গল্প- সত্তা



সত্তা
তামান্না তাবাসসুম

‘পার্থ ভাইয়া, সুকন্যার নামে আমার এত্তো এত্তো নালিশ আছে । সে ফেসবুকে ছবি দেয় না মানলাম , তাই বলে আমাকে ইনবক্স করতেও তার অসুবিধা? আমার বাসায় দাওয়াত দিলাম, এলো না, তার নাকি মানুষের সঙ্গ ভাল লাগে না। আমি ওর বাসায় আসতে চাইলাম, তাতেও নারাজ!’
‘দেখো মৌ, তুমি ওকে তোমার আর পাঁচটা বন্ধুর সঙ্গে মেলাতে পারো না...তোমাকে বুঝতে হবে ব্যাপারটা।’
‘সেটা তো বুঝিই। যাইহোক, আপনাদের বিয়েতে তো আমি সাক্ষী হয়ে আছিই। তখনি দেখা হয়ে যাবে। হি হি হি...’
‘আরে, তোমার হাসির শব্দ একদম সুকন্যার মতো !’
‘কিন্তু ও তো...’
‘শোনো, আমি একটু ব্যস্ত ...পরে ফোন দিচ্ছি।’
সাত দিন পার হলো। রাতে ঘুম আসছে না মৌর। শুধু পার্থ’র কথা মনে পড়ছে। সেই সাথে কাজ করছে অপরাধবোধের অস্বস্তি। তারা একে অপরের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে না তো? কিন্তু পার্থ তার পরিবারের বাইরে গিয়ে সে একটা বাকপ্রতিবন্ধি মেয়ের হাত ধরেছে, আর ঐ মেয়েটি মৌয়েরও বান্ধবী; হোক না ফেসবুকে; এই ভাবনা মৌকে বার বার অস্বস্তিতে ফেলে।
এমন সময় পার্থর ফোন। ধরবে কি ধরবে না ইতস্তত করতে করতে ধরেই ফেললো।
‘সরি, এতো রাতে ডিসর্টাব করলাম,’ পার্থ বললো।
‘কোনও দরকার ছিলো?’
মৌর হঠাৎ এমন শক্ত প্রশ্নে একটু ধাক্কা খেল পার্থ।
‘তোমাকে ধন্যবাদ দেয়ার ছিল, তুমি আমার অনেক বড় একটা উপকার করেছ।’
মৌ অবাক। ‘মানে? আমি আবার কবে আপনার উপকার করলাম?’
‘আমাকে বড় ধরনের মানসিক সমস্যাথেকে তুমি বের করে এনেছ মৌ,’ পার্থ দম নিয়ে বললো।
‘আপনার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না...’
‘শোনো মৌ, সুকন্যা আসলে মানে... আচ্ছা অনেক রাত হয়েছে এখন, ঘুমাও... রাখি।’ লাইন কেটে দিল পার্থ।
তারপর থেকে সুকন্যার ফেসবুক আইডি ডিএকটিভেটেড। পার্থও মৌকে অদ্ভুতভাবে এড়িয়ে চলে।

পার্থর কথা; মৌ এর সাথে কথা হওয়ার পর থেকে একদিনও শান্তিতে থাকতে পারছি না। ছোটবেলা থেকে খুব কড়া শাসনে মানুষ হওয়ায় কারো সাথে সহজে মিশতে পারি না। খুব চুপচাপ লাজুক স্বভাবের ছেলে আমি। আমার মাথায়ও এই বয়সের আর সবার মত রাজনৈতিক, রোমান্টিক ইত্যাদি অনেক ধরনের চিন্তা ঘুরপাক খায়। সেগুলো নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলতে পারি না। ফেসবুকে একবার দেশ নিয়ে একটা স্ট্যটাস দেওয়ায সব ক্লাসমেটরা হাসাহাসি শুরু করে দেয়। ব্যাপারটা ছিল এমন, আমাদের ক্লাসের হাবা-গোবাটা আবার এত কঠিন কথাও বলে!
কিন্তু আমার আবেগগুলো শেয়ার করতে খুব ইচ্ছা হয়। আমারও ইচ্ছে হয় রাজনৈতিক বা পারিপার্শিক কোনো ইসুতে ঝাল মিটিয়ে একটা স্ট্যটাস দিতে । হঠাৎ কি মনে করে একটা ফেইক আইডি খুলে ফেললাম। কিন্তু স্ট্যাটাসে কারো কাছে তেমন রেসপন্স পাই না। তখন ভাবলাম, মেয়ের নামে আইডি খুললে হয়তো অনেক রেসপন্স পাবো। তাই করলাম!
কিন্তু ব্যাপারটাকে যতটা সোজা ভেবেছিলাম, তা নয়। অনেকেই আমার সাথে কথা বলতে চায়, দেখতে চায়। বারবার এড়িয়ে চলি। ফলে অনেকেই আমাকেফেইক ভাবতে থাকে। কিন্তু কারো সঙ্গে কথা বলা কোনোভাবেই সম্ভব না কারন পক্সি দেয়ার মত কোন মেয়ে বন্ধু আমার নেই। এর আগে একবার এক তামিল নায়িকার ছবি দিয়ে ধরা খেয়েছিলাম, তাই সেটাও রিস্কি।

অগত্যা খুব করুণ একটা গল্প বানালাম। ইনডায়রেক্টলি নিজেকে বাক-প্রতিবন্ধী বললাম। বিভিন্ন গ্রুপে আর পেইজে পোষ্টটা ছড়িয়ে দিলাম। সারাদিনে অনেক মানুষ আমাকে ইনবক্স করে সমবেদনা জানায়, যে কোনও প্রয়োজনে পাশে থাকতে চায়। আমার ভেতরে যে এতো বাস্তববাদী লেখনীশক্তি আছে, এটা আবিষ্কার করে নিজেই অবাক হলাম!
একদিন আমি হুট করে নিজের আসল আইডির সাথে ফেইক আইডির ‘ইন এ রিলেশনশিপ’স্টাটাস দিয়ে দিলাম। যা হবার তাই হলো; বন্ধু মহলে বেশ আলোচনায় এলাম। মনে মনে যেমন মেয়ে আমার জীবনে চাইতাম, নিজের সুকন্যা নামের ফেইক আইডিকে তেমনি রূপ দিলাম । এক আইডি থেকে অন্য আইডির ওয়ালে আদান প্রদান হতে থাকলো ভালবাসার পংক্তিমালা। এভাবে কখন যে নিজের সৃষ্ট চরিত্রের প্রেমে নিজেই পড়ে গেলাম টেরই পেলাম না ! এমন কি দুই ফোনে দুই আইডি থেকে ইনবক্সে চ্যাটিং করতে থাকলাম ঘন্টার পর ঘন্টা !
সুকন্যা আইডিতে লগ ইন করার পর আমি হয়ে যাই অন্য এক মানুষ, অন্য এক স্বত্বা। বিভিন্ন ইস্যুতে প্রচুর শেয়ার হয় আমার স্ট্যটাস, লাইক কমেন্টের বন্যা বয়ে যায়।
কিন্তু আমার সামনে এখন বিরাট যুদ্ধ। আমি জানি, প্রেমিকের কাছ থেকে প্রতারিত হয়ে ভালোবাসার প্রতি, মানুষের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল মৌ । সুকন্যার এত কষ্টের পরেও এগিয়ে যেতে দেখে নিজেকে অনেক সুখী মনে হয়েছে তার। সুকন্যার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী হয়। আমার আর সুকন্যার জুটিকে দেখে তার মনে হয়েছে, সত্যিকার ভালোবাসা বলতে দুনিয়ায় এখনো কিছু আছে। সেভাবেই মৌর সঙ্গে আমার আলাপচারিতা।
মৌ এর সাথে কথা বলার পর, তাকে দেখার পর থেকে আমার মনে হয়েছিল, মনের মাধুরী মিশিয়ে যে নারীকে লালন করেছি এতোটা দিন, মৌ যেন তারই বাস্তব প্রতিমা। অবশেষে এই কোণঠাসা ছেলেটির জীবনে সত্যিই কেউ এলো! আস্তে আস্তে আমি নিজের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকি। সুকন্যা আর মৌর চ্যাট হিস্ট্রি পড়তে থাকি। কি সরল মনে বিশ্বাস করে নিচ্ছে সে সুকন্যার সব কথা!
বুঝতে পারি মৌও আমার প্রতি দুর্বল। কিন্তু এই ভয়ংকর সত্য জানার পর মৌ কি পারবে স্বাভাবিক থাকতে? আমাকে বিশ্বাস করতে?
নাহ, মৌর ঘৃণার পাত্র হওয়া চলবে না। মৌর উদ্দেশ্যে নীরবে ক্ষমা চেয়ে আমি হারিয়ে যাওয়াই ভাল মনে করলাম ।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট