গল্প- গাই



 গাই
 লুৎফুন নাহার লোপা

অগ্রাহায়ন মাসের শেষ।  ভোর হলেই এখন হালকা কুয়াশায় পথ ঢেকে যায়। শহরের চেয়ে গ্রামে শীতের রাজত্ব বেশি থাকে। নদীর পার ধরে হিমেল বাতাস কদভানুর ঘর পর্যন্ত চলে আসে । দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো,রোদের আচ কমলো।  সাঁই সাঁই করে বাতাস কদভানুর ঘরে ঢুকে গেল। কদভানু উঠানে বসে একদৃষ্টে গোয়াল ঘরের দিকে চেয়ে রইল।  ভাবতে লাগলো - গাইডা বিয়াইলে সংসারডা যদি ভালো মতন চলত...।এমন সময় পাশের বাড়ির রহমতের মা এসে বলল-কিরে কদভানু রান্দন চরাবি না?
-  কি রানমু, ঘরে কিছুই নাই
- রাবেয়ার বাপ কনে?
-হের কতা আর কইয়ো না, কামলা দিবার গেছে। হের বাড়ির চিন্তা নাই। কাম করবার জাইয়া খালি গপ্প করে,আইতেসুম গঞ্জে থিকা চা,বিড়ি খায়। বাইত্তে যে আমরা না খাইয়া মরি হেই চিন্তা ওই বেটা জীবনেও করে নাই।
-কি আর করবি,  সারা জীবন তো কম কষ্ট করলি না, এহন নু আমগোর বাড়িত,কয়ডা আলু দিয়া দেই, আইজক্যা বত্তা দিয়া কোনরহম চালা।

কদভানুর চোখে পানি এল। পোলায় শীতের কাপড় চাইছে দিতে পারে নাই, মাইয়ার স্কুল এর ফিস বাকি, এদিকে গায়ের খেতাডাও ছিঁড়া গেছে। চারজনের খাওয়া পরা আর কামাই করে একজন। দু চোখে আন্ধার দেখে কনভানু। চোখের জল মুছে সে আলু ধার করতে চলে যায়।

জুলহাস কামলা দিয়া বাড়ি ফেরার পথে ২০ টাকায় ২টা ফুলকপি কেনে,২০ টাকার আলু আর ১৫০ টাকা দিয়া ১ টা পাংগাস কেনে। ৪০০ টাকা কামাই কইরা পথেই অর্ধেক শেষ করে। বাড়ি ফিরেই সে রাবেয়া কে ডাকে- রাবু..  ওই রাবু...
- আব্বা কি কও
- ধর বাজার রাখ, তর মায়ে কো?
-ওই বাড়িত গেল
- ওই বাড়িত গেল মানে,হারা দিনই পাড়া বেড়ান লাগবো নাকি?
- বাড়িত কিছু নাই দেইখা মা ওই বাড়িত আলু চাইবার গেছে।
-কিয়ের আলু চাইবার গেছে,দেগগা কোন বাড়িত গিয়া ফাও প্যাঁচাল পারতাছে।
কদভানু বাড়ি এসে দেখল জুলহাস চৌকিতে পা মেলে বসে আছে। তাকে দেখেই জুলহাস বলে উঠল - কিরে পাড়া বেড়ান শ্যাষ অইলো তোর?
-কি কন,পাড়া বেড়াবার কেরা গেছে? ঘরে কিছু নাই দেইখা খাওনের ব্যাবস্থা করবার গেছিলাম।
- তর কি মুরাদ, ওইডা আমার জানা আছে।  আমি কামাই না করলে যে গলা দিয়া ভাত উঠবো না হেইডা বুঝা শ্যাষ। হারাদিন কামকাইজ ছাড়া থাকসতো তাই পাড়া বেড়ানি আহে,
- কতা হুইনা গাও জইলা যায়, ২ জন পুলাপান, আবার গাইডা রে দেহন লাগে। হারাদিন মরবার সময় নাই...
- বেশি চাপা করিস না কইলাম, আমার চান্দি গরম অইতাছে, তাড়াতাড়ি রানবার যা কদভানু পাকঘরে ঢুকলো। জুলহাস চিল্লাইয়া কইলো পাঙাশ টা আলু দিয়া ঝোল করিস কিন্ত।

২.
রাবেয়া স্কুলে এসেছে। স্যার আজো তাকে ফিসের জন্য দার করিয়েছে। রাবেয়া বলল- কাইল দিমু স্যার। স্যার বলল - কাইল দিমু, কাইল দিমু কইরা তো জনম পার করলি, তোর কাইল কবে হবে বল দেখি?।  ছাত্রছাত্রীরা রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে ফেললো। রাবেয়া লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইল। টিফিনের সময় সব ছেলেমেয়েরা সদাই কিনে খায়। রাবুর খেতে ইচ্ছা করে কিন্তু মায়ের কাছে টাকা চাওয়ার সাহস হয় না। কেও সদাই কিনতে ডাকলে কোন দিন মাথা ব্যাথা, কোন দিন পেটে ব্যাথা বলে কেটে পরে। মনে মনে ভাবে- যেদিন আমাগো মেলা টাকা হবো সেদিন ইচ্ছামত সদাই খাইতে পারুম। চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে দিয়া যাওয়ার সময় পাকা দালান দেখে ভাবে - ইশ যদি আমাগো এমন একটা বাড়ি থাকতো।
বাড়ি ফিরে রাবেয়া মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে - মা,  ও মা, আমার ইস্কুলের ফিস দেওন লাগবো। কাইল না দিলে স্যার কইছে ফাইনাল পরীক্ষা দিবার দিবো না। কদভানু মেয়েকে বলে- দিমুনি মা। বাবেয়া বলে- আমারে সদাই খাইবার টাকাও দিও কইলাম।কদভানু গোয়াল ঘরের দিকে চেয়ে বলে- রাবু আমাগো গাইডা বিয়াইলে দুধ বেইচা তোর সব আবদার মিটামু। রাবু কল্পনায় চলে যায় -" নতুন জামা পড়ে রাবু স্কুল যাচ্ছে, স্যার তাকে আদর করছে। বাড়ি ফিরে দেখে মা তার জন্য একবাটি পায়েস বেড়ে রেখেছে "। মা রাবুর মাথায় হাত দিলে তার ভাবনা কাটে। কদভানু মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়,বলে- তোর ভাই ম্যাট্রিক পাশ করলে গার্মেন্টসএ কাম নিব।  আমাগো আর অভাব থাকবো না। কদভানুর ছেলে নুরনবি এসে বলে - মা আব্বারে কইয়া আমারে একটা শীতের জ্যাকেট কিনা দেও।কদভানু টাংক থিকা শশুরের রেখে যাওয়া পুরান চাদর টা বের করে দেয়।  ছেলে সেটা গায়ে জড়ায় না।  বলে- দোস্তোরা তারে নিয়া তামাশা করে, এই পুরান চাদর আর কতদিন গায়ে দিব। কদভানুর বুক ফেটে যায়।  ছেলেকে বলে - গাই বিয়াইলে দুধ বেচে সব আবদার মিটাবে। ছেলে তার রাগ করে বাহির হইয়া যায়।
৩.
ভোর সকালে কদভানু বেড়িয়ে পরে বাশি ভাতের খোঁজে।  বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাশি পচা ভাত এনে গরুটারে  যতœ করে খাওয়ায়। দুপুরে ক্ষেতে যায় ঘাস কাটতে। গরুকে খাওয়ায় আর শরীর হাতায়।গরু লেজ দিয়ে মশা তাড়ায়, কদভানু ভাবে গাইডার জন্য রাবুর বাপকে কয়েল আনতে কইবে।
জুলহাস সন্ধায় বাড়ি ফেরে। মনে মনে ভাবে কদভানুর কথা-বউডারে হুদাউ বকা দিছিলাম, বেচারি কোন দিন কোন আবদার করে নাই। বিয়ার পর থিকা ঠিকমতন ভাত কাপড় দিবার পারি নাই। এ বাড়ি ও বাড়ি কাম কইরা দুই পয়সা জমাইয়া কাপর কিনছে, তাও কোন দিন কিছু চায় নাই। যা কামাই করছি তাতে খাওয়াই চলে নাই। কদভানুর জন্য মায়া হয়  জুলহাসের, বুকের ভেতর ভালোবাসা জাগে। ভাবতে ভাবতে বাড়ির উঠানে চলে আসে সে। দরজায় টোকা দিলে রাবু দরজা খুলে দেয়। ঘরে ঢুকে দেখে কদভানু নতুন পাটিতে বসে ভাত বারতেছে। জুলহাস হাত ধুয়ে খেতে বসে।  খেতে খেতে বলে- নতুন পাটি পাইলি কই?
-কিনছি।
- কত নিছে?
- ১৮০ ট্যাহা
-কি কইলি? ট্যাহা কি গাছে ধরে?
- আমার জমাইনা কিছু ট্যাহা আছিল, হেইডা দিয়া...
-বিছানার নিচে যে ১০০ ট্যাহা রাখছিলাম, হেইডা কো?
কদভানু চুপ করে থাকে। জুলহাসের রাগ আরো বেড়ে যায়। বলে- মাগি আমার ট্যাহা তুই এবা কইরা নষ্ট করস?
-আমি কি করছি যে মুখ খারাপ করেন? সংসারের একটা জিনিস কিনছি। নিজে তো জিন্দিগিতে কিনেই না আবার আমি কিনলেও দুষ
- তুই কি বুঝবি টেহা তো আমার যায়।
-পাটি না কিনলে এহন কিয়ে বইয়া ভাত খাইতেন?
-মাটিতে বইয়া খাইতাম,তোগো মত জমিদার না আমি
জুলহাসের রাগ বেড়ে যায়।  উঠে দুই কিল বসায় কদভানুর পিঠে। কদভানু কানতে কানতে ঘরের বাহির হয়। নদীর ধারে যায় ঝাপ দিয়া মরতে । ভাবে এ জীবন রেখে কি লাভ।  কিন্তু মরন এত সহজ না বলে হয়ত সে মরতে পারে না ।  সারারাত নদীর ধারে দারিয়ে কাটায়।
৪.
নুরনবি স্কুলে যায় বন্ধুদের সাথে। চেহারা ভালো থাকায় তার চোখে মুখে দারিদ্রতা ধরা যায় না।  কখনো কোন বন্ধুকে সে নিজ বাড়িতে যেতে বলে না। ভাবে ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকা চাকরি করতে চলে যাবে। নিজের খরচ নিজে চালাবে। তাছাড়া ভারায় সি এন জি তো আছেই। সংসারের এ টানাপোড়েন অল্প বয়সেই তার মানসিকতা পাল্টে দিয়েছে। স্কুলের স্যার রা বলে তোমার বাবা কে একটা প্রাইভেট মাষ্টার রাখতে বলো। নুরনবি বাড়ি গিয়া বলে না, কারন উত্তর তার জানা। ক্লাসের রুবি তাকে মাঝে মাঝে কলম ধার দেয়,  কাছে গিয়ে নুরনবি কে বলে - তোমাকে আমার ভালো লাগে, তোমার চেহারা অনেক সুন্দর।  নুরনবি জবাব দেয় না।  জানালা দিয়ে বাহিরে তালগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে। রুবি তাকে মুখ ভেংচি দিয়ে বলে- এত অহংকার জীবনে দেখি নাই। নুরনবি তাও জবাব দেয় না। রুবি স্কুল ছুটির পর তার পেছন পেছন অনেক দূর আসে, তাও সে রুবি কে বাড়ি আসতে বলে না। মনে মনে ভাবে এইতো আর কটা দিন, তারপর সকল বন্ধুকে দাওয়াত করে খাওয়ালেও তার অসুবিধা হবে না।





৫.
জুলহাস আজ কাজ পায় নাই। চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে সে বাড়ির দারোয়ান তাকে ডেকে বলে - বাইর বাড়ির বেড়া টা ভাইংগা গেছে,ঠিক করলে ২০০ টাকা পাবি,করবি নি? ।  জুলহাস বলে - একটু বাড়াইয়া দিও।দারোয়ান তাচ্ছিল্য করে বলে-তাইলে রাস্তা মাপো।  জুলহাস বাধ্য হয়ে কাজে রাজি হয়। বেড়া দিতে দিতে মাগরিব পার হয়। চেয়ারম্যান বাড়ির ভেতর থেকে মাংস পোলাওয়ের গন্ধ আসে । জুলহাসের খেতে সাধ হয়। কিন্তু দারোয়ান তাকে ২০০ টাকা দিয়েই বিদায় করে দেয়। রাস্তা দিয়ে আসার সময় জুলহাস বিড়ি কিনে ধরায়। হাটতে হাটতে মনে পড়ে গত রাতের কথা।  কদভানু কে অজথাই মেরেছিল সে। সে বউয়ের পছন্দের বাদাম টানা আর গাইয়ের জন্য কয়েল কিনে বাড়ি ফেরে।
৬.
কদভানু স্বামীর জন্য চিন্তায় থাকে। রাত হয়ে গেছে তবুও তার স্বামী ঘরে ফেরে নাই।  নুরনবি ও রাবু বাশি ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পরে।  জুলহাস এসে কড়া নাড়ে। কদভানু দরজা খুলে দেয়। জুলহাস বও এর হাতে সদাই দিয়া বলে- কাইল রাতে বকছিলাম কিছু মনে নিস না,। কদভানু ঠোঙা হাতে নিয়া মুচকি হাসে। তারপর স্বামীকে নিয়া গোয়ালে যায় গাইডারে দেখতে।  যতœ করে কয়েল জালায়।  কিন্তু পাশেই পাটখড়ির বোঝা সরাইতে তাদের চোখে পরে না।
কনভানু আজ স্বামীর পাশে ঘুমায়। হঠাৎ গরমের তোরে কদভানুর ঘুম ভাঙে। চেয়ে দেখে ঘরের দরজায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সে চিৎকার করলে জুলহাস চেতন হয়।  পোলাপান নিয়া কোন রকম বাইর হয় তারা। জুলহাস পানির কলস ভরতে পুকুরে যায়। এসে দেখে কদভানু গোয়ালের দিকে ছুটে যাচ্ছে। জুলহাসের হাত থেকে পানির কলস ছিটকে  পরে যায়। কদভানু আগুনের গোয়ালে ঝাপাইয়া পরে।নুরনবি কোন রকমে তার মা কে টেনে বের করে আনে। পাড়ার লোকেরা এসে ঘর বাচাইতে চেষ্টা করে। কিন্তু হায় - সব শেষ হয়ে যায়। গাভিন গাইয়ের পোড়া শরীর দূর্বল কে আরো দূর্বল করে তোলে।
৭.
কদভানু চেয়ে দেখে সে হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে আছে।মনে পরে গাইডারে বাচাইতে গিয়া আগুনে ঝাপ দেওয়ার কথা।  ভাবে-আহারে গাইডা না জানি কত কষ্ট পাইয়া মরছে,বোবা জানোয়ার কিছু কইবার পারে নাই। খোদা যদি তার জবান দিত তাইলে শুনতে পারতাম, না জানি আমারে কত বার নাম ধইরা ডাকছে। আর কিছু মনে করতে পারে না সে। জানালা দিয়া বাইরে তাকায়। নীল আকাশে সাদা মেঘ দেখে তার বুক কাপে। জানালার ভেতর দিয়ে হালকা বাতাস এসে তার মুখে পরশ বুলায়। তার চোখের কোনা দিয়া টলটল করে জল ঝরে পড়ে। মনে মনে খোদাকে  বলে- "কেন তুমি অসহায়ের সম্বল এমন কইরা কাইরা নিলা।এ তোমার কেমন বিচার"।খানিক পরেই আবার ক্ষমা চায় খোদার কাছে।
জুলহাস গঞ্জে গঞ্জে জায় সাহায্য তুলতে। রাবু আর নুরনবি যায় বাড়ি বাড়ি। সন্ধায় হাসপাতালে ফেরে তারা। রাবু মায়ের কাছে গিয়ে বলে- বাড়ি চল মা। কদভানুর কলিজা ছিরে যায়। সেই বাড়ি সেই সংসার আর নাই। জুলহাস পাশে নিশ্চুপ বসে রয়। রাত বাড়ে, একসময় চোখে ঘুম নেমে আসে সবার।
ভোরের আলো কদভানুর চোখে লাগে। স্বামীর হাত ধরে স্বামীকে জাগায় সে। বলে- আমি ভালা অইছি, চলো  ভিটায় ফিরি। জুলহাস কথা কয় না, চুপচাপ হাসপাতালের বিল মিটাইতে চইলা যায়। ফিরে এসে বলে- তরে আমি কই নিমুরে বউ?। কদভানু মুচকি হাসে আর বলে- জীবন মানেই ভাঙনের খেলা, চলেন নতুন কইরা ঘর বানমু।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট