরেছে। নানাজান যেহেতু ভোরে ঘাটে এসে দোকান খুলে বসে আর রাতবিরাতে বাড়ি ফিরে তাই নাতি আমার টাটকা মিষ্টি নিয়েই বাড়ি হয়ে আমার দোকানে এসে হাজির।

আমার নাতি আবার নানাজানের গল্পের পাগল। তাই বরাবরের মতই আজও গল্প শোনার আবদার করে বসল। সূর্য তখনও মাথার উপরে আসেনি। দোকানের খরিদ্দের নেই বললেই চলে। তাই মিষ্টি খেতে খেতে গল্প ধরলাম। দুই শালিকের গল্প।  

দুটো মানুষ। একজনের বয়স পয়তাল্লিশ কিংবা সাতচল্লিশ হবে আর অন্যজনের চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। প্রথমে ছোট জনের কথা বলি। ছোট জনের কোন নাম নেই। মানে নাম, খ্যাতি, সম্মান, সম্পদ এককালে ছিল তবে এখন নেই। সব কিছু হারিয়েছে সে। প্রশ্ন হল, কিভাবে হারালো আর কেন হারালো? যদি বলেন কাজের কোন ছোট বড় নেই তাহলে উদাহরণটা এভাবে দেওয়া যেতে পারে, ছোট জন ছিল মাঝি। নৌকায় এপার ওপার করে আর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। পরিবারের মধ্যে গণ্যযোগ্য হলেও কোনদিন কেউ গণ্যমান্য হিসেবে গণনা করেনি। এমনকি সে নিজেও এভাবে চিন্তা করেনি। কেন চিন্তা করেনি জানেন, কারণ সে মানুষকে খুব বিশ্বাস আর ভালোবাসতো। সমাজের সবার সাথে কাছের মানুষের মত হাসিমুখে চলত। এভাবে সময়গুলো ঠিকঠাক কাটছিলো।

একদিন হঠাৎ মাঝির নৌকা, কে বা কারা চুরি করে নিয়ে যায়। মাঝি তখনও কিছু বুঝতে পারল না। মাঝির কোন জমানো অর্থ ছিল না যে সে, নতুন একটা নৌকা কিনবে। তাই সে পরিবারের সকলের কাছে টাকা ধার চাইল কিন্তু তাকে সাহায্য করার মত কেউ এগিয়ে এলো না। এরপর সমাজের বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী যাদের সে আপন মনে করত তাদের কাছে গিয়েও সে তার সমস্যার কথা জানালো কিন্তু তাতেও তারা কেউই সাহায্য করল না। মাঝি তখন বড় বিপদে পড়ল। মাঝির ঘরে ক্ষুধার্ত দুই সন্তান, স্ত্রী আর মা অপেক্ষা করে। মাঝি ফেরে না। মাঝি তখন চরম এক বাস্তবতার সম্মুখীন। দু’রাত মাঝি ঘরে আসেনি। স্ত্রীর গালমন্দ সভাব। তাই স্ত্রীর গালিগালাজ হরদম চলছেই আর মা তো খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন সন্তানের চিন্তায়। ঘাটে মাঝিকে সবাই ভোলা নামেই চেনে। 


আসুন বড় জনের ব্যাপারে একটু জেনে নেই। বড় জন ছোট জনের একদম অনুরুপ। বয়স বেশি। মন আকাশের চেয়েও বিশাল। মা ভক্ত। বউ বাচ্চাকেও অনেক ভালোবাসে। শুধু একটা সমস্যা বড় জনের। মিথ্যা, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস কোনটাই তার ভেতরে নেই। শুধু একটা সমস্যা ছাড়া। আর সেটা হল মাদকের প্রতি আসক্ত। বড় জন হল মাদকাসক্ত। মায়ের আদরের সন্তান সে। ভাই বোনের মধ্যে সে মধ্যম। ছেলে হিসেবে সে পরিবারের মধ্যমনি। কিন্তু সবাই এই একটা বিষয় নিয়েই চিন্তিত আর বিরক্ত আর সেটা হল, মাদক সেবন। 

একদিন পরিবারের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, গাঁয়ের সংসারী মেয়ে দেখে তাকে বিয়ে দিলে হয়তো ছেলেটি শুধরে যাবে। কথা মত তাই হল। বিয়ে হল অজপাড়া গাঁয়ে। মেয়েটিকে পেয়ে বড় জন নতুন জীবন গাঁথতে শুরু করেছে। এমনকি সে মাদক সেবন ছেড়ে দেয়। শুরু হয় আলাদা একটা পৃথিবী। মায়ের কথা মত নামাজ আদায় করে। বিয়ের কিছুদিন ঘোরাঘুরি আর শশুড়বাড়ি ঢু দেয়া ছাড়া কোন কাজ তেমন নেই তার। এক্কেবারে আলালের ঘরে দুলাল। বিয়ের কয়েক মাস কাটানোর পর হঠাৎ বড় জন আবিষ্কার করল অন্য এক সময়কাল। আসলে সে কি করছে? বউ শশুড় বাড়ির লোকের ঐ এক কথা “জামাই কি করে?” 

তার কি উত্তর সে দেবে? আর বিয়ের পর ভরনপোষণ এর একটা দায়িত্ব থেকে যায়। শুধু শুধু ঘরে থাকলেও তো চলবে না। বাবা মায়ের কাছে বিষয়টি তুলে ধরলে তেমন আশাবাদী উত্তর সে পায় না। এরমানে হল, বউ আর বউয়ের বাড়ির লোকেরা তাকে কিছু বলেছে। যেমন ধরুন কথায় কথায় খোঁটা দেয়া। স্বামী অকর্মা। বেশ কিছুদিন ছটফট করে হঠাৎ একদিন সে বেড়িয়ে গেল এক নদীর পাড়ে। কোন নদীর পাড়ে জানেন? 

এ সেই নদী, যেখানে ভোলা নৌকা ভেড়াতো। জগতনন্দী নদী। বড় জনের নাম হল শাহীদ। 


মানুষের কাঁধে যখন দায়িত্ব ঝুলিয়ে দেয়া হয় তখন সে হয়ে ওঠে অন্য এক মানুষ। ভোলা খুব অল্প বয়সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল। সব ঠিকঠাকই কাটছিলো শুধু হঠাৎ এক বৈরী হাওয়া অর্থাৎ নৌকা চুরি যাওয়া। ভোলা সব কিছু হারিয়ে নদীর পাড়ে চায়ের দোকানে মানে আমার টঙ্গের উপর বসে আছে। পকেটে কোন টাকা নেই যে এক কাপ চা খাবে। তবে সে হাল ছাড়েনি। এই যদি পরিচিত কোন কাস্টমার এর সাথে দেখা হয়ে যায় সে হয়তো এক কাপ চা এর অনুরোধ করে বসতে পারে। সেরকমই হল, শাহীদের সাথে দেখা হয়ে গেল ভোলার। এইতো কয়েকদিন আগের কথা, শাহীদ পরিবার পরিজন নিয়ে ভোলার নৌকায় চরে নদী ভ্রমণ করেছে। দু’জনের ঠিকই মনে আছে। তাই আর বুঝতে এবং কুশলাদি বিনিময় করতে দেরি হল না। বিকেল ঠিক চারটে। দু’জনের কথোপকথন -

শাহীদ- ভোলা দা, কেমন আছো? আজ নৌকা বের করোনি? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে সারাদিন তেমন কিছু খাওনি। কিছু হয়েছে নাকি? বলো তো? 

ভোলা- আর শাহীদ ভাই। ভগবান যে হালোতে রাখেন ভালই আছি। আশাকরি আপনিও ভাল। নৌকাটা আর নেই ভাই। শকুনের চোখ পরেছে। হঠাৎ দু’দিন আগে কে বা কারা আমার নৌকাটা চুরি করে নিয়ে গেল। ওটাই আমার একমাত্র সম্বল ছিল। হাতের অবস্থা এতোটাই খারাপ যে বাসায় কিছু নিয়ে যেতে পারিনি। পেটেও তেমন কোনো দানাপানি পরেনি। এখানে বসে বসে ভাবছি কি করব।

এই কথা শুনে শাহীদের বুঝতে বাকি রইল না যে ভোলা তেমন কোন ভাল পরিস্থিতিতে নেই। বড় জন, ছোট জনের কথা থামিয়ে দিয়ে দোকানিকে দুটো টোস্ট বিস্কুট আর দু কাপ দুধ চা দিতে বললেন। তারপর আবার ছোট জনকে কথা শুনতে চাইল। 

“বিশ্বাস আজ কোথায় বলতে পারেন! কই আমি তো কারও ক্ষতি করিনি। বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবার নিয়ে আলাদা হয়ে গেলাম। দিন আনি দিন খাই। আজ দু’দিন হল বাড়ি ফিরি না। কোন মুখ নিয়ে ফিরবো তাও বুঝে উঠতে পারি না। চোখের সামনে সন্তানের অনাহারী মুখ ভেসে ওঠে। গ্রাম থেকে লোক পাঠায় খবর নিয়ে গেছে। আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। নিজে অসুস্থ। ঔষধের দাম বেশি দেখে খাই না। এই তো কয়দিন আগে ঘাটেই অজ্ঞান হয়েছিলাম। চোখ খুলে দেখি হাসপাতালে মেঝেতে শুয়ে আছি। চোখে ঝাপসা আলো। কত মানুষ চলাচল করছে কেউ কারও দিকে তাকানোর সময় নেই। বাসায় জানাইনি। জানি, বাসায় জানালে চিন্তায় সবাই অসুস্থ হয়ে যাবে। সুস্থতা দেখিয়ে ডাক্তার বাবুর হাতে পায়ে ধরে হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। ডাক্তার সাহেবের মুখে শুধু এতুটুকু জেনেছি শরীরের ভেতর রক্ত পচে গেছে।“ 

এই বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চুপ হয়ে গেল ভোলা। চায়ের কাপে চা শেষ। শাহীদ তাকিয়ে আছে ভোলার মুখের দিকে। কিছু বলবে মনে হল। হঠাৎ করে ভোলা বলে উঠল, “আমাকে কিছু টাকা দিতে পারেন? এই ধরেন হাজার বিশেক টাকা। নতুন একটা নৌকা কিনে আমি ধিরে ধিরে শোধ করে দেব। অনেক্কেই তো বলেছি। কেউ সায় দিল না।” 

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। মাগরিবের আজান পরছে। শাহীদ ভোলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কাল দেখা হবে। আমি নামাজ পড়ে চলে যাবো। আর আমি টাকার ব্যবস্থা করছি। আপাতত আমার কাছে পাঁচশত টাকা আছে। এটা রাখো। কিছু খরচ নিয়ে বাসা যাও। আমি আগামীকাল বিকেলে আসবো। তুমি চিন্তা করোনা।” 

টাকা পেয়ে ভোলা অনেক খুশি। আশার আলো দেখতে পেয়েছে সে। হাট বাজার থেকে ব্যাগ ভর্তি করে বাজার করে বাসায় ফিরল ভোলা। আর এরই মাঝে সব কিছু মন দিয়ে শুনছিলাম, দেখছিলাম আমি, শের আলী। 

পরদিন দুপুর ঘনিয়ে বিকেল। ছোট জন ভোলা মাঝি হাজির। অপেক্ষা শাহীদ নামের সেই বড় জনের জন্য। ভোলা আত্মহারা। গুনগুনিয়ে গান গাইছে। মনের কামনা পূর্ণ হবার পালা। ভোলা বলল- 

“আলী চাচা, এক কাপ চা দাও। তুমি দেখে নিও যারা আমার ক্ষতি করেছে তাদের ভগবান একটা বিচার করবে। গতকাল বাড়িতে গিয়ে বাচ্চা দুইটারে দেখিয়া চোখের পানি আটকাইতে পারি নাই। জানো আলী চাচা, থাকতে থাকতে হঠাৎ মাথা চক্কর দেয়। ডাক্তার বাবু বলেছিল শরীরে বড় অসুখ! সব ঠিক হয়ে যাবে কি বল চাচা? কিন্তু গতকালের ঐ ভাই আসতে চাইল। এখনও নেই।” 

এভাবে অপেক্ষা করতে করতে সময় পেড়িয়ে যায়। সন্ধ্যা নেমে আসে। তারপর ভোলা মাঝি চুপচাপ চলে যায়। 

পরের দিন বিকেল বেলা বড় জন এসে ছোট জনের কথা জিজ্ঞেস করে। জানালাম, গতকাল এসেছিল। আজ আসেনি। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল। এসব শুনে বড় জন আমাকে একখানা প্যাকেট দিয়ে বলে ভোলা মাঝি আসলে যেন তাকে এই প্যাকেটটা দেই। আর বলে, সে দু’ একের মধ্যে দেখা করবে। এই বলে শাহীদ আর দেরি করে না। 

কাগজের প্যাকেট টা হাতে নিয়েই আমার আর বোঝার বাকি নেই যে এর মধ্যে ভোলা মাঝিকে ওয়াদা করা সেই বিশ হাজার টাকা আছে। তবে যাই হোক আমাকে আমানত বুঝিয়ে দিতে হবে। একদিন পর ভোলা ঘাটে ফিরলে আমি তার হাতে প্যাকেট টা বুঝিয়ে দিলাম আর বললাম শাহীদ মিয়া তোমাকে এটা দিতে বলেছে। আর বলেছে খুব তাড়াতাড়ি সে তোমার সাথে দেখা করবে।

ভোলার চোখে তখন জল টলমল করছে। এ এক আকস্মিক ঘটনা। মনে হল, ভগবান নিজে এসে ভোলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভোলা হু হু করে কেঁদে উঠলো। ভোলা আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা। আমাকে জড়িয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করল। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না যে এটা কষ্টের কান্না নাকি উপকারীর উপকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। ভোলাকে সামলাতে বলে এক কাপ চা বানিয়ে দিলাম। ভোলা মাঝ দরিয়ার মত শান্ত হয়ে কি যেন ভাবলো। চা খাওয়ার পর কাগজের প্যাকেট টা হাতে নিয়ে বলল, “আলী চাচা, আমি চলি। নৌকাটা তাড়াতাড়ি প্রস্তুত করতে হবে। আমার প্রাণের শাহীদ ভাই কখন চলে আসবে জানি না। এসে যদি দ্যাখে নৌকা এখনো জগতনন্দীর ঘাটে বাঁধতে পারিনি তাহলে মনে কষ্ট পাবে। হাতে সময় কম। আমি চললাম চাচা। আমি চললাম।”


ইতিমধ্যে সূর্য মাথার উপর ঢলে পরেছে। জোহরের ওয়াক্ত হয়ে এসেছে। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই মুয়াজ্জিন জোহরের আজান দিবে। আমি আর আমার নাতী ছগির, মুড়ি আর খেজুরের গুড় মাখা টিন নিয়ে বসলাম। বললাম, দ্যাখ তোর নানীজান কতো সুন্দর করিয়া মুড়ি মাইখা দিছে। নে খা। 

ছগির মুড়ি চিবাইতে চিবাইতে বলল, “ও নানা, তারপর কি হইল কও তো”। 

“ওরে আমার আদরের পোলা, আগে খাওনটা শ্যাষ কর। আমি নামাজটা আদায় করে আসি।”

ছগির মুড়ি চিবাইতে চিবাইতে আবার বলল, “তুমি ঝটপট আসো কইলাম। আমি তোমার গল্প শেষ না কইরা যাইতাম না।” আমি নামাজ বাদ কবর জিয়ারত করিয়া আবার দোকানে গিয়া দুই মুঠ মুড়ি নিয়া খাইতে খাইতে গল্প শুরু করলাম।


দেখতে দেখতে পনের দিন পাড় হল। শাহীদ মিয়ার দেখা নেই। ভোলা নতুন নৌকা নিয়ে আবার লোকজন পারাপারের ব্যবসা শুরু করে। বিকেল হলে আবার আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘আলী চাচা, শাহীদ ভাইয়ের কোন খবর আছে?” আমি প্রতিবারেই একই জবাব দেই - “না”। তারপর হঠাৎ করে ক’দিন পর বিকেল বেলা শাহীদ মিয়া হাজির। আমি তড়িঘড়ি করে দোকান থেকে নেমে শাহীদ মিয়ারে জিজ্ঞেস করলাম, “এই মিয়া এতোদিন কই ছিলা। তোমার অপেক্ষায় আমাদের ভোলা মাঝি আধখান হয়ে গেছে। প্রতিদিন বিকালে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে শাহীদ ভাই এর কোন খবর আছে কি না? তুমি বসো মিয়া। কিন্তু মিয়া, তোমার শরীরের এই অবস্থা কেন? মনে হয় বহুদিন ধরে ভাত খাও না। কি হইছে? অসুস্থ নাকি?

আমি ভোলারে ডাক দেই। 

ভোলা, ভোলারে, তাড়াতাড়ি আয়। শাহীদ মিয়া আইছে। আমি চা বিস্কুট দিতাছি তোমারে। তুমি খাও অপেক্ষা কর। ভোলা আইবোই আইবো।” 

এরপর ভোলা মাঝি আর শাহীদ মিয়া একসাথে বসে অনেক সময় কাটায়। অনেক গল্প করে। আমি শুধু ওদের দু’জনের চোখে মুখে এক দীপ্ত কিরণের ঝলকানি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার মনে তখনও কিছু প্রশ্ন বারবার নাড়া দিচ্ছিল, শাহীদ মিয়া এই টাকা পেলো কোথায়? কেন এতো দিন পর শাহীদ মিয়া ভোলার সাথে দেখা করতে এলো? শাহীদ মিয়া এতো দিন কোথায় ছিল?


একদিন ভোলা মাঝি শাহীদ মিয়াকে সংগে করে নৌকা নিয়ে নদীর মাঝ খানে গিয়ে মাছ ধরার জাল ফেলে বসল। অকুতভয় ভোলা শাহীদ মিয়াকে বলল, “ভাইজান, এতো দিন কোথায় ছিলেন?” 

শাহীদ বলল, “আমি মনে হয় বেশি দিন তোমার নৌকায় যাত্রী হতে পারবো না ভোলা। আমি অনেক একা মানুষ। আগুনে পুড়ে পুড়ে এখন স্বপ্নহীন একজন মানুষ। শহরের সমভ্রান্ত পরিবারে আমার জন্ম। আমাদের খানদান চেনে না এমন কেউ নেই। আমার স্থাবর সম্পত্তি থেকে প্রতি মাসে যে ভাড়া পাই তা খেয়ে দেয়ে আমি এবং আমার পরিবারের দিব্বি চলে যায়। শুধু চলে যায় না, খেয়ে পড়ে আরো বেঁচে যায়। কিন্তু ভোলা জানো, উপরে উপরে আমি যতই সুখি দেখাই না কেন ভেতরে একজন মরা মানুষ। আমার স্ত্রী, আমার সন্তান আমাকে কোন মূল্যায়ন করে না। সম্মান করে না। বাড়ির চাকর-ঝি এর মত আচরণ করে। কেন করে তাও জানি। মেয়েকে কেউ যদি প্রশ্ন করে যে, তার বাবা কি করে তাহলে সে কি বলবে সে উত্তর তার কাছে নেই। বউকে তার পরিবারের সদস্যরা যদি প্রশ্ন করে যে তার স্বামী কি করে সে প্রশ্নের উত্তরও তার জানা নেই। আমি আমার সয় সম্পত্তি আমার বউকে লিখে দেয়ার পরেও তার ভালোবাসা আমি আজও পাইনি। এসব কিছু সহ্য করতে না পেরে আমি নেশা করতে শুরু করেছি। এমনকি তোমাকে যে অর্থ আমি দিয়েছি সেও আমাকে বউয়ের হাতে পায়ে ধরে এনে দিয়েছি। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না ভোলা। বউয়ের অকথ্য গালিগালাজ শুনে বাসায় থাকতে ইচ্ছে করে না। তার এই অমানবিক অত্যাচারে আমি সাত হাজার টাকা বেতনে পাশের এক পাড়া গ্রামে দোকানের চাকরি নিয়েছি। যেখানে মানুষ আমাকে না চেনে। আমার সম্পত্তির ভাড়ার টাকা সব আমার স্ত্রী একাই নিয়ে নেয়। একটি টাকাও আমাকে দেয় না। সকালে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। ইদানিং আমার বেতনের টাকার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আমার মেয়ে আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে। এও কি সম্ভব ভোলা।

শাহীদ ভাই, আমার যে বড্ড অসুখ। আমিও হয়তো

বলতে বলতে ভোলা আর শাহীদ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। মনে হল পৃথিবী এই দুই জনের কাছে অনেক ঋণী। পৃথিবীর কি কোন শক্তি আছে এ দুজনের বুকের উপর থেকে পাহাড় সমান পাথর সরিয়ে দেবে? 


একদিন ভোলা বিকেল বেলা এসে শহীদ আর ভোলার কথাগুলো গল্পের তালে তালে সব আমাকে জানালো। আমি বিষন্নতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসমানের দিকে চেয়ে রইলাম। বেশ কিছুদিন যাবৎ শাহীদের দেখা নেই। আগের মত নদীর পাড়ে আসে না। ভোলারও দিন যায় নিশ্চুপে। ভোলার চিকিৎসা চলছে কিন্তু অর্থ যোগান দিতে না পেরে হোমিওপ্যাথি উপর ভরসা রেখে দিন রাত্রি এক করে কাজ করে যাচ্ছে। তবুও মাঝে মধ্যে লোক মুখে শোনা যায় ভোলা প্রায়শই অজ্ঞান হয়ে যায়। 

একদিন হঠাৎ দুপুর বেলা ক’জন লোক চা খেতে খেতে আলাপ করছিল, গড়ের মাঠ নামক স্থানে কে বা কারা অজ্ঞাতনামা একজন মানুষকে খুন করে হাটখোলায় ফেলে রেখেছে। থানার দারোগা আর সাংবাদিকরাও উপস্থিত হয়েছে। পোশাক আসাক আর গড়ন গঠনের কথা শুনে ভেতরটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল। দোকানে আর থাকতে পারলাম না। দ্রুত নেমে হাটখোলার দিকে হাঁটা ধরলাম। ভীর ঠেলে উঁকি দিয়ে দেখলাম, আমারদের বড় জন। সারা শরীর জুড়ে জখম। কাপড় রক্তাক্ত। লাশ পুলিশ ভ্যানে তুলবে এমন একটা পরিস্থিতি। আমি পিছিয়ে গেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পাচ্ছি না। এ কি আমাদের শাহীদ মিয়া!! আমি ভোলা- ভোলা করতে করতে নদীর পাড়ের দিকে দৌড়ে গেলাম। 

“ভোলা কোথায়? ভোলা?” পাড়ে এসে অনেককে জিজ্ঞেস করলাম। রতন নামের আরেক মাঝি আমাকে দেখে দৌড়ে এসে বলল, আলী চাচা কি হইছে? 

“ভোলাকে দেখছ কি রতন?” ভোলারে আমার খুব দরকার।

রতন বলল, “ ক্যান চাচা, আপনে জানেন না, ভোলারে দাহ করতে শ্মশানে নিয়ে গেছে। গতকাল মাঝ দরিয়ায় ভোলা অজ্ঞান হয়ে যায়। আমরা ধরাধরি কইরা হাসপাতালে নিতেই ডাক্তার বাবু কইল ভোলা আর নাই। চাচা ও চাচা, কথা কওনা কেন!” 

না, আমি ঠিক আছি রতন। খুব কাছ থেকে দুইটা শালিক পাখি উইরা যাইতে দেখলাম রতন। 

নাতী ছগিরকে নিয়ে আলী চাচা বাড়ি পথে হাঁটা ধরল। 


রংপুর



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট