গল্প- ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট



ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট
সাফি উল্লাহ্

প্রায় হাজারখানেক মানুষের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট ঝুলে আছে। ঝুলিয়ে রেখেছি- ব্যাপারটা এমন না। কর্তৃপক্ষের বেধে দেয়া পাঁচ হাজার এর কৌটা পেরিয়ে যাওয়াই ঝুলে আছে। নামগুলো একএক করে পড়তে লাগলাম। অমি রহমান নামটার কাছে গিয়ে চোখ আটকে গেল।
মেয়েটাকে অনেকবার রিকুয়েস্ট পাঠাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন তখন ফেসবুকে তার অ্যাকাউন্ট ছিল না। গ্রামে সে সময় অনার্সে ওঠার আগে মেয়েদের হাতে ফোন দেয়া হতো না। কিন্তু যখন জানতে পারি সে অ্যাকাউন্ট খুলেছে, তখন রিকুয়েস্ট পাঠাতে গিয়ে আর পারিনি। তার পাঁচ হাজারের কৌটা পূরণ হয়ে গেছে। ছেলেদেও চেয়ে মেয়েদের বন্ধুর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। নির্দিষ্ট কৌটা পার হয়ে গেলেও ফলোয়ারের সংখ্যা আকাশচুম্বি হতে থাকে। বাড়তে থাকে লাইক কমেন্টের সংখ্যা।
তবে তার ফ্রেন্ডলিস্টে যুক্ত হওয়ার জন্য বারবার ইচ্ছে হতো। মাঝরাতে জেগে উঠে ফেসবুকের নোটিফিকেশন চেক করতাম। এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। বারবার মনে হতো- এই বুঝি এখনই আমাকে রিকুয়েস্ট পাঠাবে। সে ইচ্ছে করলেই তার নিষ্ক্রিয় বন্ধুদেও দু-একজনকে আনফ্রেন্ড করে অনায়াসে আমাকে অ্যাড করে নিতে পারে। কিন্তু না। তেমনটি কখনো হয়ে ওঠে নি।
এর মধ্যে অনলাইন নিউজ পোর্টালে চাকরি হলো। পার্ট-টাইম। তেইশ দিন কাজ করার পরে ছেড়ের দিলাম। চাকরিটা করার সতেরতম দিনে কাটাখালিতে বাস দূর্ঘটনায় তিন কলেজ ছাত্রী নিহত হওয়ার নিউজ হাতে এলো। ট্রাকের ধাক্কায় বাস খাদে পড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলে একজন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসাপাতালে আরো দুজন মারা যায়। হাসপাতালে মারা যাওয়ার দুজনের একজন অমি। আমি থমকে গেলাম। কাপাশিয়া থেকে কাটাখালি অল্প দূরত্বের। তবে কি সে বাসে ওঠার পরপরই এই দূর্ঘটনা! নাহ। এসব কিছু ভাবতে ইচ্ছা করল না। আব্বাকে ফোন দিলাম। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া উচিত। কিন্তু কল দিতেই সাবলীল কণ্ঠে এক মেয়ে জানালো, আপনার ফোনে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স নেই। আর কল করা হলো না। বিকেলে অফিস শেষ করে ফোন দেব- এইটা ইচ্ছে। কিন্তু দুপুরের পরপরেই চার্জ না থাকার কারণে ফোন বন্ধ হয়ে গেল। মোহাম্মদপুর থেকে শাহবাগ এসে জাদুঘর কোয়ার্টারে একটা ছাত্রীকে পড়িয়ে রুমে ফিরলাম। চার্জে লাগিয়েই ফোন অন করলাম। আব্বাকে কল দিতে চেষ্টা করছি কিন্তু ফোন ব্যস্ত দেখাচ্ছে। একটু পর আব্বার নম্বর থেকেই ফোন এলো। আব্বা সেই বিকেল থেকে আমাকে কল দিতে চেষ্টা করছে। জানালো, এখন অমিদের বাড়িতে। অমি একটি বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।
আব্বা আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বাকিটা আমি বললাম।
সেই অমি প্রথম মেয়ে যাকে আমি চিনেছিলাম। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তখন তার সাথে প্রথম দেখা। আমাদের বাড়িতে তখন দু-টি ঘর। মেহমান এলে আমার ঘরে বসত। অমি আমার ঘরে বসেছিল বলে খানিকটা লজ্জা, খানিকটা সঙ্কচে সারাদিন বাড়িতে এসেছিলাম না। একটু বেশিই লাজকু ছিলাম বোধ হয়। আমি এইচএসসি পাশ করার পর ওদের বাড়িতে প্রথমবারের মত গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, এবং সেবারই জীবনের প্রথম কোন মেয়ের সাথে ছাদে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করেছিলাম। কী গল্প করেছিলাম, মনে পড়ে না। তবে, পাশের পোল্ট্রি ফার্মের ছাদ থেকে ছেলেরা যে তাকে উত্যক্ত করার বেশ চেষ্টা করত, এ ব্যাপারে কথা হয়েছিল। ছাদের এক দিকে পা ঝুলিয়ে বসে, কিংবা রেলিংয়ে হেলান দিয়ে, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, তার সাথে গল্প করেছিলাম। আমার বার বার মনে হচ্ছিল, এমন জায়গাতে দাঁড়িয়ে গল্প করা উচিত, যেখান থেকে বাসার সবাই দেখতে পাবে। সে আমার সঙ্কোচের কথা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু সঙ্কচ কাটিয়ে ওঠার জন্য যখন তার রুমে বসে গল্প শুরু করলাম সঙ্কোচটা আরো বেড়েই চলল। আমি এই সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় নিয়েছিলাম বলেই দীর্ঘদিন তাদের বাড়িতে যেতে পারিনি। কিংবা যাইনি। দতবে যেতে বারবার ইচ্ছে হতো। ইচ্ছে হতো, কিছু একটা বলি। কিন্তু কী বলা যায় কিংবা কিভাবে বলা যায়, এসবের স্পষ্ট ধারণা ছিল না বলেই বলা হয়ে ওঠেনি।
শেষবার একটি অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। অতিথি হিসেবে আমি গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে। আর কৃতী ছাত্রী হিসেবে অমি বক্তব্য দিয়েছিল। কিন্তু মুখোমুখি কথা হয়নি। ভালো আছি কি না তা একবার জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি ঘাড় নেড়ে উত্তর দিয়ে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। সে ভালো আছি কি না প্রশ্নের সাথে আরো কিছু জানতে চেয়েছিল কি না, সেটা জানতে খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কখনো কিছু নিজ থেকে জানতে চাওয়া হয়নি বলে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আবার অজুহাতের কথা মনে হলে নিজের প্রতি বিরূপ ধারণা আসে। অন্তত কেমন আছি, সেটা বলতে পারতাম। কিংবা সে কেমন আছে, সেটাও জেনে নেয়ার সুযোগ ছিল। অথবা কথা আরো অনেক দূর, কত দূর সেটা জানিনা, কিন্তু অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারতাম। 
অমির সাথে আর কখনো কথা বলা হয়নি। সচেতনে। কিন্তু কিছু একটা বলতে চাইতাম। কখনো রিকোয়েস্ট পাঠাতে পারিনি কিন্তু মনে হতো রিকোয়েস্ট বোধ হয় সে-ই পাঠাবে।
হ্যাঁ, পাঠিয়েছে। বছর দুয়েক হয়ে গেল। তবে কি সেই ব্যস্ততামুখর তেইশ দিনের চাকরি জীবনে সে এসেছিল!  আমি তার টাইমলাইন ঘুরে দেখি। একবার আমার মেসেজ রিকুয়েস্ট অপশনে গিয়ে অনেকগুলো মেসেজ দেখতে পাই। সেখানে অমি লিখেছে, কায়েস ভাই। আমি অমি। রিকুয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করেন না ক্যান! হুহ।
আমি দেখি। কিন্তু কিছু বলতে পারিনা। কেন সে সময় মেসেজ রিকুয়েস্ট চেক করিনি, নিজেকে অপরাধী মনে হয়। অপরাধটা কী, স্পষ্ট না... 
অমি মারা যাবার ছ-মাস পর ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কাকি ওকে নিয়ে কতই না স্মৃতিচারণ করলেন। আসার আগে আামাকে বললেন, আবার এসো বাবা। আমি বললাম, কাকি আসব। এবার তিনি হুঁহুঁ করে কেঁদে উঠলেন। বললেন, বাবাওে, অমি হাসপাতালে শুয়ে। চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। নাকে অক্সিজেনের নল। জ্ঞান ফেরার সময় ডাক্তার নল খুলে দিয়েছিল। অমি চোখ তুলে তাকালো। তাকিয়ে বলল, ও মা। মাগো। দেখো, আমি ঠিকই সুস্থ হয়ে যাব।
তার তিন মিনিট পরে সে মারা গেল।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট