গল্প- যদি



যদি
মুহাম্মদ আরিফ বিল্লাহ

বটতলার বকুল চাচার চায়ের দোকানটা আবার জমে উঠেছে। বিকেল থেকেই বেচাবিক্রির ধুম। উত্তর পাড়া থেকে সুমন রাজন মনির হেদু মিয়া সবাই এসেছে। দক্ষিণ পাড়ার কালু মিয়া দুপুর থেকেই বসে আছে বকুল চাচার চায়ের দোকানে। মাঝ পাড়ার শরীফ শেখর হই হুল্লোড় করে বটতলা জমিয়ে তুলেছে। সবার মধ্যমণিতে বসে আছেন হাস্যোজ্জ্বল সবার প্রিয় সকলেরই শ্রদ্ধার পাত্র আবার সকলেরই বন্ধু চারু দাদা।
বয়সের ভারে ন্যুজ হলেও চারু দাদার মনটা তরুণ। ১০০ বছর বয়সে একজন বৃদ্ধ লোকের শরীরের বয়সের যে ছাপ পড়ে থাকে চারু দাদার বেলায় তার ব্যত্বয় ঘটেনি। তবে তিনি সবার মাঝে আশার সঞ্চারের প্রতীক হিসেবে থাকেন।
প্রযু্িক্তর ছোঁয়া থাকলেও সবুজে ঘেরা শান্ত সুনিবিড় গ্রামে বকুল চাচার চায়ের দোকানটা এই এলাকার বিভিন্ন যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। সবাই এখানে এসে চারু দাদার খোঁজ খবর নেন। তিনি অসুস্থ্য। তাই নিত্যদিনকার বিকেলের আড্ডায় এখন আর চারু দাদা আসেন না। এক মাস জ্বরে ভোগেন চারু দাদা। এই এক মাস বকুল চাচার চায়ের দোকানটা তেমন জমেনি।
মধুপুর গ্রামটি আকারে বড় নয়। তাই গ্রামের ছোট বড় সবাই সবাইকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায়। আবহমান কাল থেকে এখানকার সামাজিক মুল্যবোধ সম্প্রীতির গন্ডির ভেতর দিয়ে চলমান। আজ প্রায় ৩০ বছর গ্রামের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধানের  দায়িত্ব পালন করছেন চারু দাদা। দীর্ঘদিন অসুস্থ্য থাকায় গ্রামের অনেক সমস্যায় জট লেগেছে। আবার নতুন ভাবে কেউ চারু দাদার ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে একটি সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে আরও তিনটি সমস্যা তৈরি করেছেন। এই এক মাসে চারু দাদার অভাব অনুভব করেছে ছোট-বড় ধনী-গরীব অনেকেই। শুক্রবার জুমার নামাজের পর গ্রামের সবাই মিলে মসজিদে দাদার জন্য দোয়া করে। ইমাম সাহেব দীর্ঘ মুনাজাত করেন। পরপারে গত হওয়া ময়মুরুব্বিদের জন্য। এখানেও বিপত্তি। ইমাম দুরুদ কম পড়েছেন। দোয়া দীর্ঘ করেছেন। মিলাদে কিয়াম করেন নি। নানান সমালোচনা। অথচ যিনি সকালে ফজরের নামাজ পড়েন নি তিনিই সবার আগে ইমামের দোষ ধরেন।
রাশেদ মিঞা বিড় বিড় করতে করতে মসজিদ থেকে বের হয়ে যান। সমাজটা গেছে রসাতলে। তিন হাজার টাকা ইমামের বেতন। চুলা প্রতি একশত টাকা মাসে। তাও আবার রতন মোড়লের ছয় মাস বাকি। এখন মাতব্বরও সে; আবার ইমামের বেতনও বাকি!
বটতলায় ছায়া পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে দীর্ঘ হচ্ছে। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে শেখর কথা শুরু করে।
হেদু মিয়া শেখরকে থামিয়ে দিয়ে রাজনকে কথা বলার সুযোগ দেয়।
হেদু মিয়া বলে, এই রাজন পনের দিন আগে তোর ব্যাপারে যে অবিচার করা হলো, অন্যায় ভাবে রায় দিল তার বেবকটা চারু দাদারে খুইল্যা ক। রতন মাতব্বর নতুন মাতব্বরি কইরা সমাজের কত ঝামেলা বাড়াইছে তার সবটা কইয়া দে।
মনির বলে- চারু দাদা থাকতেই সমাজের এহেন অবস্থা। পরে কি অইব আল্লায়ই জানে।
কালু মিয়ার এক কথা, যুগ যুগ ধরে চলে আসা গ্রামের ন্যায় বিচার আর সম্প্রীতি কোন অবস্থাতেই দুই একজন অমানুষের হাতে তুলে দেয়া যায় না।
দাদা চুপ করে আছেন। আস্তে আস্তে চা খাচ্ছেন। মনে মনে বর্তমান থেকে কয়েক যুগ বা শতাব্দীর পরের ছবি আঁকছেন। কালু মিয়ার টিপ্পনিতে সম্বিত ফিরে পায় চারু দাদা। কালু মিয়া মাঝে মাঝেই দাদীকে নিয়ে টিপ্পনি কাটে। দাদা তখন মুচকি হাসেন। দাদা মুচকি হাসলে কালু মিয়ার টিপ্পনি আরও বেড়ে যায়। দাদা তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। ফুলবানুর ফুলের অকৃত্রিম ভালোবাসায় চারু দাদা এখনো চিরসবুজ।
কালু ভাই তোমরা আমার চেয়ে তোমার দাদীর জন্য দোয়া করো বেশি। সে ভালো থাকলেই তো আমি তোমাদের মাঝে হাসি খুশি থাকি ।

চারু দাদার বৃদ্ধ ভালোবাসায় ঘরপালানো জোয়ানরাও চুপসে যায়।
কথায় ছেদ পড়ে চারু দাদার। গলাটা কেশে এদিক ওদিক তাকিয়ে রাজনকে ডাক দেয়।
রাজন মান্যতা বজায় রেখে দাদার সামনে এসে বসে। দাদা রাজনকে তার উপর অবিচার হওয়ার ঘটনা বলতে বলেন।
রাজন বলতে শুরু করে-
আমার বাবা চাচা মিলে তিন ভাই। আমার বাবা সবার বড়। বাবা ইহধামের মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেছেন আমার কথা বলা শেখা আগেই। পিতৃ¯েœহ বঞ্চিত এই আমি বড় হয়েছি মায়ের আদর, এই বনবাদাড় আর এই সহযাত্রিদের মায়া মমতায়। আমি একটু কম বুঝি। তাই তেমন কিছু করতে পারি না। আমার মেঝে চাচা আমাদের বাড়ির মতব্বরি করে থাকেন সব সময়ই। আমরাও সব সময় চাচাকে মান্য করেই আসছি। আমি সখ করে একটি লাল রঙ্গের গরু পালন করি। আমি গত ষোল সতের দিন আগে চাচার ভূট্টা ক্ষেতের পাশে আমার গরুটা ঘাষ খাওয়ার জন্য বেঁধে রাখি। চাচার ভূট্টা ক্ষেত থেকে আমার গরু প্রায় দুই হাত দূরে অবস্থান করছিল। এমতাবস্থায় চাচা উত্তর পাড়ার সেন্টুকে সাথে নিয়ে ভূট্টা খেতে পারে এমন আশংকা করে গরুটা নিয়ে যায়।


কথার ফাঁকে ফাঁকে দাদা চায়ে চুমুক দেন। আবার হুকায় টান দেন। মাঝ খানে থামিয়ে রাজনকে জিজ্ঞেস করেন- তো তোর গরু কি ছমিরের ভূুট্টা খেয়েছিল?
রাজন- না দাদা। গরু তো খুঁটি দিয়ে বেঁধে রাখা ছিল।
ঐদিন রাতেই আমার বিরুদ্ধে সালিশ বসায়। সালিশে আমার কোন জবানবন্দি দেয়ার সুযোগই রাখা হয়নি। রতন মোড়লের পক্ষে বিচারকের আসনে বসে উত্তর পাড়ার সেন্টু।
সালিশে চাচা চেয়ারে বসে হুকায় টান দেয়। অতঃপর ধুয়া ছাড়ে। হুকার ধুয়ায় চারদিক যেন অন্ধকার হয়ে যায়। সেই অন্ধকারের মতই সেন্টু একটি আজগুবি রায় ঘোষণা দেয়। যদি রাজনের গরু ছমির চাচার ভূট্টা খেয়ে ফেলতো তখন চক্রবৃদ্ধি হারে ছমির চাচার অনেক ক্ষতি হতো। যার মূল্য এমন তিনটি গরুর সমান হবে। তাই আপন ভাতিজা হিসেবে রাজনকে দু’টি গরু মাফ করে দেয়া হলো। ভূট্টা খেতের পাশে গরু বেঁধে রাখায় ফসল হানির যে আশংকা তৈরি হয়েছে তার জরিমানা স্বরূপ এখন থেকে রাজনের গরুর মালিকানা ছমির চাচার।
রাজন প্রতিবাদী হয়। সেন্টুর মুখের উপর কথা বলতে চায়। কিন্তু চাচা তাকে থামিয়ে দেয়।
রাজন, সেন্টু বয়সে কাঁচা হলেও কথাগুলো অংকের হিসেবে পাকা। সুতরাং কথা না বাড়িয়ে গরুটা আমার গোয়ালে এনে রেখে যা। নইলে ছুতা নাতা বের করে বাড়ি ছাড়া করবো হতচ্ছাড়া কোথাকার। বিচারকের মুখের উপর কথা। কুড়হাসির ফাঁক গলে কথাগুলো বের হয় ছমির চাচার মুখ থেকে।
বকুল চাচা এক কাপ আদা চা এগিয়ে দেয় দাদার হাতে। একটু খেয়ে নেন। গলাটা পরিষ্কার হবে। শরীরটাতে তেজ পাইবেন।
চারু দাদা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চারদিকটা দেখে নেন। কেমন যেন একটা নিরবতা কাজ করছে। রাজনের কথাগুলো যেন আমেরিকার আফগানিস্তান আক্রমন অথবা রাসায়নিক অস্ত্রের মিথ্যা অজুহাতে ইরাক ধ্বংস কিংবা রাখাইনে বৌদ্ধদের মানবতা ধ্বংসের পূর্ব রিহার্সেলের পান্ডুলিপি। নিজেদের শহর, গাঁও গেরামে এমন নীতি বিরুদ্ধ কাজের দহরম মহরম তো হরহামেশাই হচ্ছে। দিন দিন সুবিধা ভোগীদের জয় যাত্রা বেড়েই চলেছে।
শেখর সুবিধাভোগীদের জয়যাত্রা মানতে রাজি নয়। সমাজে সেন্টু তো মাত্র একজন, আর কয়জন চেলা।
ভালো মানুষের সংখ্যা বেশি। আমরা যুবকরা এক হলে আর চারু দাদার মতো বয়ষ্করা আমাদের পরামর্শ দিলে সেন্টুরা লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হবে।


শরীফ কথাকে এগিয়ে দেয়। শেখর তুমিতো বোঝই সেন্টুদের পক্ষেই থাকে থানা পুলিশ। তুমি কিভাবে সৎ কাজ করবে। তোমাকে ফাঁসানোর ফন্দির শেষ নেই।
মনির থেমে যাবার পাত্র নয়। লেখাপড়া কম জানে, তবে হতাশ নয়। ভালো কাজে সবসময় এগিয়ে থাকে। এতে ঝাক্কি ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে অনেক। কিন্তু থেমে যায় নি। দাদার মুখের দিকে চেয়ে কি যেন বলতে চাইলো। দাদা মনিরকে থামিয়ে দিয়ে বকুল চাচার চায়ের বেচাবিক্রি দেখে নিল। এই বকুল সবাইকে চা দে। আজ কি শুধু অভিযোগ শুনবো। কিছু আনন্দও করবো। মুর্শিদি গাইবো। ভাবের গান ধরবে হেদু মিয়া।
হেদু তুমিই আগে শুরু কর।
হেদু মিয়া গান ধরে-
পরের জায়গা পরের জমি
ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো এই ঘরের মালিক নই।
গানের ভেতর দিয়ে একটি ভাবের আবহ তৈরি হয় বটতলায়।



জাগতিক ক্ষোভ, অপ্রাপ্তি, সামাজিক অনাচার কিছু সময়ের জন্য ভুলে যায় বটতলার উপস্থিতিরা।
সন্ধা ঘনিয়ে আসে। দাদাকে রাত বাড়ার আগেই ঘরে ফিরতে হবে। নতুন ভোরে যুবকদের নতুন ভাবে কাজ করার পরামর্শ দেন চারু দাদা। আগামীকাল প্রথম কাজ হবে রাজনকে দিয়ে। সবাই সকালে রাজনের বাড়িতে যাব। সেন্টু রতন মোড়ল আর ছমিরের হিসেব দিয়েই শুরু হবে মধুপুর গ্রামের শুদ্ধি অভিযান।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট