হেমন্তের পদাবলি











হৈমন্তী
জালাল জয়

শিশিরে ভিজে ছুঁয়ে দেয় কুয়াশা।
ভোরের আলোয় ধীরে ধীরে দেয় ডাক,
রাস্তার দু’পাশে বৃক্ষের সমারোহ,
তারপরেই জল আর জলের খেলা
জলের পরেই জমি।যেখানে করি চাঁষ।
বৃক্ষগুলো আদ্র ছোঁয়ায়,পরশ মেখে দেয়।
জমিতে সুর,ধানের কন্ঠে ,
লিখে দেই কবিতা
আমি চাঁষি গো, আমি চাঁষি।

জীবনের সমস্ত ক্লান্তি, দেবো তুলে
যদি এ জমিনের চাঁষে বপন করো
হৃদয়ের বীজ। মূল্যহীন।

পুকুরে ¯œান শেষে, ভেজা দেহে
জমিনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাও,
রুপালি মুখে, যেন সূর্যের ঢেউ
থরথর কম্পন, শুরু হয় বুকে।
কন্ঠে তোমার মায়ারস শুনি
চেয়ে থাকি বোবা হয়ে,
ভেজা চুলে শব্দ আঁকি
ভালোবাসি ভালোবাসি...



হেমন্তের রূপ
অনন্ত পৃথ্বীরাজ

কার্তিক আর অগ্রহায়ণ হেমন্ত কাল
রাশি রাশি সোনালি ধান
ছড়ায় আনন্দ প্রবল।

নবান্নের বাংলাদেশ উৎসবে মাতে
নতুন চালের পায়েস ওঠে সবার পাতে।

ব্যস্ত সব কৃষাণিরা কাজের শেষ নাই
আমন ধানে ভরা গোলা, দেহে যেন
প্রাণ ফিরে পাই।

কুসুম কুসুম শীত এখন লাগে বড্ড ভালো
অনাহারী শিশুটির মুখখানি কালো।

আকলিমা চোখের পাতায় স্বপ্ন বোনে
সুদর্শন পোকাটি যেন তার কথা শোনে।

গাশশির কাঁচা হলুদ গায়ে পরে নারী
আয়নাতে দেখে মুখ লাগেনা কোনো কড়ি।

মার্বেল খেলা নিয়ে ছেলেরা সবাই ব্যস্ত
একটি খোয়া গেলে রাখবেনা আর আস্ত।

কুয়াশা চারদিকে সকালটা হয় শাদা
শিশিরের জলে ভিজে পায়ে জমে কাঁদা।

আকাশটা পরিষ্কার ¯িœগ্ধ রাত
কাঁশফুল ঝরা ঐ পূণিমার চাঁদ।


পহেলা প্রেম
বিটুল দেব

রাতদুপুরে ঝিঁঝিঁ পোকার স্বরলিপি আর ব্যাঙ-ব্যাঙানির রূপকথার বয়ানে প্রিয়ার নাম । সবুজাভ পাতারা বাতাসের সাথে মিতালী । ভরা চাঁদে দেখি মায়াময় অবয়ব । জোৎ¯œার স্বচ্ছ জলেও চুরি করে টোল পড়া হাসি । আমি চেয়ে-চেয়ে শুধু প্রণয় জ্বরে ভোগি । গুনগুনে গায় দোলা চলে দোলে রে মন... ।
হাত চিঠির প্রত্যাশায় খুঁজি নিজস্ব খেঁজুরে শব্দ । মন ধরা বিশুদ্ধ বিবরণ গাঁথি শব্দফুলের মালা । চিঠির শরীরে জমে উঠে তুমি... তুমি ডাকের গন্ধ । গোপন বুক পকেটে পুষে চলার পথে করি ঘুরঘুর । অপেক্ষমাণ সরল সকাল আর হ্যাঁ সূচক প্রতিউত্তর ।




দাওয়াই
আশিক বিন রহিম

মাথার উপর ঝুলে থাকা চাঁদ, খুঁঁটিহীন নীল আসমান
মেঘ ভেঙে সূর্য হাসে; অথচ কি আশ্চর্য প্রেম-
যেখানে ক্ষত আঁকে সেখানেই লিখে দেয় দাওয়াই
মসৃণ মমতা।

ভালোবাসায় ক্ষত, রক্তাক্ত মনে যতোটুকু দহন-অসুখ
প্রেমেই চুর্ণ হয়- পূর্ণ হয় হৃদয়।

প্রেম; বড়ই আশ্চর্য দাওয়াই।


হেমন্তের ঠিকানায় খোলাচিঠি
ইউসুফ কবিয়াল

আউশ ধানের সোনামুখ ঘরকে করল আলো
নতুন ধানের শুভক্ষণে যাক মুছে সব কালো।

শিউলি ফুল উঠল হেসে নতুন ধানের গন্ধে
ফিরনি হবে পায়েশ হবে বাতাস বলছে ছন্দে।

নাগরদোলা দুলবে দেখো শখের চুড়ি বাজবে
কৃষাণবধূ বাউলগানে নাচবে দেখো নাচবে।

শিউলিমালা কামিনী ফুলে সাজবে বধূ সাজবে
নবান্নের এই উত্সবে বাঁশের বাঁশি বাজবে।

সবুজ পাতায় চিঠি লেখে পাঠিয়ে দিলাম যেমন-ত
খোলা ডাকের চিঠি পেয়ে আসল শেষে হেমন্ত।


ডেকে আনি দীর্ঘ আঁধার
যাহিদ সুবহান

এই মাঠে এই প্রান্তরে একদিন
ধেঁয়ে আসবে শিকারি খেচর
ওরা এসে লুটে পড়বে আমাদের ফসলের মাঠে
ছিড়ে ছিড়ে খাবে আমাদের সোনালী ধানগুলো
আর যতেœ গড়ে তোলা সবুজ ফসল
আমাদের অবনতি দেকে দেখেও আমরা একদিন
না জেনে অথবা না বুঝেই উল্লোসিত হয়ে
আমাদের অগোচরে আমরা ডকে আনি দীর্ঘ আঁধার...



কথা ছিল দু’জনার
স্বপন শর্মা

হেমন্তের দাপটে হিমেল হাওয়া
আমার অবসাদ; তোর উন্মত্ত মন,
দিতে চেয়েছিলি সবুজ আকাশ- দিলি কই?
সবুজ মাঠ, অন্ততঃ একটা বৃক্ষ; তাও না।

চল আজ দু’জনে রোদ কুড়িয়ে সূর্য বানাই--
সেটাই না হয় আমায় দিস..



অরণ্যের আর্তনাদ
নাবিল তুরাব

গভীর রাতে নীরবে ঝরে পড়া পাতাদের হাহাকার
জীবনে শুনেছি অনেক বার।
ছাদের ওপর জমে থাকা জলের টুপ করে নিচে পড়ার ব্যথাও
অনুভব করেছি বহুবার।
আমি দেখেছি মাটির কষ্ট, পাহাড়ের কষ্ট, নদী ও সমুদ্রের কষ্ট।
দেখেছি আকাশের, জোসনার, নীলিমার কষ্ট।
রাতের প্রগাঢ়তায় গহন অরণ্যের আর্তনাদ
আমাকে বহুকাল বিহ্বল করেছিলো।
আমি ভাঙা দেয়ালের খাঁজে গুটিয়ে নিয়েছি
নিজেকে অসংখ্য বার।
আমার ভগ্ন হৃদয়ের চিৎকার পুঁতেছি মাটির ভেতর।





হেমন্তকাল
শরীফ সাথী

ষড়ঋতুর স্বর্ন ফলা হেমন্তকাল জানে,
গ্রাম বাংলায় পার্বন এলে বলতে কথা কানে।
সবুজ হাসির সুখের ছোঁয়া ঝরে সর্ব খানে,
নদীর জলে মাঝির দলে আনন্দে দাঁড় টানে।
মেঠো পথের সরু মাঠের সকল বামে ডানে,
পাল¬া দিয়ে ধান কাটানোর তাকাও দৃশ্য পানে।
গাছে গাছে মুখরিত পাখির নানা গানে,
হেমন্তের এই মধুক্ষণে গোলা ভরে ধানে।
চাঁদের আলোয় স্বর্নালী ধান জ্বলে গো উঠানে,
বউ দিদিরা হেঁসিল পাড়ে ঢেঁকিতে ধান ভানে।
আলো চালের সাদা আটা করতে গো সমানে,
রাত্রী জেগে পড়শিরা সব গড়তে রুটি ছানে।
সারা বাংলার পাড়া ঘরে ভরে পিঠার ঘ্রাণে,
নতুন মিঠা হরেক পিঠা তৃপ্তি আনে প্রাণে।
হৈ হুলে¬াড় আনন্দ সব কিশোর কলতানে,
গরম পিঠা’র সজিবতা হেমন্ত-কাল আনে।


হেমন্ত দিন কই হারালো
মাহদী হাসান

দপ দপাদপ শব্দে আমার ঘুম হতো না- একি!
রান্না ঘরে ঠুকতো মাথা আমার মায়ের ঢেঁকি।
পায়ের ছন্দে সুরের লহর চলতো তালে তালে
ধানভানা সেই দৃশ্যগুলো দেখি না এই কালে।

ঢেঁকিঘরের ধানভানা গান বাজছে আজো হৃদে
নতুন ধানের গন্ধে ব্যাকুল বাড়তো আমার খিদে।
হেমন্ত আজ যন্ত্রে ছোঁয়া, হারিয়ে গেছে ঢেঁকি
দপ দপাদপ শব্দগুলো, কই হারালো- একি!

হিম সকালের শিশিরগুলো জ্বলতো রুপোর মতো
দৌড়ে গিয়ে সবুজ ঘাসে, পা ভেজাতাম কতো!
দৌড়ে চলা আলপথে সেই মটরশুঁটির ক্ষেতে-
শিশিরবিন্দু, রোদের আলো- উঠতো খেলায় মেতে।

ঘাসফড়িঙের সাথেই ছিলো, সুখের মাখামাখি!
পুকুর ঘাটের চালতা গাছে ডাকতো দোয়েল পাখি
ধানশালিকের জোড়ায়, হৃদয়- ওঠতো মেতে কতো!
দোয়েল শালিক কই হারালো, পাই না দেখা অতো!

কাট্টা ঘুড়ির পেছন পেছন, সেই যে ছুটে চলা—
নাটাই হাতে গোত্তা মারা, থাকতো হাজার কলা।
ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা মেরে, সেই যে বাড়ি ছাড়া,
বিকেল গড়ায় সন্ধ্যা নামে খেতাম মায়ের তাড়া।

সেদ্ধ ধানের গন্ধে হৃদয়, নবান্ন স্বাদ পেতো-
বইয়ের পাতায় চোখটা রেখে মন হারিয়ে যেতো।
স্মৃতির পাতায়, বাস্তবতায়- কত্তো ফারাক দেখি!
হেমন্ত দিন কই হারালো, পাই না খুঁজে-একি!


মখমল হেমন্ত
রিক্তা রিচি

হেমন্ত,
তোমার ঝলমলা আকাশে পাখির ওড়াওড়ি
শাদা পায়রার বুকে উপচে পড়া প্রেম
সাতসকালে ঘাসের আবরণে পা ভিজানো
ঐ দূরের ঠিকানায় না পাঠানো চিঠি
আমার চোখের জল
সবই সোনালী, মখমল।

হেমন্ত,
কৃষকের জ্বলে জ্বলে একজোড়া চোখ
কৃষকের ঘরে ঘরে তোমার প্রার্থনা
অবিরত প্রার্থনা নতুন ধানের
কৃষাণীর ঠোঁটে মধুমাখা হাসি
ধানের শীষে জমে থাকা শিশির
মনে জাগে প্রেম কিশোরির।

হেমন্ত,
বিলের বুকে কাগজের নৌকা
আঁখের গুড়ের সাথে সকাল শুরু
দাওয়ায় দাদুর কোরআন পড়া
তারপর মুড়ি, খই নিয়ে জমপেশ আড্ডা
প্রজাপতিময় দিন
মনে খুশির বীণ।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট